শনিবার, ২ জুন, ২০১২

পুলিশ সাংবাদিকদের ওপর এতো বেপরোয়া কেন?



মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী :
 বিচার বিভাগ ও পুলিশি ভূমিকার ওপর ন্যায়বিচার নির্ভরশীল থাকলেও দুর্ভাগ্যক্রমে আজ এ দুটি সেক্টরই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে জাতির বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিকদের কারোই জান-মালের নিরাপত্তা নেই। এই নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও সরকার ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের দুর্নীতির খতিয়ান সম্পর্কে সম্প্রতি বোমা ফাটানো বক্তব্য দিয়েছেন খোদ সরকার দলীয় এক সিনিয়র মন্ত্রী। আবার কেউ কেউ কুকুর আর পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার নছিহত করছেন! সিলেট-১ আসনের এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত  ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের  প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি রয়েছে'। এক্ষেত্রে পুলিশ শীর্ষে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সংবিধান স্বীকৃত জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তা থাকে না।
পুলিশ জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানকারী। দেশের আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রিয় এই বাহিনী এখন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। যেখানে গিয়ে র্নিযাতিত অসহায় মানুষ আইনের আশ্রয় চেয়ে স্বস্তিবোধ করার কথা ইদানিং সেই পুলিশের কাছে যেতে মানুষ বেশি অস্বস্তিবোধ করেন। ওরা এখন বেসামাল হয়ে উঠেছে। ক্ষেত্র বিশেষে লেবাসধারী পুলিশের কিছু লোক হিংস্র প্রাণী ও ভাদ্র-আশ্বিনের পাগলা কুকুরের ন্যায় তাদের ব্যবহার। জাতীয় সংসদ সদস্য থেকে মসজিদের ইমাম, ছাত্র-শিক্ষক, এমনকি মহিলা থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত কারো যেন রক্ষা নেই। পঞ্চাশ পয়সা থেকে যারা কোটি টাকা এমনকি একটি পান-সিগারেট পর্যন্ত ঘুষ আদায়ের মাধ্যমে যাদের কর্মঘণ্টা শুরু ও শেষ হয়, ওরাই হলো পুলিশ। খুন-খারাবী, ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, মদ, গাঁজা, হেরোইন, নারী পাচার থেকে শুরু করে পতিতাবৃত্তিতেও জড়িত, এই পুলিশ বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য। সকল আমলের সরকারের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে খ্যাত গোটা পুলিশ প্রশাসনই  সম্প্রতি  একটি বিশেষ দলের ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, খুনী, সন্ত্রাসীদের সাথে অাঁতাত করার ফলে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। কালো বিড়াল ও রাঘব বোয়ালদের ব্যবসায়িক পার্টনার বা বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীতে অযোগ্য, অদক্ষ ও দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগের কথাও শুনা যাচ্ছে।  আমার মনে হয় পুলিশের চরিত্র ও দুর্নীতির উপর যদি নিরপেক্ষ জরিপ চালানো হয়, তাহলে বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ নাগরিকই পুলিশের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। সম্ভ্রান্ত কোন পরিবারের মা-বাবারা ছেলেদের এখন পুলিশে চাকরিতে অনিহা প্রকাশ করতে দেখা যায়। কারণ একটাই আর তাহলো এই সেক্টরে ঘুষ আর দুর্নীতির চর্চা।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ২০১২ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে র্নিযাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিচার বহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার রিপোর্টে সাংবাদিক, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি উল্লেখ করা হয়। সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলন্ত বাংলাদেশের (ফেলানীর লাশ) দৃশ্যের ন্যায় আমরা যখন দেখি পুলিশের বুটের তলায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র! পিষ্ট, রাজপথে প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে মহিলা নেত্রীদের গায়ে হাত দেয়ার দৃশ্য দেখার পর কোন বিবেকবান লোক অন্তত পুলিশকে জনগণের কল্যাণকামী বলবে না। রাজপথে মিছিল মিটিংয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী ঐ পুলিশ বাহিনী এখন চড়াও হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের ওপর। ওরা ইদানিং অসম্ভব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জনগণের টাকায় পালিত পুলিশের ইদানিং অসম্ভব বেপরোয়া হয়ে উঠায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়া জংলী শাসন ব্যবস্থারই ইঙ্গিত বহন করে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে (দৈনিক প্রথম আলোর) ৩ জন ফটোসাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার তিন দিনের মাথায় (২৯.৫.১২) মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ আবারও একই কায়দায় সমূহ হিংস্রতা নিয়ে নির্যাতন চালালো আরো তিন সাংবাদিকের উপর। পুলিশ ক্লাবে বিচারপ্রার্থী এক নারীর শ্লীলতাহানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে পুলিশ তিন সাংবাদিক ও দুই আইনজীবীকে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। জানা গেছে, পুলিশি নির্যাতনে আহত তিন সাংবাদিক হলেন কালের কণ্ঠের আদালত প্রতিবেদক এমএ জলিল উজ্জ্বল, বাংলাদেশ প্রতিদিনের আদালত প্রতিবেদক তুহিন হাওলাদার ও প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কর্মকার। মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের প্রবেশপথে কোতোয়ালি থানার ওসি সালাহ উদ্দিনের উপস্থিতিতে ওই তিন সাংবাদিককে মারধর করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানিয়েছেন। কোতোয়ালী থানার এসআই জামান ও জাহাঙ্গীর বিচারপ্রার্থী এক নারীকে পুলিশ ক্লাবে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছেন বলে অভিযোগ শোনার পর সাংবাদিকরা পুলিশের কাছে যান। এরপরই পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। ঘটনার শিকার ওই নারী বাংলানিউজকে জানান, স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা করতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যান তিনি। এ সময় কোতয়ালী থানার এসআই জামান ও জাহাঙ্গীর তাকে পুলিশ ক্লাবের ভেতরে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে হাত দেন এবং জড়িয়ে ধরাসহ শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। বাবা ফারুক আহমেদ তার মেয়েকে ভেতরে নেয়ার প্রতিবাদ করলে তাকেও মারধর করা হয়। এরই মধ্যে অনেক মানুষ ক্লাবের সামনে জড়ো হন। তারাও প্রতিবাদে  ফেটে পড়েন। এ সময় প্রতিবাদকারী সাখাওয়াত ও রাজু নামের ২ আইনজীবী ও ওই তিন সাংবাদিককে পুলিশ বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। পুলিশী নির্যাতনের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা এখন বৃদ্ধি পেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর যেন কিছুই করার নেই।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর খুনীদের পুলিশ এখনো গ্রেফতার করেনি। চিরকুমারী আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এখনো যেন শেষ হচ্ছে না। অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ  টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর ঐ একই ক্যাসেট শুনা যাচ্ছে, গ্রেফতার হচ্ছে না দুর্বৃত্তরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছে।        
লেখক : প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, অনলাইন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, সিলেট। ০১৭১৬৪৬৮৮০০।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন