রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

মহাজোট আমলে নির্বাচনী স্ব”ছতা কতটুকু


ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক উষ্ণতার আধিক্যে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রকৃতিতে যেমন প্রয়োজন মৌসুমী বায়ুর আগমন এবং দ্র“ত বরিষণ, তেমনি রাজনীতিতেও সহিংসতা ও উত্তাপ হ্রাসে জর“রি হয়ে পড়েছে সংলাপ-সমঝোতার সুবাতাস ও স্বস্তির বারিধারা। আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, রাজনীতি ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়ে দুই বড় দলের বিরোধ থেকে। বেশির ভাগ দল ও নাগরিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলেও সরকার চাইছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। এ লক্ষ্যে উ”চ আদালতের একটি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যব¯’া বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যব¯’া করেছে, যদিও ওই রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি নির্বাচন করার সুযোগ ছিল। যেহেতু রায় অনুযায়ী ওই দুটি নির্বাচন করতে হলে সেখানে বিচারপতিদের জড়িত করা যাবে না, সে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন পড়বে। কিš‘ তত্ত্বাবধায়ক ব্যব¯’ার ত্র“টি-বিচ্যুতি সংশোধনের দিকে সরকারের আগ্রহ নেই। পরিবর্তে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন এবং তাদের দাবি ও গণআকাক্সক্ষা উপেক্ষা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যা”েছন এবং এ লক্ষ্যে তিনি অব্যাহতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশে নির্বাচন করার কথা বলছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তিনি দানবের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এ সরকার কিছুই দিতে পারেনি, দিয়েছে অপশাসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতাকে ‘সুখকর নয়’ উল্লেখ করে তিনি এ সরকারের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে বলেন। সম্প্রতি ২৬ মে গণভবনে মেহেরপুর জেলার দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক সেট যায় আরেক সেট আসে। তারা তো নির্বাচন দিতেই চায় না। আমাদের টেনেহিচঁড়ে গ্রেফতার করে।’ প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওনার দুই ছেলেকে পিটিয়ে দেশের বাইরে বের করে দিয়েছে। কীভাবে তিনি ভুলে যান ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। সে সময়ের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা তিনি কি ভুলে গেছেন?’ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনেই হবে। বর্তমান সরকার ৫ হাজার ১৭৫টি নির্বাচন যখন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পেরেছে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনও অবশ্যই করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা এবং দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে প্রদত্ত বক্তব্যে কিছু ফাঁকফোকর ও চাতুরি আছে। প্রধান চাতুরি হল, একটি অসাংবিধানিক ও অ-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জুলুমবাজি কর্মকাণ্ডের দায় প্রধানমন্ত্রী অব্যাহতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপিয়ে যা”েছন। কোন মানদণ্ডের বিচারেই যে ফখর“দ্দীন-মইনউদ্দিন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায় নাÑ এ কথাটি যিনি যতবারই বলুন না কেন, প্রধানমন্ত্রী তা শুনছেন না। এ অ-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জুলুমবাজি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি খালেদা জিয়াকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। আর এসবের উদ্দেশ্য হল, সরকারের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাসনা। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ৫ হাজার ১৭৫টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে ‘স্ব”ছভাবে’ সম্পন্নের দাবি করে সংসদ নির্বাচনও স্ব”ছভাবে করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সে সম্পর্কে এ নিবন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব।
প্রধানমন্ত্রীর মহাজোট সরকার আমলে অনুষ্ঠিত ৫ হাজার ১৭৫টি নির্বাচনের স্ব”ছতার দাবি পরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা প্রতিটি নির্বাচনের চরিত্র পৃথকভাবে পরীক্ষা করব না। কারণ, ভাত সেদ্ধ হল কিনা তা বোঝার জন্য যেমন দু-চারটি ভাত টিপলেই চলে, তেমনি উল্লিখিত নির্বাচনগুলোর চরিত্র অনুধাবনের জন্য ওই সব নির্বাচন থেকে কতিপয় নির্বাচনের স্ব”ছতা বিশ্লেষণ করাই যথেষ্ট হবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত ৫ হাজার ১৭৫টি নির্বাচনের মধ্যে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মিলেই প্রায় ৫ সহস্রাধিক, বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু উপনির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচন। এ কারণে প্রথমে উপজেলা ও ইউপি নির্বাচন কেমন হয়েছিল সে প্রসঙ্গে দৃষ্টি দেয়া যুক্তিসঙ্গত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ২৩ দিন পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে সরকারদলীয় এমপি ও মন্ত্রীদের বাড়াবাড়িতে নির্বাচনটি ভণ্ডুল হয়ে যায়। সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের বিশাল বিজয়ের পর চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীদের অনেকেই যখন আÍগোপনে, তেমন সময় এ নির্বাচন হওয়ায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে পড়েন। সরকারি দলের নবনির্বাচিত এমপি-মন্ত্রীদের দাপটে ব্যাপক সন্ত্রাস-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীরা দু-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেলেও নির্বাচনটি স্ব”ছ চরিত্র অর্জনে ব্যর্থ হয়। ‘অধিকার’-এর তথ্যানুযায়ী এ নির্বাচনের প্রাক্কালে সহিংসতায় চারজন নিহত, আট শতাধিক আহত ও নির্বাচনের দিন ১৪ জন নিহত এবং প্রায় দুই সহস্রাধিক আহত হন। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, বোমাবাজি, প্রতিপক্ষের নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, মন্ত্রী-এমপিদের নগ্ন হস্তক্ষেপ, সরকারদলীয় ক্যাডারদের ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরা, ফলাফল জালিয়াতি, প্রিসাইডিং অফিসারদের মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শন, ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্সে আগুন, নির্বাচনী মালামাল ছিনতাই প্রভৃতি দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটে। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সরকারি দলের ক্যাডাররা প্রতিপক্ষের নারী ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধাদানের উদ্দেশ্যে রাস্তায় দিগম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নির্বাচনী দুর্নীতিতে অভূতপূর্ব কুৎসিত মাত্রা যোগ করে। এ নির্বাচনে ভোটার উপ¯ি’তি কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে যখন সিইসি সিদ্ধান্ত নেন, তখন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় ভোট পড়ে শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। ওই উপজেলার ৬০টি কেন্দ্রে ভোটার ১ লাখ ৫ হাজার ৫৬৬ জন হলেও প্রদত্ত ভোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২১। কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের বক্তব্য উপজেলা নির্বাচনের সন্ত্রাস-দুর্নীতি অনুধাবনে সহায়ক। তিনি বলেন, ক্যাডাররা কেন্দ্রটি দখলে নিয়ে তাকে বলে, ‘এখন আমাদের সরকার। শান্তিমতো চাকরি করতে হলে কিছু বলবেন না। আমরা আমাদের কাজ সেরে চলে যাব।’ নির্বাচন কমিশন শত শত অভিযোগের মধ্যে প্রথমে সাতটি এবং পরে ৪৫টি উপজেলার নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা ¯’গিত করে। একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থীরা ছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষকসহ সবাই এ নির্বাচন সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। নির্বাচন কমিশনও যখন স্বীকার করে যে উপজেলা নির্বাচনটি ভালো হয়নি তখন এ নির্বাচনের দুর্নীতি-কারচুপি সম্পর্কে বেশি আলোচনা না করাই শ্রেয়।
মহাজোট সরকার আমলে অনুষ্ঠিত ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন শুধু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতেই ব্যর্থ হয়নি, সরকারি দলের ক্যাডারদের চাপাতি, রামদা, রড, হোন্ডা-গুণ্ডার দাপট, হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং বিএনপি সমর্থকদের ভোট প্রদানে বাধা দেয়া রোধেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনের দিন সরকারি দলের প্রার্থীর ক্যাডারদের হামলায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীর নেতাকর্মীরা আবার আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর বাসভবনে চিকিৎসা নেন। কমিশন নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, সন্ত্রাস ও একাধিক গণধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধেও ব্যর্থ হয়। থানায় ধর্ষণের মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়ার পর থানা ‘শ্লীলতাহানি’র মামলা নেয়। কমিশন বিএনপি প্রার্থীর জোরালো দাবি সত্ত্বেও সেনা মোতায়েন না করে ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে ওই নির্বাচনে সরকারি দলের বিজয় নিশ্চিত করে। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদের মন্তব্যে ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনের চরিত্র স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, ‘ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর বিজয় হলেও গণতন্ত্র পরাজিত হয়।’
মহাজোট সরকার আমলে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো মুক্ত ও অবাধ হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন এসব নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের বেপরোয়া ভূমিকা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ২৫৪টি পৌরসভার নির্বাচনে কারচুপি-দুর্নীতি বৃদ্ধি পেলেও কমিশন তা দমনে ব্যর্থ হয়। ২০১১ সালের মার্চ থেকে শুর“ হয়ে ৫ জুলাই শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, ফলাফল জালিয়াতি, কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়াসহ সব ধরনের অনিয়ম-অব্যব¯’াপনা সংঘটিত হলেও কমিশন এসব রোধে সক্রিয়তা না দেখিয়ে পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে কীভাবে ইভিএম ব্যবহার করে সংসদ নির্বাচন করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রথমদিকে ইউপি নির্বাচনের নেতিবাচকতা এড়িয়ে যেতে চাইলেও সহিংসতা ব্যাপক আকার নিলে নির্বাচন কমিশন দু’জন কর্মচারীকে ওই নির্বাচনের সহিংসতার পরিসংখ্যান তৈরি করতে নির্দেশ দেয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ইউপি নির্বাচনে দুই সহস্রাধিক সংঘর্ষে ৬৬ জন নিহত ও আট সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হলেও ইসি কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন নির্বাচনটিকে হাস্যকরভাবে ৯৮ ভাগ ভালো ও ২ ভাগ খারাপ দাবি করেন। এ নির্বাচনে জমা পড়া চার সহস্রাধিক অভিযোগের মধ্যে কমিশন মাত্র ২০টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও এসব অভিযোগের মধ্যে ফলাফল জালিয়াতি, কারচুপি, জালভোট দিতে সহায়তা করা, কয়েকটি ইউপিতে শতভাগ ভোট পড়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া, প্রভৃতি ধরনের মারাÍক অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং অফিসারদের অনিয়ম-দুর্নীতির বির“দ্ধে। কমিশন এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে রাজধানীতে বসে উদ্বেগ প্রকাশের মধ্যে দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ রাখে। ইসি কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, ‘কমিশনে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ছে। পরাজিত প্রার্থীসহ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ করছেন। তাই এসব অভিযোগ পড়িও না।’ ইউপি নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহারের ব্যাপকতা স্বয়ং সিইসির বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেও খুন ঠেকাতে পারিনি। নির্বাচনে টাকার ব্যবহার হ”েছ। আসলে টাকার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কাজে আমাদের সহায়তা করার কেউ নেই।’
এসব নির্বাচন ছাড়াও মহাজোট আমলে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মধ্যে কমিশন নাসিক ও কুসিক নির্বাচন দুটি দুই কারণে স্ব”ছভাবে অনুষ্ঠানে মনোযোগী হয়। প্রথমত. এ দুটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে কমিশন নাগরিক সমাজকে ইভিএমের ওপর আ¯’াশীল করতে চায় এবং দ্বিতীয়ত. এ দুটি নির্বাচন কমিশনের আয়ুষ্কালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ায় নির্বাচনগুলো ভালোভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কমিশন তার হƒত ভাবমূর্তি উদ্ধারে মনোযোগ দেয়। এর আগে সিসিসি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিছুটা তৈরি করতে পারলেও কমিশন সাহসিকতা প্রমাণ করতে পারেনি। ওই নির্বাচনে আচরণবিধি ভাঙার কারণে একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীকে অর্থ জরিমানা করে আদায় করলেও একই অপরাধে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে এ ব্যাপারে মৃদু ভাষায়ও তিরস্কার না করা, কমিশনকে না জানিয়ে নির্বাচনের আগের রাতে বিরোধী দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে পুলিশের গ্রেফতার করা, রিটার্নিং অফিসারের হাতে পোশাকধারী বাহিনীর ২২ হাজার সদস্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের দিন রাতে কিছুক্ষণের জন্য ভোটের ফলাফল ঘোষণা বন্ধ থাকা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে কমিশনের দুর্বলতা ও ব্যব¯’াপনার ব্যর্থতা ধরা পড়ায় এ নির্বাচনের স্ব”ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নাসিক নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের জন্য কমিশনের লিখিত অনুরোধ উপেক্ষা করে সরকার সংবিধানের ১২৬ ধারা লংঘন এবং কমিশনের চিঠির সময়মতো জবাব না দিয়ে শিষ্টাচার ভঙ্গ করে। ইভিএমবিরোধী বক্তব্য দেয়ায় বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে শোকজ করলেও সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান নির্বাচনে জঙ্গি হামলার কথা বলে আতংক ছড়ালেও তার বির“দ্ধে কমিশনকে একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এছাড়া নাসিক ও কুসিক নির্বাচনে ইভিএমকেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি হয় উল্লেখযোগ্য হারে। এসব নির্বাচনে ইভিএমকেন্দ্রিক ত্র“টি-বিচ্যুতির মধ্যে ছিল স্বল্পশিক্ষিত বয়স্ক ভোটারদের ভোটদানে অস্বস্তি প্রকাশ, ভোটদানে ভুল করা, অনভ্যস্তদের ভোটদানে দীর্ঘ সময় নেয়া, কতিপয় ইভিএম মেশিনের কিছুসংখ্যক বাটন অকার্যকর থাকা, কতিপয় ইভিএম বিকল হয়ে যাওয়া, ইভিএম পদ্ধতিতেও জাল ভোট পড়া, কতিপয় ইভিএমে কাস্টিং ভোট ডামি ভোট হয়ে যাওয়া এবং যান্ত্রিক ত্র“টিসহ বিভিন্ন কারণে ভোট নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। এই হল মহাজোট আমলের নির্বাচনী স্ব”ছতার (?) সংক্ষিপ্ত চিত্র।
ভুলে না যাওয়া ভালো, সংসদ নির্বাচনের গুর“ত্বের সঙ্গে উপনির্বাচন বা ¯’ানীয় সরকার নির্বাচনের গুর“ত্ব তুলনীয় নয়। কারণ, সংসদ নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে সরকার গঠনের প্রসঙ্গ জড়িত। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনে জয়ী হতে যতটা প্রাণ বাজি রেখে কাজ করে অন্য কোন নির্বাচনে ততটা মরিয়া হয়ে কাজ করে না। মহাজোট আমলে বিভিন্ন নির্বাচন কেমন হয়েছে সে চিত্র অবলোকনের পর যদি দু-একটি নির্বাচন ভালোও হয় তাহলে সে ভালোত্বকে সংসদ নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ হওয়ার নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কাজেই সরকার ৫ হাজার ১৭৫টি নির্বাচন ‘ভালো’ করতে পারলে সংসদ নির্বাচনও অবাধভাবে করতে পারবে বলে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যকে বিরাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোন চিন্তাশীল ও বিবেকবান নাগরিক বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। ছোট ছোট আন্দোলন কর্মসূচি, যেমন বিভাগীয় পর্যায়ের অঞ্চলভিত্তিক রোডমার্চ ও জনসভাগুলোয় সহযোগিতা করলেও ঢাকার মহাসমাবেশের মতো বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করার জন্য এ সরকার রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বি”িছন্ন করে, হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, যানবাহন, পানি বন্ধ করে, জলকামান, ডগ স্কোয়াড, রায়ট ফোর্সসহ পোশাকধারী বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মী-ক্যাডার নামিয়ে যে আসুরিক ভঙ্গিমায় ওই আন্দোলন মোকাবেলা করেছে তাতে নাগরিক সমাজ যদি ভাবেÑ সরকার নাগরিক আ¯’া অর্জনের জন্য দু-একটি ছোট নির্বাচনে ভালো আচরণ করে সংসদ নির্বাচনে নিজ বিজয় নিশ্চিত করার জন্য র“দ্র ও স্বৈরাচারী মূর্তি ধারণ করবে, তাহলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর আওয়ামী লীগের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার দাবির পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধীদলীয় দাবি বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ধশযঃবৎসু@মসধরষ.পড়স 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন