অজয় দাশগুপ্ত
আ নন্দবঞ্চিত শিক্ষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সতর্ক বাণী নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। ভীতি আর শাসনে শিক্ষা কখনোই প্রাণ খুলে নিজেকে তুলে ধরতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য ও দুঃখের বিষয় যুগ যুগ ধরে তাই চলে আসছে। আমাদের দেশ ও সমাজে কতকিছু বদলালো, কত পরিবর্তন ঘটল কিন্তু শিক্ষা যে তিমিরে সে তিমিরেই পড়ে রইল। আমরা ভেবেছিলাম এক কেন্দ্রিক সরকার ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই হয়তো এই দুর্দশা। যে সব জাতি ও রাষ্ট্র উন্নতির চরম শিখরে, যারা দুনিয়াময় শিক্ষাকে উজ্জ্বল ও আলোকিত করে রেখেছে তাদের গৃহীত অনুসৃত শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণেই মুক্তি— এমনও ভেবেছি আমরা। কালক্রমে সময়ের হাত ধরে সরকার বা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়লো। একেবারে অক্ষর জ্ঞান বা প্রাথমিক ধাপ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত প্রাইভেটাইজেশনের জোয়ার এসে লাগল দেশে। এখন তো এমন অবস্থা রাস্তাঘাটে হাঁটাও মুশকিল। গত নভেম্বরে ঢাকায় কয়েকদিন থাকার সুবাদে সচক্ষে দেখে এসেছি, কয়েকটা দালানের পর পরই হয় একটি স্কুল অথবা বিশ্ববিদ্যালয়। মজার ব্যাপার এই, কলেজ কমে গেছে। হয় স্কুল লেভেলের চাপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মান ও গুণের বিশেষণে সয়লাব সাইনবোর্ডে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা, অতঃপর বিদেশে যাবার প্রলোভন আর ভিসা সহজ করার নামে ইংরেজি বা অন্য ভাষার কথিত কেরামতির প্রতিষ্ঠান, গজিয়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা-প্রশাখা দেখে বিদেশি বা আগন্তুকরা ভাবতে পারেন আমাদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিতভাবেই সর্বত্রগামী ও ইলেকট্রিকের প্যাঁচানো তার বা ডিস লাইনের এন্টেনার মত বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেছে। আসল চেহারাটা যে কি তাও আমাদের অজানা নয়। কোথায় সংকট, কোথায় এর শেকড় তা খুঁজতে গেলে কিংবা গ্রাসরুটে বা মূল জায়গায় হাত দিতে হলে পুরো ব্যবস্থাই বন্ধ করে আবার চালু করার প্রয়োজন পড়তে পারে। যা অসম্ভব। ফলে যেটুকু আছে বা যা বাস্তবতা তার ভেতরেই সমাধান প্রক্রিয়া তৈরি করে এ সমস্যা থেকে বেরুতে হবে। কিভাবে তা সম্ভব ? একটা সংক্ষিপ্ত কলাম বা পরিমিত পরিসরে তার জবাব দেয়া অথবা সমাধান খুঁজে পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তাই আমরা শুধু শিক্ষার নৈতিক দিকটা নিয়েই আলাপ করব। এ কথা সবার জানা, নৈতিক বল বা মেরুদণ্ড না থাকলে মানুষের শরীরের মত যে কোন কিছুই নতজানু হয়ে পড়ে। যে বিষয় বা যা না থাকলে শির উঁচু করে বাঁচা যায় না, নিজ দেশে এমনকি পৃথিবীর কোথাও অস্তিত্ব থাকে না তার মেরুদণ্ড বা নৈতিকতা তো অবশ্যই জরুরী। এককালে তা ছিল বলেই অভাব, দুঃখ-দৈন্যের দেশেও শিক্ষা তারার মত জ্বল জ্বল করত। সেকালে ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড ক্লাসের আকাশ জুড়ে ছিল একটাই চাঁদ আর অজস্র তারার ভিড়। আজ পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তারায় তারায় ভরা আকাশে জ্যোতি নেই। স্টার মার্ক বা তারার মিছিলে নেই নৈতিক আলোর ঝর্ণা।
গত হপ্তায় স্থানীয় ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন উত্সবে গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে। মূলত অভিভাবক হিসেবেই যাওয়া। শুরু থেকে শেষ অবদি নৈপুণ্য আর শৃঙ্খলার এক অসামান্য উদাহরণ এই আয়োজন। গ্রাজুয়েটদের গাউন পরিয়ে দেয়া থেকে সার্টিফিকেট বিতরণ শেষে সুরেলা সঙ্গীত আপ্যায়ন।
বিন্দুমাত্র ত্রুটি বা বিচ্যুতি ছিল না কোথাও। প্রায় শ’খানেক গ্রাজুয়েট ও স্নাতকোত্তরদের এই মহতী অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখল মাত্র একজন। বাংলাদেশি রুমানা ইসলাম। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের বুকের ছাতি স্ফীত হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বহুজাতিক সংস্কৃতি ও মিশ্র জাতিসত্তার প্রতি এ দেশের ও এই জাতির সম্মান জানানোর প্রক্রিয়াও মনে রাখার মত। এত এত দেশের প্রতিনিধিদের ভেতর থেকে তারা রুমানাকে বেছে নিয়ে নিরপেক্ষতা ও মেধার যে স্বীকৃতি দিলেন সেটাই তো শিক্ষার মেরুদণ্ড। আমাদের দেশে কি তা সম্ভব? যে কোন ছোট-বড় অনুষ্ঠানে স্বজনপ্রীতি, দলীয় বাড়াবাড়ি, আধিপত্য আর জবরদস্তির জোয়ার। লবিং, রাজনৈতিক কানেকশন ও সামাজিক প্রতিপত্তিই ঠিক করে দেয় কে হবে বক্তা আর কে হবে শ্রোতা। রাজনীতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এতটাই গ্রাস করেছে যে ছাত্র থেকে শিক্ষক এমনকি ভাইস চ্যান্সেলরের মত শীর্ষ পদটিও আজ আর অক্ষত বা নিরপেক্ষ নেই। এককালে সাদামাটা জীবনের মানুষদের শিক্ষায় আলোর পথ দেখেছে বাঙালি। তখন ঘরে-বাইরে, পাড়া-মহল্লায় এমনকি জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে এঁরাই ছিলেন অতিথি বক্তা বা সভাপতি। আজকের মত ক্ষমতাবান অর্থবিত্তে ঝলসে ওঠা মানুষ বা রাজনীতিকদের প্রতাপ ছিল না। এখন এদের ভিড়ে শিক্ষকরা উধাও। তারাও আসেন বটে কখনো বাধ্য শ্রোতার মত, কখনো বা দুঃস্থ, অসহায় হিসেবে সাহায্য গ্রহণের জন্যে। মঞ্চে ওঠা, মঞ্চ আলো করে শিক্ষার প্রভা বা জ্ঞান বিতরণ আজ আর কোথাও দেখি না। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাটিতে আমাদের সেই গৌরবময় অতীতের ছায়া দেখলাম। ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর নিজে উপস্থাপক হয়ে যাকে একমাত্র অতিথি বক্তার সম্মান দিলেন— না তিনি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, না মিনিস্টার, না কোন সাংসদ, এমনকি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা বা কোটিপতি কেউই নন, অস্ট্রেলিয়াব্যাপী দুর্যোগ, দুর্ভোগ আর অনটনে অপেক্ষাকৃত পশ্চাত্পদ বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো দাতব্য সংগঠন সেলভেশন আর্মির এক সেবক, সেলভেশন আর্মি প্রথাগত কোন আর্মি বা সেনা সংগঠন কিছু নয়। দুঃস্থ ও গরীবের বিপর্যয়ে মুক্তি ও উদ্ধারের লক্ষ্যে আর্মি বা সেনাদলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেই এদের এই নাম, এই ভদ্রলোকের বক্তব্যও ছিল অসাধারণ, বলছিলেন রেপুটেশান আর ক্যারেকটার নিয়ে। রেপুটেশান বা কৃতিত্ব হচ্ছে চারা বা ছত্রাকের মত জন্মায় আর মরে। চরিত্র হচ্ছে বটবৃক্ষ, একবার তা জন্মালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাতে ছায়ালাভ করে। সত্যি কি তাই নয়? চরিত্রহীনতার যূপকাষ্ঠে ছটফট করতে থাকা আমাদের দেশ ও জীবনব্যবস্থাই তার সবচে’ বড় নজীর।
আজ অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা, দম্ভ, অধিকার সব থাকলেও জাতীয় চরিত্র নেই— নেই ব্যক্তিচরিত্র। শিক্ষার মূল জায়গাটাই তাই আক্রান্ত। যে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার সনদপত্র ও সবচে’ বড় উত্সবে এ জাতীয় সাধারণ জনসেবককে ডেকে সম্মানিত করেন, কথা বলার সুযোগ দেন, সেখানে জীবন তো মেরুদণ্ডের উপরই দাঁড়াতে শিখবে। শিক্ষার্থীরা জানালেন, এই জাতীয় জনসেবা করার পুরস্কার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি। জ্ঞানী ও মেধাবি মানুষের সাথে এক চেয়ারে, এক মঞ্চে বসার ও কথা বলার যোগ্যতা হচ্ছে জনসেবা।
আমরা এ সব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গুণাবলী হারিয়ে আজ পঙ্গু। যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা করে না, করতে ভুলে যাচ্ছে, তাকে জাগানো বা তার পক্ষে মেরুদণ্ড নির্মাণ কি সহজ কাজ? শীতার্ত সিডনি অপরাহ্নে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল আমাদের সভ্যতা ও অতীত যে গৌরব ও শিক্ষায় বলীয়ান তার জন্ম হয়েছিল প্রকৃতির কোলে, যে কারণে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ছিল প্রকৃতি অথবা বৃক্ষের আচ্ছাদন, আজ সে বটবৃক্ষগুলো নেই বলেই শিক্ষা জিম্মি হয়ে আছে অর্থ-বন্দুক ক্ষমতাসহ নানা জাতীয় অপপ্রক্রিয়ার কালো হাতের ছায়ায়। কে তাকে বাঁচাবে? কে দেখাবে মুক্তির পথ?
সিডনি থেকে
Dasguptaajoy c hotmail.c
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন