বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

মন্তব্য প্রতিবেদন : জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাই


মাহমুদুর রহমান




আজ বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ইংরেজি সাল ২০১৩। আমার অফিস বন্দিত্বের এক মাস ৩ দিন চলছে। এর মধ্যে এ মাসের ৮ তারিখে হাইকোর্টে একবার আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার দেশ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক মাত্রই জানেন, সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ সেদিন দীর্ঘ শুনানি শেষে আমার আবেদন ফিরিয়ে দিয়ে সিনিয়র কোনো বেঞ্চে যাওয়ার মৌখিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্য যে লিখিত আদেশ পরদিন বিচারপতিদ্বয় দিয়েছেন, সেখানে বোধগম্য কারণে ‘সিনিয়র বেঞ্চ’ এই কথাটি আর রাখেননি। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তাদের আদেশে লিখেছেন, Let it go out of list with liberty to mention the matter before any other appropriate bench (আবেদনটি তালিকার বাইরে পাঠানো হোক এই স্বাধীনতা সহকারে যাতে অন্য কোনো উপযুক্ত বেঞ্চে উত্থাপন করা যায়)। হাইকোর্টে বেঞ্চ গঠনের সময় আদালতের গঠনবিধি অনুসারে প্রতিটি বেঞ্চের এখতিয়ার বিশদভাবে বর্ণনা করা থাকে। সাধারণত উচ্চ আদালতের সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতীত যে কোনো দীর্ঘ ছুটির পরই হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। এছাড়া প্রধান বিচারপতি চাইলে যে কোনো সময়ই বেঞ্চ নতুন করে গঠন করতে পারেন।
এ বছরের শীতের ছুটির শেষে উচ্চ আদালত ২ জানুয়ারি থেকে খুলেছে। তার একদিন আগে অর্থাত্ ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ২০১৩ইং সনের ১নং গঠনবিধি শিরোনামে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ গঠন করেছেন। তার উপরোক্ত আদেশের ১৪ নম্বর সিরিয়ালে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের এখতিয়ার নিম্নরূপ : “একত্রে ডিভিশন বেঞ্চে বসিবেন এবং শুনানীর জন্য ডিভিশন বেঞ্চে গ্রহণযোগ্য ফৌজদারী মোশন; ফৌজদারী আপীল মঞ্জুরীর আবেদনপত্র এবং তত্সংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র; মঞ্জুরীকৃত আপীল ও তত্সংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র; ২০০৮ইং সন পর্যন্ত ফৌজদারী বিবিধ এবং ফৌজদারী রিভিশন ও রেফারেন্স মোকদ্দমাসমূহ এবং উপরোল্লিখিত বিষয়াদি সংক্রান্ত রুল ও আবেদনপত্র গ্রহণ করিবেন।” আইনি ভাষার কূট-কচালি বাদ দিলে মোদ্দা কথা আমার মতো নাগরিকের আবেদন শুনানির জন্য উল্লিখিত দ্বৈত বেঞ্চকে প্রয়োজনীয় সব এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। তারপরও আমার জামিন আবেদন বিষয়ে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় কেন তাদের বেঞ্চকে উপযুক্ত বিবেচনা না করে অন্য কোথাও যেতে আদেশ দিলেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে সেদিনকার আদালতের বিচিত্র পরিস্থিতি বয়ান করতে হবে।
জানুয়ারির ২ তারিখ আদালত খুললেও আমার জামিন আবেদনের শুনানি উল্লিখিত বেঞ্চ ৮ তারিখের আগে শুনতে সম্মত হননি। আমার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী তার সাধ্যমত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সেই ১৩ ডিসেম্বর থেকে অফিসে অবরুদ্ধ রয়েছি, তাই শুনানি ৩ জানুয়ারি করা হোক। কিন্তু, আদালত অটল থেকে বলেছেন আগাম জামিন আবেদন শুনানির জন্য সপ্তাহের নির্ধারিত দিবস মঙ্গলবার ব্যতীত তারা আমার আবেদন শুনবেন না। এতে নাকি নিয়মের ব্যত্যয় হবে। অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে মেনশনের দিনেই শুনানি হওয়ার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। তার মধ্য থেকে একটা প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০০০ সালে ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক এ. এম. এম. বাহাউদ্দীনের জামিনের শুনানি গ্রহণের জন্য রাত দশটায় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ বসানো হয়েছিল এবং তিনি সে রাতে আগাম জামিনও পেয়েছিলেন। সম্পাদক বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধেও তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকার আমার মতোই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিল। এখন অবশ্য তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধুর সম্পর্ক রয়েছে।
আমি মাওলানা মান্নানের পুত্র, ইনকিলাব সম্পাদকের মতো ভাগ্যবান নই তাই ৬ দিন অপেক্ষা করেই হাইকোর্টে গেলাম। পথিমধ্যে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমার সহকর্মী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান আমার দেশ অফিস থেকে একই গাড়িতে উঠলেন। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া কোনো বিষয় নয়, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমের মতো গুম হওয়াটাই অধিকতর আশঙ্কার। সেই জন্যই ছোটভাইসম দুই বন্ধু আমার সঙ্গেই আদালতে গেলেন। সাড়ে দশটায় আদালতে উঠতেই হতাশ হলাম। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী জানালেন যে, শুনানি দুপুর দুটো পর্যন্ত মুলতবি থাকবে, কারণ ‘মহামহিম’ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্বয়ং আসবেন জামিনের বিরোধিতা করতে। আর তার অভিপ্রায় উপেক্ষা করবে এমন ক্ষমতা কার? সরকার আমার মতো এক নগণ্য নাগরিককে এতখানি সম্মান দেয়ায় পুলকিত বোধ করলাম। আমার আইনজীবীরা দেখলাম খুবই আত্মবিশ্বাসী। সরকারের দায়ের করা মামলা এতই বানোয়াট যে পাঁচ মিনিটে জামিন হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বাইরে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গঠিত বাংলাদেশের ‘স্বাধীন’ আদালত, যেখানে বেছে বেছে ‘সেরা’ ব্যক্তিদের ‘মাননীয়’ বিচারপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমি চাইলাম আর তারা জামিন আবেদন মঞ্জুর করে ফেললেন, এতখানি আশাবাদী হতে পারছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত বেলা আড়াইটায় শুনানি শুরু হলো। কোথায় গেল পাঁচ মিনিটে জামিনের আশাবাদ। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আমার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ যে কতটা মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হয়রানিমূলক এবং বেআইনি সেটা বিভিন্ন ধারা উল্লেখপূর্বক দীর্ঘক্ষণ ধরে বলেই যাচ্ছেন। আর মাননীয় বিচারকদ্বয়ের একজন স্মিতমুখে এবং অপরজন দৃষ্টি সামনের ফাইলে নিবদ্ধ করে বিষম গাম্ভীর্যের সঙ্গে অসীম ধৈর্যসহকারে সেই নিবেদন শুনেই যাচ্ছেন। মনে হলো তারা সামান্য জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নয়, মূল মামলার রায় যেন আজই দিয়ে ফেলবেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমার পক্ষের আইনজীবী থামলেন। এবার অ্যাটর্নি জেনারেলের পালা। ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার নিজস্ব রাজনৈতিক বাচনভঙ্গিতে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে আধ ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন, বিচারপতির সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত অপর এক ব্যক্তির চলমান মামলা সংক্রান্ত আলাপচারিতা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমিই নাকি মহা অপরাধ করে ফেলেছি যদিও হ্যাকিংয়ের সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পৃক্ততার প্রমাণ সরকারের কাছে নেই। সে সব বিষয় এখনও প্রাথমিক তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
বিচারপতির স্কাইপ সংলাপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কোনো বিচারপতির এই আচরণ আইনসম্মত কিনা, আদালত সেটি জানতে চাইলে বিব্রত অ্যাটর্নি জেনারেল আমতা আমতা করে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যানের পক্ষাবলম্বন করে কিছু একটা বলতে চাইলেন। আদালত কক্ষে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারছিলেন যে, অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তাছাড়া এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের আমার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন রুল দেয়া প্রসঙ্গেও অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো যুক্তি খাড়া করতে ব্যর্থ হলেন। সেই বেআইনি রুল অবশ্য আপিল বিভাগ ইতোমধ্যে স্থগিত করে দেয়ায় অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের পক্ষে তার বিরোধিতা করাও সম্ভব হয়নি। বক্তব্যের শেষে তিনি আমার আদালত অবমাননার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্তির পুরনো প্রসঙ্গ তুলে জামিন দেয়ার বিরোধিতা করলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের আর্গুমেন্টে আমি কৌতুক বোধ করছিলাম। আমার বিরুদ্ধে মামলার ধারা হলো রাষ্ট্রদ্রোহের, আর তিনি তুলছেন আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ।
অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে আমার জামিন আবেদন দাখিল নিয়েও অসত্য বক্তব্য দিলেন। আমার বিরুদ্ধে সরকার ১৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে মামলা দায়ের করলে আমি পরবর্তী কার্যদিবস অর্থাত্ সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন দাখিল করি। অথচ অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম অম্লান বদনে দাবি করলেন, আমি নাকি ইচ্ছা করে ৮ জানুয়ারি জামিনের আবেদন করে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। দুই পক্ষের সওয়াল-জবাব শেষ হলে আদালতের আদেশ দেয়ার পালা। আদেশ শুনে আদালতে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত।
আমার মামলাটি নাকি এতই জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ যে, আদালত তাদের চেয়েও সিনিয়র কোনো বেঞ্চে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তালিকার মামলা দীর্ঘ দুই ঘণ্টা শুনানির পর উচ্চ আদালতের এমন আদেশ নজিরবিহীন। হাইকোর্টের বেঞ্চের এখতিয়ার সিনিয়র-জুনিয়র বিবেচনা করে নির্ধারিত হয় না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী সেটি নির্ধারণ করে দেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাভভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন অন্তত পরবর্তী বেঞ্চে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে যেন পুলিশ হয়রানি না করে এ ধরনের একটি মৌখিক আদেশ প্রদানের জন্য। কিন্তু আদালত সেই অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে শুধু বললেন, আমরা দুঃখিত। পীড়াপীড়ি করে তাদেরকে আর বিব্রত না করারও অনুরোধ করলেন। এদিকে আদালতের সময়ও ততক্ষণে প্রায় শেষ। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলীর তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ওই আদালত থেকে ছুটে বেরিয়ে আমাকে এক রকম টানতে টানতেই নিয়ে গেলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে। দুই মাননীয় বিচারপতি সেই মুহূর্তে অন্য একটি মামলা শুনছিলেন। শুনানির মাঝখানে কিছুটা প্রথা ভেঙেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আমাদের অসহায় অবস্থার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। দৃশ্যত বিরক্ত হয়েই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী বললেন, আপনাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, শুনানি যেটা চলছে শেষ হতে দিন, তারপর না হয় আপনাদের কথা শুনব। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শুনানি শেষ হলে আদালত আমার পক্ষের আইনজীবীর কথা শুনতে চাইলেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী উত্তেজনা ও হতাশা যথাসম্ভব চেপে রেখে অতি সংক্ষেপে পূর্ববর্তী বেঞ্চের কাহিনী বর্ণনা করলেন। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী সঠিকভাবেই আদালতের নিয়ম-কানুনের উল্লেখ করে দুই সিনিয়র আইনজীবীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এভাবে হঠাত্ করে তাদের পক্ষে কোনো মামলা শোনা সম্ভব নয়। তালিকাভুক্ত কোনো মামলার আবেদন নিয়ে অন্য বেঞ্চে যাওয়ার আগে অবশ্যই প্রথমে আদালতের লিখিত আদেশ নিয়ে আসতে হবে। আমাকে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর আদালতে অপেক্ষা করতে বলে আমার অত্যন্ত শুভানুধ্যায়ী আইনজীবীদ্বয় আবার ছুটলেন বিচারপতি কামরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে। আমি ভাবলাম হয়তো আজই দ্বিতীয় আদালতে আবেদন পেশের সুযোগ পাব। প্রত্যাশা করছিলাম প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদের ফেরা পর্যন্ত নিশ্চয়ই বিচারপতিরা অপেক্ষা করবেন। আদালত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের তখনও বাকি ছিল। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক চারটা বাজতেই বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এত দ্রুততার সঙ্গে বেঞ্চ থেকে নেমে গেলেন যে, আমার ভয় হচ্ছিল মাননীয় বিচারপতিরা না আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আঘাত পান। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন বিএনপি সমর্থক নবীন আইনজীবী ছিলেন। বিচারপতিদের এজলাস থেকে নেমে যাওয়ায় তাদের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট হতাশার চিহ্ন দেখলাম। বেচারাদের চোখ বলছিল আমার গ্রেফতার বোধহয় আর ঠেকানো গেল না। কেন জানি না এইসব কাজ-কারবারে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল। আদালতে হাসা বারণ, কারণ তাতে আবার আদালত অবমাননা হয়। দ্রুত হাসি গিলে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই পত্রিকা অফিসে ফিরব। কিন্তু, নাছোড়বান্দা শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকটা জোর করেই আমাকে বার প্রেসিডেন্টের অফিসে নিয়ে তুললো। পাঁচ মিনিটের বেশি অবশ্য সেখানে ছিলাম না।
লোকজন পরামর্শ দিচ্ছিল রাতের মতো কোনো এক আইনজীবীর কক্ষে পালিয়ে থাকতে। তাদের তখনও আশা পরদিন নিশ্চয়ই কোনো একটা আদালত আমার আবেদন শুনবেন। পরামর্শ শুনেই ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। তরুণ ব্যারিস্টার কায়সার কামালকে বেশ উচ্চস্বরেই বললাম, তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমি রাজনীতিবিদ কিংবা আইনজীবী নই। অনেকের মতো, মধ্যরাতে চুপিসারে আদালতে ঢোকা কিংবা ছদ্মবেশ ধারণ করা ইত্যাদি কাজ-কর্মে আমি মোটেই অভ্যস্ত নই। অনেকটা ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন অগুনতি ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে রয়েছে। সেগুলো দুই হাতে ঠেলে পথ করে নিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে দেখি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান অপেক্ষমাণ। কোনো কথা না বলে আমাকে অনুসরণের ইশারা করে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। আমার এক সহকর্মীকে বললাম গাড়ি খুঁজে বের করতে। চকিতে চারদিকে চেয়ে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ দেখতে পেলেও পোশাকধারী কাউকে না দেখে অবাকই হলাম। বুঝলাম প্রশাসনও সম্ভবত ঘটনার এই আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
অনেকটা নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো গাড়িতে উঠলাম। পেছনে আমি এবং আমার দেশ-এর রিপোর্টার মাহবুব ও বাছির জামাল। সামনের সিটে আদিলুর রহমান খান। কুড়ি বছর ধরে আমার গাড়িচালক বাদলকে বললাম সোজা কারওয়ান বাজার যেতে। আদিলকে বললাম রাস্তায় গ্রেফতার হলে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সেই ঘটনার সাক্ষী থাকতে। গাড়ি থেকে স্ত্রীকে ফোন করে সারাদিনের ঘটনা জানালাম। সৌভাগ্যক্রমে অন্যান্য দিনের তুলনায় রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা লাগলো। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় ভবনের চত্বরে। ততক্ষণে আমার সব সহকর্মী সাংবাদিক ১১ তলার অফিস ছেড়ে নিচে নেমে এসেছে। আমি হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামতেই একটা হর্ষধ্বনি উঠলো। অপেক্ষমাণ লিফটে চড়ে পৌঁছে গেলাম আমার দেশ কার্যালয়ে। সকাল সাড়ে আটটায় যে অবরুদ্ধ জীবন ছেড়ে গিয়েছিলাম আদালতে ন্যায়বিচারের অলীক প্রত্যাশায়, বিকাল পাঁচটার মধ্যে সেখানেই আমার প্রত্যাবর্তন ঘটলো। বাংলাদেশে কথিত আইনের শাসনের অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা দিনভর সঞ্চয় হলো।
এতদিন জানতাম জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তির জন্যই জনগণ উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চের আজকের আদেশ শোনার পর থেকেই একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা যে মামলার গুরুত্ব ও জটিলতার কারণে কোনোরকম আদেশ দিতে বিব্রত হন, সেই মামলার বিচারকার্য সিএমএম কিংবা জেলা জজ আদালতের মতো নিম্ন আদালতে তাহলে কেমন করে চলবে, এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে খুঁজব? সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের সব বেঞ্চই যে আমার প্রতি একই রকম আচরণ করবেন না, তারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়? আজই তো দুটো বেঞ্চে ছুটোছুটি করেও ন্যায়বিচার অধরাই থেকে গেল।
আদালতের ৮ তারিখের রোমাঞ্চকর গল্প শেষ হলো। এবার আমার মামলা জনগণের আদালতে পেশ করার পালা। তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার যে আমি পাবই, এ নিয়ে আমার মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। সপ্তাহ তিনেক আগে ‘এক অবরুদ্ধ চান্স সম্পাদকের জবানবন্দী’ শিরোনামে মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখেছিলাম। সেই লেখায় সরকারের এই দেশদ্রোহ মামলার খানিকটা বিবরণ ছিল। দুই কিস্তির বর্তমান মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রসঙ্গক্রমে সেখানকার কিছু তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলে পাঠকের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
(দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি আগামী বুধবার)
admahmudrahman@gmail.com

উচ্চআদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও আমাদের গন্তব্য


অলিউল্লাহ নোমান, যুক্তরাজ্য থেকে




জরুরি অবস্থার মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের উত্তরসূরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জোট সরকারের বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রায় এক মাস ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। আমার অভিভাবক ও দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান অফিসে দিন-রাত কাটাচ্ছেন। তারই উদ্যোগে ও নির্দেশে আমাকে অফিস থেকেই তাত্ক্ষণিক দেশের বাইরে চলে আসতে হলো। সম্পাদক মহোদয় অফিসবন্দী আর আমি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে। কারণ একটাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার ঘনিষ্ঠ ঘাদানিক নেতা ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ করা। সম্পাদক মহোদয় দায়িত্ব নিয়ে এটা প্রকাশ করেছেন। তার মতো সত্য প্রকাশে অদম্য সাহসী সম্পাদক ছাড়া এ রিপোর্ট প্রকাশ করা কারও পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তার মতো সত্য প্রকাশে অদম্য সাহসী ও দায়িত্বশীল সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করতে পারাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার সাংবাদিকতা জীবনে বিচার বিভাগ নিয়ে রিপোর্টিংয়ের শুরু থেকেই যেসব অন্যায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছার কারণে ছাপতে পারতাম না তখন আল্লাহর কাছে একজন সাহসী সম্পাদকের অধীনে কাজ করার কামনা করতাম। অবশেষে আল্লাহ আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যিনি সত্যিকারের অভিভাকের ভূমিকায় থেকে অদম্য সাহস নিয়ে সত্য প্রকাশ করছেন। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন থেকে যখনই তার সঙ্গে কথা হয় একটা বিষয় সব সময় বলেন, সেটা হলো তার ভাষায়—‘তোমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পেরে আমি দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আমার যা হয় হবে, অন্তত তোমাকে নিরাপদে রাখতে পেরেছি।’ তার মুখ থেকে প্রতিদিনই যখন একথাগুলো শুনি তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। সত্যি একজন প্রকৃত অভিভাবক তিনি। আমি নির্বাসিত জীবনে রওয়ানা দেয়ার এক সেকেন্ড আগেও জানতাম না তিনি আমার বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাকে ডেকে নিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন পাসপোর্টে কোনো দেশের ভিসা আছে কিনা। যুক্তরাজ্যের মাল্টিপল ভিসা আমার পাসপোর্টে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি টিকিট করার জন্য পত্রিকার জিএম জিল্লুর ভাইকে নির্দেশ দিলেন। বাসা থেকে পাসপোর্ট আনানোর জন্য বললেন আমাকে। বিকাল ৩টায় একথা বলার পর সন্ধ্যার ফ্লাইটে রওয়ানা। তার সামনে আমি চোখের পানি ফেলে কাঁদলাম। তাকে ছেড়ে আসতে আমার ইচ্ছা ছিল না। তিনি আমার কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। শুধু বললেন—‘তোমার জীবন রক্ষা হোক সেটা আমি চাই। আগে তোমার জীবন রক্ষা কর, তারপর যা হবে হোক।’ তার এ কথার উপর আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। নিজের জীবন অফিসবন্দী রেখে সহকর্মীকে নিরাপদে দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করার হিম্মত কতজন সম্পাদকের রয়েছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
আমার আরেকটি রিপোর্টের জন্য দু’জনেরই দণ্ড হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্ট আমাকে এক মাসের কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং সম্পাদক মহোদয়কে ৬ মাসের কারাদণ্ডসহ ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। জরিমানা অনাদায়ে আমাকে অতিরিক্ত ৭ দিন এবং সম্পাদক মহোদয়কে অতিরিক্ত একমাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল। কারণ আমরা কেউ জরিমানা পরিশোধ করিনি। আমরা মনে করি অন্যায়ভাবে সুপ্রিমকোর্ট আমাদের এই জেল ও জরিমানা আরোপ করেছে। আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট এই রায় দিয়েছিল। এছাড়া রায় দেয়ার আগে শুনানির সময় সুপ্রিমকোর্ট বলেছিল—‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। এ কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সঙ্গে আরও বলেছিল—‘সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আমরা এখানে বসিনি।’ সেদিন আমাদের প্রকাশিত রিপোর্টের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করলে সুপ্রিমকোর্ট এ মন্তব্যগুলো করে। সুপ্রিমকোর্টের এমন মন্তব্যে সেদিন গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। অন্তত, সুপ্রিমকোর্ট স্বীকার করে নিল যে আমাদের রিপোর্ট সত্য। সেদিন আমার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলাম সত্য প্রকাশ করে কারাগারে যাওয়াও গর্বের বিষয়। ছোট বেলায় হাতের লেখায় কত লিখেছি ‘সদা সত্য কথা বলবে’। আমাদের দণ্ড দেয়ার আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুনলাম ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। সত্য মানুষকে রক্ষা করতে পারে না, সেটাই জানালেন আমাদের উচ্চ আদালত।
এই সূত্র ধরে পাঠকের আদালতে প্রশ্ন রেখে বলতে চাই—যে দেশের সুপ্রিমকোর্টে সত্য ডিফেন্স হিসেবে কাজ করে না, সেই দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু আছে কিনা সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন।
আমাদের বিচার ব্যবস্থা কতটা আজ্ঞাবহ সেটা প্রমাণ করতে হলে বেশিদূর যাওয়ার দরকার হয় না। আমি নির্বাসনে থাকা অবস্থায় এ দেশের গণমানুষের প্রিয় সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই জামিনের আবেদন শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ দিন ধার্য করে। ২ জানুয়ারি আবেদনটি পেশ করা হলে ৮ জানুয়ারি শুনানি গ্রহণের জন্য ধার্য করে হাইকোর্ট বেঞ্চ। ধার্য তারিখে দুই ঘণ্টার বেশি শুনানি হয়। দুই ঘণ্টা শুনানি গ্রহণের পর আদালত জটিল বিষয় বলে আবেদনটি ফেরত দেয়। একই সঙ্গে ‘সরি’ বলে অন্য কোনো বেঞ্চে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে জটিল বিষয় বলেই তো উচ্চ আদালতে যায় মানুষ। জটিল বিষয় না হলে মানুষ উচ্চ আদালতে যাবে কেন? এমনকি সাংবিধানিক কোনো বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে এর ব্যাখ্যা দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের। এর আগে আরও জটিল বিষয় নিয়ে মানুষকে উচ্চ আদালতে যেতে দেখেছি। উচ্চ আদালত বিচার-বিশ্লেষণ করে সংবিধান ও আইনের আওতায় আদেশ বা রায় দেবেন এটাই নিয়ম। জটিল বিষয় বলে একটি বেঞ্চ কোনো আদেশ দিলেন না। সমান এখতিয়ার প্রাপ্ত আরেকটি বেঞ্চ আদেশ দেবেন কেমন করে!
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করে পারছি না। ২০০০ সালের ঘটনা। দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে একসঙ্গে বিভিন্ন থানায় ২৪টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল। তখনও ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকার। সেই মামলাগুলোতে জামিনের জন্য দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন। দুটি বেঞ্চ জামিনের আবেদন শুনানি করতে বিব্রতবোধ করে। এতে তৃতীয় আরেকটি বেঞ্চে যাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেদিনও সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে রেখেছিল পুলিশ। ইনকিলাব সম্পাদক বের হলেই গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সুপ্রিমকোর্ট থেকে জামিন নিয়েই বের হয়ে আসেন। প্রধান বিচারপতি সন্ধ্যার পর তৃতীয় একটি বেঞ্চকে দায়িত্ব দেন রাতেই বিষয়টি শুনানি গ্রহণের জন্য। রাত ১০টার পর একটি বেঞ্চ বসে। প্রথম একজন বিচারপতির বাড়িতে আদালত বসানোর কথা বলা হয়েছিল। তখন জানানো হয় জামিন অবেদনকারী হাইকোর্টের ভেতর রয়েছেন। বের হলেই তাকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা রয়েছে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুই বিচারপতি হাইকোর্টে আসেন। সেখানে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি শেষে জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়া হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে ইনকিলাব সম্পাদক হাইকোর্ট থেকে বের হয়েছিলেন। এবার দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণের পর কোনো আদেশই দিলেন না। আদালত ‘সরি’ বললেন। পৃথিবীর কোনো দেশের উচ্চ আদালতে এমন ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই।
এই লেখাটি লিখতে বসে আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিএম বাকের হোসেনের কারাগারে মৃত্যুর পর শুনানিতে ব্যারিস্টার রফিক উল হকের একটি মন্তব্য। বাকের হোসেনের মৃত্যুর পর তার জামিনের আবেদন সুপ্রিমকোর্টের শুনানির তালিকায় এসেছিল। ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগের বিচারপতিদের উদ্দেশ করে সেদিন বলেছিলেন—‘আপনাদের আর জামিন আবেদন শুনতে হবে না। আল্লাহ তাকে চিরদিনের জন্য জামিন দিয়েছেন।’ বিএম বাকের হোসেন কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার গুরুতর অসুস্থতার বিষয়টি জানিয়ে আপিল বিভাগে জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। কারণ তার মামলাটি ছিল তখন আপিল বিভাগের এখতিয়ারে। আপিল বিভাগ ব্যারিস্টার রফিক উল হককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—এত গুরুতর অবস্থা থাকলে সেটা তো আমাদের সেদিন বলেননি। জবাবে ব্যারিস্টার রফিক উল হক আপিল বিভাগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—‘আপনারা আমার আবেদনটি সেদিন পড়ারও প্রয়োজন মনে করেননি। আবেদনটি নথিতে রয়েছে, এখনও পড়ে দেখেন। আবেদনে সবকিছু বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। আপনারা আবেদনটি না পড়েই সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের মুখের কথা শুনে এক সপ্তাহ পর শুনানির দিন ধার্য করলেন। আপনারা আমাদের আবেদন পড়বেনও না, অ্যাটর্নি জেনারেলের কথা শুনে আদেশ দেবেন। এখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ সেদিন সৌভাগ্যক্রমে উপস্থিত থেকে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও আদালতের এই বক্তব্যগুলো শোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। শুধু তাই নয়, বাকের হোসেনকে যে মামলায় আপিল বিভাগ জামিন নামঞ্জুর করে জেলে আটক রেখেছিল একই মামলায় অন্য আসামিদের জামিন দিয়েছিল। বাকের হোসেনের পরিচয় তিনি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল করেন। এজন্য তার জামিন হয়নি। এরকম উদাহরণ দিলে বহু দেয়া যাবে। ক্ষুদ্র সাংবাদিকতা জীবনে প্রায় এক দশক উচ্চ আদালতের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে। আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রেখেই বলতে চাই, পর্যায়ক্রমে দলীয়করণের কড়াল গ্রাসে নিমজ্জিত আমাদের সুপ্রিমকোর্ট।
বিচারপতিরা দায়িত্ব নেয়ার আগে একটি শপথ নেন। তাদের শপথের মধ্যে রয়েছে অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। বিচারপতিরা কতটা অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, তা আমরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি আপিল বিভাগে আমাদের আদালত অবমাননা মামলার শুনানি ও রায়ে।
সবশেষে যেটা উল্লেখ করতে চাই—সবাই বলেন, উচ্চআদালত হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। একটি দেশের বিচার ব্যবস্থায় যদি দলীয়করণ হয়, মানুষের আস্থা যদি বিচার বিভাগ থেকে উঠে যায়, সেই দেশের ভবিষ্যত্ কোনদিকে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। আদালতের ওপর থেকে গণমানুষের আস্থা চলে গেলে সেই দেশে নৈরাজ্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি?

বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে কী কারণে আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনছে?


ব দ রু দ্দী ন উ ম র




প্রধানমন্ত্রী তার রাশিয়া সফরে গিয়ে ১৫ জানুয়ারি তাদের সঙ্গে এক বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকার এক অস্ত্র ক্রয়চুক্তি করেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী সরকার সামরিক বাহিনীর জন্য নানা ধরনের অস্ত্র আমদানি করবে। এর জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। এই ঋণের সুদসহ অন্য শর্ত সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট আজকের (১৬.১.১৩) সংবাদপত্রে না থাকলেও আগের কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, সুদের হার বেশ উঁচুই রাখা হয়েছে। মোট কথা, ঋণ নিয়ে আট হাজার কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া থেকে কেনার ব্যবস্থা এখন চূড়ান্ত করেছে। এছাড়া তারা রাশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্যও চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই বর্তমান বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল।
বাংলাদেশ যে এভাবে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিষ্প্রয়োজনে অস্ত্র কিনছে এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করে দেশ ও জনগণের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে, এটা কোনো অবহেলা বা অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। শুধু রাশিয়ার সঙ্গে এই অস্ত্র ও ঋণচুক্তিই নয়, একইভাবে মাত্র কিছুদিন আগে এরা চীন থেকেও ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকেও তারা সামরিক জিনিসপত্র কিনেছে। এসব ব্যয় জোড়া দিলে যে পরিমাণ দাঁড়ায় সেটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অঙ্ক। তার থেকেও বড় কথা এই ব্যয় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।
আমরা এর আগেও বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয় সম্পর্কে বলেছি যে, দেশ রক্ষার নামে যে ব্যয় করা হয় এবং ক্রমাগত যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয় তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যৌক্তিকতা নেই এ কারণে যে, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে আক্রমণ করার মতো কোনো দেশ এর চারপাশে নেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে আসবে এমন কোনো দেশও নেই। কাজেই অন্য দেশের আক্রমণ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ যে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছে তা অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয়। কিন্তু যতই অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজনীয় হোক, এই ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বেপরোয়াভাবে করেই চলেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এখন রাশিয়া গিয়ে যে চুক্তি করেছেন এটা এই ধরনের অপচয়েরই এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। ভারত বাংলাদেশ সরকারের পরম বন্ধু দেশ। নেপাল ও ভুটানের পক্ষে বাংলাদেশ আক্রমণের চিন্তা উন্মাদের ব্যাপার। মিয়ানমারের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও সেটা এমন নয় যে, তার ফলে মিয়ানমার সামরিকভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো দেশও নেই যাদের দ্বারা দূর থেকে এসে বাংলাদেশের ওপর সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা। তাহলে কার থেকে দেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এত বিশাল ও বেপরোয়া অস্ত্র মজুত প্রয়োজন? এই শত্রুর কোনো কথা, কোনো পরিচয় বাংলাদেশ সরকারের থেকেও শোনা যায় না।
তবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শুধু বাইরের শক্তিই নয়, দেশের ভেতরের শক্তিরও মোকাবিলা করতে হয়। শাসক শ্রেণী যাদের শোষণ করে, যাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে সমগ্র শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে, তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরকেও মনে করে নিজেদের শাসন ক্ষমতার বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ। এ কারণে তাদের দমন করার জন্যও প্রয়োজন হয় বলপ্রয়োগের। এই বলপ্রয়োগ বাস্তবত করাও হয়ে থাকে যা আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানেও কথা আছে। জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের জন্য যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তার থেকেও অনেক বেশি এখন সরকারের হাতে আছে। অস্ত্র শুধু এখনই কেনা হচ্ছে না। নিয়মিতভাবে অস্ত্র কিনে সরকারের অস্ত্রভাণ্ডার ভরপুর করে রাখা হয়েছে। এদিক দিয়েও বর্তমান অস্ত্র ক্রয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। অথচ এই অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারটি এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয় এটা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট অর্জন এবং বিজয়!
এখানে অবশ্যই বলা দরকার, এই অস্ত্র ক্রয় এমন সময়ে হচ্ছে যখন ঢাকার রাস্তায় গরিব শিক্ষকরা সামান্য বেতন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন। আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় অস্ত্র কেনার জন্য সরকার চড়া সুদে রাশিয়া থেকে ধার করছে, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য সামান্য ব্যয়ের ক্ষমতা সরকারের নেই! তাদের মাসিক বেতন নিশ্চিত করার জন্য এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে নামা, অনশন করাও তাদের মস্ত অপরাধ!! এই ‘অপরাধের’ জন্য সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, তাদের শরীরে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছে, তাদের ওপর গরম পানি স্প্রে করছে!!! এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, ভোট পেয়ে কেউ ক্ষমতায় গেলে সে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হবে এমন কথা নেই। শুধু তা-ই নয়, এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার চরিত্র এমন যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধি ও তাদের বন্ধু নয়, বরং শত্রুরাই ক্ষমতাসীন হয়?
বাংলাদেশ সরকার যখনই কোনো বড় প্রকল্প ও বিশাল আকারে কিছু কেনার জন্য কোনো বিদেশি সরকার বা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তখনই তার সঙ্গে দুর্নীতি জড়িত থাকে। অস্ত্র ক্রয় এর মধ্যে একটি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট ও বিমানবাহিনীর জন্য মিগ কেনার সময় দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়ে আদালতকে দিয়ে খারিজ করিয়ে নেন। এখন রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কেনার জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং থাকলে তার পরিমাণ কত এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। শুধু এই অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেই নয়, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়েছে সে ক্ষেত্রেও কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটাও দেখা দরকার। কারণ বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী এই প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (pre-feasibility study) জন্য একশ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়! অথচ এই বাবত ঋণ নেয়া হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা!! এর থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে জনগণের সম্পদ কী পরিমাণে লুটপাট ও অপব্যয় হচ্ছে এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপরাধীকীকরণ (criminalisation) ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশে আজ যতই উন্নতির কথা বলা হোক, এ দেশের জনগণের জীবন এখন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার কারণে বিপর্যস্ত। চিকিত্সা এতই ব্যয়সাপেক্ষ যে সাধারণ মানুষ, শতকরা আশিভাগ মানুষের সুচিকিত্সার কোনো সুযোগ ও ব্যবস্থা নেই। এই শীতের মধ্যে গরিবদের কোনো শীতবস্ত্র নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও পুষ্টির অভাবে গরিবদের মধ্যে নানা ধরনের কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাব। শহরে হাজার হাজার বাড়ি টাকাওয়ালা লোকদের থাকলেও লাখ লাখ মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বস্তিতে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের কোনো বিশুদ্ধ পানীয়জল নেই, স্যানিটারি ব্যবস্থা নেই, একই ঘরে গাদাগাদি করে তাঁদের দিনরাত্রি যাপন। এসবই বাস্তব ব্যাপার। গরিবদের স্কুলের গরিব শিক্ষকদের কী অবস্থা এটা আগেই বলা হয়েছে। এসব দিকে সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। তাদের অবস্থা দেখে এবং বড় বড় হামবড়া কথাবার্তা শুনে বোঝাই যায় যে, এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, তাদের কোনো করণীয় নেই। তারা শুধু নিজেদের, নিজেদের পরিবার ও দলীয় লোক এবং আত্মীয়স্বজনের পকেটভর্তি করতেই ব্যস্ত। এ কারণে তারা যা-ই করে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে দুর্নীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার শেষ সময়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় এবং রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করেছে, যে বিশাল ঋণের বোঝা দেশের জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে কী পরিমাণ দুর্নীতি জড়িত আছে, এর তদন্ত অবশ্যই হওয়া দরকার।

১৬.১.২০১৩

লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বহীন ভাষণ


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম




নতুন বছর ভালো যাবে—এমনটা সবাই চায়। নতুন বছরের প্রথমেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটু দেরি করে ১১ জানুয়ারি তিনি তার সালতামামি জাতির উদ্দেশে উপস্থাপন করেছেন। চারদিকে সমস্যাক্রান্ত একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে তার ভাষণে যতটা জাতীয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা, তাকে যতটা ধীরস্থির-উদ্বিগ্ন থাকা দরকার, তার কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি। সভা-সমাবেশে তিনি যে রঙে-ঢঙে কথা বলেন বরং সেদিন তারচেয়েও শক্তভাবে তিনি তার ভাষণ দিয়েছেন। বহুদিন পর তার ভাষণ শুনে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জাতির উদ্দেশে ভাষণের একই সুর-তাল-লয় কানে বাজছিল। তার ভাষণে তিনি কোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত করেননি। হয় জাতি তার কাছে কোনো কিছুই নয় অথবা খুবই সুকৌশলে সংঘাত জিইয়ে রাখার জন্য সমস্যাগুলোর সমাধানের সামান্যতম আভাসও দেননি। ক্ষমতার গরমে বেসামাল পতিত শাসকদের অতীতের কীর্তিকলাপ যখন যেখানে যা দেখা গেছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাল-চলনে-বলনে কোনো পার্থক্য নেই। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে—এসবই দলীয় স্বার্থে সৃষ্টি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার সমর্থন চেয়েছেন, ভোট চেয়েছেন। নির্বাচনী আইনে সব প্রার্থীর একই সমান সুযোগ পাওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রচারযন্ত্রে বা অর্থে ভোটের ক্যানভাস করতে পারেন না। বর্তমান নীতিমালা অনুসারে এটা বিশুদ্ধ নয়। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফেরাবে কে? একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি তাকে বুঝ দেন, তা না হলে তাকে বোঝাবার ক্ষমতা এ জগতসংসারে যে কারও নেই—এটা তিনি এরই মধ্যে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধানের লেখা অনুসারে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু জনগণের সে কি দুর্ভাগ্য—দেশের প্রধান সেবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন কোথাও যান, মালিকদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ, চলাফেরা বন্ধ, রাস্তাঘাট বন্ধ। সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এদিক-সেদিক যান, দু’ঘণ্টা আগে থেকে সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন বলাবলি করে—ঢাকা শহরের অর্ধেক যানজটের কারণ নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জানি না জনগণের ভোটে, জনগণের সেবায় নিয়োজিত একজন প্রধানমন্ত্রীর চলাফেরার সময় এভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাখা কতটা সংবিধানসম্মত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সবকিছুই জানেন। তা যদি জানেন, তাহলে তার চলাফেরার সময় প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা আগে থেকে রাস্তা বন্ধ থাকে—তা কি তিনি জানে না? তিনি যেদিক যান, সেদিকে তো বিড়ম্বনার শেষ নেই-ই। লিঙ্ক রোডগুলোর মুখ বন্ধ থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও দু’তিন ঘণ্টা ভোগান্তি ভুগতে হয়। ঘ্যাগের ওপর তারাবাত্তি’র মতো বছরখানেক তো হলো মিরপুর রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের (গণভবন) আশপাশ দিয়ে রাত ১১টার পর সব গাড়ি চলাচল বন্ধ। দেশের মালিক চলতে পারে না সেবকের বাড়ির কাছ দিয়ে, রাস্তা বন্ধ! প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান কার্যকলাপ দেখে আমার পুরনো দু’একটি কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজের সামনে ছিল কালিদাস রায়দের বাড়ি। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্ম হয়েছে। কালিদাস রায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক, পরাক্রমশালী জমিদার। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ সাইকেলে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারত না, ছাতা মাথায় দিতে পারত না আভিজাত্যের কারণে। কিন্তু সেই জমিদারের বংশধরদের করুণ দুর্দিন আমি দেখেছি। বেশি দূরে যেতে হবে কেন? ১৯৫০-৫৫ সালের দিকেও শত শত কোটি টাকার মালিক রণদা প্রসাদ সাহা করটিয়া জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়িতে চড়ে যেতে পারতেন না। করটিয়া বাজারের কাছে এসে কিছুদূর পায়ে হেঁটে তারপর আবার গাড়িতে উঠতেন। ছোটবেলায় কারণ বুঝতাম না। বুদ্ধি হলে বুঝলাম রণদা প্রসাদ সাহা নিম্ন জাতি ও এক সময় গরিব ছিলেন। আর করটিয়ার জমিদাররা সম্ভ্রান্ত, তাই তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না! বর্তমানে রণদা প্রসাদ সাহারও সেই জৌলুস, সেই খ্যাতি নেই। কিন্তু দানবীর মানবহিতৈষী করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অযোগ্য বংশধরদের দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তাদের এখন করুণ দশার শেষ নেই। দু’একজন যারা লেখাপড়া শিখেছেন, তারা অন্যের দুয়ারে চাকরি করে খান; জমিদারি চলে না, মর্যাদাবোধও নেই।
যা বলছিলাম, তাই বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দক্ষিণে বিশাল ক্রিসেন্ট রোড ১১টার পর বন্ধ। পশ্চিমে গা ঘেঁষে মিরপুর রোড। ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারলেও গাবতলী থেকে আড়ং বা মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পৌঁছতে কখনও আধঘণ্টা, কখনও দু’ঘণ্টার প্রয়োজন। দূরত্ব বড়জোর দু’তিন কিলোমিটার। সেখানে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো রাত ১১টায় দুমুখী রাস্তার এক মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। মিরপুর থেকে ঢাকার দিকে যেই মাত্র সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, সেই মাত্র মহাযানজটের কারণ ঘটে। ঢাকার দিক থেকে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি শ্যামলীর কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে পার হতে না পেরে দিন-রাত এক যানজটের সৃষ্টি হয়। তার ওপর রাত ১১টায় যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছাকাছি এলে দক্ষিণ দিকে বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন এক অমানবিক দুর্যোগের কারণ ঘটে। রাতে সৃষ্টি হওয়া যানজট সকালেও শেষ হয় না। কত রোগী ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে রাস্তায় আটকে পড়ে মারা যায়। আবার কত লাশ ঢাকা থেকে গ্রামে নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে সৃষ্ট যানজটে বাড়ি পৌঁছতে পারে না। ১২ জানুয়ারি সখীপুরের বাঘবেড়ে এক জনসভা করতে গিয়েছিলাম। বিপুল লোকের সমাগম হয়েছিল সে সভায়। তবে সখীপুর এবং অন্যান্য স্থানে জনসভায় যে পরিমাণ মেয়েরা আসত, তত মহিলার সমাগম হয়নি। হয় আমাদের আকর্ষণ নষ্ট হয়ে গেছে, না হয় কর্মীরা মহিলাদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারছে না কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গ্রাম-গঞ্জের মা-বোনরা দেশের প্রতি, দেশের কথা শোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সখীপুরের বাঘবেড় থেকে রওনা হয়েছিলাম ৫টা ১০ মিনিটে। ৭টা ৫০ মিনিটে উল্টো পাশ দিয়ে আমিনবাজার মসজিদের কাছাকাছি এসেছিলাম। সামনে বিকল গাড়ি থাকায় এমন এক বিশ্রী অবস্থায় পড়েছিলাম; ১ ঘণ্টায় ১ ইঞ্চিও আগপিছ হতে পারিনি। পুরনো ড্রাইভার শাহ আলম হঠাত্ বলল—পেছনে খালি হয়েছে, আমরা কি ঘুরে আবার ওই লেনে যাব। আল্লাহর অশেষ দয়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এক-দুই কিলোমিটার সাভারের দিকে গিয়ে রাইট ট্র্যাকে এসেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়; গাড়ি এগুচ্ছিল না। হঠাত্ এক মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত নাসিরের কথা মনে হলো। ওর এক ভাই যুদ্ধের সময় খুবই ছোট ছিল। দু’চারবার কোলেও উঠেছে। অনেক বছর সার্জেন্টের চাকরি করেছে। হঠাত্ করে আমার এক সহকর্মী তাকে ফোন করে কি যেন বলেছিল। এরই মধ্যে ফরিদের ফোন পেলাম, ‘দাদা আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘আমিনবাজারে ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।’ অনেক বছর ঢাকার ট্রাফিক কন্ট্রোল আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে। ও কি করে যেন ভিআইপি ট্রাফিক কন্ট্রোলের ডিসি-এডিসিকে ফোন করেছিল। সব সময়ই দেখছি বিরুদ্ধ মতবাদী ছাড়া সাধারণ কর্মচারী-কর্মকর্তারা সবাই দারুণ সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। তারা নাকি তাকে বলেছেন, যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেবেন। ওর কয়েক মিনিট পরই গাড়ি চলতে থাকল। কোথাও দ্রুত, কোথাও একটু ধীর কিন্তু এক জায়গায় ছাগলের খুঁটি মেরে আর দাঁড়িয়ে থাকছে না। মিরপুর ব্রিজের ওপরে হঠাত্ এক অপরিচিতের ফোন পেলাম, ‘স্যার আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘মিরপুর পুলের ওপর।’ তিনি বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা আপনাকে পার করে আনছি।’ মাঝে মাঝে ফোন আসতে থাকল। দু’একবার আমিও করলাম। আমিনবাজার মসজিদের কাছে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় ৪০-৪৫ মিনিটে বিজয়নগরের দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে গেলাম। আর ১০ মিনিট দেরি হলে ১২ তারিখ শনিবারের প্রোগ্রামটি করতে পারতাম না। আগে মনে হতো ‘সবার ওপরে দেশ’ বোধ হয় কেউ দেখে না। কিন্তু গত ক’মাস এত চিঠিপত্র, এত ফোন পাই; তাতে বিস্মিত না হয়ে পারি না। তাই প্রোগ্রামটি মিস হলে দর্শক-শ্রোতারা যেমন কষ্ট পেতেন, আমারও খারাপ লাগত। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ১২ তারিখের অতিথি। তার আবার বাংলা ভিশনে ১২টা কয়েক মিনিটে সরাসরি সম্প্রচার ছিল। তাই তারও তাড়া ছিল। এসব কারণে খুব বিব্রত ছিলাম। আমি সাধারণত সরকারি লোকের সরকারি কাজে খুব একটা খুশি হই না। মনে করি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু ১২ তারিখে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় দারুণ খুশি হয়েছি। সেজন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, তারা যেন শুধু আমাকে নয়, ছোট-বড়, ধনী-গরিব আমজনতাকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে সাহায্য করে।
সেই সকাল ৮টায় টাঙ্গাইল থেকে বেরিয়েছিলাম। সিলিমপুর-সখীপুর বাঘবেড় হয়ে রাত ১০টায় দিগন্ত টিভিতে গিয়েছিলাম। মিনিট দশেক লেগেছিল বিজয়নগর থেকে অত রাতে আসাদ গেটে আসতে। সেখানে এসেই মারাত্মক জ্বালা—প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা। তখন রাত ১১টা ৩ মিনিট। আসাদ গেট থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কত আর হবে, পাঁচশ’-ছয়শ’ গজ। এটুকু আসতেই দীর্ঘ ৫০ মিনিট লেগে গেল। বুকের ভেতর হুতাশ উঠেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমার জীবনের মনে হয় ৫০ বছর ধ্বংস হয়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগর গণভবনের কোথায় থাকেন, অন্যরা না জানলেও আমি জানি। রাস্তা থেকে তার ঘর বহু দূরে। বন্দুকের গুলিও তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছবে না। তাহলে জনগণের নেতা হয়ে এত ভয় কেন? মিরপুর রোডের এক পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে আর ২০-২৫ গজ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে গাড়ি-ঘোড়া চলাচল করলে কি ক্ষতি? পশ্চিমে মিরপুর রাস্তা থেকে তার অফিস এবং শোবার ঘর প্রায় চার-পাঁচশ’ গজ দূরে। আর মাত্র ২৫-৩০ গজ কাছে গিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চললে তার কি এমন ক্ষতি হতে পারে? কিন্তু এ সামান্য বাধায় হাজার হাজার মানুষের শত শত ঘণ্টা কর্মকাল নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণের ক্রিসেন্ট রোড থেকেও তার ঘর ৩০০ গজের কম দূরে নয়। কার ভয়ে, কি কারণে এসব রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? কারা এসব পরামর্শ দিয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তা কি আদৌ জানেন? না জেনে থাকলে একটু খোঁজ-খবর করে দেখুন না রাস্তাঘাটে মানুষজন কি সব বলাবলি করে। নিরপেক্ষ কোনো মাধ্যমে তার সামান্য কিছু জানলেও কষ্ট করে আমার এসব অপ্রিয় কথা বলতে হতো না।
গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন। বিপুল ভোটে মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়েছিল, তারই চতুর্থ বার্ষিকী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। সবকিছুতেই সাবেকরা বহাল। সরকারি দল, একটা কিছু দেখানো দরকার—দেশবাসীকে তারা তাই দেখিয়েছে। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ খুবই ছোট্ট দল। আমাদেরও ওইদিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। একসময় সবার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলাম, নাম-ঠিকানাসহ সর্বনিম্ন দশ টাকা। অসংখ্য কর্মী এবং দু’চারজন আগন্তুক নাম-ঠিকানাসহ দশ-বিশ-পঞ্চাশ-শ’-হাজার, এমনকি দশ হাজার টাকাও দিয়েছেন। তারচেয়েও বেশি দেয়া একজন সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লিডার, এভাবে দশ-বিশ টাকা সহযোগিতা নিয়ে আপনি দল চালাবেন কি করে?’ প্রশ্নটা শুনে বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অর্থ সংগ্রহ করত স্বেচ্ছাসেবক ইউনিয়ন কমান্ডাররা। হিসাব ছিল কঠিন। এক টাকা এদিক-ওদিক হলে শাস্তি। সাধারণ মানুষ দু’এক টাকা করে চাঁদা দিত। যারা চাঁদা সংগ্রহ করত, তারা পাগল হয়ে যেত। বিকালে দেখত অর্থের পরিমাণ তিন-চার বা পাঁচ হাজার টাকা। তার জন্য দু’একজনকে হয়তো জবাবদিহিও করতে হতো। এত লোক কিন্তু অর্থ এত কম কেন? আবার কোনো কোনো জায়গায় দেখা যেত ঝামেলাহীন, লোক কম। কিন্তু চাঁদার পরিমাণ বেশুমার। তাই স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররাই তাদের বাস্তব জ্ঞানে অল্প কিছুদিন পর থেকে দু’এক টাকা চাঁদা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দু’চার-পাঁচশ’-হাজার যারা দিতেন, তাই-ই সংগ্রহ করতেন। তাতে ঝামেলা কম, অর্থের পরিমাণ বেশি। এরকম এক সময় জুলাই মাসের প্রথম দিকে আক্কেল আলী সিকদারের নেতৃত্বে কালিয়াকৈরের ১৩০ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণ দেখার জন্য অনেক লোকসমাগম হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এক-দেড় হাজার তো হবেই। এক সহযোদ্ধা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা অনেক যুদ্ধ করেছে। দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাতে নিজেই গান বেঁধেছে, সুর করে শুনিয়েছে। সে যেন নতুন নতুন স্লোগানের স্রষ্টা। হঠাত্ করেই ‘বঙ্গবীর’ স্লোগান আবিষ্কার করে ফেলে। তাদের কাছে স্লোগানটি ভালো লাগলেও আমি খুব উত্সাহ পাইনি। থামিয়েও রেখেছিলাম অনেকদিন। পরে আর পারিনি। অস্ত্রসহ একদল রাজাকার সারেন্ডার করায় আমরা খুব ফুর্তিতে ছিলাম। সব অনুষ্ঠান শেষে জনতার উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়, হানাদারদের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা চিত্কার করে বলছিলাম। আমার বক্তৃতার মাঝে একজন সাধারণ মানুষ সভাস্থলে গর্জে উঠেছিল, ‘এই যে কাদের সিদ্দিকী, গরিবের টেহার মুক্তিগোরে দরকার আছে কি নাই? আইজ কইয়া যাওন লাগবো।’ প্রথমে আমি তেমন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররা হিসাবের ভয়ে গরিব মানুষের দু’এক টাকা এখন আর নেয় না। দু’দিন পরই সাইক্লোস্টাইল করে জানিয়ে দেয়া হলো, ইউনিয়ন পরিষদে ট্যাক্স দিলে মুক্তিবাহিনীর তহবিলে জমা হবে। যাদের ট্যাক্স নেই, তারাও এক টাকা থেকে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিতে পারবে। মাত্র বিশ দিনে তিরাশি লাখ টাকা উঠেছিল। আমরা চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছিলাম। তাতেও অর্ধেক টাকা বেঁচে গিয়েছিল। যে কারণে স্বাধীনতার পর গ্রাম-গঞ্জে আমার সম্মান ছিল আইয়ুব সরকারের চেয়েও বেশি। আইয়ুব সরকারও চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের একবারে বেতন দিতে পারেনি। ১০-১২ বছর বেতন বাকি ছিল। তাই সবাই ভাবত যুদ্ধ করেও আমি সব বেতন দিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।