রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২

শরিয়া শাসনেও আপত্তি নেই যদি …


মিনার রশীদ
তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২


‘সৎ লোকের শাসন চাই ও আল্লাহর আইন চাই।’ সবার আগে স্লোগানটি নিয়ে এই অঞ্চলে  রাজনীতিতে নামে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু এক-এগারোর অব্যবহিত আগে স্লোগানের অর্ধেক নিয়ে নেমে পড়ে একটি বিশেষ দল। চেহারা ও লেবাস ভিন্ন হলেও আগে স্লোগানদাতারা তাতে কিছুটা আরাম বোধ করে। এই আরামের আরেকটি কারণ ছিল এই বিশেষ দলটি বিএনপিকে যেভাবে আক্রমণ করেছে অন্যদের সেভাবে আক্রমণ করেনি। তাতে কারো কারো মধ্যে তখন একটা আত্মপ্রসাদও কাজ করেছে এই  ভেবে যে,  এটা হলো  তাদের সততার প্রমাণ।
কিন্তু আসল খেলাটি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে  ভাবনার অন্য কেন্দ্র  থেকে।  সেটি ছিল এক কৃষকের চার চোরকে সাজা দেয়ার গল্পের অনুরূপ। চালাক কৃষক  প্রথমে বলল, তোরা তিনজন হলি আমার নিজের গ্রামের মানুষ। তোরা আমার ফসল খেতেই পারিস। কিন্তু এই ব্যাটা হলো ভিন্ন গ্রামের। ‘এই বলে ভিন্ন গ্রামের চোরটিকে চারজন মিলে  ইচ্ছেমতো ধোলাই দিয়ে তাড়িয়ে দিলো। তারপর বাকি দু’জনকে বলল, তোরা দু’জন  মুসলমান আর ওই ব্যাটা হিন্দু।’ এই প্রক্রিয়ায় ভাগ করে একে একে সবাইকে আচ্ছামতো ধোলাইয়ের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলল।
উদ্দিনদের জরুরি সরকারের সময় জামায়াতে ইসলামীকে অনেকটা এড়িয়ে ‘টাইট’ দেয়া  হয়েছে বিএনপিকে। জরুরি সরকারের গণতান্ত্রিক এক্সটেনশনে এবার ধরা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ফোরামগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, একজনকে ধরলে যাতে অন্য জন এগিয়ে আসতে না পারে। জামায়াতকে দেয়া হয়েছে ‘সততার  থেরাপি’  আর বিএনপিকে দেয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ থেরাপি’। এক পক্ষকে হয়তো বোঝানো হয়েছে, বিএনপির দুর্নীতির দায় তোমরা নেবে কেন এবং অন্য দিকে বিএনপিকে বোঝানো হয়েছে যে, ’৭১-এর দায় তোমরা বহন করবে কেন ?
বিএনপিসহ ভূতপূর্ব চারদলীয় এবং বর্তমানের ১৮ দলীয় জোট বিষয়টি সম্ভবত উপলব্ধি করতে পেরেছে। জামায়াতকে ত্যাগ করার পরামর্শ শেখ হাসিনা এবং তার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী পরিষদ  অহরহ দিয়ে  যাচ্ছেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বলেছেন, আগে স্বৈরাচারকে ত্যাগ করুন, পরে অন্যকে পরামর্শ দেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রোপটে বহুরূপী এরশাদ মহাজোটকে ডিভোর্স দিয়ে বসলে মুখরা প্রধানমন্ত্রী কিংবা পারিষদরা কোনোরূপ লজ্জা পাওয়া ছাড়াই অনায়াসে বলতে পারতেন, দেখুন, আমরা স্বৈরাচারকে ত্যাগ করেছি। অবশ্য মির্জা ফখরুল বলেছেন, শেখ হাসিনার পরামর্শ শুনে রাজনীতি করলে অনেক আগেই আমাদের পথে বসতে হতো।
কাজেই শেখ হাসিনার পরামর্শ বিএনপি কতটুকু শুনবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে এ সব কিছু নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রটি হতাশ হয়ে পড়ে নেই। একই উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন সুর ও ভিন্ন প্লাটফরম থেকে  এগিয়ে এসেছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো অনেকেই। বিএনপির প্রতি জাফর ইকবালেরা  বোধগম্য কারণেই হতাশ। তবে আশার কথা। তিনি ছাত্রদলের প্রতি এখনো নিরাশ হননি। গত কয়েক বছরে শিবিরের এক দিনের কর্মকাণ্ড দেখেই  লিখে ফেলেছেন , ‘তোমরা যারা শিবির করো’। কিন্তু এ দেশের ছাত্ররাজনীতির ফ্রাংকেনস্টাইন, ছাত্রলীগের ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৪৫০ দিনের কর্মকা  দেখে তিনি লিখতে পারলেন নাÑ তোমরা যারা ছাত্রলীগ করো। অথচ ছাত্রশিবিরের তরুণদের চেয়ে ছাত্রলীগের তরুণদের  প্রতিই তার প্রভাব অনেক  বেশি বলে মনে হয়। এমনকি ছাত্রদলের চেয়ে ছাত্রলীগের ছেলেদের কাছেই তিনি অধিক দেবতা বলে পূজিত হন। তার স্বপ্নের দল  ছাত্রলীগকে যদি তিনি পরিবর্তন করতে পারতেন তবে আজকে ছাত্রদলকে ঘুরিয়ে (পুত্রকে পিতার বিরুদ্ধে) কিংবা শিবিরকে সরাসরি এ ধরনের পরামর্শ দেয়ার প্রয়োজন পড়ত না।
অথচ তার বলয়ের কথা শুনে কেউ ছাত্রদল কিংবা শিবিরে নাম  লেখায় না। বরং তাদের অনেকের বুদ্ধিবৃত্তিক হিপোক্র্যাসি, অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ, নিজের ও পরিবারের বল্গাহীন  জীবনধারা  দেখেই অনেকে ছাত্রশিবির কিংবা আরো কড়া ডোজের ইসলামি সংগঠনে নাম লিখাচ্ছেন। প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের পরবর্তী প্রজন্মের চেহারা ও ভাবসাব  দেখে প্রবাসী বাঙালিরা এই সর্বনাশা বন্যা থেকে বাঁচতে ‘অন্য’  কিছু খুঁজছে। অনেকেই এক সময়কার দারুণ হিট ছবি ময়নামতির মতো   অনেক সাধের ‘ময়নাপাখি’টি  ইতোমধ্যেই খুইয়ে ফেলেছে। বন্ধু-বান্ধব যাদেরকে কখনই ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করতে দেখিনি, তারাও আজ আমাকে কম ধর্মপ্রাণ জ্ঞান করে ধর্মের সবক দিতে চায়।
২০১২ সালে এসে জাফর ইকবাল বিএনপির প্রতি যে আবেদনটি রেখেছেন,  ১৯৯৬ সালে কিন্তু  তিনি তার প্রিয় (?)  দলকে এমন আবেদনময় ভাষায় কখনোই উপদেশ দেননি। তখন এই একই ‘ঘৃণিত’ মানুষগুলোর সাথে জাফর ইকবালের প্রিয় মানুষগুলো একই মঞ্চে দিনের পর দিন বসেছেন। শুধু লোকচুর অন্তরালেই নয়Ñ  প্রকাশ্যে বসে ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন। সেই ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনুমান করি, তার দুই-একটি অতি সংবেদনশীল জাফর ইকবালের চোখেও পড়েছিল। কাজেই এই ইকবালরা কৃষ্ণের বেলায় যা লীলা খেলা মনে করেন অন্যের বেলায় তা গণ্য করেন পাপ হিসেবে।
আগেই জানিয়েছি, জাফর ইকবাল ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা   তাদের রাজনীতির গন্ধসম্পন্ন প্রতিটি লেখায় প্রথমেই নিজের  ‘নিরপে’ পরিচয়টুকু জানিয়ে দেন কিংবা রাজনীতি সম্পর্কে তাদের যে স্বল্পজ্ঞান রয়েছে সেই বদান্যতাটুকু এক ধরনের গৌরব সহকারে প্রকাশ করে থাকেন। এর মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের চেয়েও বড় রাজনীতি করেন এই অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা। সমস্যা হলো, দেশের মানুষ যে তাদের এই রাজনীতিটি বুঝতে পারেন সেই বিষয়টি তারা নিজেরা উপলব্ধি করতে  পারেন না। তারা মনে করেন, তারাই শুধু ভাত খেয়ে বড় হয়েছেন। আর দেশের বাদবাকিরা বড় হলেন ঘাস খেয়ে। মির্জা ফখরুলের কথাটিকে একটু টেনে বলা যায়, এই বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ কিংবা মনের মতো এই দেশের রাজনীতির প্লাটফর্মটি রচিত হলে বাকশাল পুনর্জন্ম নিতো; এ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ সম্ভব হতো না।
এ দেশের চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী বা সুশীলসমাজ শরিয়া, ইসলাম প্রভৃতি শব্দ শুনলেই জলাতঙ্ক রোগীর মতো কেঁপে ওঠেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, তিনি তার নিজের একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দরকার পড়লে শরিয়া শাসন কিংবা  কিসাস প্রয়োগ করবেন তখন ‘রাজনীতি নিরপে’ এই সুশীলসমাজ কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দরকার পড়লে শরিয়া আইনের আওতায় ‘ কিসাস’ প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। গত জোট সরকারের আমলে বঙ্গভবনের অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়ার জন্য ওবায়দুল কাদের হুমকি দিয়েছিলেন। সব স্থানীয়  উপকরণ দিয়ে তৈরি এই ‘আন্তর্জাতিক’ আদালতের প্রতি তেমন  ধরনের কোনো  হুমকি বর্তমান বিরোধী জোট কখনই  দেয়নি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী কেন ওই আদালতের প্রতি আস্থাটি রাখতে পারছেন না? কেন তার মনে হলো এই বিশেষ আদালতেও বিচারটি সম্ভব হবে না? শেষমেশ তারও শরিয়া আদালতের প্রয়োজন পড়বে।
এই ঘোষণার সময়েই তার পাশে বসা মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী আরো খোলাসা করে বলেছিলেন, ‘বিচারটিচার দরকার কী, এদের সরাসরি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই হয়।’ বিরোধী দলকে অহেতুক দুষলেও এই বিচারটির যতটুকু মেরিট ছিল তাকে প্রকৃত অর্থেই আরো খেলো করে ফেলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী পরিষদের কিছু সদস্য। তাদের মনের ভেতর কী রয়েছে, তা বিশ্বের  যে কেউ পড়তে পারছেন।
সাধারণ মানুষের কনসার্নটি হলো, অপরাধী যেই হোক না কেন, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ধরনের উচ্চারণ বিচারব্যবস্থাকে নাজুক ও অস্থির করে তুলতে পারে। আবেগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করবেন না বলে যে শপথটি প্রধানমন্ত্রীসহ তার পরিষদের সদস্যরা করেছিলেন, তা বার বার জনসমে  ভঙ্গ করছেন।  তার পরিণাম ও আলামত আজ বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট। ১৬ কোটি মানুষ সত্যিই আজ  অরতি হয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগের তা ব দেখে মন্ত্রীরাও  অসহায়ের মতো কপাল চাপড়ান বা  চোখের জল ফেলেন।
আর কিসাসের বিধান শুরু হয়ে গেলে তা কি শুধু ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা এর পরেও সম্প্রসারিত হবে? সিরাজ সিকদারসহ জাসদের আরো ৩০ হাজার কর্মী হত্যার কিসাসের কী বিধান হবে? নাকি এই কিসাসের বদলায় জাসদের হাসানুল হক ইনু এক বছরের জন্য মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন?  লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো মানুষ মারার দায়ে কিসাসের বিধানটি কী হবে? সবাই যার যার স্টাইলে কিসাস শুরু করলে সমাজটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সবাই তো আর কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে উড়াল দিতে পারবেন  না।
শেখ হাসিনা শরিয়া শাসন কায়েম করলে যুদ্ধাপরাধী ছাড়া আর  কাদের কাদের শাস্তি দেয়া হবে তাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। মহাজোটের শরিক এবং শিল্পী কামরুল হাসান কথিত সেই  বিশ্ববেহায়াকে কি তার আশির দশকের ঘটনায় পাথর ছুড়ে মারা হবে? নাকি এই পাথর ছোড়ার ভয় দেখিয়ে আরো কিছু দিন মহাজোটে রাখা হবে? ‘সুদখোর’ ইউনূসকে যদি শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে মনে হয় ফতোয়াবিরোধী নারী নেত্রীরা খুব বেশি অখুশি হবেন  না। বাংলাদেশে সফরে এসে হিলারির সাথে ইউনূসের ‘একান্ত সাাৎ’  নিয়ে লন্ডনে গিয়ে  শেখ হাসিনা কোরাস  গেয়েছিলেন , ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে শ্যামে পাইল ভ্রমরা, ময়ূর বেশেতে সাজন রাধিকা’।  গানের ছন্দে যে ইঙ্গিতটি তিনি তুলে ধরেছিলেন, তার নৈতিক আইনসম্মত শাস্তি কারো অজানা নেই। কাজেই তখন শাসন শেখ হাসিনার হাত থেকে হিলারি ফসকে গেলেও  ইউনূস রেহাই পাবেন না।
শরিয়া, কিসাস, ফতোয়া ইত্যাদি শব্দগুলো শুনলেই যাদের মাথার চুলে রক্ত উঠে পড়ে, সেই সব বুদ্ধিজীবী নেতা-নেত্রীও  কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কথাটি সিলেট বা কক্সবাজারের কোনো মাদ্রাসা থেকে উচ্চারিত হয়নি। উচ্চারিত হয়েছে খোদ গণভবন থেকে;  রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর মুখ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর একটি মুখের কথাই যেখানে প্রায় আইনের সমতুল্য, সেখানে এই মহলের নীরবতা অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। বোঝা গেল শরিয়া শাসনেও অনেকের আপত্তি নেই যদি তার খলিফাতুল মুসলেমিন থাকেন তাদের নেত্রী।
minarrashid@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন