বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই


মাহমুদুর রহমান




বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি আর কত দিন?


 আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ২৭-১২-২০১২

গত এক দশকের অধিক কাল খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধে রুজু করা কয়েক হাজার মামলা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিনা বিচারে অব্যাহতি পেয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ অভিযুক্ত ব্যক্তি। এ অব্যাহতির প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই। মনে হচ্ছে, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। খবরের কাগজে এসব তথ্য প্রায়ই আসছে। জানা গেল, অতিসম্প্রতি খুন-ধর্ষণজনিত ১০টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আরও বিস্ময়কর হলো, এগুলোর কয়েকটি মামলা প্রত্যাহারের জন্য জেলা কমিটি সুপারিশ করেনি। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের বিধান আছে। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে পিপিকে অবগত করলে তাঁর আবেদনে সংশ্লিষ্ট আদালত মামলার সব কিংবা আংশিক আসামিকে অব্যাহতি দিতে পারেন। জানা যায়, বর্তমান সরকারের সময় আলোচিত ১০টিসহ সাত হাজার ১০১টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। এতে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত প্রায় এক লাখ আসামি অব্যাহতি পেয়েছে বা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ আখ্যায় এ ধরনের মামলা প্রত্যাহার শুধু ঠিক নয় বললে যথার্থ হবে না, এটা আইনের শাসনের গুরুতর ব্যত্যয় বটে।
এ বিষয়গুলোর দিকে যাঁরা নজর রাখছেন, তাঁরা এটাও দেখছেন, আমাদের বিরোধী দলগুলো অন্য অনেক বিষয় নিয়ে যথেষ্ট জোরদার আন্দোলনের অব্যাহত প্রচেষ্টা নিলেও এ বিষয়ে মামুলি কয়েকটি কাগুজে বিবৃতি ছাড়া জোর প্রতিবাদের প্রয়াস নেয়নি। সংসদে বা সংসদের বাইরে সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ লক্ষণীয় হয়নি। এতে অবশ্য বিস্ময়ের কারণও নেই। কেননা, একই সংবাদে উল্লেখ রয়েছে, বিগত জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে তারাও ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে পাঁচ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। কিছু আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয় ৯৪৫টি মামলা থেকে। সে প্রক্রিয়ায় ৭৩ হাজার ৫৪১ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পায়। এর মধ্যেও খুন, ডাকাতি ও ধর্ষণের মামলা ছিল। হয়তো বা ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় গেলে মহাজোট সরকারের নতুন রেকর্ড ভাঙার অপেক্ষাতেই তারা এ বিষয়ে দায়সারা বিবৃতিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় সংসারকে দয়াহীন দেখেছেন। দেখেছেন, ‘প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ প্রশ্ন জাগে, তিনি কি কল্পনেত্রে আজকের বাংলাদেশের সমাজচিত্রকেই দেখতে পেয়েছিলেন?
বলা হয়তো যাবে, কোনো মামলায় রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমনটা ঘটে চলছে; এটা সবার জানা। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা এরূপ কিছু ব্যক্তিকে আইনের বিধান প্রয়োগে অব্যাহতি দিতেও পারে। সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রত্যাহার করা হলে এর সংখ্যা এত বিশাল হতো না। আরও বলা যাবে, আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে মামলা প্রত্যাহার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, এ ধরনের ফৌজদারি মামলায় বাদী সরকার। সরকার যখন মামলা থেকে সরে যেতে চায়, তখন আদালত সম্মত না হলে হয়তো মামলা চলবে, কিন্তু এটা প্রমাণে সচেষ্ট হবে না বাদীপক্ষ। হাজির করবে না সাক্ষীসাবুদ। ন্যূনতম আইনি লড়াইয়ে তারা নিস্পৃহ থাকবে। তখন আদালতে মামলাটি প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ তেমন থাকবে না। আদালত আপসহীন মনোভাব নিলে দু-একটি বিরল ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান হয়তো হবে; কিন্তু এটা বাস্তবে কতটুকু সম্ভব? আর আদালত তো বাদী-বিবাদী সবারই। মামলা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীপক্ষের। সুতরাং, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আদালত সাধারণত নাকচ করেন না।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এভাবে মামলা প্রত্যাহার করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা বিচার পাবে কোথায়? উল্লেখ করা প্রয়োজন, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ইত্যাদির মতো গুরুতর অভিযোগে সরকার বাদী বটে; তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হচ্ছে নিহত ব্যক্তির আপনজন, যারা সন্ত্রাস ও ডাকাতির শিকার এবং ধর্ষণের শিকার নারী ও তার নিকটজন। তাদের পক্ষ হয়ে সরকার মামলা লড়বে—এ দর্শন থেকে সরকার বাদী হয়ে মামলা করে। এর মূলে নিহিত আছে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে আঘাত হানা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিপরীতধর্মী আচরণ তার কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে—এটা বলা কি খুব বাড়াবাড়ি হবে? এ মামলাগুলো কিছু জঘন্য প্রকৃতির অপরাধ সংঘটনের পর দায়ের করা হয়। তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করে। বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল প্রত্যাহার করা এসব মামলা। কোনোটির অভিযোগপত্র গঠন করা হয়েছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষ্যগ্রহণও হয়েছে। আদালতের বিচারে অনেক মামলাতেই হয়তো বা সাজা হতো না প্রমাণের অভাবে। নিরপরাধ বলে যদি কেউ নিশ্চিত থাকে, তাহলে বিচারের অপেক্ষায় থাকতে দোষ তো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। আর অপরাধের সঙ্গে যদি সংশ্লিষ্ট থাকে, তাহলে তাদের অব্যাহতি দিতে আইনের এ ব্যবহার অপব্যবহারের নামান্তর।
অনেকেই প্রশ্ন রাখেন, বিশেষ সুবিধাভোগী এ লোকগুলো কারা? আপাতদৃষ্টিতে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু এটাও কেউ কেউ জোর দিয়ে বলে থাকে যে দলীয় আনুগত্যের সনদও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংগ্রহ করা হয় বাঁকা পথে। আর উভয় সরকারের সময়ে তা হয়েছে বা হচ্ছে। এর প্রভাব সহজেই অনুমেয়। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, ক্ষমতায় থাকা দলটির নেকনজরে থাকলে আইনের এ ধরনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে পার পেয়ে যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা অপরাধজগতের জন্য সবুজসংকেত। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিই স্বাভাবিক। অপরাধ করে পার পাওয়ার সহজ রাস্তায় কিছু ব্যক্তি উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারের ভাবমূর্তি। জনমনে সৃষ্টি হয় আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতা। অপরাধী দ্বিগুণ উৎসাহে আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে আঘাত হানার দায়িত্ব যে সরকারের, তাদের কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীতধর্মী। এতে শঙ্কিত দুর্বল ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা; পাশাপাশি উল্লসিত দুর্জনেরা। হতাশ ও বিচলিত সাধারণ মানুষ। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি আদৌ কারও জন্য সুফল আনেনি।
অতিসম্প্রতি শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত বিকাশ নামের এক ব্যক্তি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। কোনো মামলায় তার সাজা হয়নি। বিচারাধীন সব মামলাতেই সে জামিনপ্রাপ্ত। যতটুকু জানা যায়, জামিনপ্রাপ্তির পরও বাইরের জগৎকে নিরাপদ মনে না করে আইনের কৌশল খাটিয়ে বেশ কিছু সময় সে কারাগারে ছিল। তার আকস্মিক মুক্তি ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়া কিন্তু বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ, অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া এবং রীতি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত না করায় বিষয়টি সবাইকে হতবাক করেছে। তার অবস্থান নিয়ে অনেক কথাই আসছে সংবাদমাধ্যমে। কোনোটির মতে সে দেশান্তরি কিংবা তার অপেক্ষায় সীমান্তে অবস্থান করছে। আবার কিছুসংখ্যকের মতে, সে দেশের অভ্যন্তরে অন্ধকার জগতে আবার মিশে গেছে। তার মুক্তিতে সবুজ সংকেত গেল অপরাপর শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে। কারাগার থেকে বিকাশ বেরিয়ে যদি স্বাভাবিক জীবন যাপন করত, তাহলে এসব কথা আসত না। এ মুক্তি জনমনে বড় ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা হয়তো অনেকেই ভাবতে ভুলে যান, এ ধরনের সন্ত্রাসীরা কখনো কারও আপনজন হয় না। যখন যাদের হাতে সুযোগ, তারা তাকে কাজে লাগাতে পারে অন্যদের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, এ দেশে অপরাধীদের কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়ে নিজদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা এবারই প্রথম ঘটল, এমনটা কিন্তু নয়; অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।
বিচারাধীন মামলা প্রত্যাহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রেহাই দিয়েই শুধু সরকারগুলো থেমে থাকেনি, আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বোধগম্য কারণ ব্যতিরেকেই ছেড়ে দিয়ে অপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে সরকার। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা (যা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রয়োগ করতে হয়) বলে মার্জনা পেয়েছে এবং পাচ্ছে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিরা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সরকারের সময় এরা সংখ্যার বিচারে সর্বাধিক। যে অপরাধে তারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল, তাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের প্রশ্নের কী জবাব সরকারের কাছে আছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনীতি করে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হয়। তাই বলে নিজ রাজনৈতিক দলের নামে বিভিন্ন ধরনের যথেচ্ছাচার আমরা দেখতে থাকব আর কতকাল? যথেচ্ছাচারের অন্যবিধ প্রসঙ্গ এ নিবন্ধের বিবেচ্য নয়; আলোচনায় আসছে শুধু বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে লালন ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি। এখানে দ্বিমতের সুযোগ নেই যে এ সংস্কৃতি খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজন, ধর্ষণের শিকার নারী ও তার নিকটজন, ডাকাতি ও সন্ত্রাসের শিকার সবার প্রত্যাশার প্রতি অবমাননার তুল্য। সরকারে যাঁরা ছিলেন, আছেন বা আসবেন, তাঁরা কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে একটিবার মনে করেছেন বা করবেন রবীন্দ্রনাথের ‘অপমানিত’ কবিতার এসব পঙিক্ত:
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

বিচারপতি নিজামুল হক একই সাথে জজ ও প্রসিকিউটরের কাজ করেছেন : ব্যারিস্টার রাজ্জাক


মেহেদী হাসান
তারিখ: ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (১)-এ আবার বিচার শুরুর আবেদনের ওপর গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তি পেশ করেছেন আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ সংলাপ এবং ইমেইল ডকুমেন্ট তুলে ধরে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম একই সাথে একজন জজ ও প্রসিকিউটরের (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) কাজ করেছেন। আর জজ যেখানে প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন সেখানে ন্যায় বিচার থাকে না।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক যা যা করে গেছেন তা যদি ন্যায় বিচারের মধ্যে পড়ে এবং আপনাদের দৃষ্টিতে যদি এসব কাজ ন্যায় বিচারের অংশ হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বলার কিছু নেই। আর যদি এসব ন্যায় বিচারের অংশ না হয়ে থাকে তাহলে এ বিচার আবার শুরুর কোনো বিকল্প নেই।
আবার বিচার শুরু নিয়ে আইনি বিতর্ক প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক একজন জজ হিসেবে যা করেছেন তার বিষয়ে কোনো বিধান আইনে থাকে না। আইন তৈরি করার সময় এটা চিন্তা করা হয় না যে, একজন জজ জালিয়াতি প্রতারণার আশ্রয় নেবেন বা তিনি ন্যায় বিচার করবেন না। তাই এ বিষয়ে কোনো বিধানও রাখা হয় না আইনে।
তিনি বলেন, কাজেই আইনের ৬(৬) ধারা এ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। আইনের এ ধারা এ বিষয়টি কাভার করে না। তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে এর আগে দুইবার বিচারপতি বদল হয়েছে, তখন তো আমরা আবার বিচার দাবি করিনি।
গতকাল যুক্তি উপস্থাপনের সময় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বিচারপতি নিজামুল হক ও ব্রাসেলস নিবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কাইপ সংলাপ থেকে বিচারসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথোপকথন তুলে ধরেন। বিচার চলাকালে ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন বেলজিয়াম থেকে যেসব ইমেইল পাঠিয়েছেন বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে তারও কিছু কিছু উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন; বিচারপতিদের আচরণবিধি, শপথ ও আইনের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী নির্বাচন, সাক্ষী কি বলবেন তা নির্ধারণ, আসামি পক্ষের সাক্ষীর সংখ্যা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি আহমদ জিয়াউদ্দিনের সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের দিকনির্দেশনা মোতাবেক বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন। এসবের মাধ্যমে তিনি পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছেন। সেই সাথে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনও বিচারকাজে পুরোপুরি হস্তক্ষেপ করেছেন।
তিনি বলেন, ২২/১০/২০১২ তারিখে অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা নির্ধারণ করে তিনি আদেশ দিলেন। আর সাক্ষীর সংখ্যা কত হবে এসব বিষয় নিয়ে তিনি ৫/১০/২০১২ তারিখ ড. আহেমদ জিয়াউদ্দিনের সাথে আলোচনা করেছেন। সব কিছু তারা দু’জনে কোর্টের বাইরে আলোচনা করে ঠিকঠাক করে কোর্টে এসে তা মঞ্চস্থ করেছেন মাত্র। সাক্ষীর সংখ্যা সীমিত করে দিলে তা নিয়ে হইচই হতে পারে এ বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক স্কাইপ সংলাপে বলেছেন, আমি এ নিয়ে কেয়ার করি না। আমি সাক্ষীর সংখ্যা নির্ধারণ করে দেবো।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা যে ১১০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি তা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনি কিভাবে সম্পূর্ণ অন্যের নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন।
তিনি বলেন, সরকারি গেজেটে সহায়ক বাহিনী বা অক্সিলিয়ারি ফোর্সের যে সংজ্ঞা তাতে জামায়াতে ইসলামীকে কোনো অক্সিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। কিন্তু ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের পরামর্শে বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠন আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে সহায়ক বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন স্কাইপ সংলাপের সময় বিচারপতি নিজামুল হককে বলেছেন গোলাম আযমতে ধরতে হলে জামায়াতে ইসলামীকেও অক্সিলিয়ারি ফোর্স বানাতে হবে। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, জিয়াউদ্দিনের নির্দেশনা মেনেই বিচারপতি নাসিম ফরমাল চার্জে জামায়াতের নাম অক্সিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে ঢুকিয়ে দেন পরে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জালিয়াতির একটা সীমা থাকা দরকার।
তিনি বলেন স্কাইপ আলোচনার সময় তারা বিচারপতি ও বেলজিয়াম প্রবাসী বলেছেন, সুলতানা আপা খুব ভালো সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি হাই কাস সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়ার পর তিনি বুঝে গেছেন কোন জিনিসটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে সাক্ষ্য দেয়ার সময়। এ নিয়ে তার সাথে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। তারা আরো আলোচনা করেছেন, জেনারেল শফিউল্লাহকে সাক্ষী হিসেবে আনার দরকার নেই। কারণ তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ওনার ওপর কন্ট্রোল নেই। এ ধরনের জেনারেল সাহেবদের সমস্যা হলো তাদের ওপর কন্ট্রোল নেই। তা ছাড়া তার মধ্যে একটা কমান্ডিং ভাব আছে। তিনি যুদ্ধ করেছেন। আর্মিরাই যুদ্ধ করেছে আই টাইপের। তিননি যুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারেন। মালুম ভাই বলেছেন, তারা যুদ্ধ ইস্যুটাকে এড়িয়ে যেতে চান। মালুম ভাই এ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। তার (শফিউল্লাহ) মুখ দিয়ে যদি বের হয়ে যায় এখানে একটা সত্যিকার যুদ্ধ হয়েছিল এবং পাকিস্তান আর্মিই ছিল মূল নায়ক; তারা আসলে কিছু ছিল না; তাহলে সেটা সুবিধার হবে না। এটাই হলো উদ্বেগের বিষয়।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এসব কারণে জেনারেল শফিউল্লাহকে সাক্ষী হিসেবে না আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তারা বলেছেন, মুনতাসির মামুনকে দিয়ে গ্যাপ পূরণের জন্য তাকে প্রয়োজনে আবার ডাকা হবে। কে স্টার সাক্ষী, কে ভালো সাক্ষী, কাকে আনলে ভালো হবে, কাকে দিয়ে কী বলাতে হবে এসব বিষয় নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, স্কাইপ সংলাপে বিচারপতি নিজামুল হক বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীকে তিনি কোর্টে ধমকিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন। কারণ তিনি যা বলছিলেন তা রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ট্রাইব্যুনালের একটি কাগজ সরবরাহ বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনকে বলেছেন, ওই মিয়া আমাকে গোপনে বললেই তো হতো। আমি তাকে পাঠিয়ে দিতাম।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, একজন বিচারক কি এ কাজ করতে পারেন? তিনি শুধু যে সচেতনভাবেই এসব করেছেন তা নয়, বরং এসব নিয়ে তিনি আবার সচেতনভাবে আরেকজনের সাথে আলোচনাও করেছেন স্কাইপের মাধ্যমে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আরো কিছু স্কাইপ সংলাপ তুলে ধরে বলেন, কোন কোর্টে কোন কেস আগে এগিয়ে নিতে হবে, কোনটার রায় আগে দিতে হবে, কোনটার রায় পরে দিতে হবে এসব নিয়ে বিচারপতি নাসিম আলোচনা করেছেন ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে। বিচারপতি নিজামুল হক বলেছেন, সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধতা গোলাম আযমের। সে টিম লিডার। তার কেস আগে নিতে হবে। সাঈদীর ক্ষেত্রে টিম লিডারের প্রশ্ন নেই। বড়গুলারে বাদ দিয়ে ছোটগুলারে আনার যুক্তি নেই। আমি মনে করি সবার আগে গোলাম আযম, তারপর সাঈদী, তারপর মোল্লা। আর তা না হলে সবার আগে সাঈদী। সেটা সবার আগে এগিয়ে আছে।
বিচারপতি নিজামুল হক বলেছেন, তার বাসায় আইন প্রতিমন্ত্রী এসেছিল। তাড়াতাড়ি রায় দিতে বলেছেন তিনি। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এ বিচারে সরকারের তথা নির্বাহী বিভাগের কতটা প্রভাব ছিল।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল নিয়েও তারা অনেক আলোচনা করেছেন। আলোচনার একপর্যায়ে ড. জিয়াউদ্দিন বলেছেন স্যারের (আইনমন্ত্রী) বাসায় দুই কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে তিনি বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন।
তিনি বলেন, গোলাম আযমের মামলায় আসামি পক্ষের সাক্ষীর তালিকা প্রদানসংক্রান্ত বিষয়ে ওই বিচারপতি আসামি পক্ষকে কিছুটা সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনভাবে তা দেননি। তারও প্রমাণ রয়েছে সংলাপে। তিনি বলেছেন, সময় না দিলে গভর্নমেন্ট আবার কইতÑতখন তুমি টাইম দিতা। এ থেকে বোঝা যায়, সরকার কি বলবে না বা না বলবে সে দিক বিবেচনা করে প্রভাবিত হয়ে তিনি আমাদের সময় দিয়েছেন; স্বাধীনভাবে দেননি তিনি।
আইনে আবার বিচারের সুযোগ আছে কি নেইÑ এ বিষয়ক আলোচনার পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনের ৬ (৬) ধারায় বলা আছে ‘শুধু ট্রাইব্যুনালের কোনো সদস্যের পরিবর্তন হলে বা কোনো সদস্য অনুপস্থিত থাকলে ইতঃপূর্বে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এমন কোনো সাক্ষীকে আবার সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তলব করতে বা আবার শুনানি গ্রহণে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য থাকবে না।’
তিনি বলেন, কোনো সদস্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইংরেজিতে ‘সিয়ারলি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় এর মানে হলো ‘নিছক’।
তিনি বলে, এর আগে এই ট্রাইব্যুনালে মোট তিনবার বিচারপতি বদল হয়েছে।
প্রথমবার ২২/৩/২০১২ সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয় এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হককে নিয়োগ দেয়া হয় তার স্থলে।
দ্বিতীয়বার ২৮/৮/২০১২ বিচারক জহির আহমেদ চলে যান এবং তার স্থলে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়।
তৃতীয়বার ১১/১২/২০১২ বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন।
ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী প্রথম দুই বার যে বিচারপতি বদল হয়েছে সেটা স্বাভাবিক বিষয়। তাই তখন আমরা বিচারপতি বদলের কারণে বা সদস্য পরিবর্তনের কারণে আবার বিচার দাবি করিনি। কিন্তু তৃতীয়বার বিচারপতি নিজামুল হকের চলে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একটা অস্বাভাবিক ঘটনার কারণে তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ বিষয়টি আইনে উল্লেখ নেই। তাই আমরা আবার বিচার দাবি করেছি।
তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক যা করেছেন একজন জজ হিসেবে, তার বিধান আইনে থাকে না। আইন তৈরি করার সময় এটা চিন্তা করা হয় না যে একজন জজ জালিয়াতি-প্রতারণার আশ্রয় নেবেন বা তিনি ন্যায় বিচার করবেন না। তাই এ বিষয়ে কোনো বিধানও রাখা হয় না আইনে।
কাজইে আইনের ৬(৬) ধারা এখানে কার্যকর হবে না। আইনের এ ধারা এ বিষয়টি কাভার করে না।
ট্রাইব্যুনালকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, আপনারা ন্যায় বিচারের স্বার্থে যেকোনো আদেশ দিতে পারেন এবং সেটি আপনাদের সহজাত ক্ষমতা। এ ক্ষমতা আপনাদের দেয়া হয়েছে। কাজেই আইনে আবার বিচারের বিধান নেই এ দাবি সঠিক নয়। ট্রাইব্যুনাল ন্যায় বিচারের স্বার্থে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে এবং এটাই ন্যায়ের দাবি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের দাবি শুধু আবার বিচার নয়, আমাদের দাবি আরো বেশি।
গতকাল দিনব্যাপী শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। আগামীকাল এক ঘণ্টার মধ্যে তার শুনানি গ্রহণ শেষ করার জন্য কোর্ট অনুরোধ করেছেন তাকে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে শুনানির সময় সহায়তা করেন ব্যারিস্টার এমরান সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির প্রমুখ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, মতিউর রহমান আকন্দ প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল (১) চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক শুনানি গ্রহণ করেন।
শুনানি চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন অধ্যাপক গোলাম আযম : গতকাল শুনানি চলাকালে কাঠগড়ায় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন অধ্যাপক গোলাম আযম। দুপুর সাড়ে ১২টার সময় তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অল্প সময় পরে আবার তার জ্ঞান ফিরে আসে। তাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়। স্ট্রেচারে শুইয়ে তাকে দোতলা থেকে নামানো হয়।
হাজতখানায় সব শীর্ষ নেতা : গতকাল প্রথম এবং দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন মামলা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় জামায়াতের বন্দী সব শীর্ষ নেতা একত্রে অবস্থানের সুযোগ পান। তাদের মধ্যে ছিলেন দলের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জোনরেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা। এ ছাড়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও এ সময় হাজতখানায় ছিলেন।

আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী লাইন


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এটা তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে ঠিক মনে হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে তো সব শেষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এর শেষ চাওয়ার পরিবর্তে এই ইস্যুটিকে ঝুলিয়ে রেখে তার রাজনৈতিক চালবাজি চালিয়ে নিতে চায়, এমনটাই এখন দেখে-শুনে মনে হচ্ছে। এদিক দিয়ে যত গর্জে তত বর্ষে না—এটাই আওয়ামী লীগের অবস্থা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়ে সরকারি লোকজন যেসব কথাবার্তা বলছেন তাতে মনে হয় এদের ধারণা শাস্তির সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বিচারকদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে এখন শুধু কোনো রকমে বিচার সেরে শাস্তি কার্যকর করার অপেক্ষা! মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের দফতরবিহীন পরগাছা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আগামী বছরের মধ্যেই ১৪ জন বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারাধীন মামলার রায়ের ব্যাপারে এ ধরনের কথাবার্তা বলা যে শাস্তিযোগ্য কাজ, এটা সবাই জানে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি একজন বিজ্ঞ আইন বিশেষজ্ঞ! তা সত্ত্বেও তিনি এমন কথা বলছেন এটা তার স্থির বিশ্বাস থেকেই যে, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহল যেভাবেই হোক, বিচারাধীন ব্যক্তিদের ফাঁসি চান, এমনকি আদালতকে প্রভাবিত করে হলেও তারা এ কাজ সম্পন্ন করবেন! এটা এতই স্থূল যে, তার এই বক্তব্য প্রদানের পর আদালতেরও টনক নড়েছে এবং তারা এই পরগাছা মন্ত্রীকে এর কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু এই মন্ত্রীই নয়, আওয়ামী লীগের কিছু ভূঁইফোড় নেতা ও তাদের সরকারি জোটের নেতা এখন প্রায় প্রতিদিনই এ বিষয়ে এমন সব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা একটি বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে বলা চলে না। তারা নিজেরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই চাইতে পারেন এবং তার মধ্যে ন্যায্যতা আছে। কিন্তু এই বিচারাধীন মামলায় বিচারপতিরা কী রায় দেবেন তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান তারা করতে পারেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার ঘরানার লোকরা এসবের কোনো পরোয়া করেন না। ক্ষমতার জোরে তারা বেপরোয়া। তাদের দুই মহিলা নেত্রীর জবানও এদিক দিয়ে লক্ষ্য করার মতো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমাপ্তি ও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের শাস্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আগাম স্ট্র্যাটেজি যাই হোক, এ নিয়ে জোর প্রচারের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের যত রকম শক্তি আছে তা প্রদর্শনের চেষ্টায় এখন নিযুক্ত আছেন। এজন্য সম্প্রতি তাদের দেখা গেছে তাদের ঘরানার বামপন্থী দল ও বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে ‘আন্দোলন’ করতে। প্রথমোক্তরা এই উদ্দেশ্যে এক সরকার সমর্থিত হরতাল ডেকে মস্তবড় কেলেঙ্কারি করেছেন এবং দ্বিতীয়োক্তরা সাম্প্রদায়িকতার নামে এক ভুয়া ‘জাতীয়’ সম্মেলন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকেই সামনে এনেছেন। তাদের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্মেলনের আসল লক্ষ্য এর মাধ্যমে তারা প্রকটিত করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন ঘোর অমাবস্যা। এই অমাবস্যার অবস্থায় এখন অন্ধকারের জীবদেরই রাজত্ব। চোর, দুর্নীতিবাজ, লুণ্ঠনজীবী ও দস্যুরাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং জনগণের জীবনে এক অভিশাপের মতো নেমে এসেছে। এ সবই যুক্ত আছে এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান, রুচিহীনতা ও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সঙ্গে। এদের সাংস্কৃতিক নিম্নমান ও রুচিহীনতার যে প্রতিফলন এদের নানা বক্তব্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয় তার থেকে পীড়াদায়ক ব্যাপার কমই আছে। এ বিষয়টি নিয়ে কাউকে বিশেষ কথাবার্তা ও আলোচনা করতে দেখা যায় না। কিন্তু নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতা যে নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত, এটা এক প্রমাণিত সত্য।
শুধু বিচার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীই নয়, অন্য অনেকভাবেই আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরানার রংবেরঙের লোকজন যেসব কথা বলছে ও কাজ করছে, তাতে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো মূল উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এত মাতামাতি করছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একেবারে ভরাডুবি হবে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই এ অবস্থা। বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে তারা যতই ভাড়া করা লোক নামিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করুক, তাদের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। এ উপলব্ধি তাদের যতই হচ্ছে ততই তারা মরিয়া হয়ে এমন সব কাজ ও কাণ্ড করছে, যার মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান বলেও কিছু নেই।
এদের নিম্ন সাংস্কৃতিক মান ও রুচিহীনতার যে কথা আগে বলেছি তার প্রমাণ এরা প্রায় প্রতিদিনই নানাভাবে দিয়ে যাচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম হাস্যকর দৃষ্টান্ত হলো—কিছুদিন আগে জাতিসংঘে শান্তি বিষয়ক শেখ হাসিনার এক প্রস্তাব গৃহীত হওয়া নিয়ে তাদের প্রচারণা। বলা দরকার, এ ধরনের প্রস্তাবের ও প্রস্তাব পাস হওয়ার কোনো গুরুত্ব বাস্তবত নেই। এমন প্রস্তাবের অভাব জাতিসংঘে নেই, যেগুলো পাস হওয়ার পর অবহেলায় পড়ে থাকে। এগুলো অনেকটা কথার কথার মতো। কিন্তু এ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আওয়ামী মহলে এখন তোলপাড় চলছে। হাসিনাকে ‘বিশ্ব শান্তি মডেলের রূপকার’ আখ্যায় ভূষিত করে তার দলের লোকরা ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে তারা মিছিল করছে, জনসভা করে বিশ্ব নেত্রী হিসেবে হাসিনার গুণকীর্তন করে গলা ফাটাচ্ছে! এসবই হচ্ছে নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রুচির প্রতিফলন। কিন্তু হায়! এ নিয়ে তারা যতই প্রচার-প্রচারণা ও মাতামাতি করুক জনগণের মধ্যে তাদের সম্পর্কে ধারণা মোটেই পরিবর্তিত হচ্ছে না। ভোটের বাজারে তাদের দর বৃদ্ধি হচ্ছে না। উপরন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন লেজেগোবরে হচ্ছে।
দেশের সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে রিপোর্ট প্রদান ও লেখালেখি প্রকাশ করছে। টিভি চ্যানেলগুলোও পিছিয়ে নেই। সমালোচনা তো বটেই, এমনকি তাদের নিজেদের কাণ্ড-কারখানার রিপোর্টও তাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসবের হিসেব করে কথাবার্তা বলা ও কাজ করার কোনো ব্যাপারই আওয়ামী লীগ, তাদের শরিক দলগুলো ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অদমিতভাবে এ লাইনে কাজ করে যাওয়ার থেকে একটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে আত্মঘাতী আর কী হতে পারে?
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
২৬.১২.২০১২

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো?


মিনা ফারাহ
তারিখ: ২০ ডিসেম্বর, ২০১২


“মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিলো, বড়ো হও দাদা ঠাকুর
তোমাকে আমি তিনপ্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
যেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে।
…তারপর কতো চন্দ্রভুক অমাবস্যা এসে চলে গেলো,
সেই বোষ্টমি আর এলো না
২৫ বছর প্রতীায় আছি।” Ñসুনীল গঙ্গোপধ্যায়।
দুই শিশু, ২৮ বছরেও বড় হলো না। পাঁচ বছরের জন্য মতায় গিয়ে জনপ্রিয়তায় ধস নামায়। ফলে এরা কেউ নির্বাচন দিতে ভয় পায়, অন্যজন তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে মানুষ খুন করে। তখন মতাসীনদের একমাত্র অস্ত্র, একনায়কতন্ত্র কায়েম করে গদি দখলে রাখা; অন্যথায় জেলে পচতে হবে।
অতীতেও জোট সরকারের যথেষ্ট সমালোচনা করেছি। এখন দেখছি এর চেয়ে শতগুণে বেশি ফ্যাসিস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকার। জোট সরকার যদি চামড়া পর্যন্ত দুর্নীতি করে থাকে এরা করেছে মজ্জা পর্যন্ত। আইন-বিশৃঙ্খলার দেশে তরতাজা বিশ্বজিৎ খুনের পর আমি এই বাংলাদেশে ভালো মন্দের মধ্যে আর কোনো পার্থক্যই দেখছি না। কেউ দেখাতে পারলে লেখালেখি ছেড়ে দেবো। মানুষ সোচ্চার হলে বিশ্বজিৎ একাই সরকারকে টেনে নামাবে। সত্য যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এই সরকার কিছুতেই মানবে না বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের চেষ্টা, আরেকটা ‘১/১১’ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়া। বিদেশে সবারই আস্তানা আছে, লুটপাটের পাহাড় আছে। তার পরেও শেষ রাস্তা হিসেবে রয়েছে জ্ঞানের সর্বোচ্চ চর্চা এবং সেই ল্েয বিরোধী দলকে সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে অবশ্যই যোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা পেশ করে ‘১/১১’-এর রাস্তা বন্ধ করতে হবে। এরপর যা হয় হবে। সংসদ এখন টেলিভিশনে, মানুষ বিচার করবে কে ফ্যাসিস্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ট্যাক্সিড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে ভাইস-প্রেসিডেন্টের নাম বলতে মাথা চুলকায়। কিন্তু ঢাকার একজন রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলে খালেদা-হাসিনার ইতিহাস মুখস্থ বলতে পারে। এর কারণ হলো, রাজনীতিবিদেরা ৯৯ ভাগ মানুষের মগজ মাথা থেকে নারিকেলের শাঁসের মতো তুলে এনে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ নামের দু’টি পাত্রে রেখে দিয়েছে। আমরা এখন মগজবিহীন জাতি। শিাঙ্গনে পড়ানো হয়, বন্দুক-কামান আর লগি-বৈঠা-চাপাতি। ভিসি সাহেবরা যেন পার্টি অফিসের কর্মচারী। বিশ্বে আর কোনো দল আছে যারা বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বিদেশে দল পালে? এমনকি হার্ভার্ড-কলম্বিয়াতে পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিক না থাকলেও বিএনপি-আওয়ামী লীগের ছাত্র আছে যারা পোস্টার হাতে ‘খালেদা-হাসিনা’ করে। নানক আসেন, ফিরতি ফাইটে মির্জা ফখরুল। প্রবাসের বাঙালিরা খালেদা-হাসিনার পোস্টার হাতে কেনেডি এয়ারপোর্টে কুড়াল মারামারি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাগনা বাংলা পত্রিকার ছড়াছড়ি, ঘরে ঘরে সংগঠন আর বাংলা টেলিভিশন। ভারত ও পাকিস্তানের দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কিছু নেই। দলের নামগন্ধও নেই। বাঙালি যেটা ধরে, শেষ না করা পর্যন্ত ছাড়ে না।
প্রসঙ্গ হরতাল
সিপিবির হরতাল ঘোষণা শুনে মনে হয়েছে, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের কথা। এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বামশক্তি। কিন্তু সাইন বোর্ডসর্বস্ব সুবিধাবাদী কমিউনিস্টগুলো একটি সভা পর্যন্ত করতে পারে না। দুর্ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় লম্বা লম্বা বক্তৃতা, টকশো। তারপর আর পাত্তা নেই। অনেকেই শ্রমিক সংগঠনের নামে নিজেরা বড়লোক হয়, এনজিওর টাকায় ল্যান্ডরোভার গাড়ি চালায় (হায়রে শ্রমিক সংগঠন)। ৫০০-এর বেশি শ্রমিক পুড়ে কাবাব হয়ে গেল, রাজপথে আজ পর্যন্ত একটিও জোরালো প্রতিবাদ করল না বরং হরতাল ডেকেছে জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবিতে। জামায়াত সমর্থন করি না করি, সেটা বড় কথা নয়। যা ধ্র“ব সত্য তা হলো পৃথিবীতে যদি একটি দেশও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকে সেটা ভারতবর্ষ। মুসলমানদের জন্য আলাদা ভূমির দাবিতে পাকিস্তানের পে বাঙালি মুসলমানদের ভোট ৯৬% আর পশ্চিমা মুসলমানদের ভোট ৪৯%। সেই দিন স্বাধীন বাংলার দাবি ত্যাগ করে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর সাথে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বাধীন পাকিস্তান আন্দোলনে। ক্যাবিনেট মিটিংয়ের অন্যতম দূতিয়ালি সোহরাওয়ার্দী। জিন্নাহর ডানহাত সোহরাওয়ার্দীর অন্যতম শিষ্য শেখ মুজিব। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে কলকাতা, নোয়াখালী, খুলনায় যে ভয়াবহ রায়ট হয়, সে ১০ হাজার প্রাণহানির জন্য ইতিহাস কাকে দায়ী করে? সেই রায়টে লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার কে ছিল। তাও সবার জানা। আমি বলছি, ঐতিহ্য পরম্পরায় লগি-বৈঠা আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাস্তবতা এবং পাকিস্তান পরম্পরায় বাংলাদেশের জন্মের নেপথ্যের পটভূমি। প্রমাণ ছাড়া একপেশে হওয়ার উপায় নেই। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। মুসলিম লীগের মতো বৃহৎ দল পর্যন্ত যুক্তফ্রন্টের কাছে ধরাশায়ী। আবার যুক্তফ্রন্টে কুড়াল মারামারির ফসল আইউব খানের সামরিক শাসন। জামায়াতও যে একদিন ত আর দুর্গন্ধমুক্ত হয়ে বড় শক্তি হবে না এমন কথা বলা যাবে না। কারণ তাদের মধ্যে শিতি এবং প্রগতিশীল চিন্তার প্রজন্ম ঢুকে পড়েছে (সাম্প্রতিকালে জামায়াত-শিবিরকে উদ্দেশ্য করে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখাটি বলতে গেলে মেধাশূন্য)। অতীতের যেকোনো অভিযুক্তমুক্ত এরা শুধু সময়ের পরীার অপোয়। যতই এদের বিলুপ্তির চেষ্টা চলবে, (অতীতের শিা) ততই এরা জনপ্রিয় হবে। জামায়াত বিলুপ্তির দাবিতে সিপিবির কর্মকাণ্ড দেখলে ‘লেনিন’ সাহেব হয়তো আত্মহত্যা করতেন। সেলিম সাহেবকে বলব, অবিলম্বে হাস্যকর হরতাল প্রত্যাখ্যান করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়াই কাজের কাজ হতে পারে। কারণ পশ্চিমের রক্তচোষারা সস্তা শ্রমিকের খোঁজে পুঁজি করেছে ৩৭ ডলারের জীবন। এজন্য তারা সরকার, বিজিএমইএ, এফবিসিসিআইয়ের সাথে ষড়যন্ত্র করে বেতন আর ট্রেড ইউনিয়নের বারোটা বাজিয়েছে। সঙ্ঘবদ্ধ মাফিয়ারা ভর করেছে হাড়-মাংস সম্বল শ্রমিকদের ওপর। ৩০ পয়সা খরচা করে গার্মেন্ট মালিকেরা লাভ করে তিন হাজার টাকা। এভাবে চলতে দিলে দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য আকাশ ছোঁবে। একই সাথে, এই মাপের ফ্যাসিস্ট আর মুক্তবাজার অর্থনীতি পৃথিবীর কোথাও নেই।
আন্দোলন-অবরোধের বিরুদ্ধে বিএনপিকে সরকার আসলেই কী বোঝাতে চায়? ২৮ অক্টোবর ২০০৬ মূলত ২১ আগস্টের চেয়েও ভয়াল একটি দিন। ২৬ অক্টোবর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ২৮ অক্টোবর সারা দেশে জ্বালাওপোড়াও এবং লগি-বৈঠা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যেকোনোভাবে রাস্তা আমাদের দখলে রাখতে হবে। দাবি না মানা পর্যন্ত লগি-বৈঠা-চইর নিয়ে আন্দোলন করতে হবে (দ্র: ইউটিউব ভিডিও কিপ)। ওই দিনটি ছিল জোট সরকারের পঞ্চম বার্ষিকী, তাদের শোডাউনের বিপরীতে ২৭ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত লগি-বৈঠা আন্দোলনের ঘোষণায় অকার্যকর হয়ে যায় দেশ। শ্রমিকদের সাথে নিয়ে ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা মারপিটে গোটা পল্টন এবং বায়তুল মোকাররম সেদিন রণত্রে। অবরুদ্ধ দেশ, ভয়াল রাজধানী, রাজপথে পড়ে রয়েছিল পিটিয়ে মারা লাশ। প্রতিটি পয়েন্টে ১৪ দলের মিছিলে উত্তেজিত মানুষের ঢল। পুলিশ, জামায়াত ও ১৪ দলের সংঘর্ষে পল্টন ময়দানের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি। বায়তুল মোকাররম, মুক্তাঙ্গন, পল্টন মোড়ে দিনভর সংঘর্ষে ২১ জনের মৃত্যু রেকর্ড হয়েছিল। এর বাইরেও অনেক মানুষ মারা গেছে। যুবলীগের আগুনে বাসের মধ্যে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে ১১ জন। বেলা ১১টার মধ্যে সারা শহরই রণাঙ্গনের মতো জ্বলছিল, পেট্রল-কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হলো ফুটপাথে শত শত গরিব মানুষের দোকানে, নানা প্রতিষ্ঠানে। ফার্নিচারের দোকান ভেঙে সেই কাঠ এনে রাস্তায় রাস্তায় পুড়িয়ে করা হলো ভয়ঙ্কর ‘ঐতিহাসিক লগি-বৈঠা আন্দোলন।’ কয়েক শ’ হাতবোমা, ৫০০ রাউন্ডেরও বেশি গুলি। পুলিশের ওপর আওয়ামী লীগের মারাত্মক আক্রমণে সেদিন পুলিশ পর্যন্ত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল। বিএনপি মতায় এলে ২৮ অক্টোবরকে যেন  ২১ আগস্টের মতো পালন করে।
জানি, হরতাল খারাপ। এতে দেশের তি হয়। তারপরও আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি কখনোই হরতালের অধিকার ৫০ ভাগও ভোগ করেনি। ১৭৩ আর ১৩০ দিনের বিপরীতে, এই পর্বে মাত্র ১০ দিনের। কারণ রাস্তা এখন পুরোপুরি মতাসীনদের দখলে। আমরা বোধকরি, হোসনি মোবারকের স্টেশনে পৌঁছে গেছি।
এই সরকার মতায় এসে নিজেদের মামলার সাথে ২৮ অক্টোবরের খুনিদের মামলাও বাতিল করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে একটার পর একটা ফাঁসির আসামিকে মা করে দিয়ে গিনেস বুকে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন সামনে রেখে রাস্তায় খুনি নামানোর জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চক্রান্তে মুক্তি দেয়া হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। অতীতে খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচক হয়েছিলাম বলেই শেখ হাসিনা হাতে অস্ত্র পেয়েছিলেন। এর ব্যাখ্যা আমি এখন করব না, তবে এটুকু বলব যে, এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে কঠিন ভাষায় যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদের চূড়ান্ত সময় এখন। আমরা যারা প্রবাসে থাকি তাদের দেশপ্রেম বরং একটু বেশি। দূরে থাকলেও সবই দেখি। অফিস ঘেরাও, হামলা-মামলা, নেতারা উধাও হয়ে যায়। দেশটাই পুলিশি রাষ্ট্র, ৫৬ হাজার বর্গমাইল এখন একটি কারাগার, এই সরকার এখন পুরোপুরি একটি স্বৈরাচারী সরকার। বিরোধী দলের প্রয়োজন নস্যাৎ করে দিচ্ছে এরা। পুবের অন্য ব্লকে যোগ দিয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত মতা পাকাপাকি করে ফেলেছে বলেই তারা মনে করে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ঘোষণা করলেন, বিরোধীদলীয় নেতা স্মৃতিসৌধে যাওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।’ এই দেশে হোসনি মোবারকের শাসনতুল্য পরিস্থিতি এখন বাস্তবতা। ২০১২ সালে পৌঁছে যারা মসনদে, তারাই রাস্তায়। সংসদের ভেতরে বিরোধী দলের জন্য কাঁটা ফেলে রাখা হয়েছে, আর রাস্তায় নামানো হয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনিদের। অর্থাৎ দেশে বিরোধী দল থাকবে না। এ ল্েযই জামায়াতকে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে এবং ইলিয়াস আলীদের মতো নেতারা গুম হয়ে যাচ্ছেন। ২০০১-এর সংসদে যখন লাগাতার বর্জন অব্যাহত, মাঝে মাঝে সংসদে গিয়ে তুমুল হইচই, এক দিন শেখ হাসিনার মুখে (দ্র: ইউটিউব ভিডিও কিপ) ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে বিষোদগার শুনেছিলাম। দারুণ সন্দেহ জাগে। ভাবি, কার নির্দেশে গুম হলো ইলিয়াস আলী?
চোরের মা’র বড় গলা। অবরোধ হরতালের বিরুদ্ধে কামান দাগানো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। এদিকে ‘১/১১’-এর সরকার ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে বাসে আগুন দিয়ে ১১ জন মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগে শেখ সেলিমকে রিমান্ডে নিয়ে, যা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল তার ুদ্র অংশই শুধু জাতি জানে।
রিমান্ড : আমি মিথ্যা বললে জানাবেন। কারণ আমার কাছে সাী আছে। ওই মিটিংয়ে আপনিও ছিলেন, সেখানে জলিল সাহেবও ছিল, এটা কি সত্য নয় যে শেখ হাসিনার হুকুমেই ১১ জন পুড়ে মারা গেছে? শেখ হাসিনার কড়া হুকুম, যেকোনো মূল্যেই রাস্তা দখলে রাখতে হবে। আপনি কি মনে করেন না, ওনার এরকম একটি কঠিন বক্তব্যের জন্যই পরের দিন এরকম দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, যেজন্য আপনারা পরের দিন তাকে খুব কঠিনভাবে ধরেছিলেন?
শেখ সেলিম : এই কথাটি তিনি বলেছেন যে, রাস্তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
রিমান্ড : যেভাবেই হোক রাস্তাটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আপনারা তাকে বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি বলেছেন খুব শক্তভাবে। শেখ হাসিনা আপনাদের কথা শোনেননি।
শেখ সেলিম : জ্বি।
রিমান্ড : বন্ধ ঘরে সিদ্ধান্ত হয় বাস পোড়ানোর। আমাদের হাতে পুরো তথ্যপ্রমাণ আছে। স্যার, আপনি ঘটনাটা বলেন, আপনিও সেখানে ছিলেন। এই যে কিলিংটা হলো, তার আগের রাতের কাহিনীটা বলেন।
শেখ সেলিম : প্রেসিডিয়াম মিটিংয়ে ঠিক হয় যে রাস্তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
রিমান্ড : তিনি কিন্তু বলেছিলেন ‘যেকোনো মূল্যে হোক’। স্যার, আপনি মনে করার চেষ্টা  করেন।
শেখ সেলিম : মনে করতে পারছি না।
রিমান্ড : যুবলীগের অফিসে ‘যে বাস পোড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো, ওটা ওই মিটিংয়ের কার্যক্রমেরই অংশ ছিল।
শেখ সেলিম : যুবলীগের ঘটনা অনেক আগের, শাহবাগের সামনে…।
রিমান্ড : অনেক আগের? পত্রিকা অফিসে গানপাউডার…।
শেখ সেলিম : সে তো অনেক আগের ঘটনা।
রিমান্ড : স্যার! পার্টি অফিসে এই ঘটনার পরে তো এসব নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন, জিজ্ঞাসাও করেছেন। তখন স্যার এসব গানপাউডার নিয়ে কথা ওঠেনি?
শেখ সেলিম : হ্যাঁ, গানপাউডারের কথা তো পুলিশই বলেছে।
রিমান্ড : (রেগে চড়া গলায়) স্যার! আপনে খালি ডাইনে-বাঁয়ে কথা বলেন। এখন যদি হঠাৎ করে একটা থাপ্পড় মারি (ঠাস করে চড়ের শব্দ) দাঁত পইরা যাবে স্যার, আমার কিন্তু রাগ উঠতেছে স্যার! সিগারেট কি এমনিই খাওয়াছি? আপনে বলতেছেন, পুলিশ বলছে, আপনারা তো অফিসে আলাপ-আলোচনা করলেন। ওইটা বললেন না কেন? এখন রাত কয়টা বাজে? এত্ত বড় একটা ঘটনা ঘটল; আপনি না বড় প্রেসিডিয়াম মেম্বার? সেই খানে কি এনালাইসিস হলো স্পষ্টভাবে বলেন। ডাইনে-বায়ে কথা বলবেন না। বলেন ওই ঘটনার পর কি আলাপ হইছিল?
শেখ সেলিম : কোথায়?
রিমান্ড : বাসে আগুন দেওয়ার পরে মিটিংয়ে বইসা কী করলেন?
শেখ সেলিম : কিসের মিটিং?
রিমান্ড : ওই যে মিটিংয়ে পর ১১ জন মারা গেল, আন্দোলনের মাঝখানে এই নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করেন নাই?
শেখ সেলিম : আলাপ করছি তো।
রিমান্ড : কী আলাপ করছেন?
শেখ সেলিম : নেত্রীরে বলছি, ঘটনা ঠিক হয় নাই।
রিমান্ড : ঠিক হয় নাই? এতবড় ঘটনা ঘটল, ঠিক হয় নাই?
শেখ সেলিম : বলছি পার্টির জন্য ভালো না। আমাদের লোক যদি জড়িত থাকে, ফাইন্ডআউট করা উচিত। বলছি।
রিমান্ড : আপনেরাই তো জানেন, কে জড়িত ছিল। হঠাৎ কইরা ফাইন্ডআউট কেন?
শেখ সেলিম : বলছি, কারণ আওয়ামী লীগের সবাই তো ঘটনা জানত না।
রিমান্ড : আপনি কী বলছেন?
শেখ সেলিম : বলছি অ্যাকশন নিতে হবে, কাজটা ঠিক হয় নাই।
রিমান্ড : নেত্রী কী বলল?
শেখ সেলিম : আমার খেয়াল নেই।
রিমান্ড : কেন খেয়াল নাই?
শেখ সেলিম : এত দিনের পুরান কথা।
রিমান্ড : কিসের পুরান কথা? আমরা নিজেরা কিছু করি নাই, আমরা জানি কিভাবে?
শেখ সেলিম : ঘটনা ঘটার পর অফিসে যুবলীগের লোক আসছিল।
রিমান্ড : নাম বলেন।
শেখ সেলিম : মনে নাই। বলল, নানক, আজম এইগুলো করছে। ঠিক হয় নাই, ভাই, আপনেরা দেখেন।
রিমান্ড : নেত্রীরে বলছেন? নেত্রী কী বলল?
শেখ সেলিম : নেত্রীকে বললাম, যুবলীগ ঘটনা ঘটাইছে। খবর আছে। এগুলো ঠিক হয় নাই। যা করার করো, তুমি এখন অ্যাকশন নাও।
রিমান্ড : কী বলল?
শেখ সেলিম : বলছে, ঠিক আছে আমি দেখতেছি।
রিমান্ড : পরে অ্যাকশন কী হইছে?
শেখ সেলিম : অ্যাকশন তো হয় নাই।
রিমান্ড : অ্যাকশন হয় নাই? কেন? এত বড় ঘটনা ঘটল, কেন অ্যাকশন হয় নাই? পরে নেত্রীকে জিজ্ঞেস করেন নাই? আপনি তো এত বড় প্রেসিডিয়াম সদস্য।
শেখ সেলিম : না। উনি ব্যবস্থা না নিলে, না শুনলে, আমি কী করব?
রিমান্ড : যুবলীগের মধ্যে ভাঙন ধরছে, আপনাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
শেখ সেলিম : এই কথা তারে বহুবার বলা হইছে। বলা হইছে যে, যুবলীগ আর যুবলীগ নাই।
রিমান্ড : নেত্রী আপনার কথা শোনে নাই?
শেখ সেলিম : নাহ্।
(এই লেখাটিকে কেউ ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। কারণ কথোপকথনের পুরোটাই যেমন ভিডিও কিপে রয়েছে, তেমনিই পাশাপাশি রয়েছে ২৮ অক্টোবর সব টিভি চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজে)।
নিউ ইয়র্ক।
farahmina@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : এক অবরুদ্ধ ‘চান্স’ সম্পাদকের জবানবন্দি


মাহমুদুর রহমান




আমার আকস্মিকভাবে মিডিয়াতে আসা নিয়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী সম্পাদককুল এবং জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী কয়েকজন সুবিধাবাদী, মুখচেনা ব্যক্তি। আমার অপরাধ, সাংবাদিকতা পেশায় জীবন শুরু না করে এই শেষ বয়সে এ পথে কেন এলাম। বিষয়টা অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এ বাড়ির কর্তার কোনো কারণ ছাড়াই চোখ টাটানোর সমতুল্য। ওই ছেলে পরীক্ষা দিলেও পাস করবে না, পাস করলেও চাকরি পাবে না, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না, বেতন পেলেও সেই টাকা বাজারে চলবে না ইত্যাদি।
প্রথমে প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্পাদক আতাউস সামাদের শিক্ষানবিশগিরি এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রূপে চার বছরেরও অধিককাল পার করেছি। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণকালে যে সার্কুলেশন ছিল এই সময়ের মধ্যে তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ১০ লাখের কাছাকাছি ইন্টারনেট হিট এখন ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। অ্যালেক্সা রেটিং এ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও বিশ্বে ১০০ এবং ২০০০০ নম্বর থেকে ডিসেম্বরে ১৭ তারিখে আমার দেশ ৩৯ এবং ১০৬৬২ নম্বরে রয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ১৬ পাতার পত্রিকার মূল্য প্রায় এক বছর আগে ১০ টাকা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও প্রাণের টানে পাঠক সেই বাড়তি দামের বোঝা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন। সার্কুলেশন কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েছে।
এই পাঠকশ্রেণী আমাদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মূল শক্তি। এদের অনুপ্রেরণা এবং সমর্থনের কারণেই আমার দেশ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা আলোচিত দৈনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাত্র চার বছরে নিতান্তই দীনহীন, বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হওয়াটাকে হয়তো মিডিয়া জগতেরই অনেক রথী-মহারথী মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং এই মন্তব্য প্রতিবেদনের লেখককে পত্রিকা সম্পাদক রূপে মেনে নিতে এই অস্বীকৃতির পেছনের কারণ যে অক্ষমের অন্তর্জ্বালা সেটা বুঝে নেয়া কঠিন নয়। এদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, কেবল একরাশ অনুকম্পা রয়েছে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকে অনেকেই আমার মতো করেই পরিণত বয়সে অন্য পেশা থেকে এসে সরাসরি পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে আজ সংবাদপত্র জগতের লিজেন্ড হয়েছেন। তাদের নাম আজও আমরা বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি। অপরদিকে মালিকানা সূত্রে রাতারাতি সম্পাদক বনে যাওয়ার সংখ্যা এ দেশের পত্রিকা শিল্পে অগুনতি হলেও চিহ্নিত ‘মহামহিম’ সম্পাদককুলের তাতেও কোনো আপত্তি নেই। যত সমস্যা এক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে। গত বছর আমার জেল মুক্তির পর থেকে এরা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে কোনোক্রমে আমাকে সহ্য করছিলেন। স্কাইপি কেলেঙ্কারির ঘটনা লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ এবং আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্র তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে টেলিভিশনের পর্দা ফাটাচ্ছেন। সরকারের উন্মত্ত আচরণের পাশাপাশি এই তল্পিবাহকদের হিংসা-বিদ্বেষে কাল হয়ে যাওয়া মুখের নানা রকম অভিব্যক্তি টেলিভিশনে দেখে আমার ছোট্ট অফিস ঘরের অবরুদ্ধ জীবনেও বিমলানন্দ অনুভব করছি। এদের বিপরীতে আমাদের সমর্থনে দেশের প্রবীণতম সম্পাদক-সাংবাদিক এবিএম মূসা এগিয়ে এসেছেন। মূসা ভাই আমার মিডিয়ার শিক্ষক মরহুম আতাউস সামাদেরও শিক্ষক। তাঁর প্রতি আমার দেশ পরিবারের সব সদস্যের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের সব কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের। এ মাসের ৬ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সবাইকে চমকে দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর বিরুদ্ধে এক চাঞ্চল্যকর রুল জারি করেন। সেই রুলে তিনি স্বীকার করে নেন যে, বিচারাধীন মামলা নিয়ে বিচারকার্যে সম্পৃক্ত নন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছেন এবং বিষয়টি ইকোনমিস্টের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ইকোনমিস্টের একজন সাংবাদিক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে টেলিফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে কতগুলো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে বিচারপতি মহোদয় থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি আদালত অবমাননা নামক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বর্মের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ ইকোনমিস্টে না ছাপানোর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদের হাত দেশের মধ্যে অনেক লম্বা হলেও সেটা যে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছায় না, সেটা বোধহয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
একজন বিচারপতি বিচারাধীন মামলার বিষয়ে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করেছেন, এই তথ্য জনগণকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিচারাঙ্গনকে নানাভাবে বিতর্কিত করার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও এই অবিশ্বাস্য নতুন নমুনা মেনে নেয়া কোনো বিবেকবান নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বেলজিয়ামবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং ইউকেবাসী জনৈক রায়হানের কথোপকথনের রেকর্ডকৃত অংশ এবং তাদের মধ্যকার আদান-প্রদানকৃত ই-মেইলের কপি বিদেশ থেকে আমার দেশ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করাকালে ইউ-টিউবেও বিচারপতির স্কাইপি আলাপন ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিষয়টির নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা জনস্বার্থে কথোপকথন হুবহু প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। তবে রিপোর্টে ইকোনমিস্টের মতো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য প্রদান থেকে আমার দেশ বিরত থাকে।
ইকোনমিস্ট সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি আলাদা সম্পাদকের নোট (Editors Note) লিখে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে তাদের যুক্তি পেশ করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেই নোট থেকে খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
“Normally, we would not publish confidential e-mails and conversations. But there is a compelling public interest. Lives are at stake. So are the court’s reputation .......
We did not solicit the material. We did not pay for it, nor offer any commitment to publish it, we have no reason to suppose that the tapes and e-mails we have seen are fakes, or have been tampered with. The Economist also does not know whether the accused in the trial are innocent or guilty, merely that they are entitled to a presumption of innocence and to an even-handed trial.
(সাধারণত, আমরা গোপনীয় ই-মেইল এবং টেলিফোন আলাপ প্রকাশ করি না। কিন্তু, এখানে গুরুতর জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে। জীবন এখানে ঝুঁকির মধ্যে। একইভাবে আদালতের মর্যাদাও ...
নিজ থেকে আমরা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা কোনো অর্থ প্রদান করিনি, কিংবা সংবাদ প্রকাশ করা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেইনি। এমন ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই যে, টেপ এবং ই-মেইলগুলো জাল অথবা সেখানে অসত্ উদ্দেশ্যে কোনোরকম পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্ট এটাও জানে না যে অভিযুক্তরা দোষী অথবা নির্দোষ, তবে তাদের বিচারপূর্বক সাময়িক নির্দোষ বিবেচিত হওয়া এবং সঠিক বিচার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।)
আমার দেশ পত্রিকা এ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ এই পাঁচদিন স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করেছে। এই সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমসহ কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পত্রিকায় কোনো প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেননি। এখানে কোনো মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, এ জাতীয় দাবি কোনো মহল থেকে অদ্যাবধি শোনা যায়নি। কিংবা সংবাদ না ছাপানোর নির্দেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রুলও জারি করা হয়নি। বরঞ্চ, ট্রাইব্যুনাল-১ এর দ্বিতীয় সিনিয়র বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন আমার দেশ-এর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে বলেছেন, পত্রিকার কাজ হচ্ছে লেখা, আমার দেশ তাই করেছে। অনৈতিক ও বেআইনি আচরণের দায় মাথায় নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও লাজ-লজ্জাহীন সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং আওয়ামীপন্থী মিডিয়া স্কাইপি সংলাপ লেখার আগে ‘কথিত’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন।
সরকারের লেজুড়ধারী টক-শো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বিভিন্ন টক-শো’তে অবলীলাক্রমে দাবি করছেন যে ইকোনমিস্টে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। নির্জলা মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সেই সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। সে সব মহাপণ্ডিতরা অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। আরে বাবা, ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে যাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে তার কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রক্ষে ছিল? সংবাদ ধামাচাপা দিতে প্রতিবেদক এবং সম্পাদককে হয়তো গুম করে ফেলা হতো। অথবা সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে হতো। তাছাড়া সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলাই তো বিচারপতির ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ লংঘন। এদিকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে প্রায় প্রতিদিন এত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে যে জনগণের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
হাইকোর্টে সাধারণত যে কোনো মামলায় একটি বেঞ্চ কোনো রুল, নির্দেশ অথবা অভিমত দিলে অন্য বেঞ্চ সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। বাদী অথবা বিবাদী ওই মামলা নিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চে গেলে তাদের প্রথম বেঞ্চে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। স্কাইপি স্ক্যান্ডালের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার অ্যাডভোকেট হায়দার আলী ১০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার নাম উল্লেখপূর্বক বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১ এর নজরে আনেন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আদেশ দেয়ার জন্য ১১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। ওইদিন বিচারপতি নাসিম এবং প্রসিকিউটার হায়দার আলী ট্রাইব্যুনালে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে আর আদেশ প্রদান সম্ভব হয়নি। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন যে, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান এবং প্রসিকিউটর আদালতে ফিরলে আদেশ প্রদান করা হবে। কিন্তু, ওই দিনই বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় সেই প্রক্রিয়াও ঝুলে যায়।
১৩ তারিখে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত একই বিষয় ট্রাইব্যুনাল-২ এ উত্থাপন করলে বিচারপতিগণ স্কাইপি সংলাপ বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় আর প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক আদেশ প্রদানকালে একই বিষয়ে প্রথম আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল-১ এ অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল। এরপর একই দিনে সরকার ছুটে যায় হাইকোর্টের চরম বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে। আদালতের রীতিনীতি অনুযায়ী তিনি আমার বিষয়ে কোনো আবেদন শুনতে পারেন না, কারণ দুর্নীতি এবং বিচারপতির কোড অব কনডাক্ট (Code of Conduct) ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য আমার আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পত্র সংখ্যা ০১.০০.০০০০.০০১১.৩২.০০১.১২-৩১৭ তারিখ ০৮ নভেম্বর ২০১২-এর মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
আদালতের নিয়ম-কানুনের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোর্টের দিনের নির্ধারিত সময় পার করে আমার বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় আদালতে তার আচরণও বিচারকসুলভ ছিল না। বরঞ্চ, আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিরাগ, বিদ্বেষ এবং ক্ষোভ তার প্রতিটি কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারপতি মানিকের রুলকে ভিত্তি করে সে রাতেই সিএমএম আদালতে বায়বীয় দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী (CRPC) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমতি (Sanction) ব্যতীত এ ধরনের মামলা দায়ের সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও আমার ক্ষেত্রে আদালতে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানেই শেষ নয়। ১৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই বিষয়ে আরও একটি অভিমত (Observation) দেন। বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে উচ্চ আদালতের তিনটি পৃথক সমমানের বেঞ্চ থেকে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদেশের এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ছোটবেলায় শোনা এক জোকের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্র শিক্ষককে প্রশ্ন করল, স্যার Pillar লিখতে কয়টা L (এল) লাগে? জবাবে শিক্ষক বললেন, ‘একটা দিলেও হয়, তয় দুইটা দিলে পোক্ত হয়।’ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অতি-উত্সাহে দেখা যাচ্ছে আদালত পোক্ততর করতে গোটা চারেক L-এর ব্যবস্থা করেছেন।
অপর একটি বিতর্কের বিষয় উত্থাপন করছি। স্কাইপি কেলেঙ্কারির কাহিনী ছাপা হওয়ার পর থেকে সরকার সমর্থক গোষ্ঠী কেবল একটি প্রশ্নের অবতারণা করে চলেছেন। তাদের কথা হলো, হ্যাকিং অথবা গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ সত্য হলেও মিডিয়ায় প্রকাশ করা নাকি অনৈতিক। দি ইকোনমিস্ট তার সম্পাদকের নোটে এই সমালোচনার যথাযথ জবাব দিয়েছে বলে আমি এই ইস্যুতে নতুন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার প্রশ্ন হলো, একজন বিচারপতি কি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে গোপনে শলা-পরামর্শ চালিয়ে যেতে পারেন? বিচারপতি নাসিমই তো ইকোনমিস্টের সাংবাদিককে বলেছেন যে, তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেন না। তাহলে কি ধরে নেব ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে তার স্ত্রীর চেয়েও আপন? অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা যায় না বলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জ্ঞান দিচ্ছেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৭ ঘণ্টার স্কাইপি কথোপকথনে এবং শত শত ই-মেইলে ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তার আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন। এমনকি আগাম রায় লিখে দেয়ারও আবদার করেছেন। রায় প্রদানের বিনিময়ে পদোন্নতি প্রাপ্তি নিয়ে আপিল বিভাগের জনৈক বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার চরম নিন্দনীয় উদাহরণও প্রকাশিত স্কাইপি আলাপে রয়েছে। সুতরাং, ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের যোগসাজশে। সেই অপরাধের কথা প্রকাশ করে গণমাধ্যম বরঞ্চ প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন অভিমত প্রদানকালে সম্ভবত এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ, আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে পাঠককে কিছু তথ্য দেয়া আবশ্যক বিবেচনা করছি। ১৩ তারিখ রাতে সিএমএম আদালতে মামলা দায়ের থেকে এই লেখাটা ১৯ তারিখ রাতে ছাপা হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা অফিসেই অবস্থান করছি। সকালে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছানো পর্যন্ত এখানেই থাকব, নাকি পুলিশ হেফাজতে—সেটা আল্লাহ্ জানেন। সেদিন টক-শোতে এক আওয়ামী সম্পাদক আমার পত্রিকা অফিসে থাকা নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনলাম। আমার পত্রিকা অফিসে আমি রাত্রিযাপন করব, তাতে পঞ্চাশ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার জন্য আত্মগর্বে ফুলে থাকা সম্পাদক কেন বা কোন অধিকারে কূপিত হলেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। অবশ্য, আওয়ামী লীগারদের কাছে যুক্তির কথা বলে কোনো ফায়দা নেই।
এক সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে (Scroll) লেখা দেখলাম, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার এড়াতে আমার দেশ অফিসে অবস্থান করছেন। এতদিন জানতাম গ্রেফতার এড়াতে লোকজন পলাতক থাকে। আওয়ামীপন্থী মিডিয়ার কাছ থেকে জানা গেল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পত্রিকা অফিসে অবস্থান করলেও নাকি গ্রেফতার এড়ানো যায়। এই আমাকেই ২০১০ সালের ১ জুন মধ্যরাতে শত শত রায়ট পুলিশ পাঠিয়ে একটা সাধারণ ডাইরির (General Diary) ভিত্তিতে শেখ হাসিনার সরকার একই পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেটা বোধহয় ওই টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ভুলে গেছেন!
এদের নিরেট মাথায় হয়তো ঢুকছে না যে, আমার এবারের লড়াই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার অথবা আদালত কর্তৃক মিডিয়ার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ দলমত নির্বিশেষে সব মিডিয়া কর্মীর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা তাদের স্বার্থেই প্রয়োজন। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে আজ গণমাধ্যমের যে অংশ আমার দেশ’র বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হলে তারাও একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। তখন কিন্তু আজকের এইসব কথা তাদের বেমালুম গিলে ফেলতে হবে।
তবে সমস্যা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পাপের সব রেকর্ড মুছে ফেলা আগের মতো আর সম্ভব নাও হতে পারে। হাওয়া ভবনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত সম্পাদককুল আজ যখন আমাকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে ওঠে। দেশবাসীকে একটি ভরসার কথা বলে অবরুদ্ধ সম্পাদকের জবানবন্দী সমাপ্ত করব। মিডিয়ায় যারা মাহমুদুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত দেখার আশায় ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনসাপেক্ষে তারা আমার মতো তখনকার সরকারের অন্যায় আচরণের শিকার হলে আমার দেশ তাদের রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। নীতির দুর্ভিক্ষের এই দেশেও সব সরকারের আমলে নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে এই পরিবারের প্রতিটি সংবাদকর্মী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ইমেইল- admahmudrahman@gmail.com

সরকারের বেনামি হরতাল সফল হয়েছে


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান আওয়ামী জোট সরকারের হাতে কতখানি নিরাপদ এবং এদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ কতখানি উজ্জ্বল তার প্রমাণ প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর জবানীতে পাওয়া যায়। তিনি নিয়মিতভাবে প্রতিদিনই বাণী বিস্তারে অভ্যস্ত এবং এইসব বাণী যতই আবোলতাবোল ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন হোক, সরকারি শাস্তির ভয়ে প্রচার মাধ্যমগুলো তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করে থাকে।
এই ধরনের বাণী বিস্তার করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা, তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ড অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা—এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর উদ্দেশ্য সরকারকে হেয় করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা।’ তিনি এখানেই না থেমে আরও বলেছেন, ‘সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলতে বিদেশি সংস্থার চাপ ও কৌশল আছে। সরকারের তরফ থেকে দুদককে কোনোদিন চাপ প্রয়োগ করা হয় না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। যখন তারা সঠিকভাবে কাজ করছে তখন কোনো কোনো বিদেশি সংস্থা দুদককে চাপ প্রয়োগ করে। এগুলো কেন? সরকারকে যদি জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা যায়। তাদের বাঁচানো যায়।’ (আমার দেশ, ১৮.১২.২০১২)
এসব কথা এমন যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখনিসৃত না হলে এগুলোকে পচা নর্দমায় নিক্ষেপ করাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। শুধু এসব কথাই নয়, প্রতিনিয়ত তিনি যেসব কথা অবলীলাক্রমে বলে যান সেগুলোর বিপুল অধিকাংশের অবস্থাই এরকম। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে সমাসীন এক ব্যক্তির এ ধরনের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার মতো সাংস্কৃতিক যোগ্যতা নেই। কাজেই এইসব নোংরা ও নিষ্প্রয়োজনীয় কথা ঘাঁটাঘাঁটি করে তার ওপর বাধ্য হয়েই আমাদের আলোচনা করতে হয়।
প্রথমেই বলা দরকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট সরকারের শরিকরা যেসব কথা এখন অনর্গল বলছেন ও কাণ্ডকারখানা করছেন তা রীতিমত রহস্যজনক। এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবার ও স্বজনরা ১৯৭২ সাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আসছেন। কিন্তু সে দাবির প্রতি আওয়ামী বাকশালী সরকার, জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার প্রথম পাঁচ বছরের সরকার কেউই কর্ণপাত করেনি। মুখে কেউ কেউ এ বিষয়ে কিছু কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে কাউকে কিছুই করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে বর্তমান সরকার যেভাবে হঠাত্ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মাতামাতি করছে তার সঙ্গে তাদের ১৯৯৬-২০০১ সালের সরকারের উদাসীনতা খুব লক্ষ্য করার মতো। এ প্রসঙ্গে এটা এখানে বলা দরকার যে, ১৯৯৬ সালের সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো দূরের কথা, সে বিষয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কারণ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারা যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তাতেই লাভ করেছিল! জামায়াতে ইসলামীর ভোটেই জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মহিলা সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল!! সে সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকেও সংসদে মহিলা সদস্যের ভাগ দিয়েছিল!!! কাজেই বলা চলে, এখন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কই তখন ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের!!!! হতভাগ্য এই দেশে এসব বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করা ও বলার মতো কেউ নেই। বর্তমানে আওয়ামী লীগ তাদের ১৯৯৬ সালের দোসরদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থার জন্য যেভাবে মাতামাতি করছে তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যে কাজ করছে এটা বেশ স্পষ্ট হলেও এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে ব্যাখ্যা কেউ চাইছে না।
১৯৯৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সে সময়ে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, তারা এখন সেটা নিয়ে এত গলাবাজি, এত মাতামাতি যেভাবে করছে তা বিস্ময়কর। শুধু বিএনপি নয়, দেশে তাদের বিরুদ্ধে যারাই রাজনৈতিক ও পেশাগত কারণে কিছু আওয়াজ তুলছে ও কর্মসূচি পালন করছে তাকেই এরা যুদ্ধাপরাধীদের সাঙ্গাত বলে অভিযুক্ত করে তোলপাড় করছে। শুধু তাই নয়, তারা এমন সব কাজের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র দেখছে যাকে দুরভিসন্ধিমূলক এবং সেটা না হলে উন্মাদতুল্য বলা ছাড়া উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী ১৭ ডিসেম্বরের আলোচনা সভায় বলেছেন যে, রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিেক কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র! এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই, কারণ রামুর ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এমন অনেক ধরনের লোকই যে জড়িত ছিল এটা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি তদন্তের মাধ্যমেই দেখা গেছে। বিশ্বজিত্ হত্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবিকই উন্মাদতুল্য এবং এক চরম মিথ্যা ভাষণ যা একেবারে জেনেশুনেই করা হয়েছে! এ বিষয়ে দেশের প্রত্যেকটি মানুষই জানে যে, বিশ্বজিত্ হত্যা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজ। এর সব ধরনের প্রয়োজনীয় প্রমাণই আছে। যদি এই কাজ সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বলতে হবে যে, আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আকাশ-বাতাস উতলা করলেও খুব চাতুর্যের সঙ্গে তারাই এ বিচার বানচাল করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। তাদের দ্বারা এই ধরনের কাজ যে অসম্ভব নয়, এটা ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের আঁতাতের কথা বিবেচনা করলে উড়িয়ে দেয়ার নয়। তাছাড়া দিবালোকে সবার সামনে নিজেরা বিশ্বজিেক হত্যা করলেও তার জন্য যারা অন্যদের দায়ী করে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে তাদের দ্বারা এমন কী অপকর্ম আছে যা অসম্ভব!
এখানেই শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, দুদকের ওপর তারা কোনো চাপ সৃষ্টি করছেন না, দুদক স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এবং সে কাজ করছে কোনো বিদেশি সংস্থা! অর্থাত্ এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক!! এর চেয়ে উন্মাদ এবং অর্থহীন বক্তব্য আর কী হতে পারে? এর থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, আমাদের দেশ ও জনগণ এই প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল ও জোটের শাসনে কতখানি নিরাপত্তাহীন ও বিপদগ্রস্ত। এ বিষয়ে যে বিস্তারিত কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই এটা বলাই বাহুল্য।
এবার আসা যেতে পারে ১৮ ডিসেম্বর সিপিবির নেতৃত্বে কতকগুলো বাম সংগঠনের হরতাল প্রসঙ্গে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার বিরোধিতা করে তারা তাদের হরতাল আহ্বান করেছিল। এই হরতাল সফল হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা প্ররোচিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে তাদের এই উদ্যোগ যে এক মহা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি এটা দেশের প্রচারমাধ্যম, সব রাজনৈতিক মহল ও জনগণের কাছে এখন স্পষ্ট। এ হরতাল এমন শান্তিপূর্ণ হয়েছে যাতে হরতাল আহ্বানকারীরা রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে সঙ্গীত গেয়েছে! কোনো গাড়িঘোড়া ভাঙা হয়নি, পুলিশ কাউকে লাঠিপেটা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এক কথায় বলতে গেলে এটা ছিল এক আদর্শ হরতাল! এই হরতাল হয়েছে বামপন্থীদের আহ্বানে!!
প্রথমেই বলা দরকার যে, বামপন্থীরা যে মূল ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে এটা আওয়ামী লীগেরই ইস্যু। জনগণ ১৯৭২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেও সে বিচার যে আওয়ামী লীগসহ কেউ করেনি, এটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যে কায়দায় এখন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চারদিক উতলা করছে সেটা আওয়ামী লীগের কায়দা। এই আওয়ামী কায়দাতেই বামপন্থীরা তাদের হরতাল ডেকেছে। মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের নানা ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে আজ পর্যন্ত এই বামপন্থীরা হরতাল দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কারণ সোজা। হরতাল সফল করার মতো তাদের কোনো শক্তি নেই এবং আসলে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হরতাল দেয়ার আগ্রহও তাদের নেই। সেটা থাকলে ব্যর্থতার কথা জেনেও তারা হরতাল দিতে পারত। ১৮ তারিখের হরতাল দেয়া হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগেরই সর্বপ্রধান ইস্যুকে সামনে রেখে এবং আওয়ামী লীগেরই উদ্যোগ ও সহায়তায়। সে কারণে তাদের নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও সরকারি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বামপন্থীদের এই হরতালকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। হরতালের দিন সরকার বিআরটিসির কোনো গাড়ি পথে নামায়নি, যা তারা সাধারণত হরতালের সময় নামিয়ে থাকে। অর্থাত্ সরকারই হরতালে অংশগ্রহণ করে রাস্তায় গাড়ি নামায়নি! রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে নিজেরাই গাড়ি চলাচলে এমনভাবে বাধা দিয়েছে যাতে রাস্তা গাড়িশূন্য থাকে। তাছাড়া অনেক জায়গায় পুলিশকে হরতালের পিকেটিংয়েও অংশ নিতে দেখা গেছে। এই অবস্থায় হরতালকারীরা যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে তাদের হরতাল সফল করবে এতে আশ্চর্য কী? হরতাল শেষ হওয়ার পর দেখা গেল সরকারের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বামপন্থী হরতালকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন! আমরা কি জিজ্ঞেস করতে পারি, এরপর বাকি থাকল কী? যে বামপন্থীরা এভাবে সরকারের বেনামি হরতাল সফল করলেন তাদের বুদ্ধির অভাব আছে একথা কেউ বলবেন না। আমরাও বলি না। কাজেই এই হরতালের সঙ্গে যে সরকারের সম্পর্ক নেই, এটা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ও নিজস্ব ক্ষমতার ভিত্তিতেই তারা করেছেন, এ নিয়ে নানা যুক্তি তারা দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ চোখের সামনে যা দেখেছে তা অবিশ্বাস করে সিপিবির নেতৃত্বাধীন বামপন্থীদের ধূর্ত বক্তব্য বিশ্বাস করবে এমন অবস্থা দেশের জনগণের নেই। ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, হরতালের জন্য পিকেটিং করার মতো কর্মীর সংখ্যা তাদের নগণ্য থাকা সত্ত্বেও হরতাল সফল হয়েছে। সরকার পক্ষ কর্তৃক হরতালের বিরুদ্ধে মারমার কাটকাট করে আগের দিন কোনো মিছিলও বের হয়নি। কারণ ‘বিজয়ের মাসে’ প্রধানমন্ত্রীর গদগদ হরতালবিরোধী বক্তব্য সত্ত্বেও নিজেদের দ্বারা প্ররোচিত ও সংগঠিত হরতাল সফল করতে তাদের কোনো অসুবিধে নেই! তাদের কথা ও কাজের মধ্যে গরমিল কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বামপন্থীদের মাধ্যমে তাদের বেনামি হরতাল সফল করার মধ্যে এটা নতুনভাবে প্রমাণিত হলো।
১৯.১২.২০১২

বিচারের নামে আসামি হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে এখানে : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী

জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের আবেদন


মেহেদী হাসান
তারিখ: ২০ ডিসেম্বর, ২০১২


বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, বিচারের নামে ট্রাইব্যুনালে আসামিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সাক্ষী মিলে গোপন আঁতাত করা হয়েছে আসামির বিরুদ্ধে। এখানে একটি ষড়যন্ত্র সংঘটিত হয়েছে। স্কাইপি সংলাপ ফাঁসের মাধ্যমে এ আঁতাত ও ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গতকাল ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, হ্যাকিংয়ের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যে চুরি করল সেই চোরের বিচার হবে না, আর যারা চোরকে ধরিয়ে দিলেন তাদের বিচারের আয়োজন চলছে।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত থাকার দায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণ ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গতকাল ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, জেয়াদ আল মালুম স্কাইপি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত এবং তিনি এ বিচারকে কলুষিত করেছেন। তিনি সাক্ষী ও বিচারপতির সাথে গোপন আঁতাত করেছেন আসামিকে ফাঁসানোর জন্য। বিচারপতির সাথে আঁতাতের মাধ্যমে প্রকাশ্যে ট্রাইব্যুনালে নাটক করেছেন তিনি। স্কাইপি সংলাপে তার বিষয়ে যেসব কথাবার্তা রয়েছে তাতে এটি স্পষ্ট যে, জেয়াদ আল মালুম ন্যায় বিচারের পথে বাধা স্বরূপ। তিনি ন্যায় বিচারকে বিঘিœত করার কাজে লিপ্ত ছিলেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম আবেদনটি জমা দেন। আগামী রোববার এ বিষয়ে শুনানির জন্য ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে একজন মহিলা সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়াল নির্ধারিত ছিল। ক্যামেরা ট্রায়াল বিষয়ে আপত্তি জানান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের যে দরখাস্ত দেয়া হয়েছে তার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া চলতে পারে না। এখানে একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে। ১৭ ঘণ্টার সংলাপের মাত্র দুই ঘণ্টার বিবরণ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে তিনি বলেন, সংলাপের পুরোটাই প্রকাশ করতে দেয়া উচিত এবং আপনাদের জানা উচিত কী হয়েছে এখানে বিচারের নামে। এখানে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে বিচারের নামে। আপনাদের, বিচার বিভাগের মানমর্যাদা রক্ষার জন্যই তা জানা উচিত। স্কাইপি সংলাপে যা ফাঁস হয়েছে তারপর কী এ ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? মানুষ জেনে গেছে বিদেশ থেকে কিভাবে এ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে তিনি জানান, ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার একটা জরিপ করেছে। তাতে ৭৩ শতাংশ মানুষ স্কাইপি কেলেঙ্কারির পর এ বিচার পুনরায় শুরু হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন। বিচারপতিদের লক্ষ্য করে এই বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বলেন, আপনারা কী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মত শুনবেন না?
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, স্কাইপি সংলাপ ফাঁস হওয়ার পর জাতির সামনে আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। ৩৩ বছর জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আজ দুই বছর আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমি তো আদালত অবমাননা করিনি। আদালতের মর্যাদা গেলে দেশের মর্যাদা থাকে না; বিচারকদের মর্যাদা থাকে না। আমি এ ট্রাইব্যুনালের, বিচারবিভাগের মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য এ দরখাস্ত দিয়েছি। আপনারা এর মান রক্ষা করুন। আমি মনে করেছিলাম এ ঘটনার পর প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনাল বিব্রত বোধ করবে। কিন্তু এখন তো আমিই বরং বিব্রত বোধ করছি।
তিনি বলেন, স্কাইপি সংলাপ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বলেছেন আপনারা। যে চুরি করেছে তার বিচার হবে না, অথচ যারা চোর ধরছে তাদের বিচার হবে?
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কথা বলার সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির বলেন, চৌধুরী সাহেব আপনি এখন থামেন। আপনার কথা তো আমরা শুনলাম।
জবাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, জনগণ আমাকে ভোট দেয়। আমি সংসদে গিয়ে কথা বলি তাদের জন্য। কিন্তু দুই বছর কোনো কথা বলতে পারছি না। এখানে আমাকে আনলে, আপনাদের দেখলে কথা বলতে মন চায়। মনে শান্তি পাই। সেজন্য কথা বলি, দাঁড়িয়ে যাই।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির বলেন, আমি জানি আপনি বসার মতো লোক নন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, স্পিকার সাহেবের মতো আপনিও আমাকে স্বীকৃতি দিলেন। ধন্যবাদ।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকের ক্যামেরা ট্রায়াল তো অনেক আগে থেকেই ঠিক করা আছে। যখন এটা ঠিক করা হয়েছে তখন তো আপনারা কোনো আপত্তি করেননি। কাজেই আপনাদের আবেদন শুনানি হবে; কিন্তু আজ ক্যামেরা ট্রায়াল হয়ে যাক।
এর জবাবে কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, তখনকার পরিস্থিতি আর স্কাইপি সংলাপ ফাঁসের পরবর্তী পরিস্থিতি এক নয়। আমরা তো আগে জানতাম না কিভাবে মালুম সাহেব এবং অন্যরা মিলে সাক্ষীকে তৈরি করেছেন আসামিকে ফাঁসানোর জন্য। আমরা তো জানতাম না ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির সাথে তিনি গোপন আঁতাত করে এখানে কিভাবে নাটক করেছেন। তিনি বিচারপতির চেম্বারে গিয়ে বিচারপতিকে বলেছেনÑ আমি দাঁড়িয়ে যাব আর আপনি আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেবেন। লোকে দেখুক আমাদের মধ্যে কোনো খাতির নেই। সাক্ষীকে ভিডিও দেখিয়ে সে অনুযায়ী সাক্ষ্য দিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও সাক্ষী তা মনে রাখতে না পারায় তাকে হাজির করা হয়নি। এসব কথা আছে স্কাইপি সংলাপে। এসব বিষয় ফাঁস হওয়ার পরে আমরা কী করে আর ন্যায় বিচারের আশা করতে পারি? কাজেই জেয়াদ আল মালুমকে আমরা ন্যায় বিচারের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করি। তাকে অপসারণ না করা পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখা হোক।
ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি রোববার শুনানির জন্য ধার্য করে সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি করেন।
জেয়াদ আল মালুমের বিরুদ্ধে দরখাস্তে অভিযোগ : স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁসের জের ধরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক ও ব্রাসেলস নিবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে তার মধ্যে অসংখ্যবার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমের প্রসঙ্গ এসেছে। গতকাল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জেয়াদ আল মালুমকে অপসারণের দাবি জানিয়ে যে দরখাস্ত করেছেন তাতে জেয়াদ আল মালুম বিষয়ক কিছু সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে।
দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, সাক্ষী ও জেয়াদ আল মালুমের মধ্যে একটি আঁতাত হয়েছিল। আসামিকে ফাঁসানোর জন্য জেয়াদ আল মালুম সাক্ষীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কোন সাক্ষীকে দিয়ে কী বলানো হবে, কতটুকু বললে রায় লিখতে সুবিধা হবে এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সাথে তার যোগসাজশ ছিল। এ বিষয়ে স্কাইপি সংলাপে আলোচনা হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে। এক দিকে গোপনে ট্রাইব্যুনালের সাথে আঁতাত করা হয়েছে অন্য দিকে প্রকাশ্যে দেখানো হয়েছে যে, ন্যায়বিচার চলছে। সাক্ষী সুলতানা কামালের সাক্ষ্য বিষয়ে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে আলোচনায়। তাকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেই মোতাবেক তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। তা ছাড়া সাক্ষী জেনারেল (অব:) শফিউল্লাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বিধায় জেয়াদ আল মালুম ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন তাও উল্লেখ আছে সংলাপে। শফিউল্লাহকে দিয়ে নির্দেশমতো সাক্ষ্য দেয়ানো যাবে না আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত তাকে সাক্ষী হিসেবে হাজিরই করা হয়নি। বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে জেয়াদ আল মালুমের গোপন আঁতাত বিষয়েও স্কাইপি সংলাপ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে দরখাস্তে।
দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়েছে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জেয়াদ আল মালুমের সাথে আলোচনা করতেন; দিকনির্দেশনা দিতেন। ড. জিয়াউদ্দিন আবার এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে। একই ব্যক্তি একই সাথে রাষ্ট্রপক্ষ ও ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে বিচার চালিয়ে যাওয়া হবে সে বিষয়ে। বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. জিয়াউদ্দিন উভয়ে আলোচনার সময় পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করেছেন অমুক বিষয় নিয়ে মালুম সাহেবের সাথে কথা হয়েছে কি না। এ থেকে এটি পরিষ্কার যে উভয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেয়াদ আল মালুমকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হিন্দু সাক্ষী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্য আর ভালো হবে না বলে মনে করছেন জেয়াদ আল মালুম। এ বিষয়েও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে।
দরখাস্তে বলা হয়েছে জেয়াদ আল মালুম একজন আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও এসবের মাধ্যমে নিজেকে গুরুতর অসদারচণে লিপ্ত করেছেন এবং ন্যায়বিচারকে কলুষিত করেছেন। ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত করছেন। আড়ালে বিচারপতির সাথে গোপন আঁতাত করেছেন আর প্রকাশ্য কোর্টে নাটক করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তারা ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করছেন। ন্যায়বিচারকে বিঘিœত করা এবং অসদাচরণে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নিবেদন করা হয়েছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দরখাস্তে।
স্কাইপি কেলেঙ্কারি নিয়ে কৌতুক : গতকাল ট্রাইব্যুনালে স্কাইপি সংলাপ নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা ও ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বেশ কয়েকবার কৌতুক ছুড়ে মারেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনাও দেখা দেয়। একপর্যায়ে আহসানুল হক হেনা বলেন, আশা করেছিলাম এ ঘটনার পর তারা একটু সংযত থাকবেন। কিন্তু যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয়…। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে যেসব কথাবার্তা রয়েছে সংলাপে তাতে আমি হলে আর ট্রাইব্যুনালেই আসতাম না। এখানে মুখও দেখাতাম না। কিন্তু ওনারা তো দেখছি আসছেন। প্রসিকিউটর হওয়ার পর কে কোথায় কী বাড়ি বানিয়েছেন, কে কাকে সন্দেহ করছেন, কার ল্যাপটপ চুরি হয়েছে, কার কী মান তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এ সময় প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, আপনার সম্পর্কেও কথা আছে। আহসানুল হক হেনা বলেন, হ্যাঁ আছে। আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, হেনা সাহেব শুধু আইনজীবী নন আরো বেশি কিছু, এটা তো খারাপ কথা নয়।

দেশের ঠাকুর ফেলি…


কাজী সাইদ
তারিখ: ২০ ডিসেম্বর, ২০১২


বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মতায় আসার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশীদের ‘স্বাধীনতা সম্মাননা’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ নামে নানা ধরনের মর্যাদা দেয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। ২৫ জুলাই ২০১১ সর্বোচ্চ স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২৭ মার্চ ২০১২-তে ৮৩ জন বিদেশীকে সম্মাননা দেয়া হয়। তৃতীয় পর্বে ২০ অক্টোবর ২০১২ আরো ৬১ জন বিদেশীকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা জানানো হয়। এবার ১৫ ডিসেম্বর ২০১২-তে ৬০ জন বিদেশী বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্র, তার স্বামী রমেশ মিত্র, গণসঙ্গীতশিল্পী সলিল চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে, চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক ঋত্বিক ঘটক ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিল্পী মকবুল ফিদা হোসেন, রাজনীতিক বাঘা যতিন, নেপাল নাগ, নিবেদিতা নাগ, সাংবাদিক বাসব সরকার,  বরুন সেনগুপ্ত প্রমুখ। এর পাশাপাশি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পত্রিকার মুখপত্র প্রাভদা এবং ত্রিপুরার একটি হাসপাতালকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিদেশী বন্ধুদের সম্মান জানানোয় আমরা দোষের কিছু দেখি না। ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ সম্মাননা প্রদানের সে অনুষ্ঠান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে আমার মতো দেশের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী মানুষ দেখেছে। বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে আমাদের দেশীয় যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন এমন রাষ্ট্রীয় খেতাবধারী বীর উত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীকদের তেমন দেখা যায়নি। দেখা যায়নি মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকদের, অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী; যাদের মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। হ্যাঁ, কিছু মুখের উপস্থিতি ছিল যারা মতাসীন দলের সুবিধাভোগী, উজির-নাজির এমন। ‘স্বাধীনতার মাসে মানবতার অপমৃত্যু’ শিরোনামে ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার লেখা কলামে লিখেছেন, ‘সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতার বেদনার সাথে জড়িত প্রত্য মুক্তিযোদ্ধারা সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই অবহেলিত, নির্যাতিত। এখনো পণ্ডিতেরা মনে করেন, তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি লেখালেখিতেই সব হয়ে গেছে। তাদের কাছে কলমের কালির দাম আছে, মুক্তিযোদ্ধার রক্তের কোনো দাম নেই। স্বাধীনতার ৪২ বছরে গ্রামগঞ্জের প্রত্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কত কী যে মাদারীর খেল হলো, বলে শেষ করা যাবে না; তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের দোষের অন্ত নেই। পদে পদে তাদের গলা টিপে ধরেছে। যারাই শাসক হয়, তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মায়াকান্না করে, চেতনার কথা বলে ফায়দা লোটে। কেউ এর ব্যতিক্রম নেই।’ একই কলামের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘তবে আজ যে মেজর জেনারেল জ্যাকবকে নিয়ে এত নাচানাচি, সেই জেনারেল কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক দিনও রণাঙ্গন দেখেননি। আমরা মাইলের পর মাইল হেঁটে, কখনো গাড়িতে, কখনো হেলিকপ্টারে, কখনো মৌচাকে, কড্ডায় আবার সাভারের হেমায়েতপুরে রণাঙ্গনে উল্কার মতো ঘুরেছি। হেমায়েতপুর থেকে সৈন্যদের সাথে হেঁটে হেঁটে মিরপুর এসেছি। মিরপুর থেকে সসৈন্য ১৪ ডিভিশন হেডকোর্টার দখল নেয়াতেও যদি আমাদের কোনো কৃতিত্ব না থাকে, যশোর থেকে হেলিকপ্টারে মুক্ত ঢাকায় আসা মেজর জেনারেল জ্যাকবের সব কৃতিত্ব হয়, তাহলে এই ইতিহাস বিকৃতির জমানায় কী আর বলার থাকে।’

মেজর জলিলের স্যা
মেজর জলিলের নেতৃত্বে বৃহত্তর বরিশাল-পটুয়াখালী শত্র“মুক্ত থেকেছিল ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ পর্যন্ত। এপ্রিলের শেষ নাগাদ বরিশাল-পটুয়াখালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে নেয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মেজর জলিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন পশ্চিম বাংলার বশিরহাটের হাসনাবাদে। এ সময় বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে নবম সেক্টর গঠিত হলে কমান্ডার নিয্ক্তু হন তিনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ সেক্টরটিতে কোনো নিয়মিত বাহিনী ছিল না। প্রবাসী সরকার ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় মেজর জলিলের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠল ৮০ হাজার সদস্যের বিরাট মুক্তিবাহিনী। নবম সেক্টরকে ভাগ করা হলো পাঁচটি সাব-সেক্টরে। এগুলো ছিলÑ সাতীরা, খুলনা, সুন্দরবন, বরিশাল ও পটুয়াখালী। তার নেতৃত্বে ৭ ডিসেম্বর সাতীরা, ৮ তারিখে বরিশাল-পটুয়াখালী মুক্ত হলো। ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ী বেশে তিনি খুলনা প্রবেশ করেন। সেখানে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন দলবীর সিং। মুক্তবাংলায় ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে অংশ নিলো। বাংলার সম্পদ পাচার শুরু করল। এ সময় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মেজর জলিল। মিত্রবাহিনীর প্রধান দলবীর সিংকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার সৈন্যরা লুটেরার ভূমিকা থেকে সরে না দাঁড়ালে আমি গুলি ছুড়তে বাধ্য হবো।’ দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলার মাটিতে কারারুদ্ধ হলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক, বিদেশী মিডিয়ার চোখে ‘হিপ্পি মেজর’ খ্যাত নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী। পাঁচ মাস সাত দিন পর তিনি মুক্তি পেলেন। বন্দীজীবন সম্পর্কে তার ছোট্ট বর্ণনাÑ ‘যশোর সেনাছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে বেলা ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ি না, যেন হানাবাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশে বেশ কিছু নরকঙ্কাল পড়ে আছে। ঘরের রুমে মানুষের রক্তের দাগ। কোনো ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল।’
রচনাবলীর অন্য এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ কয়েকটি মোটর লঞ্চ সহকারে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতের উদ্দেশে রওনা করি। প্রধান ল্যই ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা। বরিশাল সদর থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য (প্রাদেশিক) জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ইতিপূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বরিশালে ফেরত এসে আমাকে জানালেন যে, লে: জেনারেল অরোরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙ্গালী অফিসারের কাছে অস্ত্রের সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত আছেন। এ তথ্য লাভের এক দিন পরই আমি কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহকারে ভারত অভিমুখে রওনা হয়ে প্রথমে পৌঁছি পশ্চিম বাংলার বারাসাত জেলার হাছনাবাদ বর্ডার টাউনে। ঐ অঞ্চলের বিএসএফের কমান্ডার শ্রী মুখার্জির সঙ্গে হয় প্রথম আলোচনা। কমান্ডার মুখার্জি অত্যন্ত সহৃদয় বাঙ্গালী অফিসার। তিনি সর্বান্তকরণেই আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সরাসরি লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিয়ে গেলেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তার হেডকোয়ার্টার। তিনি আমাকে প্রথম সাাতেই সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সাী-প্রমাণ দাবি করলেন আমার কাছে। তখনই আমাকে সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী সাহেবের নাম দিতে হয়েছে। উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কে যা বাজে মন্তব্য করলেন তা কেবল ইয়াংকিদের মুখেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে। সোজা ভাষায় তার উত্তর ছিলÑ ‘ঐ দুটো ব্লাডি ইঁদুরের কথা আমি জানি না, ওদের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। অন্য কোনো সাী থাকলে আমাকে বলো।’

অস্থায়ী সরকার
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ শেখ মুজিবুর রহমানকে (যিনি ২৫ মার্চ ১৯৭১ গ্রেফতার বরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে কারারুদ্ধ) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী; খোন্দকার মোশতাক আহমদ বৈদেশিক, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী; এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। উল্লেখ্য, প্রকৃতপে ১৯৭১ সালের জুন মাসের আগ পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলা’ সরকারের কোনো নির্দিষ্ট অফিস ছিল না। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত, বিএসএফের অফিস খালি করে প্রবাসী সরকার মন্ত্রিসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়।
মেজর জলিলের মতে, ‘ব্যক্তিজীবন পদ্ধতিতে সীমাহীন লোভ-লালসার কারণেই আশ্রয়দানকারী ভারতীয় কর্তৃপ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতাগুলো অতি সহজেই নির্ণয় করে নিয়েছে এবং তাদের ভোগবিলাসে কোনোরূপ বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থেকেছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপরে ঔদার্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উত্তরোত্তর কলঙ্কময় করে তুলতে সহায়তা করেছে। অপর দিকে, কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের অফিস থাকলেও মতার সব উৎসই ছিল ভারতীয় কর্তৃপ। স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব একজন সম্মানিত বন্দীর জীবনযাপন করা ব্যতীত আর তেমন কিছুই করার সুযোগ ছিল না তার।’

মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং অবসান
এ দেশের কামার-কুমার, জেলে, তাঁতি, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ-আনসারে কর্মরত বাংলাদেশী এবং ছাত্র-জনতা সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রাতেই পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দেয়। হতভম্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেদিন আত্মরার জন্য ভারতীয় সীমান্তকে বেছে নেয়। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে ভেসে আসে স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণার সাথে সাথেই সাড়ে সাত কোটি মানুষ ফিরে পায় আলোর দিশাÑ যুদ্ধের দিকনির্দেশনা। এরপর থেকেই সারা দেশে গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পরে সারা দেশকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের শেষ ১৪ দিন ভারতীয় সেনা কমান্ডের অধীনে থেকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ভারতীয় কূটকৌশলে পাক-ভারতের যুদ্ধে পর্যবসিত হয়ে ওঠে। অন্তত ইতিহাসে তো এটাই লেখা হয়ে আছে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। আত্মসমর্পণের দলিলে সুস্পষ্ট করে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ও সিভিলিয়ান ফোর্স তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কথা বলা হলেও সে দলিলে শুধু পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই জেনারেলই স্বার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দায়িত্বশীল কাউকে সেদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বীর সেনাদের অনেকেই এখনো জীবিত। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে তাদের অনেকেরই স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালায় খুব একটা ডাক পড়ে না। অথচ তাদের মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মতাসীন দলের অনুসারী না হলে তাদের এখন
পাকিস্তানের চর, রাজাকার এবং স্বাধীনতাবিরোধী বলে গালাগাল করা হয়। যারা স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মহান স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসকে দলীয়করণ করেছেন; ইতিহাস তাদের কখনোই মা করবে না।
লক্ষ শহীদের রক্ত আর অজস্র মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সম্মান জানান। প্রতিদিন স্যালুট করুন আমাদের যোদ্ধা বীরদের। দেশের আনাচে-কানাচে খোঁজ নিন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো কেমন আছে। ভারতীয়দের এ দেশে এনে সম্মাননা দেয়ার আগে আমাদের জীবিত বীর উত্তম, বীরপ্রতীক, বীরবিক্রমদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত ছিল। মৃতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা উচিত ছিল। দেশের বীর সন্তানদের যথাযথ সম্মানের মধ্য দিয়ে জাতি গৌরবান্বিত হয়। আর বিদেশীদের ডেকে এনে মুক্তিযুদ্ধের নামে যা করা হচ্ছে তা জাতিকে হীনম্মন্যতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইÑ কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের সেবাদাসদাসী হতে চাই না। এটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
kazi_sayed@yahoo.com