শনিবার, ২ জুন, ২০১২

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন উদ্বিগ্ন নই



 বদিউর রহমান  
২৪ মে ২০১২ ইত্তেফাকে ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন নই’ লেখার পর কিছু পাঠকের টেলিফোন পাই। তাদের বক্তব্য, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন উদ্বিগ্ন নই তা উল্লেখ করা হয়নি। কেন উদ্বিগ্ন নই সে ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্ব অবশ্যই লেখকের। পাঠকের কাছে লেখকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। লেখককে পাঠককে সম্মান করতে হয়, আপন করে নিতে হয়, পাঠকের সমালোচনা থেকে শিখতে হয়, পাঠকের সাথে শেয়ার করতে হয়, পাঠকের রুচি-অভিরুচির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়। নচেত্ লেখক আর পাঠকের নিকট লেখক থাকেন না, লেখকের গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না, লেখক  স্বৈরাচারী হয়ে যেতে পারেন, পাঠকরা লেখককে বয়কটও করতে পারেন। আমি মনে করি পাঠক হারিয়ে ফেলার মধ্যে লেখকের কোন বাহাদুরী নেই, বরং পাঠক সৃষ্টির মধ্যেই লেখকের কৃতিত্ব। অতএব লেখক পাঠকের জিজ্ঞাসা এড়িয়ে যেতে পারেন না, লেখককে উত্তর দিতেই হয়। মতের দ্বৈততা হয়তো তারপরও থাকবে, কিন্তু জবাব তো দেয়া হলো, পাঠককে সম্মান করা হলো। তাই এ লেখা।
স্বাধীনতার আগ থেকেই অর্থাত্ বাংলাদেশ হওয়ার পূর্ব থেকেই আমরা সাবেক পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা কম দেখিনি। ৪৭’র স্বাধীনতার আগের আন্দোলন তো আরো বেশি ছিল। তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আন্দোলন। ১৯০ বছর তো গেলো, ধাপে ধাপে আন্দোলন অগ্রসর হলো, মানুষ খুন হলো, গুলিতে মরলো, মারা হলো, নেতাদের জেলে ভরা হলো, অসহযোগ হলো। তখনো বেঈমান ছিল, তখনো মীরজাফররা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলো। ইতিহাস তো তখনো এক উদ্বিগ্নতার স্বাক্ষর বহন করেনি, সম্পূর্ণ বিদেশিদের কাছ থেকেই তো স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হলো। ১৯০ বছরের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারা এ জাতি কি এত সামান্যতেই উদ্বিগ্ন হতে পারে? উত্তর অবশ্যই না-বোধক। অতএব একটা জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে বা কেমন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্নতার কোন কারণ দেখি না।
তারপর পাকিস্তান হলো, পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান দুই প্রদেশ, এক দেশ। দু’প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা ভিন্ন, ধর্মে মুসলমান হলেও সংস্কৃতিও বলা চলে ভিন্ন। শাসনক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুত্ব চোখে পড়লো, অধিক জনসংখ্যার ধারক হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঞ্চনার শিকার হলো, এ অঞ্চলের জনগণের অসন্তোষ দানা বাঁধতে লাগলো। ইসকান্দর মির্জা ক্ষমতায় এলেন, তাকে হটিয়ে আইয়ুব খান এলেন,  সামরিক প্রভু গণতান্ত্রিক হতে চাইলেন, বেসিক ডেমোক্রেসির বিডি মেম্বারদের মাধ্যমে আইয়ুব খান ৫৬’র শাসনতন্ত্র বাতিল করে ৬২’র শাসনতন্ত্রে গিয়ে নিজেও ‘গণতান্ত্রিক’ প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে শুরু করে পরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠলো। শেখ সাহেবকে, পরে বঙ্গবন্ধু, জেলজুলুম দিয়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে কি দমন করা সম্ভব হয়েছিল? ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান কি ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল? কত নামের কত ঢংয়ের বিভিন্ন ‘দশক’ পালন করেও কি আইয়ুব খান টিকে থাকতে পেরেছিলেন? পারেননি। তখনও কি এত উদ্বিগ্ন ছিল? বঙ্গবন্ধু কি ভেঙ্গে পড়েছিলেন? অবশ্যই নয়। তাহলে সেই ভূমির সেই সাহসী জনগণ এখন একটা স্বাধীন দেশে সামান্য একটা নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে কেন উদ্বিগ্ন হবে?  ৭০’র নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চেয়ে কি এখনকার অবস্থা বেশি শোচনীয়? ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানীদের বর্বর আক্রমণ থেকে কি এখনকার অবস্থা আরো ভয়ংকর? অবশ্যই নয়। তাহলে এখন উদ্বিগ্ন হওয়ার তো কোন কারণ থাকতে পারে না। যে জনতা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসে একটা দেশের জন্ম দিতে পারে সেই জনতার কাছে একটা নির্বাচন ইস্যু কোন মতেই উদ্বিগ্নতার কারণ হতে পারে না।
এ-তো গেলো ৪৭’র তথাকথিত স্বাধীনতা আর ৭১’র প্রকৃত স্বাধীনতার আগের আর মধ্যবর্তী অবস্থার আলোকে ঐতিহ্যগত সাহসী মোকাবিলা আর অর্জনের কথা। এবার আসা যাক ’৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থানে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সাড়ে তিন বছরের শাসনে-দুঃশাসনে মানুষ আশাবাদী হয়েও হতাশ হলেও মনোবল তো হারায়নি। সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে মাত্র ৪টি রাখলেও, সব দল বন্ধ করে দিয়ে মাত্র একদল বাকশাল করা হলেও, সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গণতন্ত্রকে তখন কবর দেয়া হলেও এদেশ কি সে দুঃসময় অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি? রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে আর জাসদের হটকারী সিদ্ধান্তে জনগণের সাময়িক কষ্ট হলেও সময়েতো তার সমাধান হয়েছে, নাকি? তাই যদি হতে পারে তাহলে এখন এত উদ্বিগ্নতার কী আছে? সময়ের বরপুত্র জিয়ার সামরিক শাসনে, মুশতাকের বিশ্বাসঘাতকতায়, প্রধান বিচারপতির প্রধান সামরিক প্রশাসক হওয়ার পরও তো এদেশ টিকে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার হত্যার পরও  তো এদেশ মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলছে, বলা চলে প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারে (Natural Justice) জিয়া হত্যার পরও তো এদেশের জনগণ হতাশ হয়ে হতোদ্যম হয়নি। এখানকার জনগণ তো কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগই মোকাবিলা করে না, তারা তো রাজনৈতিক অত্যাচার-নিপীড়ন এবং ডাণ্ডাওয়ালাদের ডাণ্ডার শাসনও মোকাবিলা করে, নাকি? তারা কি আরেক ডাণ্ডাওয়ালা এরশাদকে রাস্তায় নামিয়ে ছাড়েনি?  ৯০’র গণঅভ্যুত্থান কি আমরা ভুলে গেছি? তারপর কি আমরা আবার গণতন্ত্রে আসিনি? এসেছি। তখনকার অবস্থা কি এখনকার অবস্থা থেকে অনেক অনেক বেশি খারাপ এবং হতাশাব্যঞ্জক ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাই যদি হয় এবং আমরা যদি সে নাজুক এবং স্পর্শকাতর অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরতে পারি, ৭৫-পরবর্তী এবং ৯১-পূর্ববর্তী সামরিক যাঁতাকল থেকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরতে পারি তাহলে সেই গণতন্ত্রে ফেরার দু’নেত্রীকে দিয়ে কিংবা ভোটের মাধ্যমে তাদের দু’জনকেই বাদ দিয়ে এখন কেন সে গণতন্ত্র ধরে রাখতে পারবো না? আমিতো এ দু’নেত্রীর তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্দলীয় কিংবা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সাময়িক ‘ঝগড়াকে’ বাস্তব দৃষ্টিতে এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ‘শক্তিপরীক্ষা’ কিংবা ‘পাতানো খেলা’ হিসেবে দেখতে চাই। আমার কেন জানি মনে হয় গত দু’দশক ক্ষমতায় থেকে, দেশ চালিয়ে, দলীয়করণ করে হলেও প্রধানমন্ত্রীত্বে থেকে দু’জনই টের পেয়েছেন যে তাঁরা ‘একত্রে’ ভুল করলে তা তাদের জন্যই বিপদ ডেকে আনে। তাদের একক-একক ভুলে ঐ একক ভুলকারীকে জনতা ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর উভয়ের একত্র ভুলে উভয়কেই ছুঁড়ে ফেলে দেয় অপর এক শক্তি। দু’জনেরই মনে আছে যে, ওই অপর শক্তি কিন্তু তখন সাময়িক হলেও জনগণেরও সমর্থন পায়। বেশি বাড়াবাড়ি হলে দু’নেত্রী নিয়ে জনগণ ভাববে।
এই-ই যখন এদেশের বাস্তব রাজনৈতিক অবস্থা তখন নিশ্চয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বদনাম নিয়ে ক্ষমতা হারানোর কোন প্রচেষ্টায় যাবে না। তাদের উদ্দেশ্য থাকবে জনসমর্থন নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসা এবং তা অবশ্যই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। মাগুরা মার্কা বা ১৫ ফেব্রুয়ারি মার্কা নির্বাচনের পরিণতি আওয়ামী লীগ দেখেছে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হিসেবে জামায়াতী-দোসর, জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক আর স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির সহায়ক বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে আবার জনগণ চাইতে পারে এমন বিশ্বাস থেকে থাকলে আওয়ামী লীগ সরকার কোন হঠকারিতার আশ্রয়ে যাবে না। হেরে গেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী সরকার দেশের ইতিহাসে নজির স্থাপন করতে চাইবে, ১৫ ফেব্রুয়ারি বা মাগুরা মার্কা নির্বাচনে যাবে না। আর বিএনপি তো নির্বাচনে যাবেই, কেননা একাধারে সাত বছরের অধিক ক্ষমতার বাইরে থেকে পরবর্তী নির্বাচনে না গেলে দলের কর্মী-সমর্থক ধরে রেখে দলকে টিকিয়ে রাখাই হবে দুষ্কর। খালেদা জিয়ার নিজ ছেলেদের রক্ষার চেয়ে দল রক্ষা হবে প্রধান কাজ, কারণ দল রক্ষা হলেই ‘রাজপুত্রের’ ‘সিংহাসনের’ উত্তরাধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা মজবুত হবে। দলই যদি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে তখন ছেলে আবার ‘রাজা’ হবে কী করে? অতএব দু’নেত্রীই নিজেদের উত্তরাধিকারের  স্বার্থে এবং দলের স্বার্থে অবশ্যই রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি অথবা অপর কোন শক্তিকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইবেন না। এখন যে ‘ঝগড়া’ তারা করছেন, যে আন্দোলনের হুমকি আর হামলা-মামলার ভাব দেখাচ্ছেন তা হচ্ছে উভয়ের পরস্পর পিঠ-চুলকানির রাজনীতি, অনেকটা জনগণের দৃষ্টি দু’দলের মধ্যে সীমিত রাখার আপসের রাজনীতি এবং সময়মতো মিলে যাওয়ার কৌশল। অপর কোন শক্তিকে সপক্ষে ভাবা কিংবা ভিন্ন সমর্থনে বা ভিন্ন শক্তিতে ‘অলীক বলীয়ান’ হয়ে কেউ কাউকে কুপোকাত করতে চাইলে তারাই যে একসাথে ধরাশায়ী হয়ে যেতে পারেন তা নিশ্চয় উভয়েই জানেন। অতএব উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোন কারণ নেই, আতেলদের সৃষ্ট উদ্বিগ্নতা রাজনীতিতে অসার হয়ে যাবে। যথাসময়ে জনগণের ভোটেই আবার সরকার গঠিত হবে এবং দেশ গণতন্ত্রে অবিচল থাকবে। এর অন্যথা আমরা চাই না।
[লেখক:সাবেক সচিব]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন