অলিউল্লাহ নোমান, যুক্তরাজ্য থেকে
জরুরি অবস্থার মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের উত্তরসূরি শেখ হাসিনার
নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জোট সরকারের বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের হাত থেকে
রেহাই পাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রায় এক মাস ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছি।
আমার অভিভাবক ও দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান অফিসে দিন-রাত
কাটাচ্ছেন। তারই উদ্যোগে ও নির্দেশে আমাকে অফিস থেকেই তাত্ক্ষণিক দেশের
বাইরে চলে আসতে হলো। সম্পাদক মহোদয় অফিসবন্দী আর আমি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে।
কারণ একটাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল
হক নাসিম ও তার ঘনিষ্ঠ ঘাদানিক নেতা ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন
প্রকাশ করা। সম্পাদক মহোদয় দায়িত্ব নিয়ে এটা প্রকাশ করেছেন। তার মতো সত্য
প্রকাশে অদম্য সাহসী সম্পাদক ছাড়া এ রিপোর্ট প্রকাশ করা কারও পক্ষে সম্ভব
হতো কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তার মতো সত্য প্রকাশে অদম্য সাহসী ও
দায়িত্বশীল সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করতে পারাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার
সাংবাদিকতা জীবনে বিচার বিভাগ নিয়ে রিপোর্টিংয়ের শুরু থেকেই যেসব অন্যায়
পত্রিকা কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছার কারণে ছাপতে পারতাম না তখন আল্লাহর কাছে একজন
সাহসী সম্পাদকের অধীনে কাজ করার কামনা করতাম। অবশেষে আল্লাহ আমার সেই
ইচ্ছা পূরণ করেছেন। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যিনি সত্যিকারের অভিভাকের
ভূমিকায় থেকে অদম্য সাহস নিয়ে সত্য প্রকাশ করছেন। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন
থেকে যখনই তার সঙ্গে কথা হয় একটা বিষয় সব সময় বলেন, সেটা হলো তার
ভাষায়—‘তোমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পেরে আমি দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছি।
এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আমার যা হয় হবে, অন্তত তোমাকে নিরাপদে রাখতে
পেরেছি।’ তার মুখ থেকে প্রতিদিনই যখন একথাগুলো শুনি তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে
পড়ি। সত্যি একজন প্রকৃত অভিভাবক তিনি। আমি নির্বাসিত জীবনে রওয়ানা দেয়ার এক
সেকেন্ড আগেও জানতাম না তিনি আমার বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাকে ডেকে
নিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন পাসপোর্টে কোনো দেশের ভিসা আছে কিনা।
যুক্তরাজ্যের মাল্টিপল ভিসা আমার পাসপোর্টে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি টিকিট
করার জন্য পত্রিকার জিএম জিল্লুর ভাইকে নির্দেশ দিলেন। বাসা থেকে পাসপোর্ট
আনানোর জন্য বললেন আমাকে। বিকাল ৩টায় একথা বলার পর সন্ধ্যার ফ্লাইটে
রওয়ানা। তার সামনে আমি চোখের পানি ফেলে কাঁদলাম। তাকে ছেড়ে আসতে আমার ইচ্ছা
ছিল না। তিনি আমার কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। শুধু বললেন—‘তোমার জীবন
রক্ষা হোক সেটা আমি চাই। আগে তোমার জীবন রক্ষা কর, তারপর যা হবে হোক।’ তার এ
কথার উপর আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। নিজের জীবন অফিসবন্দী রেখে
সহকর্মীকে নিরাপদে দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করার হিম্মত কতজন সম্পাদকের
রয়েছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
আমার আরেকটি রিপোর্টের জন্য দু’জনেরই দণ্ড হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্ট আমাকে এক মাসের কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং সম্পাদক মহোদয়কে ৬ মাসের কারাদণ্ডসহ ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। জরিমানা অনাদায়ে আমাকে অতিরিক্ত ৭ দিন এবং সম্পাদক মহোদয়কে অতিরিক্ত একমাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল। কারণ আমরা কেউ জরিমানা পরিশোধ করিনি। আমরা মনে করি অন্যায়ভাবে সুপ্রিমকোর্ট আমাদের এই জেল ও জরিমানা আরোপ করেছে। আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট এই রায় দিয়েছিল। এছাড়া রায় দেয়ার আগে শুনানির সময় সুপ্রিমকোর্ট বলেছিল—‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। এ কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সঙ্গে আরও বলেছিল—‘সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আমরা এখানে বসিনি।’ সেদিন আমাদের প্রকাশিত রিপোর্টের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করলে সুপ্রিমকোর্ট এ মন্তব্যগুলো করে। সুপ্রিমকোর্টের এমন মন্তব্যে সেদিন গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। অন্তত, সুপ্রিমকোর্ট স্বীকার করে নিল যে আমাদের রিপোর্ট সত্য। সেদিন আমার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলাম সত্য প্রকাশ করে কারাগারে যাওয়াও গর্বের বিষয়। ছোট বেলায় হাতের লেখায় কত লিখেছি ‘সদা সত্য কথা বলবে’। আমাদের দণ্ড দেয়ার আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুনলাম ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। সত্য মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, সেটাই জানালেন আমাদের উচ্চ আদালত।
এই সূত্র ধরে পাঠকের আদালতে প্রশ্ন রেখে বলতে চাই—যে দেশের সুপ্রিমকোর্টে সত্য ডিফেন্স হিসেবে কাজ করে না, সেই দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু আছে কিনা সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন।
আমাদের বিচার ব্যবস্থা কতটা আজ্ঞাবহ সেটা প্রমাণ করতে হলে বেশিদূর যাওয়ার দরকার হয় না। আমি নির্বাসনে থাকা অবস্থায় এ দেশের গণমানুষের প্রিয় সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই জামিনের আবেদন শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ দিন ধার্য করে। ২ জানুয়ারি আবেদনটি পেশ করা হলে ৮ জানুয়ারি শুনানি গ্রহণের জন্য ধার্য করে হাইকোর্ট বেঞ্চ। ধার্য তারিখে দুই ঘণ্টার বেশি শুনানি হয়। দুই ঘণ্টা শুনানি গ্রহণের পর আদালত জটিল বিষয় বলে আবেদনটি ফেরত দেয়। একই সঙ্গে ‘সরি’ বলে অন্য কোনো বেঞ্চে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে জটিল বিষয় বলেই তো উচ্চ আদালতে যায় মানুষ। জটিল বিষয় না হলে মানুষ উচ্চ আদালতে যাবে কেন? এমনকি সাংবিধানিক কোনো বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে এর ব্যাখ্যা দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের। এর আগে আরও জটিল বিষয় নিয়ে মানুষকে উচ্চ আদালতে যেতে দেখেছি। উচ্চ আদালত বিচার-বিশ্লেষণ করে সংবিধান ও আইনের আওতায় আদেশ বা রায় দেবেন এটাই নিয়ম। জটিল বিষয় বলে একটি বেঞ্চ কোনো আদেশ দিলেন না। সমান এখতিয়ার প্রাপ্ত আরেকটি বেঞ্চ আদেশ দেবেন কেমন করে!
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করে পারছি না। ২০০০ সালের ঘটনা। দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে একসঙ্গে বিভিন্ন থানায় ২৪টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল। তখনও ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকার। সেই মামলাগুলোতে জামিনের জন্য দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন। দুটি বেঞ্চ জামিনের আবেদন শুনানি করতে বিব্রতবোধ করে। এতে তৃতীয় আরেকটি বেঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেদিনও সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে রেখেছিল পুলিশ। ইনকিলাব সম্পাদক বের হলেই গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সুপ্রিমকোর্ট থেকে জামিন নিয়েই বের হয়ে আসেন। প্রধান বিচারপতি সন্ধ্যার পর তৃতীয় একটি বেঞ্চকে দায়িত্ব দেন রাতেই বিষয়টি শুনানি গ্রহণের জন্য। রাত ১০টার পর একটি বেঞ্চ বসে। প্রথম একজন বিচারপতির বাড়িতে আদালত বসানোর কথা বলা হয়েছিল। তখন জানানো হয় জামিন অবেদনকারী হাইকোর্টের ভেতর রয়েছেন। বের হলেই তাকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা রয়েছে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুই বিচারপতি হাইকোর্টে আসেন। সেখানে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি শেষে জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়া হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে ইনকিলাব সম্পাদক হাইকোর্ট থেকে বের হয়েছিলেন। এবার দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণের পর কোনো আদেশই দিলেন না। আদালত ‘সরি’ বললেন। পৃথিবীর কোনো দেশের উচ্চ আদালতে এমন ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই।
এই লেখাটি লিখতে বসে আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিএম বাকের হোসেনের কারাগারে মৃত্যুর পর শুনানিতে ব্যারিস্টার রফিক উল হকের একটি মন্তব্য। বাকের হোসেনের মৃত্যুর পর তার জামিনের আবেদন সুপ্রিমকোর্টের শুনানির তালিকায় এসেছিল। ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগের বিচারপতিদের উদ্দেশ করে সেদিন বলেছিলেন—‘আপনাদের আর জামিন আবেদন শুনতে হবে না। আল্লাহ তাকে চিরদিনের জন্য জামিন দিয়েছেন।’ বিএম বাকের হোসেন কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার গুরুতর অসুস্থতার বিষয়টি জানিয়ে আপিল বিভাগে জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। কারণ তার মামলাটি ছিল তখন আপিল বিভাগের এখতিয়ারে। আপিল বিভাগ ব্যারিস্টার রফিক উল হককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—এত গুরুতর অবস্থা থাকলে সেটা তো আমাদের সেদিন বলেননি। জবাবে ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—‘আপনারা আমার আবেদনটি সেদিন পড়ারও প্রয়োজন মনে করেননি। আবেদনটি নথিতে রয়েছে, এখনও পড়ে দেখেন। আবেদনে সবকিছু বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। আপনারা আবেদনটি না পড়েই সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের মুখের কথা শুনে এক সপ্তাহ পর শুনানির দিন ধার্য করলেন। আপনারা আমাদের আবেদন পড়বেনও না, অ্যাটর্নি জেনারেলের কথা শুনে আদেশ দেবেন। এখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ সেদিন সৌভাগ্যক্রমে উপস্থিত থেকে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও আদালতের এই বক্তব্যগুলো শোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। শুধু তাই নয়, বাকের হোসেনকে যে মামলায় আপিল বিভাগ জামিন নামঞ্জুর করে জেলে আটক রেখেছিল একই মামলায় অন্য আসামিদের জামিন দিয়েছিল। বাকের হোসেনের পরিচয় তিনি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল করেন। এজন্য তার জামিন হয়নি। এরকম উদাহরণ দিলে বহু দেয়া যাবে। ক্ষুদ্র সাংবাদিকতা জীবনে প্রায় এক দশক উচ্চ আদালতের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে। আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রেখেই বলতে চাই, পর্যায়ক্রমে দলীয়করণের কড়াল গ্রাসে নিমজ্জিত আমাদের সুপ্রিমকোর্ট।
বিচারপতিরা দায়িত্ব নেয়ার আগে একটি শপথ নেন। তাদের শপথের মধ্যে রয়েছে অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। বিচারপতিরা কতটা অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, তা আমরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি আপিল বিভাগে আমাদের আদালত অবমাননা মামলার শুনানি ও রায়ে।
সবশেষে যেটা উল্লেখ করতে চাই—সবাই বলেন, উচ্চআদালত হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। একটি দেশের বিচার ব্যবস্থায় যদি দলীয়করণ হয়, মানুষের আস্থা যদি বিচার বিভাগ থেকে উঠে যায়, সেই দেশের ভবিষ্যত্ কোনদিকে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। আদালতের ওপর থেকে গণমানুষের আস্থা চলে গেলে সেই দেশে নৈরাজ্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি?
আমার আরেকটি রিপোর্টের জন্য দু’জনেরই দণ্ড হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্ট আমাকে এক মাসের কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং সম্পাদক মহোদয়কে ৬ মাসের কারাদণ্ডসহ ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। জরিমানা অনাদায়ে আমাকে অতিরিক্ত ৭ দিন এবং সম্পাদক মহোদয়কে অতিরিক্ত একমাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল। কারণ আমরা কেউ জরিমানা পরিশোধ করিনি। আমরা মনে করি অন্যায়ভাবে সুপ্রিমকোর্ট আমাদের এই জেল ও জরিমানা আরোপ করেছে। আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট এই রায় দিয়েছিল। এছাড়া রায় দেয়ার আগে শুনানির সময় সুপ্রিমকোর্ট বলেছিল—‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। এ কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সঙ্গে আরও বলেছিল—‘সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আমরা এখানে বসিনি।’ সেদিন আমাদের প্রকাশিত রিপোর্টের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করলে সুপ্রিমকোর্ট এ মন্তব্যগুলো করে। সুপ্রিমকোর্টের এমন মন্তব্যে সেদিন গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। অন্তত, সুপ্রিমকোর্ট স্বীকার করে নিল যে আমাদের রিপোর্ট সত্য। সেদিন আমার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলাম সত্য প্রকাশ করে কারাগারে যাওয়াও গর্বের বিষয়। ছোট বেলায় হাতের লেখায় কত লিখেছি ‘সদা সত্য কথা বলবে’। আমাদের দণ্ড দেয়ার আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুনলাম ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। সত্য মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, সেটাই জানালেন আমাদের উচ্চ আদালত।
এই সূত্র ধরে পাঠকের আদালতে প্রশ্ন রেখে বলতে চাই—যে দেশের সুপ্রিমকোর্টে সত্য ডিফেন্স হিসেবে কাজ করে না, সেই দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু আছে কিনা সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন।
আমাদের বিচার ব্যবস্থা কতটা আজ্ঞাবহ সেটা প্রমাণ করতে হলে বেশিদূর যাওয়ার দরকার হয় না। আমি নির্বাসনে থাকা অবস্থায় এ দেশের গণমানুষের প্রিয় সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই জামিনের আবেদন শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ দিন ধার্য করে। ২ জানুয়ারি আবেদনটি পেশ করা হলে ৮ জানুয়ারি শুনানি গ্রহণের জন্য ধার্য করে হাইকোর্ট বেঞ্চ। ধার্য তারিখে দুই ঘণ্টার বেশি শুনানি হয়। দুই ঘণ্টা শুনানি গ্রহণের পর আদালত জটিল বিষয় বলে আবেদনটি ফেরত দেয়। একই সঙ্গে ‘সরি’ বলে অন্য কোনো বেঞ্চে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে জটিল বিষয় বলেই তো উচ্চ আদালতে যায় মানুষ। জটিল বিষয় না হলে মানুষ উচ্চ আদালতে যাবে কেন? এমনকি সাংবিধানিক কোনো বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে এর ব্যাখ্যা দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের। এর আগে আরও জটিল বিষয় নিয়ে মানুষকে উচ্চ আদালতে যেতে দেখেছি। উচ্চ আদালত বিচার-বিশ্লেষণ করে সংবিধান ও আইনের আওতায় আদেশ বা রায় দেবেন এটাই নিয়ম। জটিল বিষয় বলে একটি বেঞ্চ কোনো আদেশ দিলেন না। সমান এখতিয়ার প্রাপ্ত আরেকটি বেঞ্চ আদেশ দেবেন কেমন করে!
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করে পারছি না। ২০০০ সালের ঘটনা। দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে একসঙ্গে বিভিন্ন থানায় ২৪টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল। তখনও ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকার। সেই মামলাগুলোতে জামিনের জন্য দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন। দুটি বেঞ্চ জামিনের আবেদন শুনানি করতে বিব্রতবোধ করে। এতে তৃতীয় আরেকটি বেঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেদিনও সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে রেখেছিল পুলিশ। ইনকিলাব সম্পাদক বের হলেই গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সুপ্রিমকোর্ট থেকে জামিন নিয়েই বের হয়ে আসেন। প্রধান বিচারপতি সন্ধ্যার পর তৃতীয় একটি বেঞ্চকে দায়িত্ব দেন রাতেই বিষয়টি শুনানি গ্রহণের জন্য। রাত ১০টার পর একটি বেঞ্চ বসে। প্রথম একজন বিচারপতির বাড়িতে আদালত বসানোর কথা বলা হয়েছিল। তখন জানানো হয় জামিন অবেদনকারী হাইকোর্টের ভেতর রয়েছেন। বের হলেই তাকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা রয়েছে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুই বিচারপতি হাইকোর্টে আসেন। সেখানে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি শেষে জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়া হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে ইনকিলাব সম্পাদক হাইকোর্ট থেকে বের হয়েছিলেন। এবার দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণের পর কোনো আদেশই দিলেন না। আদালত ‘সরি’ বললেন। পৃথিবীর কোনো দেশের উচ্চ আদালতে এমন ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই।
এই লেখাটি লিখতে বসে আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিএম বাকের হোসেনের কারাগারে মৃত্যুর পর শুনানিতে ব্যারিস্টার রফিক উল হকের একটি মন্তব্য। বাকের হোসেনের মৃত্যুর পর তার জামিনের আবেদন সুপ্রিমকোর্টের শুনানির তালিকায় এসেছিল। ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগের বিচারপতিদের উদ্দেশ করে সেদিন বলেছিলেন—‘আপনাদের আর জামিন আবেদন শুনতে হবে না। আল্লাহ তাকে চিরদিনের জন্য জামিন দিয়েছেন।’ বিএম বাকের হোসেন কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার গুরুতর অসুস্থতার বিষয়টি জানিয়ে আপিল বিভাগে জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। কারণ তার মামলাটি ছিল তখন আপিল বিভাগের এখতিয়ারে। আপিল বিভাগ ব্যারিস্টার রফিক উল হককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—এত গুরুতর অবস্থা থাকলে সেটা তো আমাদের সেদিন বলেননি। জবাবে ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—‘আপনারা আমার আবেদনটি সেদিন পড়ারও প্রয়োজন মনে করেননি। আবেদনটি নথিতে রয়েছে, এখনও পড়ে দেখেন। আবেদনে সবকিছু বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। আপনারা আবেদনটি না পড়েই সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের মুখের কথা শুনে এক সপ্তাহ পর শুনানির দিন ধার্য করলেন। আপনারা আমাদের আবেদন পড়বেনও না, অ্যাটর্নি জেনারেলের কথা শুনে আদেশ দেবেন। এখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ সেদিন সৌভাগ্যক্রমে উপস্থিত থেকে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও আদালতের এই বক্তব্যগুলো শোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। শুধু তাই নয়, বাকের হোসেনকে যে মামলায় আপিল বিভাগ জামিন নামঞ্জুর করে জেলে আটক রেখেছিল একই মামলায় অন্য আসামিদের জামিন দিয়েছিল। বাকের হোসেনের পরিচয় তিনি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল করেন। এজন্য তার জামিন হয়নি। এরকম উদাহরণ দিলে বহু দেয়া যাবে। ক্ষুদ্র সাংবাদিকতা জীবনে প্রায় এক দশক উচ্চ আদালতের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে। আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রেখেই বলতে চাই, পর্যায়ক্রমে দলীয়করণের কড়াল গ্রাসে নিমজ্জিত আমাদের সুপ্রিমকোর্ট।
বিচারপতিরা দায়িত্ব নেয়ার আগে একটি শপথ নেন। তাদের শপথের মধ্যে রয়েছে অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। বিচারপতিরা কতটা অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, তা আমরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি আপিল বিভাগে আমাদের আদালত অবমাননা মামলার শুনানি ও রায়ে।
সবশেষে যেটা উল্লেখ করতে চাই—সবাই বলেন, উচ্চআদালত হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। একটি দেশের বিচার ব্যবস্থায় যদি দলীয়করণ হয়, মানুষের আস্থা যদি বিচার বিভাগ থেকে উঠে যায়, সেই দেশের ভবিষ্যত্ কোনদিকে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। আদালতের ওপর থেকে গণমানুষের আস্থা চলে গেলে সেই দেশে নৈরাজ্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন