বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বহীন ভাষণ


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম




নতুন বছর ভালো যাবে—এমনটা সবাই চায়। নতুন বছরের প্রথমেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটু দেরি করে ১১ জানুয়ারি তিনি তার সালতামামি জাতির উদ্দেশে উপস্থাপন করেছেন। চারদিকে সমস্যাক্রান্ত একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে তার ভাষণে যতটা জাতীয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা, তাকে যতটা ধীরস্থির-উদ্বিগ্ন থাকা দরকার, তার কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি। সভা-সমাবেশে তিনি যে রঙে-ঢঙে কথা বলেন বরং সেদিন তারচেয়েও শক্তভাবে তিনি তার ভাষণ দিয়েছেন। বহুদিন পর তার ভাষণ শুনে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জাতির উদ্দেশে ভাষণের একই সুর-তাল-লয় কানে বাজছিল। তার ভাষণে তিনি কোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত করেননি। হয় জাতি তার কাছে কোনো কিছুই নয় অথবা খুবই সুকৌশলে সংঘাত জিইয়ে রাখার জন্য সমস্যাগুলোর সমাধানের সামান্যতম আভাসও দেননি। ক্ষমতার গরমে বেসামাল পতিত শাসকদের অতীতের কীর্তিকলাপ যখন যেখানে যা দেখা গেছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাল-চলনে-বলনে কোনো পার্থক্য নেই। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে—এসবই দলীয় স্বার্থে সৃষ্টি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার সমর্থন চেয়েছেন, ভোট চেয়েছেন। নির্বাচনী আইনে সব প্রার্থীর একই সমান সুযোগ পাওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রচারযন্ত্রে বা অর্থে ভোটের ক্যানভাস করতে পারেন না। বর্তমান নীতিমালা অনুসারে এটা বিশুদ্ধ নয়। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফেরাবে কে? একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি তাকে বুঝ দেন, তা না হলে তাকে বোঝাবার ক্ষমতা এ জগতসংসারে যে কারও নেই—এটা তিনি এরই মধ্যে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধানের লেখা অনুসারে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু জনগণের সে কি দুর্ভাগ্য—দেশের প্রধান সেবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন কোথাও যান, মালিকদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ, চলাফেরা বন্ধ, রাস্তাঘাট বন্ধ। সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এদিক-সেদিক যান, দু’ঘণ্টা আগে থেকে সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন বলাবলি করে—ঢাকা শহরের অর্ধেক যানজটের কারণ নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জানি না জনগণের ভোটে, জনগণের সেবায় নিয়োজিত একজন প্রধানমন্ত্রীর চলাফেরার সময় এভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাখা কতটা সংবিধানসম্মত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সবকিছুই জানেন। তা যদি জানেন, তাহলে তার চলাফেরার সময় প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা আগে থেকে রাস্তা বন্ধ থাকে—তা কি তিনি জানে না? তিনি যেদিক যান, সেদিকে তো বিড়ম্বনার শেষ নেই-ই। লিঙ্ক রোডগুলোর মুখ বন্ধ থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও দু’তিন ঘণ্টা ভোগান্তি ভুগতে হয়। ঘ্যাগের ওপর তারাবাত্তি’র মতো বছরখানেক তো হলো মিরপুর রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের (গণভবন) আশপাশ দিয়ে রাত ১১টার পর সব গাড়ি চলাচল বন্ধ। দেশের মালিক চলতে পারে না সেবকের বাড়ির কাছ দিয়ে, রাস্তা বন্ধ! প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান কার্যকলাপ দেখে আমার পুরনো দু’একটি কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজের সামনে ছিল কালিদাস রায়দের বাড়ি। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্ম হয়েছে। কালিদাস রায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক, পরাক্রমশালী জমিদার। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ সাইকেলে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারত না, ছাতা মাথায় দিতে পারত না আভিজাত্যের কারণে। কিন্তু সেই জমিদারের বংশধরদের করুণ দুর্দিন আমি দেখেছি। বেশি দূরে যেতে হবে কেন? ১৯৫০-৫৫ সালের দিকেও শত শত কোটি টাকার মালিক রণদা প্রসাদ সাহা করটিয়া জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়িতে চড়ে যেতে পারতেন না। করটিয়া বাজারের কাছে এসে কিছুদূর পায়ে হেঁটে তারপর আবার গাড়িতে উঠতেন। ছোটবেলায় কারণ বুঝতাম না। বুদ্ধি হলে বুঝলাম রণদা প্রসাদ সাহা নিম্ন জাতি ও এক সময় গরিব ছিলেন। আর করটিয়ার জমিদাররা সম্ভ্রান্ত, তাই তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না! বর্তমানে রণদা প্রসাদ সাহারও সেই জৌলুস, সেই খ্যাতি নেই। কিন্তু দানবীর মানবহিতৈষী করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অযোগ্য বংশধরদের দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তাদের এখন করুণ দশার শেষ নেই। দু’একজন যারা লেখাপড়া শিখেছেন, তারা অন্যের দুয়ারে চাকরি করে খান; জমিদারি চলে না, মর্যাদাবোধও নেই।
যা বলছিলাম, তাই বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দক্ষিণে বিশাল ক্রিসেন্ট রোড ১১টার পর বন্ধ। পশ্চিমে গা ঘেঁষে মিরপুর রোড। ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারলেও গাবতলী থেকে আড়ং বা মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পৌঁছতে কখনও আধঘণ্টা, কখনও দু’ঘণ্টার প্রয়োজন। দূরত্ব বড়জোর দু’তিন কিলোমিটার। সেখানে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো রাত ১১টায় দুমুখী রাস্তার এক মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। মিরপুর থেকে ঢাকার দিকে যেই মাত্র সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, সেই মাত্র মহাযানজটের কারণ ঘটে। ঢাকার দিক থেকে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি শ্যামলীর কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে পার হতে না পেরে দিন-রাত এক যানজটের সৃষ্টি হয়। তার ওপর রাত ১১টায় যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছাকাছি এলে দক্ষিণ দিকে বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন এক অমানবিক দুর্যোগের কারণ ঘটে। রাতে সৃষ্টি হওয়া যানজট সকালেও শেষ হয় না। কত রোগী ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে রাস্তায় আটকে পড়ে মারা যায়। আবার কত লাশ ঢাকা থেকে গ্রামে নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে সৃষ্ট যানজটে বাড়ি পৌঁছতে পারে না। ১২ জানুয়ারি সখীপুরের বাঘবেড়ে এক জনসভা করতে গিয়েছিলাম। বিপুল লোকের সমাগম হয়েছিল সে সভায়। তবে সখীপুর এবং অন্যান্য স্থানে জনসভায় যে পরিমাণ মেয়েরা আসত, তত মহিলার সমাগম হয়নি। হয় আমাদের আকর্ষণ নষ্ট হয়ে গেছে, না হয় কর্মীরা মহিলাদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারছে না কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গ্রাম-গঞ্জের মা-বোনরা দেশের প্রতি, দেশের কথা শোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সখীপুরের বাঘবেড় থেকে রওনা হয়েছিলাম ৫টা ১০ মিনিটে। ৭টা ৫০ মিনিটে উল্টো পাশ দিয়ে আমিনবাজার মসজিদের কাছাকাছি এসেছিলাম। সামনে বিকল গাড়ি থাকায় এমন এক বিশ্রী অবস্থায় পড়েছিলাম; ১ ঘণ্টায় ১ ইঞ্চিও আগপিছ হতে পারিনি। পুরনো ড্রাইভার শাহ আলম হঠাত্ বলল—পেছনে খালি হয়েছে, আমরা কি ঘুরে আবার ওই লেনে যাব। আল্লাহর অশেষ দয়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এক-দুই কিলোমিটার সাভারের দিকে গিয়ে রাইট ট্র্যাকে এসেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়; গাড়ি এগুচ্ছিল না। হঠাত্ এক মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত নাসিরের কথা মনে হলো। ওর এক ভাই যুদ্ধের সময় খুবই ছোট ছিল। দু’চারবার কোলেও উঠেছে। অনেক বছর সার্জেন্টের চাকরি করেছে। হঠাত্ করে আমার এক সহকর্মী তাকে ফোন করে কি যেন বলেছিল। এরই মধ্যে ফরিদের ফোন পেলাম, ‘দাদা আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘আমিনবাজারে ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।’ অনেক বছর ঢাকার ট্রাফিক কন্ট্রোল আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে। ও কি করে যেন ভিআইপি ট্রাফিক কন্ট্রোলের ডিসি-এডিসিকে ফোন করেছিল। সব সময়ই দেখছি বিরুদ্ধ মতবাদী ছাড়া সাধারণ কর্মচারী-কর্মকর্তারা সবাই দারুণ সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। তারা নাকি তাকে বলেছেন, যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেবেন। ওর কয়েক মিনিট পরই গাড়ি চলতে থাকল। কোথাও দ্রুত, কোথাও একটু ধীর কিন্তু এক জায়গায় ছাগলের খুঁটি মেরে আর দাঁড়িয়ে থাকছে না। মিরপুর ব্রিজের ওপরে হঠাত্ এক অপরিচিতের ফোন পেলাম, ‘স্যার আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘মিরপুর পুলের ওপর।’ তিনি বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা আপনাকে পার করে আনছি।’ মাঝে মাঝে ফোন আসতে থাকল। দু’একবার আমিও করলাম। আমিনবাজার মসজিদের কাছে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় ৪০-৪৫ মিনিটে বিজয়নগরের দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে গেলাম। আর ১০ মিনিট দেরি হলে ১২ তারিখ শনিবারের প্রোগ্রামটি করতে পারতাম না। আগে মনে হতো ‘সবার ওপরে দেশ’ বোধ হয় কেউ দেখে না। কিন্তু গত ক’মাস এত চিঠিপত্র, এত ফোন পাই; তাতে বিস্মিত না হয়ে পারি না। তাই প্রোগ্রামটি মিস হলে দর্শক-শ্রোতারা যেমন কষ্ট পেতেন, আমারও খারাপ লাগত। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ১২ তারিখের অতিথি। তার আবার বাংলা ভিশনে ১২টা কয়েক মিনিটে সরাসরি সম্প্রচার ছিল। তাই তারও তাড়া ছিল। এসব কারণে খুব বিব্রত ছিলাম। আমি সাধারণত সরকারি লোকের সরকারি কাজে খুব একটা খুশি হই না। মনে করি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু ১২ তারিখে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় দারুণ খুশি হয়েছি। সেজন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, তারা যেন শুধু আমাকে নয়, ছোট-বড়, ধনী-গরিব আমজনতাকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে সাহায্য করে।
সেই সকাল ৮টায় টাঙ্গাইল থেকে বেরিয়েছিলাম। সিলিমপুর-সখীপুর বাঘবেড় হয়ে রাত ১০টায় দিগন্ত টিভিতে গিয়েছিলাম। মিনিট দশেক লেগেছিল বিজয়নগর থেকে অত রাতে আসাদ গেটে আসতে। সেখানে এসেই মারাত্মক জ্বালা—প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা। তখন রাত ১১টা ৩ মিনিট। আসাদ গেট থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কত আর হবে, পাঁচশ’-ছয়শ’ গজ। এটুকু আসতেই দীর্ঘ ৫০ মিনিট লেগে গেল। বুকের ভেতর হুতাশ উঠেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমার জীবনের মনে হয় ৫০ বছর ধ্বংস হয়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগর গণভবনের কোথায় থাকেন, অন্যরা না জানলেও আমি জানি। রাস্তা থেকে তার ঘর বহু দূরে। বন্দুকের গুলিও তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছবে না। তাহলে জনগণের নেতা হয়ে এত ভয় কেন? মিরপুর রোডের এক পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে আর ২০-২৫ গজ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে গাড়ি-ঘোড়া চলাচল করলে কি ক্ষতি? পশ্চিমে মিরপুর রাস্তা থেকে তার অফিস এবং শোবার ঘর প্রায় চার-পাঁচশ’ গজ দূরে। আর মাত্র ২৫-৩০ গজ কাছে গিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চললে তার কি এমন ক্ষতি হতে পারে? কিন্তু এ সামান্য বাধায় হাজার হাজার মানুষের শত শত ঘণ্টা কর্মকাল নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণের ক্রিসেন্ট রোড থেকেও তার ঘর ৩০০ গজের কম দূরে নয়। কার ভয়ে, কি কারণে এসব রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? কারা এসব পরামর্শ দিয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তা কি আদৌ জানেন? না জেনে থাকলে একটু খোঁজ-খবর করে দেখুন না রাস্তাঘাটে মানুষজন কি সব বলাবলি করে। নিরপেক্ষ কোনো মাধ্যমে তার সামান্য কিছু জানলেও কষ্ট করে আমার এসব অপ্রিয় কথা বলতে হতো না।
গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন। বিপুল ভোটে মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়েছিল, তারই চতুর্থ বার্ষিকী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। সবকিছুতেই সাবেকরা বহাল। সরকারি দল, একটা কিছু দেখানো দরকার—দেশবাসীকে তারা তাই দেখিয়েছে। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ খুবই ছোট্ট দল। আমাদেরও ওইদিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। একসময় সবার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলাম, নাম-ঠিকানাসহ সর্বনিম্ন দশ টাকা। অসংখ্য কর্মী এবং দু’চারজন আগন্তুক নাম-ঠিকানাসহ দশ-বিশ-পঞ্চাশ-শ’-হাজার, এমনকি দশ হাজার টাকাও দিয়েছেন। তারচেয়েও বেশি দেয়া একজন সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লিডার, এভাবে দশ-বিশ টাকা সহযোগিতা নিয়ে আপনি দল চালাবেন কি করে?’ প্রশ্নটা শুনে বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অর্থ সংগ্রহ করত স্বেচ্ছাসেবক ইউনিয়ন কমান্ডাররা। হিসাব ছিল কঠিন। এক টাকা এদিক-ওদিক হলে শাস্তি। সাধারণ মানুষ দু’এক টাকা করে চাঁদা দিত। যারা চাঁদা সংগ্রহ করত, তারা পাগল হয়ে যেত। বিকালে দেখত অর্থের পরিমাণ তিন-চার বা পাঁচ হাজার টাকা। তার জন্য দু’একজনকে হয়তো জবাবদিহিও করতে হতো। এত লোক কিন্তু অর্থ এত কম কেন? আবার কোনো কোনো জায়গায় দেখা যেত ঝামেলাহীন, লোক কম। কিন্তু চাঁদার পরিমাণ বেশুমার। তাই স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররাই তাদের বাস্তব জ্ঞানে অল্প কিছুদিন পর থেকে দু’এক টাকা চাঁদা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দু’চার-পাঁচশ’-হাজার যারা দিতেন, তাই-ই সংগ্রহ করতেন। তাতে ঝামেলা কম, অর্থের পরিমাণ বেশি। এরকম এক সময় জুলাই মাসের প্রথম দিকে আক্কেল আলী সিকদারের নেতৃত্বে কালিয়াকৈরের ১৩০ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণ দেখার জন্য অনেক লোকসমাগম হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এক-দেড় হাজার তো হবেই। এক সহযোদ্ধা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা অনেক যুদ্ধ করেছে। দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাতে নিজেই গান বেঁধেছে, সুর করে শুনিয়েছে। সে যেন নতুন নতুন স্লোগানের স্রষ্টা। হঠাত্ করেই ‘বঙ্গবীর’ স্লোগান আবিষ্কার করে ফেলে। তাদের কাছে স্লোগানটি ভালো লাগলেও আমি খুব উত্সাহ পাইনি। থামিয়েও রেখেছিলাম অনেকদিন। পরে আর পারিনি। অস্ত্রসহ একদল রাজাকার সারেন্ডার করায় আমরা খুব ফুর্তিতে ছিলাম। সব অনুষ্ঠান শেষে জনতার উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়, হানাদারদের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা চিত্কার করে বলছিলাম। আমার বক্তৃতার মাঝে একজন সাধারণ মানুষ সভাস্থলে গর্জে উঠেছিল, ‘এই যে কাদের সিদ্দিকী, গরিবের টেহার মুক্তিগোরে দরকার আছে কি নাই? আইজ কইয়া যাওন লাগবো।’ প্রথমে আমি তেমন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররা হিসাবের ভয়ে গরিব মানুষের দু’এক টাকা এখন আর নেয় না। দু’দিন পরই সাইক্লোস্টাইল করে জানিয়ে দেয়া হলো, ইউনিয়ন পরিষদে ট্যাক্স দিলে মুক্তিবাহিনীর তহবিলে জমা হবে। যাদের ট্যাক্স নেই, তারাও এক টাকা থেকে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিতে পারবে। মাত্র বিশ দিনে তিরাশি লাখ টাকা উঠেছিল। আমরা চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছিলাম। তাতেও অর্ধেক টাকা বেঁচে গিয়েছিল। যে কারণে স্বাধীনতার পর গ্রাম-গঞ্জে আমার সম্মান ছিল আইয়ুব সরকারের চেয়েও বেশি। আইয়ুব সরকারও চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের একবারে বেতন দিতে পারেনি। ১০-১২ বছর বেতন বাকি ছিল। তাই সবাই ভাবত যুদ্ধ করেও আমি সব বেতন দিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন