মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

জাতীয় বাজেট : একটি পর্যালোচনা


মো. নূরুল আমিন

অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত গত ৭ জুন ২০১২-১৩ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। ৫৫০০০ কোটি টাকার এভিপিসহ এই বাজেটের আকার হচ্ছে ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকা যা বিদায়ী অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩০,৫২৫ কোটি টাকা বেশি। বলাবাহুল্য অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিতের পেশ করা এটি হচ্ছে ৬ষ্ঠ জাতীয় বাজেট। এর আগে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ সালে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দু'টি বাজেট পেশ করেছিলেন। প্রথম বাজেটটি ছিল ৪৭৩৮ কোটি টাকার এবং দ্বিতীয় বাজেটটি ছিল ৫৮৯৬ কোটি টাকার। এবার তিনি যে বাজেটটি পেশ করেছেন তার আকার পেশ করা প্রথম বাজেটের তুলনায় ৪০ গুণেরও বেশি। আবার এই সরকারের আমলে তিনি প্রথম যে বাজেট পেশ করেছিলেন (১১৩৮১৯ কোটি) টাকার অংকে তার চেয়ে ৭৭৯১৯ কোটি টাকা বেশি। এই আমলে তার চারটি বাজেট পেশের প্রাক্কালে পার্লামেন্টে কখনো বিরোধীদলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন না।
অর্থমন্ত্রী ঘোষিত ২০১২-১৩ সালের বাজেট অনুযায়ী মোট ব্যয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৩৯৬৭০ কোটি টাকা যা বিদায়ী অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটে বর্ণিত লক্ষ্যমাত্রার (১১৪৮৮৫ কোটি) তুলনায় ২৪৭৮৫ কোটি টাকা বেশি। এই অর্থ নতুন শুল্ক ও করের আকার দেশবাসীকে পরিশোধ করতে হবে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত পন্থায় আদায় হবে ১,১২,২৫৯ কোটি টাকা। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৫২০৬৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে এডিপির পরিমাণ হচ্ছে ৫৫০০০ কোটি টাকা। এখানে মজার বিষয় হচ্ছে এডিপি থেকে ঘাটতি বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২৯৩২ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। উন্নয়ন ও উন্নয়ন বহির্ভূত উভয় বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে জনপ্রশাসন (১৪%)। অগ্রাধিকারের দৃষ্টিকোণ এর পরের অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ (১২.২%), শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তি (১১%), ভর্তুকী (৭.৫%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (৭.৪%), পরিবহন ও যোগাযোগ (৬.৮%), প্রতিরক্ষা (৬%), সামরিক নিরাপত্তা কল্যাণ (৫.৩%), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (৫%), স্বাস্থ্য (৪.৭%), কৃষি (৪.৩%) এবং জননিরাপত্তা ও শৃক্মখলা (৪.২%)। সামগ্রিক ব্যয় বরাদ্দের অবশিষ্ট অংশ যেসব খাতে বণ্টনের প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেনশন ও আনুপাতিক (২.৩%), শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা (১.৫%), বিনোদন, ধর্ম ও সংস্কৃতি (০.৮%), গৃহায়ণ (০.৭%), অবশিষ্ট ৬.৩% ব্যয় ধরা হয়েছে বিবিধ খাতে।
বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ঋণ ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৩৩৪৮৪ কোটি ও ১২৫৪০ কোটি টাকা (মোট ৪৬০২৪ কোটি টাকা)। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা, অবশিষ্ট ১০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা আসবে ব্যাংক বহির্ভূত খাত বিশেষ করে জাতীয় সঞ্চয় থেকে।
বাজেটে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির ফলে যে সমস্ত পণ্যের দাম বাড়বে সেগুলো হচ্ছে-শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রপাতি, পোশাক ও তৈরি পোশাক সামগ্রী, ফলের জুস, আইসক্রিম, মিনারেল ওয়াটার, টয়লেট পেপার, সিরামিক পণ্যসহ ৩৭টি পণ্য। এসব পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী, ফল, গ্লুকোজ, জ্যাম-জ্যালি, নিউজপ্রিন্ট ছাড়া অন্যান্য কাগজ, সস প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসির ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং অর্থমন্ত্রী আইসক্রিমের ওপর ৩০ ভাগ শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। আগে আইসক্রিমের ওপর কোন শুল্ক ছিল না। প্রস্তাবিত অর্থ বছরে সিগারেটের ওপর শুল্ক মূল্য স্তর ভেদে ১-৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আবার তামাক জাতীয় পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হলেও বিড়ি, জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের ওপর এ বাজেটে কোন করারোপ করা হয়নি। সিরামিক ও কাঁচশিল্পের ওপর শুল্কের পরিমাণ ১২৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫২ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এখাতের পণ্যসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারে তার প্রভাব পড়বে। নতুন ও পুরণো বা রিকন্ডিশন গাড়ির শুল্ক স্তর পুনর্বিন্যাস করে ১৫০ শতাংশের একটি শুল্ক কাঠামো আরোপের প্রস্তাব করায় নতুন গাড়ির দাম বাড়বে।
নতুন বাজেটে কিছু পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহারের ফলে ঐসব পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভোজ্যতেল, ফল, শিশুখাদ্য, পামতেল, পাম অলিন, খেজুর ছাড়া অন্যান্য ফল ও ফুল, কৃষি কাজে ব্যবহৃত জৈব সার, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, ধান-গম মাড়াই যন্ত্র, চালের কুড়ার তেল, ১০০ টাকা মূল্যের প্লাস্টিকের তৈরি পাদুকা এবং হাওয়াই চপ্পল, ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ, মাল্টিমিডিয়া, মেশিনারি, ইনসুলিন পিন, মা ও শিশুর জন্য নিউট্রিশন সাপলিমেন্ট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ওয়েল্ডিং রড, অপরিশোধিত সূর্যমুখী তেল, জাহাজের ট্রান্সমিশন স্যাফট, প্রফেলার প্রভৃতি।
বাজেট প্রস্তাবে মোবাইল ফোন কলের ওপর নতুন করে ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এই করারোপের ফলে সরকার বাড়তি তিনশ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হবে। বাজেটে রফতানি আয়ের উপরও উৎসে আয়কর কেটে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট ঘোষণার পর এর আকার এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দেশব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ তথা ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠজনরা একে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, পেশাজীবী ও গবেষণা সংস্থাসমূহ, অর্থনীতিবিদ এবং শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা এই বাজেটকে বাস্তবায়ন অযোগ্য একটি দলিল এবং কল্পনাবিলাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ তাদের এক মূল্যায়নে বাজেটকে উচ্চাবিলাসী, অবাস্তব এবং ইন্দ্রজালের বাজেট বলে অভিহিত করেছে। সংস্থাটি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে বলেছে যে, দেশের অর্থনীতিতে কালো মেঘের ছায়া বিরাজ করছে। সদ্য বিদায়ী অর্থ বছরকে বর্তমান সরকারের শাসনামলের দুর্বলতম অর্থবছর বলে আখ্যায়িত করে সংস্থাটি বলেছে, ২০১২-১৩ আরও দুর্যোগপূর্ণ ও দুরূহ হবে। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী বিনিয়োগে শ্লথগতি প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জনকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী নির্ধারণ করেছেন তা অর্জন করা কল্পনা-বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। সংস্থাটি আরো বলেছে যে, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সংকটের সাথে দুর্নীতির ব্যাপ্তি এবং ঋণ প্রবাহের শ্লথগতি যুক্ত হয়ে সার্বিক বিনিয়োগে স্থবিরতা এনে দিয়েছে এবং বর্তমানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। গতিশীল ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেটের মুদ্রানীতির ওপর প্রাধান্য আরোপ করা হয়েছে যা কোন কাজেই আসবে না। এ জন্যে আর্থিক নীতিকে প্রাধান্য দেয়ার প্রয়োজন ছিল। একই সাথে সরকারের ভ্রান্ত আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত কারণে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত রয়েছে বলে সিপিডি মনে করে। বাজেটের আকারটি বড় হলেও বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের জন্য তাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না। কিন্তু তথাপি বাজেট প্রণয়নে সরকার তার সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করেছেন বলে মনে হয় না। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের প্রয়োজন হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের এর দুটিই অনুপস্থিত। স্থানীয় সরকারসমূহ বিশেষ করে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বলে পরিচিত উপজেলা পরিষদসমূহ এখন পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাজ করতে পারছেন না। তাদেরকে স্থানীয় এমপি এবং আমলাদের বশংবদ করে রাখা হয়েছে। প্রশাসনে দলীয়করণ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় অকালীন অবসরে পাঠানো হয়েছে না হয় ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশাল একটি বাজেট বাস্তবায়নের কল্পনা করা অত্যন্ত অবাস্তব একটি কাজ। আবার বাজেট ও এডিপির অর্থায়নের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাও প্রশ্নাতীত নয়। প্রথমত, বাজেটটি জনবান্ধব নয়; দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও নেই। আবার বিশাল ঘাটতি মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট বাড়াবে বলেও আমার স্থির বিশ্বাস। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, তিনি মূল্যস্ফীতির হার ৭.৫%-এ নামিয়ে আনবেন। কিন্তু কিভাবে তার কোন রূপরেখা দেননি। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে সরকার যথাক্রমে ৩৩,৪৮৪ কোটি ও ২০,৩৯৮ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ৫৩,৮৮২ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে ৭৮৫৮ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ২৩,৩০২ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখানে সরকারের নীট প্রাপ্তি মাত্র ৩০৫৮০ কোটি টাকা। কিন্তু এটাও অনিশ্চিত। প্রথমত বিগত বছরের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সরকার এপ্রিল মাস পর্যন্ত অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের যে ছাড় পেয়েছেন তার পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৮৩৫ মিলিয়ন ডলার। তার বিপরীতে আগামী অর্থবছরের জন্যে অর্থমন্ত্রী সাহায্যের পরিমাণ ধরেছেন ২.৫ মিলিয়ন ডলার। বিদেশী রাষ্ট্র এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর সাথে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সম্পর্কের যে অবস্থা তাতে আগামী বছরের এই লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব না বলে উপায় নেই। দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বহির্বিশ্বে বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাইকাসহ বেশকিছু দাতা সংস্থা দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশকে তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ সাহায্য বিতরণ স্থগিত করে দিয়েছে, সরকারের আচরণের পরিবর্তন না ঘটলে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা নেই।
দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের জটিলতাও অনেক বেশি। প্রথমত, এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ ও বিনিয়োগ সুবিধা সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হয়। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে আগামী অর্থবছরে ২৩০০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। চলতি অর্থবছরে প্রথম দশ মাসেই এই ঋণের পরিমাণ ২৯০০০ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে এবং আগামী অর্থবছরে তা যে অতিক্রম করবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। বাজেট প্রণয়নের আগে সরকার আইএসএফের কাছ থেকে তিন কিস্তিতে ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার চুক্তি করেছেন এবং এর প্রথম কিস্তি নেয়া হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে নির্ধারিত ঐ অঙ্কের অতিরিক্ত ঋণ নিতে গেলে আইএমএফ ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া যাবে না। এই জটিলতা অলঙ্ঘনীয়। বলা বাহুল্য, সরলী খাতের ১৬টি সংস্থার কাছে ব্যাংকসমূহের খেলাপী পাওনার পরিমাণ হচ্ছে ৬৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
আবার ব্যাংক বহির্ভূত খাত বিশেষ করে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী ৭৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই খাতে বিদায়ী অর্থবছরের সাফল্য হচ্ছে মাত্র ৩৮০ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ গত কয়েক বছর ধরে সঞ্চয় ভেঙ্গে সংসার চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে এখন সঞ্চয়ের চিন্তাও করতে পারেন না। এই অবস্থায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে বাজেটের অর্থ সংস্থানের প্রস্তাব যখন অর্থমন্ত্রী পেশ করেন তখন তাকে এই গ্রহের মানুষ বলে মনে হয় না। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাবার দরুন শিল্পায়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
বাজেটের ভাল দিকের তুলনায় খারাপ দিকটাই বেশি এবং ভাল দিক বিশেষ কল্যাণ খাতের সম্প্রসারণ ও বরাদ্দ বৃদ্ধি দলীয় আনুকূল্য বিতরণের কৌশল বলে মনে হয়েছে। জনপ্রশাসন ও আইনশৃক্মখলা খাতের বরাদ্দ আমলা ও শৃক্মখলাবাহিনীকে তুষ্ট করে বিরোধী দল নির্মূলের হাতিয়ারে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা এই বাজেটকে বরাবরের ন্যায় গতানুগতিক এবং দেশের মানুষকে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক অবাস্তব স্বপ্ন দেখানো ও তাদের পকেট কাটার একটা দলিল বলে মনে করি। বাজেট অনুযায়ী উন্নয়ন বহির্ভূত ব্যয়ে দেশী ও বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ ২৩৩০২ কোটি টাকার বরাদ্দ ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশের জন্য লজ্জাজনক। আমরা একইভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির নামে ৫৫ হাজার কোটি টাকার যে হিসাব দেয়া হয়েছে তাও উচ্চাভিলাসী এবং সরকারের বাস্তবায়ন সামর্থ্যের বাইরে। বাজেটে একদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির বৃহদাকার চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি, অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি বিভাগ ও এজেন্সিসমূহের সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষণও এখানে স্পষ্ট নয়। বাজেটে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের ওপর অতিরিক্ত কর ও ঋণের বোঝা চাপানো হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাজেটে ৯৫৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে গ্যাস ও কয়লার প্রয়োজন তার অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদায়ী বছরের ন্যায় প্রস্তাবিত অর্থবছরেও কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে বর্তমানে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগতপ্রায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন দেশে দৈনিক গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতি যথাক্রমে ৩০ কোটি ঘনফুট ও ১৫০০ মেগাওয়াট।
অবশ্য বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী এই ঘাটতির পরিমাণ ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ও ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট শিল্পের সকল উপখাতের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়াবহ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে যেমন স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে তেমনি সরকারি বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহেও সাংঘাতিক ভাটা পড়েছে। কলকারখানাসমূহের উৎপাদন তাদের মূল ক্যাপাসিটির অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে, ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস এবং ব্যয় বৃদ্ধি রফতানি বাজারে আমাদের পণ্যসামগ্রীর প্রতিযোগিতার সামর্থ্যকে খর্ব করে দিচ্ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংকসমূহের খেলাপী ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। তার ওপর বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ২৩০০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে বলে আমরা মনে করি।
বাজেটে ২৪৭৮৫ কোটি টাকার নতুন কর জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। বলাবাহুল্য, ইতোমধ্যে সরকার বাজেট প্রস্তাবের বাইরে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সেবার উপর করারোপ করছেন বলে জানা যায়। ইউরিয়া সার, সিএনজি, পানি ও জ্বালানি তেল প্রভৃতির মূল্যবৃদ্ধি এর আওতায় পড়ছে। মোট বাজেটের বৈদেশিক নির্ভরশীলতা এর সবচেয়ে দুর্বলতম দিক। আমরা আগেই বলেছি, ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক ঋণের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে তুলবে যার ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহ শ্লথ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির হারও বৃদ্ধি পাবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস খাদ্য উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে। নির্মাণসামগ্রীর উপর করারোপ, রেজিস্ট্রেশন ফি বৃদ্ধি প্রভৃতি স্থির ও মাঝারি আয়ের লোকদের বাড়িঘর তৈরিই শুধু নয়, আবাসন খাতের উপরও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে।
ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের কর মুক্ত আয়ের সীমা জীবনযাত্রার ব্যয় ও বিদ্যমান মূল্য কাঠামোর প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরেই তিন লাখ টাকা করার দাবি উঠেছিল। বাজেটে তা পূর্ববর্তী বছরের ১.৮০ লাখ রাখা হয়েছে যা শুধু অবাস্তব নয়, জুলুমও বলে আমাদের বিশ্বাস। এই সরকারের বহুল প্রচারিত পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) থিওরি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত তিনটি অর্থবছরে এর অনুকূলে প্রদত্ত বরাদ্দের কোনও অর্থ ব্যয়িত হয়নি। আবার পিপিপি বাস্তবায়নের জন্য সরকার কোনও নীতিমালাও তৈরি করেননি। এমতাবস্থায় বাজেটে পিপিপি'র অনুকূলে নতুন বরাদ্দকে আমরা পরিহাস বলে মনে করি। এই বরাদ্দ দলীয় ক্যাডারদের উজ্জীবিত করার তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিনা তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর নির্মাণের ব্যাপারে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দের কোন ইঙ্গিত নেই। উপরোক্ত অবস্থায় প্রদর্শনীমূলক বাজেটের ধারণা প্রত্যাহার করে বাজেটের আকার হ্রাস, নতুন করারোপ প্রস্তাব বাতিল এবং সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যানেঞ্জসমূহ মোকাবিলার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক দিকদর্শন দিয়ে বাজেট পুনর্গঠন জরুরি বলে আমি মনে করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন