বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : এক অবরুদ্ধ ‘চান্স’ সম্পাদকের জবানবন্দি


মাহমুদুর রহমান




আমার আকস্মিকভাবে মিডিয়াতে আসা নিয়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী সম্পাদককুল এবং জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী কয়েকজন সুবিধাবাদী, মুখচেনা ব্যক্তি। আমার অপরাধ, সাংবাদিকতা পেশায় জীবন শুরু না করে এই শেষ বয়সে এ পথে কেন এলাম। বিষয়টা অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এ বাড়ির কর্তার কোনো কারণ ছাড়াই চোখ টাটানোর সমতুল্য। ওই ছেলে পরীক্ষা দিলেও পাস করবে না, পাস করলেও চাকরি পাবে না, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না, বেতন পেলেও সেই টাকা বাজারে চলবে না ইত্যাদি।
প্রথমে প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্পাদক আতাউস সামাদের শিক্ষানবিশগিরি এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রূপে চার বছরেরও অধিককাল পার করেছি। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণকালে যে সার্কুলেশন ছিল এই সময়ের মধ্যে তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ১০ লাখের কাছাকাছি ইন্টারনেট হিট এখন ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। অ্যালেক্সা রেটিং এ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও বিশ্বে ১০০ এবং ২০০০০ নম্বর থেকে ডিসেম্বরে ১৭ তারিখে আমার দেশ ৩৯ এবং ১০৬৬২ নম্বরে রয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ১৬ পাতার পত্রিকার মূল্য প্রায় এক বছর আগে ১০ টাকা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও প্রাণের টানে পাঠক সেই বাড়তি দামের বোঝা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন। সার্কুলেশন কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েছে।
এই পাঠকশ্রেণী আমাদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মূল শক্তি। এদের অনুপ্রেরণা এবং সমর্থনের কারণেই আমার দেশ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা আলোচিত দৈনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাত্র চার বছরে নিতান্তই দীনহীন, বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হওয়াটাকে হয়তো মিডিয়া জগতেরই অনেক রথী-মহারথী মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং এই মন্তব্য প্রতিবেদনের লেখককে পত্রিকা সম্পাদক রূপে মেনে নিতে এই অস্বীকৃতির পেছনের কারণ যে অক্ষমের অন্তর্জ্বালা সেটা বুঝে নেয়া কঠিন নয়। এদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, কেবল একরাশ অনুকম্পা রয়েছে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকে অনেকেই আমার মতো করেই পরিণত বয়সে অন্য পেশা থেকে এসে সরাসরি পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে আজ সংবাদপত্র জগতের লিজেন্ড হয়েছেন। তাদের নাম আজও আমরা বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি। অপরদিকে মালিকানা সূত্রে রাতারাতি সম্পাদক বনে যাওয়ার সংখ্যা এ দেশের পত্রিকা শিল্পে অগুনতি হলেও চিহ্নিত ‘মহামহিম’ সম্পাদককুলের তাতেও কোনো আপত্তি নেই। যত সমস্যা এক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে। গত বছর আমার জেল মুক্তির পর থেকে এরা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে কোনোক্রমে আমাকে সহ্য করছিলেন। স্কাইপি কেলেঙ্কারির ঘটনা লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ এবং আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্র তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে টেলিভিশনের পর্দা ফাটাচ্ছেন। সরকারের উন্মত্ত আচরণের পাশাপাশি এই তল্পিবাহকদের হিংসা-বিদ্বেষে কাল হয়ে যাওয়া মুখের নানা রকম অভিব্যক্তি টেলিভিশনে দেখে আমার ছোট্ট অফিস ঘরের অবরুদ্ধ জীবনেও বিমলানন্দ অনুভব করছি। এদের বিপরীতে আমাদের সমর্থনে দেশের প্রবীণতম সম্পাদক-সাংবাদিক এবিএম মূসা এগিয়ে এসেছেন। মূসা ভাই আমার মিডিয়ার শিক্ষক মরহুম আতাউস সামাদেরও শিক্ষক। তাঁর প্রতি আমার দেশ পরিবারের সব সদস্যের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের সব কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের। এ মাসের ৬ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সবাইকে চমকে দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর বিরুদ্ধে এক চাঞ্চল্যকর রুল জারি করেন। সেই রুলে তিনি স্বীকার করে নেন যে, বিচারাধীন মামলা নিয়ে বিচারকার্যে সম্পৃক্ত নন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছেন এবং বিষয়টি ইকোনমিস্টের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ইকোনমিস্টের একজন সাংবাদিক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে টেলিফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে কতগুলো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে বিচারপতি মহোদয় থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি আদালত অবমাননা নামক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বর্মের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ ইকোনমিস্টে না ছাপানোর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদের হাত দেশের মধ্যে অনেক লম্বা হলেও সেটা যে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছায় না, সেটা বোধহয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
