ব দ রু দ্দী ন উ ম র
প্রধানমন্ত্রী তার রাশিয়া সফরে গিয়ে ১৫ জানুয়ারি তাদের সঙ্গে এক
বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকার এক অস্ত্র ক্রয়চুক্তি করেছেন। এই
চুক্তি অনুযায়ী সরকার সামরিক বাহিনীর জন্য নানা ধরনের অস্ত্র আমদানি করবে।
এর জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। এই ঋণের সুদসহ অন্য
শর্ত সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট আজকের (১৬.১.১৩) সংবাদপত্রে না থাকলেও আগের
কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, সুদের হার বেশ উঁচুই রাখা হয়েছে। মোট কথা, ঋণ
নিয়ে আট হাজার কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া থেকে কেনার
ব্যবস্থা এখন চূড়ান্ত করেছে। এছাড়া তারা রাশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে ঈশ্বরদী
থানার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্যও
চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই বর্তমান বাংলাদেশ
সরকার রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল।
বাংলাদেশ যে এভাবে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিষ্প্রয়োজনে অস্ত্র কিনছে এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করে দেশ ও জনগণের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে, এটা কোনো অবহেলা বা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। শুধু রাশিয়ার সঙ্গে এই অস্ত্র ও ঋণচুক্তিই নয়, একইভাবে মাত্র কিছুদিন আগে এরা চীন থেকেও ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকেও তারা সামরিক জিনিসপত্র কিনেছে। এসব ব্যয় জোড়া দিলে যে পরিমাণ দাঁড়ায় সেটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অঙ্ক। তার থেকেও বড় কথা এই ব্যয় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।
আমরা এর আগেও বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয় সম্পর্কে বলেছি যে, দেশ রক্ষার নামে যে ব্যয় করা হয় এবং ক্রমাগত যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যৌক্তিকতা নেই এ কারণে যে, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে আক্রমণ করার মতো কোনো দেশ এর চারপাশে নেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে আসবে এমন কোনো দেশও নেই। কাজেই অন্য দেশের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ যে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছে তা অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয়। কিন্তু যতই অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয় হোক, এই ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বেপরোয়াভাবে করেই চলেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখন রাশিয়া গিয়ে যে চুক্তি করেছেন এটা এই ধরনের অপচয়েরই এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। ভারত বাংলাদেশ সরকারের পরম বন্ধু দেশ। নেপাল ও ভুটানের পক্ষে বাংলাদেশ আক্রমণের চিন্তা উন্মাদের ব্যাপার। মিয়ানমারের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও সেটা এমন নয় যে, তার ফলে মিয়ানমার সামরিকভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো দেশও নেই যাদের দ্বারা দূর থেকে এসে বাংলাদেশের ওপর সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা। তাহলে কার থেকে দেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এত বিশাল ও বেপরোয়া অস্ত্র মজুত প্রয়োজন? এই শত্রুর কোনো কথা, কোনো পরিচয় বাংলাদেশ সরকারের থেকেও শোনা যায় না।
তবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শুধু বাইরের শক্তিই নয়, দেশের ভেতরের শক্তিরও মোকাবিলা করতে হয়। শাসক শ্রেণী যাদের শোষণ করে, যাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে সমগ্র শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে, তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরকেও মনে করে নিজেদের শাসন ক্ষমতার বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। এ কারণে তাদের দমন করার জন্যও প্রয়োজন হয় বলপ্রয়োগের। এই বলপ্রয়োগ বাস্তবত করাও হয়ে থাকে যা আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানেও কথা আছে। জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের জন্য যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তার থেকেও অনেক বেশি এখন সরকারের হাতে আছে। অস্ত্র শুধু এখনই কেনা হচ্ছে না। নিয়মিতভাবে অস্ত্র কিনে সরকারের অস্ত্রভাণ্ডার ভরপুর করে রাখা হয়েছে। এদিক দিয়েও বর্তমান অস্ত্র ক্রয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। অথচ এই অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারটি এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয় এটা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট অর্জন এবং বিজয়!
এখানে অবশ্যই বলা দরকার, এই অস্ত্র ক্রয় এমন সময়ে হচ্ছে যখন ঢাকার রাস্তায় গরিব শিক্ষকরা সামান্য বেতন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন। আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় অস্ত্র কেনার জন্য সরকার চড়া সুদে রাশিয়া থেকে ধার করছে, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য সামান্য ব্যয়ের ক্ষমতা সরকারের নেই! তাদের মাসিক বেতন নিশ্চিত করার জন্য এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে নামা, অনশন করাও তাদের মস্ত অপরাধ!! এই ‘অপরাধের’ জন্য সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, তাদের শরীরে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছে, তাদের ওপর গরম পানি স্প্রে করছে!!! এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, ভোট পেয়ে কেউ ক্ষমতায় গেলে সে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হবে এমন কথা নেই। শুধু তা-ই নয়, এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার চরিত্র এমন যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধি ও তাদের বন্ধু নয়, বরং শত্রুরাই ক্ষমতাসীন হয়?
বাংলাদেশ সরকার যখনই কোনো বড় প্রকল্প ও বিশাল আকারে কিছু কেনার জন্য কোনো বিদেশি সরকার বা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তখনই তার সঙ্গে দুর্নীতি জড়িত থাকে। অস্ত্র ক্রয় এর মধ্যে একটি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট ও বিমানবাহিনীর জন্য মিগ কেনার সময় দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে আদালতকে দিয়ে খারিজ করিয়ে নেন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কেনার জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং থাকলে তার পরিমাণ কত এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। শুধু এই অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেই নয়, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়েছে সে ক্ষেত্রেও কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটাও দেখা দরকার। কারণ বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী এই প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (pre-feasibility study) জন্য একশ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়! অথচ এই বাবত ঋণ নেয়া হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা!! এর থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে জনগণের সম্পদ কী পরিমাণে লুটপাট ও অপব্যয় হচ্ছে এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপরাধীকীকরণ (criminalisation) ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশে আজ যতই উন্নতির কথা বলা হোক, এ দেশের জনগণের জীবন এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার কারণে বিপর্যস্ত। চিকিত্সা এতই ব্যয়সাপেক্ষ যে সাধারণ মানুষ, শতকরা আশিভাগ মানুষের সুচিকিত্সার কোনো সুযোগ ও ব্যবস্থা নেই। এই শীতের মধ্যে গরিবদের কোনো শীতবস্ত্র নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও পুষ্টির অভাবে গরিবদের মধ্যে নানা ধরনের কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাব। শহরে হাজার হাজার বাড়ি টাকাওয়ালা লোকদের থাকলেও লাখ লাখ মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বস্তিতে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের কোনো বিশুদ্ধ পানীয়জল নেই, স্যানিটারি ব্যবস্থা নেই, একই ঘরে গাদাগাদি করে তাঁদের দিনরাত্রি যাপন। এসবই বাস্তব ব্যাপার। গরিবদের স্কুলের গরিব শিক্ষকদের কী অবস্থা এটা আগেই বলা হয়েছে। এসব দিকে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। তাদের অবস্থা দেখে এবং বড় বড় হামবড়া কথাবার্তা শুনে বোঝাই যায় যে, এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, তাদের কোনো করণীয় নেই। তারা শুধু নিজেদের, নিজেদের পরিবার ও দলীয় লোক এবং আত্মীয়স্বজনের পকেটভর্তি করতেই ব্যস্ত। এ কারণে তারা যা-ই করে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে দুর্নীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার শেষ সময়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় এবং রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করেছে, যে বিশাল ঋণের বোঝা দেশের জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে কী পরিমাণ দুর্নীতি জড়িত আছে, এর তদন্ত অবশ্যই হওয়া দরকার।
১৬.১.২০১৩
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বাংলাদেশ যে এভাবে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিষ্প্রয়োজনে অস্ত্র কিনছে এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করে দেশ ও জনগণের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে, এটা কোনো অবহেলা বা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। শুধু রাশিয়ার সঙ্গে এই অস্ত্র ও ঋণচুক্তিই নয়, একইভাবে মাত্র কিছুদিন আগে এরা চীন থেকেও ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকেও তারা সামরিক জিনিসপত্র কিনেছে। এসব ব্যয় জোড়া দিলে যে পরিমাণ দাঁড়ায় সেটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অঙ্ক। তার থেকেও বড় কথা এই ব্যয় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।
আমরা এর আগেও বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয় সম্পর্কে বলেছি যে, দেশ রক্ষার নামে যে ব্যয় করা হয় এবং ক্রমাগত যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যৌক্তিকতা নেই এ কারণে যে, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে আক্রমণ করার মতো কোনো দেশ এর চারপাশে নেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে আসবে এমন কোনো দেশও নেই। কাজেই অন্য দেশের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ যে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছে তা অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয়। কিন্তু যতই অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয় হোক, এই ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বেপরোয়াভাবে করেই চলেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখন রাশিয়া গিয়ে যে চুক্তি করেছেন এটা এই ধরনের অপচয়েরই এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। ভারত বাংলাদেশ সরকারের পরম বন্ধু দেশ। নেপাল ও ভুটানের পক্ষে বাংলাদেশ আক্রমণের চিন্তা উন্মাদের ব্যাপার। মিয়ানমারের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও সেটা এমন নয় যে, তার ফলে মিয়ানমার সামরিকভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো দেশও নেই যাদের দ্বারা দূর থেকে এসে বাংলাদেশের ওপর সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা। তাহলে কার থেকে দেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এত বিশাল ও বেপরোয়া অস্ত্র মজুত প্রয়োজন? এই শত্রুর কোনো কথা, কোনো পরিচয় বাংলাদেশ সরকারের থেকেও শোনা যায় না।
তবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শুধু বাইরের শক্তিই নয়, দেশের ভেতরের শক্তিরও মোকাবিলা করতে হয়। শাসক শ্রেণী যাদের শোষণ করে, যাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে সমগ্র শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে, তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরকেও মনে করে নিজেদের শাসন ক্ষমতার বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। এ কারণে তাদের দমন করার জন্যও প্রয়োজন হয় বলপ্রয়োগের। এই বলপ্রয়োগ বাস্তবত করাও হয়ে থাকে যা আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানেও কথা আছে। জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের জন্য যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তার থেকেও অনেক বেশি এখন সরকারের হাতে আছে। অস্ত্র শুধু এখনই কেনা হচ্ছে না। নিয়মিতভাবে অস্ত্র কিনে সরকারের অস্ত্রভাণ্ডার ভরপুর করে রাখা হয়েছে। এদিক দিয়েও বর্তমান অস্ত্র ক্রয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। অথচ এই অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারটি এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয় এটা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট অর্জন এবং বিজয়!
এখানে অবশ্যই বলা দরকার, এই অস্ত্র ক্রয় এমন সময়ে হচ্ছে যখন ঢাকার রাস্তায় গরিব শিক্ষকরা সামান্য বেতন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন। আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় অস্ত্র কেনার জন্য সরকার চড়া সুদে রাশিয়া থেকে ধার করছে, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য সামান্য ব্যয়ের ক্ষমতা সরকারের নেই! তাদের মাসিক বেতন নিশ্চিত করার জন্য এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে নামা, অনশন করাও তাদের মস্ত অপরাধ!! এই ‘অপরাধের’ জন্য সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, তাদের শরীরে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছে, তাদের ওপর গরম পানি স্প্রে করছে!!! এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, ভোট পেয়ে কেউ ক্ষমতায় গেলে সে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হবে এমন কথা নেই। শুধু তা-ই নয়, এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার চরিত্র এমন যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধি ও তাদের বন্ধু নয়, বরং শত্রুরাই ক্ষমতাসীন হয়?
বাংলাদেশ সরকার যখনই কোনো বড় প্রকল্প ও বিশাল আকারে কিছু কেনার জন্য কোনো বিদেশি সরকার বা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তখনই তার সঙ্গে দুর্নীতি জড়িত থাকে। অস্ত্র ক্রয় এর মধ্যে একটি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট ও বিমানবাহিনীর জন্য মিগ কেনার সময় দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে আদালতকে দিয়ে খারিজ করিয়ে নেন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কেনার জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং থাকলে তার পরিমাণ কত এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। শুধু এই অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেই নয়, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়েছে সে ক্ষেত্রেও কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটাও দেখা দরকার। কারণ বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী এই প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (pre-feasibility study) জন্য একশ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়! অথচ এই বাবত ঋণ নেয়া হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা!! এর থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে জনগণের সম্পদ কী পরিমাণে লুটপাট ও অপব্যয় হচ্ছে এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপরাধীকীকরণ (criminalisation) ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশে আজ যতই উন্নতির কথা বলা হোক, এ দেশের জনগণের জীবন এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার কারণে বিপর্যস্ত। চিকিত্সা এতই ব্যয়সাপেক্ষ যে সাধারণ মানুষ, শতকরা আশিভাগ মানুষের সুচিকিত্সার কোনো সুযোগ ও ব্যবস্থা নেই। এই শীতের মধ্যে গরিবদের কোনো শীতবস্ত্র নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও পুষ্টির অভাবে গরিবদের মধ্যে নানা ধরনের কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাব। শহরে হাজার হাজার বাড়ি টাকাওয়ালা লোকদের থাকলেও লাখ লাখ মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বস্তিতে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের কোনো বিশুদ্ধ পানীয়জল নেই, স্যানিটারি ব্যবস্থা নেই, একই ঘরে গাদাগাদি করে তাঁদের দিনরাত্রি যাপন। এসবই বাস্তব ব্যাপার। গরিবদের স্কুলের গরিব শিক্ষকদের কী অবস্থা এটা আগেই বলা হয়েছে। এসব দিকে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। তাদের অবস্থা দেখে এবং বড় বড় হামবড়া কথাবার্তা শুনে বোঝাই যায় যে, এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, তাদের কোনো করণীয় নেই। তারা শুধু নিজেদের, নিজেদের পরিবার ও দলীয় লোক এবং আত্মীয়স্বজনের পকেটভর্তি করতেই ব্যস্ত। এ কারণে তারা যা-ই করে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে দুর্নীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার শেষ সময়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় এবং রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করেছে, যে বিশাল ঋণের বোঝা দেশের জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে কী পরিমাণ দুর্নীতি জড়িত আছে, এর তদন্ত অবশ্যই হওয়া দরকার।
১৬.১.২০১৩
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন