বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি আর কত দিন?


 আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ২৭-১২-২০১২

গত এক দশকের অধিক কাল খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধে রুজু করা কয়েক হাজার মামলা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিনা বিচারে অব্যাহতি পেয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ অভিযুক্ত ব্যক্তি। এ অব্যাহতির প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই। মনে হচ্ছে, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। খবরের কাগজে এসব তথ্য প্রায়ই আসছে। জানা গেল, অতিসম্প্রতি খুন-ধর্ষণজনিত ১০টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আরও বিস্ময়কর হলো, এগুলোর কয়েকটি মামলা প্রত্যাহারের জন্য জেলা কমিটি সুপারিশ করেনি। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের বিধান আছে। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে পিপিকে অবগত করলে তাঁর আবেদনে সংশ্লিষ্ট আদালত মামলার সব কিংবা আংশিক আসামিকে অব্যাহতি দিতে পারেন। জানা যায়, বর্তমান সরকারের সময় আলোচিত ১০টিসহ সাত হাজার ১০১টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। এতে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত প্রায় এক লাখ আসামি অব্যাহতি পেয়েছে বা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ আখ্যায় এ ধরনের মামলা প্রত্যাহার শুধু ঠিক নয় বললে যথার্থ হবে না, এটা আইনের শাসনের গুরুতর ব্যত্যয় বটে।
এ বিষয়গুলোর দিকে যাঁরা নজর রাখছেন, তাঁরা এটাও দেখছেন, আমাদের বিরোধী দলগুলো অন্য অনেক বিষয় নিয়ে যথেষ্ট জোরদার আন্দোলনের অব্যাহত প্রচেষ্টা নিলেও এ বিষয়ে মামুলি কয়েকটি কাগুজে বিবৃতি ছাড়া জোর প্রতিবাদের প্রয়াস নেয়নি। সংসদে বা সংসদের বাইরে সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ লক্ষণীয় হয়নি। এতে অবশ্য বিস্ময়ের কারণও নেই। কেননা, একই সংবাদে উল্লেখ রয়েছে, বিগত জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে তারাও ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে পাঁচ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয় ৯৪৫টি মামলা থেকে। সে প্রক্রিয়ায় ৭৩ হাজার ৫৪১ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পায়। এর মধ্যেও খুন, ডাকাতি ও ধর্ষণের মামলা ছিল। হয়তো বা ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় গেলে মহাজোট সরকারের নতুন রেকর্ড ভাঙার অপেক্ষাতেই তারা এ বিষয়ে দায়সারা বিবৃতিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় সংসারকে দয়াহীন দেখেছেন। দেখেছেন, ‘প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ প্রশ্ন জাগে, তিনি কি কল্পনেত্রে আজকের বাংলাদেশের সমাজচিত্রকেই দেখতে পেয়েছিলেন?
বলা হয়তো যাবে, কোনো মামলায় রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমনটা ঘটে চলছে; এটা সবার জানা। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা এরূপ কিছু ব্যক্তিকে আইনের বিধান প্রয়োগে অব্যাহতি দিতেও পারে। সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রত্যাহার করা হলে এর সংখ্যা এত বিশাল হতো না। আরও বলা যাবে, আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে মামলা প্রত্যাহার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, এ ধরনের ফৌজদারি মামলায় বাদী সরকার। সরকার যখন মামলা থেকে সরে যেতে চায়, তখন আদালত সম্মত না হলে হয়তো মামলা চলবে, কিন্তু এটা প্রমাণে সচেষ্ট হবে না বাদীপক্ষ। হাজির করবে না সাক্ষীসাবুদ। ন্যূনতম আইনি লড়াইয়ে তারা নিস্পৃহ থাকবে। তখন আদালতে মামলাটি প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ তেমন থাকবে না। আদালত আপসহীন মনোভাব নিলে দু-একটি বিরল ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান হয়তো হবে; কিন্তু এটা বাস্তবে কতটুকু সম্ভব? আর আদালত তো বাদী-বিবাদী সবারই। মামলা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীপক্ষের। সুতরাং, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আদালত সাধারণত নাকচ করেন না।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এভাবে মামলা প্রত্যাহার করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা বিচার পাবে কোথায়? উল্লেখ করা প্রয়োজন, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ইত্যাদির মতো গুরুতর অভিযোগে সরকার বাদী বটে; তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হচ্ছে নিহত ব্যক্তির আপনজন, যারা সন্ত্রাস ও ডাকাতির শিকার এবং ধর্ষণের শিকার নারী ও তার নিকটজন। তাদের পক্ষ হয়ে সরকার মামলা লড়বে—এ দর্শন থেকে সরকার বাদী হয়ে মামলা করে। এর মূলে নিহিত আছে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে আঘাত হানা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিপরীতধর্মী আচরণ তার কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে—এটা বলা কি খুব বাড়াবাড়ি হবে? এ মামলাগুলো কিছু জঘন্য প্রকৃতির অপরাধ সংঘটনের পর দায়ের করা হয়। তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করে। বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল প্রত্যাহার করা এসব মামলা। কোনোটির অভিযোগপত্র গঠন করা হয়েছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষ্যগ্রহণও হয়েছে। আদালতের বিচারে অনেক মামলাতেই হয়তো বা সাজা হতো না প্রমাণের অভাবে। নিরপরাধ বলে যদি কেউ নিশ্চিত থাকে, তাহলে বিচারের অপেক্ষায় থাকতে দোষ তো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। আর অপরাধের সঙ্গে যদি সংশ্লিষ্ট থাকে, তাহলে তাদের অব্যাহতি দিতে আইনের এ ব্যবহার অপব্যবহারের নামান্তর।
অনেকেই প্রশ্ন রাখেন, বিশেষ সুবিধাভোগী এ লোকগুলো কারা? আপাতদৃষ্টিতে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু এটাও কেউ কেউ জোর দিয়ে বলে থাকে যে দলীয় আনুগত্যের সনদও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংগ্রহ করা হয় বাঁকা পথে। আর উভয় সরকারের সময়ে তা হয়েছে বা হচ্ছে। এর প্রভাব সহজেই অনুমেয়। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, ক্ষমতায় থাকা দলটির নেকনজরে থাকলে আইনের এ ধরনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে পার পেয়ে যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা অপরাধজগতের জন্য সবুজসংকেত। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিই স্বাভাবিক। অপরাধ করে পার পাওয়ার সহজ রাস্তায় কিছু ব্যক্তি উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারের ভাবমূর্তি। জনমনে সৃষ্টি হয় আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতা। অপরাধী দ্বিগুণ উৎসাহে আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে আঘাত হানার দায়িত্ব যে সরকারের, তাদের কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীতধর্মী। এতে শঙ্কিত দুর্বল ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা; পাশাপাশি উল্লসিত দুর্জনেরা। হতাশ ও বিচলিত সাধারণ মানুষ। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি আদৌ কারও জন্য সুফল আনেনি।
অতিসম্প্রতি শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত বিকাশ নামের এক ব্যক্তি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। কোনো মামলায় তার সাজা হয়নি। বিচারাধীন সব মামলাতেই সে জামিনপ্রাপ্ত। যতটুকু জানা যায়, জামিনপ্রাপ্তির পরও বাইরের জগৎকে নিরাপদ মনে না করে আইনের কৌশল খাটিয়ে বেশ কিছু সময় সে কারাগারে ছিল। তার আকস্মিক মুক্তি ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া কিন্তু বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ, অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া এবং রীতি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত না করায় বিষয়টি সবাইকে হতবাক করেছে। তার অবস্থান নিয়ে অনেক কথাই আসছে সংবাদমাধ্যমে। কোনোটির মতে সে দেশান্তরি কিংবা তার অপেক্ষায় সীমান্তে অবস্থান করছে। আবার কিছুসংখ্যকের মতে, সে দেশের অভ্যন্তরে অন্ধকার জগতে আবার মিশে গেছে। তার মুক্তিতে সবুজ সংকেত গেল অপরাপর শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে। কারাগার থেকে বিকাশ বেরিয়ে যদি স্বাভাবিক জীবন যাপন করত, তাহলে এসব কথা আসত না। এ মুক্তি জনমনে বড় ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা হয়তো অনেকেই ভাবতে ভুলে যান, এ ধরনের সন্ত্রাসীরা কখনো কারও আপনজন হয় না। যখন যাদের হাতে সুযোগ, তারা তাকে কাজে লাগাতে পারে অন্যদের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, এ দেশে অপরাধীদের কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়ে নিজদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা এবারই প্রথম ঘটল, এমনটা কিন্তু নয়; অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।
বিচারাধীন মামলা প্রত্যাহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রেহাই দিয়েই শুধু সরকারগুলো থেমে থাকেনি, আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বোধগম্য কারণ ব্যতিরেকেই ছেড়ে দিয়ে অপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে সরকার। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা (যা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রয়োগ করতে হয়) বলে মার্জনা পেয়েছে এবং পাচ্ছে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিরা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সরকারের সময় এরা সংখ্যার বিচারে সর্বাধিক। যে অপরাধে তারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল, তাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের প্রশ্নের কী জবাব সরকারের কাছে আছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনীতি করে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হয়। তাই বলে নিজ রাজনৈতিক দলের নামে বিভিন্ন ধরনের যথেচ্ছাচার আমরা দেখতে থাকব আর কতকাল? যথেচ্ছাচারের অন্যবিধ প্রসঙ্গ এ নিবন্ধের বিবেচ্য নয়; আলোচনায় আসছে শুধু বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে লালন ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি। এখানে দ্বিমতের সুযোগ নেই যে এ সংস্কৃতি খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজন, ধর্ষণের শিকার নারী ও তার নিকটজন, ডাকাতি ও সন্ত্রাসের শিকার সবার প্রত্যাশার প্রতি অবমাননার তুল্য। সরকারে যাঁরা ছিলেন, আছেন বা আসবেন, তাঁরা কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে একটিবার মনে করেছেন বা করবেন রবীন্দ্রনাথের ‘অপমানিত’ কবিতার এসব পঙিক্ত:
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন