আর কে চৌধুরী :
ঢাকা মহানগরীতে পানি সংকটের বিষয়টি নতুন নয়। তবে গ্রীষ্ম মওসুমে তা তীব্র আকার ধারণ করে থাকে। কোথাওবা দিনের পর দিন পানি থাকে না। সেক্ষেত্রে এলাকাবাসীর ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রশমনে ঢাকা ওয়াসা গাড়িতে করে পানি সরবরাহের চেষ্টা করে বটে, তবে তা নিতান্তই অপ্রতুল।
ওয়াসার পাম্প হাউসগুলো লোডশেডিংয়ের সময় অচল থাকায় বেশিরভাগ এলাকায় হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। লোডশেডিংয়ের সময় পাম্প হাউসগুলোর জেনারেটর চালিয়ে পানি উত্তোলনের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। পাম্প হাউসের জেনারেটরের জন্য যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয় তার সিংহভাগই পাচার হয়ে যায়। ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার কারণেই রাজধানীতে পানি সংকট সীমা অতিক্রম করতে চলেছে। পানি সংকটের পাশাপাশি সরবরাহকৃত পানির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওয়াসার পানি সরবরাহ করা হয় দুই পদ্ধতিতে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি পরিশোধন করে তা পাইপ লাইনে সরবরাহ করা হয়। শেষোক্ত পানির মান আদৌ সন্তোষজনক নয়। রাজধানীর এই দু'টি নদীর পানি দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত হওয়ায় পরিশোধনের পরও তাতে দুর্গন্ধ থাকে। মাটির নিচ থেকে পাম্পের মাধ্যমে যে পানি ওঠানো হয় তার মান অবশ্য সন্তোষজনক। রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট বিরাজ করায় দূষিত পানি ব্যবহারে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। শিশুরাই এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। গ্রীষ্মের দাবদাহে পানির চাহিদা থাকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় মানবিক সংকটের উদ্ভব ঘটছে।
রাজধানীতে পানি সংকট তীব্র হওয়ার মূলে রয়েছে, জনসংখ্যানুপাতে পানির সরবরাহ কম। দ্বিতীয়ত, ঘন ঘন লোডশেডিং। বর্তমানে মহানগরীতে পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এর অন্যতম কারণ ঘন ঘন লোডশেডিং। বর্তমানে প্রায় সর্বত্রই প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। সে অবস্থায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ডিজেলচালিত জেনারেটরের সাহায্যে পানির পাম্পগুলো চালানোর কথা। জানা গেছে, পানি উত্তোলনের জন্য ওয়াসার চারটি শোধনাগারসহ পাম্পহাউস রয়েছে ৬০৫টি। এগুলোর মধ্যে ৩৬৭টি পাম্পহাউসে বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য স্থায়ী জেনারেটর রয়েছে। এর বাইরেও ৫২টি মোবাইল জেনারেটর আছে। সেক্ষেত্রে জেনারেটরের সমস্যা থাকার কথা নয়। বাস্তবে সমস্যা অন্যত্র। জেনারেটর চালানোর জন্য বরাদ্দকৃত ডিজেল চুরি। শক্তিশালী একটি জালিয়াত চক্র জেনারেটরের জন্য বরাদ্দকৃত তেল নিয়মিত চুরি করছে। প্রতিটি জেনারেটর চালাতে প্রতি ঘণ্টার জন্য বরাদ্দ থাকে ২০-২২ লিটার ডিজেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোডশেডিং চলাকালে জেনারেটর বন্ধ রেখে ডিজেল চুরি করা হয়। অথচ খাতায় ঠিকই দাখিল করা হয় গোঁজামিলের হিসাব। অফিসিয়াল খাতায় বন্ধ জেনারেটর চালু রাখার তথ্যাদি উপস্থাপন করে চক্রটি তেল চুরি করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। পানি সরবরাহ অব্যাহত ও পর্যাপ্ত রাখতে হলে যে কোন মূল্যে এই তেল চুরির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। তা না হলে লোডশেডিং চলাকালে পানি সংকটের তীব্রতা আরও বাড়বে।
ওয়াসার পানির আরও একটি প্রকট সমস্যা রয়েছে। আর তা হলো দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি, যা খাওয়ার অনুপযোগী তো বটেই, এমনকি ব্যবহারেরও অযোগ্য। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূ-গর্ভ থেকে আহরিত পানি কিছুটা ভালো হলেও পুরনো জরাজীর্ণ পাইপলাইনের কারণে তা দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ে। আর যেসব জলাধারে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-তুরাগ-বালু নদীর পানি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এর মধ্যেই হয়ে গেছে নোংরা আবর্জনা, পরিত্যক্ত বর্জ্য ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে পরিপূর্ণ, পূতিগন্ধময়। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশোধনযোগ্য রাসায়নিক ব্যবহার করেও পানি দুর্গন্ধমুক্ত তো নয়ই, খাওয়ার উপযোগীও করা যায় না। সেক্ষেত্রে আগে নদীগুলোকে সবরকম দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবহারোপযোগী সুপেয় পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ আধুনিক নগর পরিষেবার অন্যতম শর্ত। ঢাকা ওয়াসা সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিরন্তর চেষ্টা করবে বলে প্রত্যাশা। সরকারকেও এ বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।
পানি সংকট নেই, রাজধানীতে এমন এলাকা খুঁজে পাওয়া সত্যিকার অর্থেই দায় হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও পানি সংকট থেকে রেহাই পেতে নলকূপ বসানো এমনকি কুয়া খোঁড়া হচ্ছে। পানির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর অনেক এলাকায়। রাজধানীর ভূ-গর্ভ থেকে যথেচ্ছাভাবে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট সমাধানের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে উপরিভাগের পানি ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। এ উদ্দেশ্যে যমুনা থেকে পানি এনে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে সচল করার যে পরিকল্পনা সরকারের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে নেয়া হয়েছিল তা অবিলম্বে কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। পানি সমস্যার আশু সমাধানে পাম্প হাউসগুলো যাতে লোডশেডিংয়ের সময়ও সচল থাকে সেদিকেও নজর রাখা জরুরি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন