ড. মু হ. আ মি নু ল ই স লা ম আ ক ন্দ
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকারের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় অতি ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলচালিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা এগিয়ে চলছে। কিš‘ বাস্তবায়নের এ পর্যায়ে আগে ছিল না এমন যে উপাদানটি গেল বছর থেকে যোগ হয়েছে তা হল, অফ-পিক সময়ে রাত ১টা বা ২টার দিকেও বিদ্যুৎ না থাকা। এটা জেগে থাকা বিদ্যুৎ কর্মকর্তার রসিকতা হতে পারেÑ বিদ্যুৎ চলে গেলে, পাখা বন্ধ হলে, গরমে ঘুম ভাঙার পর একটুু জিরিয়ে নিলে কেমন হয়! হতে পারে এটা জর“রি অব¯’া মোকাবেলার জন্য মানুষকে সহনশীল করে তোলার উপায় কিংবা সুখের মাপকাঠির জরিপ হিসেবে ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুমাতে কত সময় লাগে তা নিরূপণের চেষ্টা। কিš‘ বাংলাদেশ তো এমন জর“রি পরি¯ি’তিতে বা কল্যাণময় রাষ্ট্রের পর্যায়ে নেই। তাহলে মাঝরাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হ”েছ কেন?
পুঁজিবাদী সমাজে হয়তো এটাও অবিশ্বাস্য হবে না যে, আইপিএস বা ঘুমের ওষুধ উৎপাদনকারীরা বিক্রয়কে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগকে প্রভাবিত করে এমনটা ঘটা”েছ। চলমান বিদ্যুৎ সমস্যায় আইপিএস কিনেছেন, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। আর যারা আইপিএস কিনেছেন, তারা হয়তো দামি ঘুমের ওষুধও সেবন করেন। তবে পণ্য দুটি মোটেও পরিপূরক নয় বরং পরিবর্তক। যারা উ”চমূল্যে আইপিএস কিনতে পারছেন না, তারা অল্প খরচে ঘুমের ট্যাবলেট কিনে সারারাত ঘুমানোকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতেও পারেন। এমন আলোচনায় বিষয় হয়তো উপহাস্য মনে হতে পারে। কিš‘ কঠিন বাস্তবতা হল, যেসব স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ভারই বহন করতে পারছে না, তারাই নিদ্রাহীন সময় অতিক্রম করছে। নানা সমস্যাজর্জরিত একজন স্বল্প আয়ের কর্মজীবীর জন্য মধ্যরাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ভোগান্তি বা সুযোগ খরচ কত?
ব্যস্ততম শহরে একজন কর্মজীবী লোককে সকাল ৯টায় অফিস ধরার জন্য সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। সে হয়তো সকাল ৭টায় কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে রওনা হয়ে অন্তত দু’ঘণ্টা যানজট অতিক্রম করে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছায়। বিকাল ৫টায় অফিস শেষ করার কথা থাকলেও বেসরকারি চাকরিজীবী হলে তাকে অতিরিক্ত কাজ করে বের হতে প্রায় ৭টা বেজে যায়। লোকটি আবার যানজট অতিক্রম করে রাত ৯টায় বাসায় ফেরে। বেশি কিছু করার সুযোগ না থাকলেও ঘুমাতে যেতে প্রায় ১১টা বেজে যায়। পরিশ্রান্ত মানুষটি আশা করে, সে রাত ১২টা থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টা ঘুমাবে। কিš‘ গভীর রাতে বিদ্যুৎ বিপর্যয় তার ঘুমটি ভাঙায়। এরপর ১ ঘণ্টা পর যদি বিদ্যুৎ আসে, তখন সমস্যাবিজড়িত মানুষটি কি সহজেই ঘুমাতে পারে? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে নিদ্রাভঙ্গের পর লোকটি হয়তো পরবর্তী অতৃপ্ত ঘুমে দুঃস্বপ্ন দেখবে, যে তৃপ্ত ঘুমে সুস্বপ্ন দেখত। পরদিন নিদ্রাহীন সেই ক্লান্ত লোকটি কর্ম¯’লে গিয়ে কর্মকর্তার বকুনি খায়। এভাবে বিদ্যুৎ সমস্যা নিদ্রাহীন মানুষকে ক্রমাগত ক্লান্ত করছে এবং তাকে মানসিক চাপের দুষ্টচক্রে ফেলছে।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য ঘুমের সমস্যার এমন সুযোগ খরচের হিসাব শিক্ষার্থীদের জন্য কেমন হবে? অনেকে মনে করেন, শিশুরা হয়তো সহজেই ঘুমায়। কিš‘ যে ছাত্রটি বিদ্যুৎ বাতি ও পাখার নিচে বসে পড়াশোনা করে তাকে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করালে কিছুটা উপযোগ আসতে পারে। কিš‘ বিদ্যালয়গুলো শিশুদের ওপর যেভাবে বাড়তি বই চাপিয়ে দিয়েছে, তাতে তারা পড়াশোনার সাময়িক সমস্যাতেই মানসিক চাপে পড়ছে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটার সুযোগ খরচ কতটা পূরণীয়? এ অব¯’ায় হয়তো একজন লোক বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ই”ছা পোষণ করে, যা ২ ঘণ্টায় তার যে বিদ্যুৎ খরচ বাড়াবে, ঘুম ও পড়ালেখার মূল্য বা সুযোগ খরচ তার চেয়ে অতুলনীয়ভাবে বেশি।
এখন প্রশ্ন আসে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্লান্ট থেকে উৎপাদিত এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়? গত বছর ন্যূনতম যে ঘাটতি ছিল ৫০০ মেগাওয়াট তা তো এ বছর বেড়ে হয়েছে ১০০০ মেগাওয়াট। বেশি দামে তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারের ভর্তুকি চাপ এতটাই বেড়েছে যে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এসব অনেক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এরকম কেন্দ্র ¯’াপন করে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপটিই যেন পরিকল্পনার ত্র“টি হিসেবে ধরা পড়েছে। এ পরিকল্পনার ত্র“টিপূর্ণ অনুমানটি হয়তো ছিল, ২০০৮ সালের জ্বালানি তেলের উ”চমূল্যের পর ২০০৯ সাল থেকে মূল্য হ্রাস হয়তো চলতেই থাকবে, যার ভিত্তি ছিল ১৯৭৩ সালের বিশ্ব জ্বালানি সংকট পরবর্তী পরি¯ি’তি। সংকটের পর দাম যখন কমেছিল, তা অনেকদিনই কম ছিল। কিš‘ বিশ্ব জ্বালানির জোগান চূড়ার কাছাকাছি থাকায় ২০০৯-এর মূল্যহ্রাস বেশিদিন চলতে পারেনি। আমাদের পরিকল্পনা সহায়তাকারীরা যদি দীর্ঘমেয়াদেও এমন ভ্রান্ত অনুমাননির্ভর বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে থাকেন, তার দায় হয়তো সরকারকেই নিতে হবে। তবে ক্লান্তি ও মানসিক চাপের দুষ্টচক্র থেকে তো মানুষ রেহাই পাবে না।
ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন