রাষ্ট্রের নানা অঙ্গ থাকে। সেগুলো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তার দক্ষতা ও নৈতিকতা তাকে জনস্বার্থের অনুকূল করে তোলে। যখন প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তখন তাদের দক্ষতা ও নৈতিকতায়ও টান পড়ে। একইভাবে দক্ষতা ও নৈতিকতা অর্জন করতে না পারলে তারা স্বভাবতই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়।
এই অবস্থা পৃথিবীর নানা দেশেই ঘটেছে। কিন্তু সেখান থেকে উঠে আসার মধ্যেই তারা তাদের শক্তি ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা কী করেছি, করছি?
প্রত্যক্ষ উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তার রায় সম্পর্কে যে বলেছেন- আমরা আমাদের স্বার্থে কোনো আদেশ দিই না, আমরা যে আদেশ দিই তা জনস্বার্থে-সেটাই আসল কথা।
এই যে সংসদে আলোচিত বিষয়গুলো আদালতের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে-তার কারণও জনস্বার্থ। যাতে জনগণের প্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ ন্যায় কাজ করে জনস্বার্থ রক্ষা করতে পারেন সে জন্যই তাদের এ অধিকার দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও ক্রোধ থেকে অন্যকে হেয় করে নিজের বা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার জন্য নয়। কোনো সংসদ সদস্য এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী ‘অধিকার’-এর সুযোগ না পেয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে তার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে যদি গণ্য করেন তবে তাকে ক্ষমতার সদ্ব্যবহার না বলে অপব্যবহারই বলতে হবে।
একইভাবে সর্বোচ্চ আদালতের বা তার অংশের বিচারপতি যদি মনে করেন জনগণের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায় করার পরিবর্তে তার কতটা ক্ষমতা আছে সেটা দেখিয়ে জনগণের বিস্ময় উত্পাদন করবেন তাহলে তিনিও ন্যায়ানুগ আচরণ করবেন না। আর যিনি ন্যায়ানুগ আচরণ করেন না, আইন অথবা বাস্তবতা যাই বলুক, নৈতিক ও ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনিও আর বিচারক থাকেন না।
সেদিন আদালতে আনিসুল হক যে একাধিকবার বলেছেন ‘দয়া করে বিষয়টি এখানেই শেষ করে দিন’ তাতে বিষয়টিকে সীমার মধ্যে রাখার একটি আন্তরিক প্রয়াস ছিল। কিন্তু তারপরেও যখন বলা হয় স্পিকার জনগণকে আদালতের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছেন এবং তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল-তাতে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছিল কি না সেই প্রশ্ন ওঠে।
এ ক্ষেত্রে স্পিকার ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী বলে সে ক্ষেত্রে তার অধিকার সীমাবদ্ধ করার যে কথা উঠেছে তা-ও যথার্থ কি না ভেবে দেখা প্রয়োজন। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশেরও প্রধান বিচারপতি, স্পিকারও শুধু সংসদে সীমাবদ্ধ নন, আইনপ্রণেতাদের প্রধান ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে চিহ্নিত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীও শুধু সরকারের প্রধান নির্বাহী নন, তিনি সরকার তথা জনগণেরও মূল চালিকাশক্তি। এই সকল ক্ষেত্রে সর্বোত্তম কাণ্ড ও মাত্রাজ্ঞান প্রয়োগ করলে দেখা যাবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর সহাবস্থান সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই শুভ নয়, তেমনি তা পরস্পরের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি করে সার্বিক প্রক্রিয়াকেই বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। ঈশপের গল্পে যেমন দেখা যায় পেট শুধু খায় এই অজুহাতে শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যখন তাকে খেতে দেয় না তখন তারা দেখে নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়ছে, হাত বা অন্যান্য অঙ্গের পক্ষেও আর কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সংসদে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষকের এত গাড়ি-বাড়ি থাকার কথা নয়। ঠিক, না থাকাই উচিত কিন্তু হিপোক্রিটাসের শপথ মেনে ডাক্তাররা যদি একে উপযুক্ত কলা ও বিজ্ঞান হিসেবে তার প্রকৃত চর্চা করেন তা হলে তাদেরও এত বাড়ি-গাড়ি থাকার কথা নয়। কিন্তু সত্য ও বাস্তব হচ্ছে, আছে এবং বিপুল পরিমাণে আছে। একইভাবে জনগণের সেবা করার জন্য যে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন জনগণের পক্ষ থেকে, আলাদিনের কোন চেরাগের বলে তারা সম্পদের পর সম্পদ করে চলেন তার হিসাবই বা কে দেবে? লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার এই বাস্তবতার মধ্যে নিজে কাচের ঘরে বসবাস করে অন্যের দিকে ঢিল ছুড়ে মারা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত তাও ভেবে দেখা দরকার। আজকাল ঘরের বউও জানেন, একটা এমপি ইলেকশন করতে কত টাকা লাগে এবং কীভাবে তিনি তা উসুল করেন। ব্যাপারটা এতটাই ডাল-ভাত হয়ে গেছে যে এ নিয়ে কেউ আপত্তিও করে না। আর করলেই বা তা কে শোনে?
এই ধরনের জনপ্রতিনিধিরা বস্তুগত সব সুবিধা নিজেরা ভোগ করেন তো বটেই, সংস্কৃতিতেও নিজেদের কর্তৃত্ব করতে না পারলে প্রাণ শীতল হয় না। এভাবে দেহের সব রক্ত যখন মুখমণ্ডলে জমা হয় তখন তাকে স্বাস্থ্য না ব্যাধি সেটা বোঝার হুঁশও তাদের হয় না।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দুঃখ পেয়েছেন, তার ‘ছাত্র’ই বলছেন, এরকম শিক্ষক যদি ছাত্রদের পড়ান তাহলে জাতির ভবিষ্যত্ কী হবে? জাতির ভবিষ্যত্ যা হওয়ার হোক, বর্তমানটাই যে ভালো নয়, সেটাই আপাতত চিন্তার কথা।
আবদুল্লাহ সায়ীদ তো ভালোই জানেন, দীর্ঘদিন অর্থাত্ বিভাগপূর্বকাল থেকে শিক্ষকতা করে মাত্র ১৯৭০ সালে শওকত ওসমান সহকারী অধ্যাপক হয়েছিলেন আর এখন এমন ‘অধ্যাপক’ও আছেন যারা নিজের বিষয়েও গুছিয়ে লিখতে পারেন না। তো শওকত ওসমান একবার বলেছিলেন, আমি যে সব ভালো ছাত্র পড়িয়েছি তা তো নয়, গর্দভ ও দুর্বৃত্তও সৃষ্টি করেছি। অতএব দুঃখের কিছু নেই। ‘সত্য’রে লও সহজে।
যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সংসদের মানমর্যাদা অথবা উপযুক্ত ভাষা সৃষ্টি করে তা শুধু ভাষারই বিষয় নয়, ভাবনা ও আইডিয়ারও বিষয়। আইডিয়া যদি উন্নত না হয়, তাহলে ভাষা কখনও উন্নত হতে পারে না। আগে আইডিয়া তথা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও তার বিকাশ দরকার। সেটা কোনো দান-খয়রাতের বিষয় নয়, অর্জনের বিষয়। আর অর্জন শারীরিক ও মানসিক শ্রমের ফসল। শারীরিক শ্রম কিছুটা করলেও মানসিক শ্রম করার লোকের খুবই অভাব। অতএব যা হওয়ার তাই, অর্থাত্ ‘ভাষা-দোষ’ ঘটে।
শুধু সংসদেই নয়, অন্যত্রও ভাষা ব্যবহারে আমরা শিথিল মনোভাবের পরিচয় দিই। যেমন খবরে আমাদের একজন প্রিয় নারীনেত্রী ডেপুটি স্পিকারকে ‘শওকত ভাই’ বলেছেন। কেন? আমরা সবকিছু ব্যক্তিগতভাবে নেব কেন? সে জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও দেখি ভাই, ভাবি ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে। এই যে আমরা নৈর্ব্যক্তিক হতে না-পেরে লেপ্টে অথবা মাখো মাখো হয়ে যাই- নৈর্ব্যক্তিকতা অথবা বৈজ্ঞানিকতার তা এক বড় শত্রু। শুধু রাজনৈতিক অর্থেই নয়, মানসিক অর্থেও পরাধীন হলে এই কাণ্ড ঘটে।
বাংলাদেশের চার দশক পার হয়েছে। আর কতদিন আমরা শিশুত্বের দোহাই দেব। ইংরেজিতে দুটো শব্দ আছে চাইল্ডলাইক ও চাইল্ডিশ। শিশুর মতো সরল হওয়া ভালো কিন্তু সব ক্ষেত্রে শিশুসুলভ আনাড়িপনা ভালো নয়। আর মতলবি শিশুত্ব তো বিষবত্ পরিত্যাজ্য। পরিণত হতে না পারলে তার উপজাত দূষণ থেকেও আমাদের পরিত্রাণ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন