মাহমুদুর রহমান
বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা
মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে।
দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত
অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা
একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের
সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্
শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর
সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের
কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ।
সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং
সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও
প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com