একজন বিচারপতি বিচারাধীন মামলার বিষয়ে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করেছেন, এই তথ্য জনগণকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিচারাঙ্গনকে নানাভাবে বিতর্কিত করার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও এই অবিশ্বাস্য নতুন নমুনা মেনে নেয়া কোনো বিবেকবান নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বেলজিয়ামবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং ইউকেবাসী জনৈক রায়হানের কথোপকথনের রেকর্ডকৃত অংশ এবং তাদের মধ্যকার আদান-প্রদানকৃত ই-মেইলের কপি বিদেশ থেকে আমার দেশ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করাকালে ইউ-টিউবেও বিচারপতির স্কাইপি আলাপন ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিষয়টির নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা জনস্বার্থে কথোপকথন হুবহু প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। তবে রিপোর্টে ইকোনমিস্টের মতো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য প্রদান থেকে আমার দেশ বিরত থাকে।
ইকোনমিস্ট সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি আলাদা সম্পাদকের নোট (Editors Note) লিখে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে তাদের যুক্তি পেশ করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেই নোট থেকে খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
“Normally, we would not publish confidential e-mails and conversations. But there is a compelling public interest. Lives are at stake. So are the court’s reputation .......
We did not solicit the material. We did not pay for it, nor offer any commitment to publish it, we have no reason to suppose that the tapes and e-mails we have seen are fakes, or have been tampered with. The Economist also does not know whether the accused in the trial are innocent or guilty, merely that they are entitled to a presumption of innocence and to an even-handed trial.
(সাধারণত, আমরা গোপনীয় ই-মেইল এবং টেলিফোন আলাপ প্রকাশ করি না। কিন্তু, এখানে গুরুতর জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে। জীবন এখানে ঝুঁকির মধ্যে। একইভাবে আদালতের মর্যাদাও ...
নিজ থেকে আমরা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা কোনো অর্থ প্রদান করিনি, কিংবা সংবাদ প্রকাশ করা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেইনি। এমন ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই যে, টেপ এবং ই-মেইলগুলো জাল অথবা সেখানে অসত্ উদ্দেশ্যে কোনোরকম পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্ট এটাও জানে না যে অভিযুক্তরা দোষী অথবা নির্দোষ, তবে তাদের বিচারপূর্বক সাময়িক নির্দোষ বিবেচিত হওয়া এবং সঠিক বিচার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।)
আমার দেশ পত্রিকা এ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ এই পাঁচদিন স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করেছে। এই সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমসহ কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পত্রিকায় কোনো প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেননি। এখানে কোনো মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, এ জাতীয় দাবি কোনো মহল থেকে অদ্যাবধি শোনা যায়নি। কিংবা সংবাদ না ছাপানোর নির্দেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রুলও জারি করা হয়নি। বরঞ্চ, ট্রাইব্যুনাল-১ এর দ্বিতীয় সিনিয়র বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন আমার দেশ-এর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে বলেছেন, পত্রিকার কাজ হচ্ছে লেখা, আমার দেশ তাই করেছে। অনৈতিক ও বেআইনি আচরণের দায় মাথায় নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও লাজ-লজ্জাহীন সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং আওয়ামীপন্থী মিডিয়া স্কাইপি সংলাপ লেখার আগে ‘কথিত’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন।
সরকারের লেজুড়ধারী টক-শো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বিভিন্ন টক-শো’তে অবলীলাক্রমে দাবি করছেন যে ইকোনমিস্টে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। নির্জলা মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সেই সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। সে সব মহাপণ্ডিতরা অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। আরে বাবা, ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে যাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে তার কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রক্ষে ছিল? সংবাদ ধামাচাপা দিতে প্রতিবেদক এবং সম্পাদককে হয়তো গুম করে ফেলা হতো। অথবা সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে হতো। তাছাড়া সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলাই তো বিচারপতির ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ লংঘন। এদিকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে প্রায় প্রতিদিন এত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে যে জনগণের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
হাইকোর্টে সাধারণত যে কোনো মামলায় একটি বেঞ্চ কোনো রুল, নির্দেশ অথবা অভিমত দিলে অন্য বেঞ্চ সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। বাদী অথবা বিবাদী ওই মামলা নিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চে গেলে তাদের প্রথম বেঞ্চে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। স্কাইপি স্ক্যান্ডালের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার অ্যাডভোকেট হায়দার আলী ১০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার নাম উল্লেখপূর্বক বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১ এর নজরে আনেন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আদেশ দেয়ার জন্য ১১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। ওইদিন বিচারপতি নাসিম এবং প্রসিকিউটার হায়দার আলী ট্রাইব্যুনালে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে আর আদেশ প্রদান সম্ভব হয়নি। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন যে, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান এবং প্রসিকিউটর আদালতে ফিরলে আদেশ প্রদান করা হবে। কিন্তু, ওই দিনই বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় সেই প্রক্রিয়াও ঝুলে যায়।
১৩ তারিখে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত একই বিষয় ট্রাইব্যুনাল-২ এ উত্থাপন করলে বিচারপতিগণ স্কাইপি সংলাপ বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় আর প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক আদেশ প্রদানকালে একই বিষয়ে প্রথম আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল-১ এ অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল। এরপর একই দিনে সরকার ছুটে যায় হাইকোর্টের চরম বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে। আদালতের রীতিনীতি অনুযায়ী তিনি আমার বিষয়ে কোনো আবেদন শুনতে পারেন না, কারণ দুর্নীতি এবং বিচারপতির কোড অব কনডাক্ট (Code of Conduct) ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য আমার আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পত্র সংখ্যা ০১.০০.০০০০.০০১১.৩২.০০১.১২-৩১৭ তারিখ ০৮ নভেম্বর ২০১২-এর মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
আদালতের নিয়ম-কানুনের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোর্টের দিনের নির্ধারিত সময় পার করে আমার বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় আদালতে তার আচরণও বিচারকসুলভ ছিল না। বরঞ্চ, আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিরাগ, বিদ্বেষ এবং ক্ষোভ তার প্রতিটি কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারপতি মানিকের রুলকে ভিত্তি করে সে রাতেই সিএমএম আদালতে বায়বীয় দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী (CRPC) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমতি (Sanction) ব্যতীত এ ধরনের মামলা দায়ের সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও আমার ক্ষেত্রে আদালতে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানেই শেষ নয়। ১৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই বিষয়ে আরও একটি অভিমত (Observation) দেন। বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে উচ্চ আদালতের তিনটি পৃথক সমমানের বেঞ্চ থেকে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদেশের এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ছোটবেলায় শোনা এক জোকের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্র শিক্ষককে প্রশ্ন করল, স্যার Pillar লিখতে কয়টা L (এল) লাগে? জবাবে শিক্ষক বললেন, ‘একটা দিলেও হয়, তয় দুইটা দিলে পোক্ত হয়।’ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অতি-উত্সাহে দেখা যাচ্ছে আদালত পোক্ততর করতে গোটা চারেক L-এর ব্যবস্থা করেছেন।
অপর একটি বিতর্কের বিষয় উত্থাপন করছি। স্কাইপি কেলেঙ্কারির কাহিনী ছাপা হওয়ার পর থেকে সরকার সমর্থক গোষ্ঠী কেবল একটি প্রশ্নের অবতারণা করে চলেছেন। তাদের কথা হলো, হ্যাকিং অথবা গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ সত্য হলেও মিডিয়ায় প্রকাশ করা নাকি অনৈতিক। দি ইকোনমিস্ট তার সম্পাদকের নোটে এই সমালোচনার যথাযথ জবাব দিয়েছে বলে আমি এই ইস্যুতে নতুন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার প্রশ্ন হলো, একজন বিচারপতি কি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে গোপনে শলা-পরামর্শ চালিয়ে যেতে পারেন? বিচারপতি নাসিমই তো ইকোনমিস্টের সাংবাদিককে বলেছেন যে, তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেন না। তাহলে কি ধরে নেব ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে তার স্ত্রীর চেয়েও আপন? অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা যায় না বলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জ্ঞান দিচ্ছেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৭ ঘণ্টার স্কাইপি কথোপকথনে এবং শত শত ই-মেইলে ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তার আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন। এমনকি আগাম রায় লিখে দেয়ারও আবদার করেছেন। রায় প্রদানের বিনিময়ে পদোন্নতি প্রাপ্তি নিয়ে আপিল বিভাগের জনৈক বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার চরম নিন্দনীয় উদাহরণও প্রকাশিত স্কাইপি আলাপে রয়েছে। সুতরাং, ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের যোগসাজশে। সেই অপরাধের কথা প্রকাশ করে গণমাধ্যম বরঞ্চ প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন অভিমত প্রদানকালে সম্ভবত এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ, আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে পাঠককে কিছু তথ্য দেয়া আবশ্যক বিবেচনা করছি। ১৩ তারিখ রাতে সিএমএম আদালতে মামলা দায়ের থেকে এই লেখাটা ১৯ তারিখ রাতে ছাপা হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা অফিসেই অবস্থান করছি। সকালে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছানো পর্যন্ত এখানেই থাকব, নাকি পুলিশ হেফাজতে—সেটা আল্লাহ্ জানেন। সেদিন টক-শোতে এক আওয়ামী সম্পাদক আমার পত্রিকা অফিসে থাকা নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনলাম। আমার পত্রিকা অফিসে আমি রাত্রিযাপন করব, তাতে পঞ্চাশ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার জন্য আত্মগর্বে ফুলে থাকা সম্পাদক কেন বা কোন অধিকারে কূপিত হলেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। অবশ্য, আওয়ামী লীগারদের কাছে যুক্তির কথা বলে কোনো ফায়দা নেই।
এক সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে (Scroll) লেখা দেখলাম, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার এড়াতে আমার দেশ অফিসে অবস্থান করছেন। এতদিন জানতাম গ্রেফতার এড়াতে লোকজন পলাতক থাকে। আওয়ামীপন্থী মিডিয়ার কাছ থেকে জানা গেল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পত্রিকা অফিসে অবস্থান করলেও নাকি গ্রেফতার এড়ানো যায়। এই আমাকেই ২০১০ সালের ১ জুন মধ্যরাতে শত শত রায়ট পুলিশ পাঠিয়ে একটা সাধারণ ডাইরির (General Diary) ভিত্তিতে শেখ হাসিনার সরকার একই পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেটা বোধহয় ওই টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ভুলে গেছেন!
এদের নিরেট মাথায় হয়তো ঢুকছে না যে, আমার এবারের লড়াই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার অথবা আদালত কর্তৃক মিডিয়ার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ দলমত নির্বিশেষে সব মিডিয়া কর্মীর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা তাদের স্বার্থেই প্রয়োজন। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে আজ গণমাধ্যমের যে অংশ আমার দেশ’র বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হলে তারাও একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। তখন কিন্তু আজকের এইসব কথা তাদের বেমালুম গিলে ফেলতে হবে।
তবে সমস্যা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পাপের সব রেকর্ড মুছে ফেলা আগের মতো আর সম্ভব নাও হতে পারে। হাওয়া ভবনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত সম্পাদককুল আজ যখন আমাকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে ওঠে। দেশবাসীকে একটি ভরসার কথা বলে অবরুদ্ধ সম্পাদকের জবানবন্দী সমাপ্ত করব। মিডিয়ায় যারা মাহমুদুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত দেখার আশায় ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনসাপেক্ষে তারা আমার মতো তখনকার সরকারের অন্যায় আচরণের শিকার হলে আমার দেশ তাদের রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। নীতির দুর্ভিক্ষের এই দেশেও সব সরকারের আমলে নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে এই পরিবারের প্রতিটি সংবাদকর্মী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ইমেইল- admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন