বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

বিচারের নামে আসামি হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে এখানে : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী

জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের আবেদন


মেহেদী হাসান
তারিখ: ২০ ডিসেম্বর, ২০১২


বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, বিচারের নামে ট্রাইব্যুনালে আসামিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সাক্ষী মিলে গোপন আঁতাত করা হয়েছে আসামির বিরুদ্ধে। এখানে একটি ষড়যন্ত্র সংঘটিত হয়েছে। স্কাইপি সংলাপ ফাঁসের মাধ্যমে এ আঁতাত ও ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গতকাল ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, হ্যাকিংয়ের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যে চুরি করল সেই চোরের বিচার হবে না, আর যারা চোরকে ধরিয়ে দিলেন তাদের বিচারের আয়োজন চলছে।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত থাকার দায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণ ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গতকাল ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, জেয়াদ আল মালুম স্কাইপি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত এবং তিনি এ বিচারকে কলুষিত করেছেন। তিনি সাক্ষী ও বিচারপতির সাথে গোপন আঁতাত করেছেন আসামিকে ফাঁসানোর জন্য। বিচারপতির সাথে আঁতাতের মাধ্যমে প্রকাশ্যে ট্রাইব্যুনালে নাটক করেছেন তিনি। স্কাইপি সংলাপে তার বিষয়ে যেসব কথাবার্তা রয়েছে তাতে এটি স্পষ্ট যে, জেয়াদ আল মালুম ন্যায় বিচারের পথে বাধা স্বরূপ। তিনি ন্যায় বিচারকে বিঘিœত করার কাজে লিপ্ত ছিলেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম আবেদনটি জমা দেন। আগামী রোববার এ বিষয়ে শুনানির জন্য ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে একজন মহিলা সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়াল নির্ধারিত ছিল। ক্যামেরা ট্রায়াল বিষয়ে আপত্তি জানান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের যে দরখাস্ত দেয়া হয়েছে তার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া চলতে পারে না। এখানে একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে। ১৭ ঘণ্টার সংলাপের মাত্র দুই ঘণ্টার বিবরণ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে তিনি বলেন, সংলাপের পুরোটাই প্রকাশ করতে দেয়া উচিত এবং আপনাদের জানা উচিত কী হয়েছে এখানে বিচারের নামে। এখানে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে বিচারের নামে। আপনাদের, বিচার বিভাগের মানমর্যাদা রক্ষার জন্যই তা জানা উচিত। স্কাইপি সংলাপে যা ফাঁস হয়েছে তারপর কী এ ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? মানুষ জেনে গেছে বিদেশ থেকে কিভাবে এ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে তিনি জানান, ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার একটা জরিপ করেছে। তাতে ৭৩ শতাংশ মানুষ স্কাইপি কেলেঙ্কারির পর এ বিচার পুনরায় শুরু হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন। বিচারপতিদের লক্ষ্য করে এই বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বলেন, আপনারা কী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত শুনবেন না?
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, স্কাইপি সংলাপ ফাঁস হওয়ার পর জাতির সামনে আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। ৩৩ বছর জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আজ দুই বছর আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমি তো আদালত অবমাননা করিনি। আদালতের মর্যাদা গেলে দেশের মর্যাদা থাকে না; বিচারকদের মর্যাদা থাকে না। আমি এ ট্রাইব্যুনালের, বিচারবিভাগের মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য এ দরখাস্ত দিয়েছি। আপনারা এর মান রক্ষা করুন। আমি মনে করেছিলাম এ ঘটনার পর প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনাল বিব্রত বোধ করবে। কিন্তু এখন তো আমিই বরং বিব্রত বোধ করছি।
তিনি বলেন, স্কাইপি সংলাপ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বলেছেন আপনারা। যে চুরি করেছে তার বিচার হবে না, অথচ যারা চোর ধরছে তাদের বিচার হবে?
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কথা বলার সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির বলেন, চৌধুরী সাহেব আপনি এখন থামেন। আপনার কথা তো আমরা শুনলাম।
জবাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, জনগণ আমাকে ভোট দেয়। আমি সংসদে গিয়ে কথা বলি তাদের জন্য। কিন্তু দুই বছর কোনো কথা বলতে পারছি না। এখানে আমাকে আনলে, আপনাদের দেখলে কথা বলতে মন চায়। মনে শান্তি পাই। সেজন্য কথা বলি, দাঁড়িয়ে যাই।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির বলেন, আমি জানি আপনি বসার মতো লোক নন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, স্পিকার সাহেবের মতো আপনিও আমাকে স্বীকৃতি দিলেন। ধন্যবাদ।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকের ক্যামেরা ট্রায়াল তো অনেক আগে থেকেই ঠিক করা আছে। যখন এটা ঠিক করা হয়েছে তখন তো আপনারা কোনো আপত্তি করেননি। কাজেই আপনাদের আবেদন শুনানি হবে; কিন্তু আজ ক্যামেরা ট্রায়াল হয়ে যাক।
এর জবাবে কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, তখনকার পরিস্থিতি আর স্কাইপি সংলাপ ফাঁসের পরবর্তী পরিস্থিতি এক নয়। আমরা তো আগে জানতাম না কিভাবে মালুম সাহেব এবং অন্যরা মিলে সাক্ষীকে তৈরি করেছেন আসামিকে ফাঁসানোর জন্য। আমরা তো জানতাম না ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির সাথে তিনি গোপন আঁতাত করে এখানে কিভাবে নাটক করেছেন। তিনি বিচারপতির চেম্বারে গিয়ে বিচারপতিকে বলেছেনÑ আমি দাঁড়িয়ে যাব আর আপনি আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেবেন। লোকে দেখুক আমাদের মধ্যে কোনো খাতির নেই। সাক্ষীকে ভিডিও দেখিয়ে সে অনুযায়ী সাক্ষ্য দিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও সাক্ষী তা মনে রাখতে না পারায় তাকে হাজির করা হয়নি। এসব কথা আছে স্কাইপি সংলাপে। এসব বিষয় ফাঁস হওয়ার পরে আমরা কী করে আর ন্যায় বিচারের আশা করতে পারি? কাজেই জেয়াদ আল মালুমকে আমরা ন্যায় বিচারের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করি। তাকে অপসারণ না করা পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখা হোক।
ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি রোববার শুনানির জন্য ধার্য করে সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি করেন।
জেয়াদ আল মালুমের বিরুদ্ধে দরখাস্তে অভিযোগ : স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁসের জের ধরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক ও ব্রাসেলস নিবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে তার মধ্যে অসংখ্যবার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমের প্রসঙ্গ এসেছে। গতকাল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের দাবি জানিয়ে যে দরখাস্ত করেছেন তাতে জেয়াদ আল মালুম বিষয়ক কিছু সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে।
দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, সাক্ষী ও জেয়াদ আল মালুমের মধ্যে একটি আঁতাত হয়েছিল। আসামিকে ফাঁসানোর জন্য জেয়াদ আল মালুম সাক্ষীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কোন সাক্ষীকে দিয়ে কী বলানো হবে, কতটুকু বললে রায় লিখতে সুবিধা হবে এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সাথে তার যোগসাজশ ছিল। এ বিষয়ে স্কাইপি সংলাপে আলোচনা হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে। এক দিকে গোপনে ট্রাইব্যুনালের সাথে আঁতাত করা হয়েছে অন্য দিকে প্রকাশ্যে দেখানো হয়েছে যে, ন্যায়বিচার চলছে। সাক্ষী সুলতানা কামালের সাক্ষ্য বিষয়ে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে আলোচনায়। তাকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেই মোতাবেক তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। তা ছাড়া সাক্ষী জেনারেল (অব:) শফিউল্লাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বিধায় জেয়াদ আল মালুম ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন তাও উল্লেখ আছে সংলাপে। শফিউল্লাহকে দিয়ে নির্দেশমতো সাক্ষ্য দেয়ানো যাবে না আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত তাকে সাক্ষী হিসেবে হাজিরই করা হয়নি। বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে জেয়াদ আল মালুমের গোপন আঁতাত বিষয়েও স্কাইপি সংলাপ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে দরখাস্তে।
দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়েছে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জেয়াদ আল মালুমের সাথে আলোচনা করতেন; দিকনির্দেশনা দিতেন। ড. জিয়াউদ্দিন আবার এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে। একই ব্যক্তি একই সাথে রাষ্ট্রপক্ষ ও ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে বিচার চালিয়ে যাওয়া হবে সে বিষয়ে। বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. জিয়াউদ্দিন উভয়ে আলোচনার সময় পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করেছেন অমুক বিষয় নিয়ে মালুম সাহেবের সাথে কথা হয়েছে কি না। এ থেকে এটি পরিষ্কার যে উভয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেয়াদ আল মালুমকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হিন্দু সাক্ষী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্য আর ভালো হবে না বলে মনে করছেন জেয়াদ আল মালুম। এ বিষয়েও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে।
দরখাস্তে বলা হয়েছে জেয়াদ আল মালুম একজন আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও এসবের মাধ্যমে নিজেকে গুরুতর অসদারচণে লিপ্ত করেছেন এবং ন্যায়বিচারকে কলুষিত করেছেন। ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত করছেন। আড়ালে বিচারপতির সাথে গোপন আঁতাত করেছেন আর প্রকাশ্য কোর্টে নাটক করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তারা ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করছেন। ন্যায়বিচারকে বিঘিœত করা এবং অসদাচরণে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নিবেদন করা হয়েছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দরখাস্তে।
স্কাইপি কেলেঙ্কারি নিয়ে কৌতুক : গতকাল ট্রাইব্যুনালে স্কাইপি সংলাপ নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা ও ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বেশ কয়েকবার কৌতুক ছুড়ে মারেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনাও দেখা দেয়। একপর্যায়ে আহসানুল হক হেনা বলেন, আশা করেছিলাম এ ঘটনার পর তারা একটু সংযত থাকবেন। কিন্তু যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয়…। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে যেসব কথাবার্তা রয়েছে সংলাপে তাতে আমি হলে আর ট্রাইব্যুনালেই আসতাম না। এখানে মুখও দেখাতাম না। কিন্তু ওনারা তো দেখছি আসছেন। প্রসিকিউটর হওয়ার পর কে কোথায় কী বাড়ি বানিয়েছেন, কে কাকে সন্দেহ করছেন, কার ল্যাপটপ চুরি হয়েছে, কার কী মান তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এ সময় প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, আপনার সম্পর্কেও কথা আছে। আহসানুল হক হেনা বলেন, হ্যাঁ আছে। আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, হেনা সাহেব শুধু আইনজীবী নন আরো বেশি কিছু, এটা তো খারাপ কথা নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন