শনিবার, ২ জুন, ২০১২

সরকারের দেউলিয়াপনা এবং বিকল্প অর্থনীতি খোঁজ



অলিউর রহমান ফিরোজ :
 রাষ্ট্রের গাফিলতির কারণে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পিত এবং সংগতির সাথে অর্থের যোগান নিশ্চিত হতে না পারায় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে দুর্দশা বিরাজ করছে। একদিকে দেশের ব্যাংকে সাধারণ মানুষের যে অর্থ সঞ্চিত ছিল তা সরকার ঋণ নিতে গিয়ে সাধারণ উৎপাদনমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে ঋণে ভাটা পড়ায় অর্থনীতি আর গতিশীলতা পায়নি। দেশের মৌলিক কিছু চাহিদার প্রয়োজন মেটাতে যেয়ে সরকার অর্থনীতিতে মূলত দেউলিয়া হয়ে পড়ার কারণেই সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। তারল্য সংকট, বিদ্যুতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, আমদানী ব্যয় মেটানো, বিনিয়োগে ঘাটতি, ভর্তুকির পরিমাণ দ্বিগুণসহ নানা কারণে অর্থনীতিতে সরকার স্বস্তিতে নেই। তাই বিভিন্ন মুখী ঋণের জালে সরকারকে বন্দী হতে হচ্ছে। তা একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে অপরদিকে দেশের মানুষের গায়ে অতিরিক্ত করের বোঝা চেপে বসবে। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে রাজনৈতিক মতাদর্শে এককাতারে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজ করার আর কোন বিকল্প নেই। দেশের নাজুক অর্থনীতি চাঙ্গা করা যেমন প্রয়োজন আবার দেখতে হবে তার জন্য ক্ষতি কতটা সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকার আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ সংগ্রহ করবে। বিকল্প হিসেবে আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থার বাহিরে সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে ঋণ নেয়ার প্রচেষ্টা করছে। বৈদেশিক লেনদেন এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই সরকারকে এ পথের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিষয়টি পর্যালোচনা করে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। তবে বিষয়টি দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য কতটা অনুকূল হবে তা আরো বিশদভাবে ভাবার সময় রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। সরকারি বন্ডের সূচনা হয়েছিল মূলত ১৬৯৩ সালে ব্রিটিশ-ফ্রান্সের যুদ্ধের সময়। তাদের যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে অর্থের প্রয়োজন হলেও আমাদের অর্থনীতির গতি ধারা বজায় রাখার জন্য এ প্রয়োজনীয়তা এখন দেখা দিয়েছে। তবে সুবিধার চেয়ে ঝুঁকির পরিমাণও কম নয়। তাই বিষয়টি যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল তা কিন্তু নয়। একদিকে সুবিধা পেলেও সরকার অপরদিকে মূল্যস্ফীতির জালে পড়তে হবে দেশের মানুষকে। এতে টাকার মান কমে গিয়ে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাবে। বন্ডের ওপর সুদ পরিশোধে সরকারকে বড় ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। একদিকে সরকারকে ঋণের টাকা শোধ করতে জনগণের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি এবং অতিরিক্ত কর দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য মোটেই সন্তোষজনক নয়। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া ১৯৯৮ সালে এবং গ্রিস ২০০১ সালে অতিরিক্ত ঋণের বোঝা বইতে গিয়ে অর্থনীতিতে দেউলিয়াপনায় পড়তে হয়েছিল। সবকিছুর মোকাবিলা করেও বাংলাদেশ সরকারের অর্থনীতিতে আর কোন  বিকল্প পথ না থাকায় এ ঝুঁকি নেয়া ছাড়া এখন আর কোন উপায়ও নেই। সরকার ব্যাংকগুলো থেকে টাকা নিয়ে তারল্য সংকটের মধ্যে ফেলেছে। রেন্টাল বিদ্যুতের কারণে আমাদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, বৈদদেশিক ঋণ এবং বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং সরকার ব্যাংকগুলো থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়ায় ব্যাংকগুলো অচলাবস্থা বিরাজ করাতেই সরকার এ পথে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রথম পর্যায় পাঁচ বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায় আট বছর মেয়াদী ৫০ কোটি ডলারের সার্বভৌম বন্ড ছেড়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদী বন্ডই আমাদের অর্থনীতির পরিকাঠামোয় ভালো। তবে সরকার যদি বন্ডের টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারেন তাতে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করবে। অপরদিকে সরকারি সিকিউরিটিজে পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ড বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সরকার। সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য একটাই- এ থেকে ঋণ গ্রহণ করা। ঋণ গ্রহণের এ ধারা মূলত পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। তবে প্রায় একদশক আগে ভারত প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) ও পেনশনের অর্থ দিয়ে সরকারি সিকিউরিটিজ কেনার ব্যবস্থা করে। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশ শ্রীলঙ্কাও ভারতের পথ অনুসরণ করে। এখন বাংলাদেশ একই পথের পথিক হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও এক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন : দেশে তহবিলযোগ্য (ফান্ডেড) পিএফ দিয়ে সিকিউরিটিজ কেনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধান নেই। কাজেই অভীষ্ট লাভ করতে হলে প্রথমেই বিধিমালা তৈরি করতে হবে। বস্তুত সরকার সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করার জন্য একজন পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে অশনি সংকেত ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যতই দিন যাচ্ছে, অর্থনীতির আশংকাজনক অবস্থাগুলো ততই কঠিন হয়ে উঠছে। বৈদেশিক লেনদেনের সামগ্রিক ভারসাম্য উদ্বেগজনক অবস্থায় চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে টান পড়েছে রিজার্ভের ওপর। ফলে ডলারের মূল্য ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলার বিপরীতে টাকার মান কমেই চলেছে। এতে মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনধারায়। মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। কষ্টের অতলান্তে হাবুডুবু খাওয়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবন থেকে দুর্ভোগের অপছায়া যেন সরতেই চাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত পরিবহন ও বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করাটা বর্তমানে দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার ভবিষ্যতের চিন্তা-ভাবনা ভুলে সঞ্চয়ের শেষ সম্বল পর্যন্ত খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার চলছে মূলত ব্যাংক থেকে ধার করা টাকায়। এক পর্যায়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সরকার এখন এ সমালোচনার পথ পরিহার করতেই বিকল্প পথের যাত্রী হয়েছে। শেয়ারবাজারসহ নানা ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আমাদের বিকল্প অবলম্বন হতে পারতো কৃষি খাত। কিন্তু প্রায় দুই দশক ধরে কৃষি খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে আছে। এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন হচ্ছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। কৃষি বিপণনে অব্যবস্থা বিরাজ করার জন্যই মূলত কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। শুধু ধান উৎপাদন করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাবে না। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে এই উপখাতগুলোকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও গত দুই দশকে আমরা মোটামুটি এগিয়েছি। একটা স্বস্তির অর্থনীতির মধ্যে বাস করব। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও শাসকগোষ্ঠী যদি এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদাসীনতার পরিচয় দেয় তাহলে এ স্বপ্নের রূপায়ণ যে দুরূহ হয়ে পড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্র সার্বিক বিষয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে নাজুক অর্থনীতি চাঙ্গা করবে-সেটাই আমাদের কামনা।
লেখক: সাংবাদিক এবং কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন