॥ মীযানুল করীম ॥
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন একবার জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে কয়েকজন অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের একজন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, অন্যজন প্রফেসর মোজাফফর আহমদ। সাক্ষাৎকার উপলক্ষে মোজাফফর আহমদের সাথে প্রথম কথা বলার সুযোগ পাই। ধানমন্ডির শঙ্কর বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনির পাশেই তার বাড়ি। সেখানে যথাসময়ে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। একজন নামকরা অর্থনীতিবিদের সহজ-সরল আচরণ, সৌজন্য ও অন্তরঙ্গতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ পরিচয় ছাপিয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন দুর্নীতি, পরিবেশ, সুশাসন প্রভৃতি ইস্যুতে জাতীয় আন্দোলনের একজন মুরব্বিস্থানীয় সংগঠকরূপে। গত ২২ মে রাতে বাসায় এশার নামাজ আদায়ের পর তিনি ইন্তেকাল করেছেন ৭৯ বছর বয়সে। অনেক বছর ধরে গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন শেষ পর্যন্ত। ১০ বছর আগেই সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছিলেন, রক্তের মারাত্মক রোগের কারণে আর মাত্র তিন বছর তার আয়ু। আল্লাহর রহমতে এরপর আরো সাত বছর জীবিত ছিলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) পর মৃত্যুকালে ‘সুজন’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। তবে টিআইবি তাকে সর্বাধিক পরিচিত ও আলোচিত করে তুলেছিল।
মোজাফফর আহমদের জীবনের দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলোÑ ব্যক্তিজীবনে তার ধর্মপরায়ণতা এবং কর্মজীবনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে (মন্ত্রীর সমমর্যাদা) বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের স্থপতির দায়িত্ব পালন। এবার অধ্যাপক মোজাফফরের মৃত্যুর পর পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা ছাপা হয়েছে তার স্মৃতিচারণ এবং অবদান উল্লেখ করে। এগুলোতে তার ধর্মভীরুতার কথা কেউ প্রশংসা, কেউবা বিস্ময়ের সাথে তুলে ধরেছেন। অন্য দিকে যে বিষয়টি দু-একজনের সামান্য উল্লেখ ছাড়া চোখে পড়েনি, তা হলোÑ জিয়ার বিখ্যাত উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম হিসেবে মোজাফফর আহমদের ভূমিকা। তখন দেশে ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিপরিষদ ছিল না। রাষ্ট্রপতি ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন উপদেষ্টাদের। তাদের প্রায় সবাই ছিলেন মেধাবী ও খ্যাতনামা। ‘রতনে রতন চেনে।’ উন্নয়নের রাজনীতির প্রবক্তা জিয়া দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই কাণ্ডারিদের বাছাই করতে ভুল করেননি। তিনি কোনো রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার প্রশ্রয় না দিয়ে উদারভাবে বাছাই করেছিলেন উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য। মোজাফফর আহমদ রাজনৈতিক অর্থনীতি বা পলিটিক্যাল ইকোনমির বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ বিষয়ে যুগ যুগ ধরে কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতিতে শামিল হননি। তার নির্দলীয় নিরপেক্ষ চরিত্র আজীবন বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দিয়ে শিল্প বিভাগের প্রধান হয়েছেন। তেমনি জিয়ার আহ্বানে তার উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়ে হয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ‘বস্ত্রমন্ত্রী’ (যদিও মন্ত্রী না বলে অফিসিয়ালি ‘উপদেষ্টা’ই বলা হতো)। সে ভূমিকায় তিনি বরাবরের মতো সততা ও দায়িত্ববোধের মাধ্যমে অবদান রেখেছেন বস্ত্র ও পাট শিল্পের উন্নয়নে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই মোজাফফর আহমদ মুজিব ও জিয়াÑ দুই আমলেই সরকারের কর্মকাণ্ডে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রেখেছেন। অথচ দলীয় রাজনীতির মতো প্রশাসনিক বা সরকারি চাকরির প্রতিও তার অনীহা ছিল। যা হোক নবগঠিত বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম শীর্ষ ব্যক্তি হওয়ার পরও এবং তখন বস্ত্র শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখা সত্ত্বেও তার জীবনের এই অধ্যায়টিকে এবার যেন সচেতনভাবে লুকানোর প্রয়াস চলেছে। সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহলবিশেষ ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সুবিধামতো ইতিহাস বিকৃত করার সাথে সাথে অনেকটা গোপনও করছে (অবশ্য তা লুকিয়ে রাখা যায় না)। মোজাফফর আহমদের জীবন ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এখন তা লক্ষ করা যাচ্ছে।
জিয়াউর রহমান দেশ পরিচালনার জন্য উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ করেছিলেন। এ দেশে আর কোনো সরকারের সময়ে একই ক্যাবিনেটে এত মেধা, প্রতিভা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমাহার হয়েছিল বলে জানা নেই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী অর্থমন্ত্রী, এম সাইফুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। ২০০৯ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি।’ এতে তিনি জিয়ার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিকে তার উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে আমিও ছিলাম। আর ছিলেন ড. এম এন হুদা, জনাব হাফিজ উদ্দিন, সৈয়দ আলী আহসান, ড. এম এ রশীদ, ড. ফসিহ উদ্দিন মাহতাব, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং আরো কয়েকজন। এ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের লোকে বলত, A Galaxy of Talents. (তারার মতো উজ্জ্বল প্রতিভাবানদের সমষ্টি)।’
দেখা যাচ্ছে, ‘উপদেষ্টামণ্ডলী’র আরেক নাম হয়ে গিয়েছিল ‘তারকামণ্ডলী’ এবং তা অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই। উপরিউক্ত ব্যক্তিরা ছাড়াও জিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল, আকবর কবির, প্রফেসর ইকবাল মাহমুদ, আজীজ-উল-হক প্রমুখ।
বাংলাদেশের প্রশাসনে বস্ত্র, ধর্ম, রেল, নারী ও শিশু, যুব ও ক্রীড়া প্রভৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা জিয়াউর রহমানের কৃতিত্ব। অধ্যাপক মোজাফফরের অর্থনীতির জ্ঞান এবং শিল্প খাতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জিয়ার ভালোই জানা ছিল। সর্বোপরি, তার সততা ও দেশপ্রেমের ওপর পুরো আস্থা ছিল। তাই জিয়া তাকেই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রথম দিকনির্দেশকের গুরুদায়িত্ব দিলেন। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে মোজাফফর আহমদ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থার (ইপিআইডিসি) ঊর্ধ্বতন পদে ছিলেন। এরপর বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে শিল্প বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আর গভীর পড়াশোনা, গবেষণা এবং সেই সাথে মেধা তো আছেই। তিনি এসব কিছু মিলিয়ে বস্ত্র ও পাট সেক্টরের উন্নতির আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৭ সালের দিকে। বাংলাদেশের পাট ও বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং রফতানি সম্ভাবনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান স্বীকার করা উচিত। বাংলাপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, ‘১৯৭৬ সাল পর্যন্ত যৌগিক কারখানাগুলোতে আধুনিক রঞ্জন সুবিধাদি সীমিত ছিল এবং হস্তচালিত তাঁতশিল্পের সনাতন পদ্ধতিতে হাত দিয়ে রঞ্জনকাজ চলত। ১৯৭৬ সালের পরে বেসামরিক খাতে স্বয়ংক্রিয় ও অর্ধস্বয়ংক্রিয় রঞ্জন (ডাইং), মুদ্রণ (প্রিন্টিং) ও ফিনিশিং সুবিধাদি সংস্থাপিত হয়।’ অন্য দিকে, ১৯৭৭-৭৮ সালে রফতানিমুখী গার্মেন্ট বা তৈরী পোশাক শিল্পের সূচনা হয়েছিল।
প্রফেসর মোজাফফর আহমদের সাথে যার ৫৭ বছরের দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতা, সেই প্রফেসর রেহমান সোবহান আওয়ামী ঘরানার শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। মোজাফফর সাহেব জিয়ার উপদেষ্টা হওয়ায় তিনি ‘বিস্মিত’ হলেও সমালোচনা করেননি। স্মৃতিচারণে রেহমান সোবহান লিখেছেন, ‘আমি তাকে চিঠি লিখে জানালাম, যারা জিয়ার সাথে যোগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে শুধু তার নিয়োগ আমাকে বিস্মিত করেছে। সে দায়িত্বে (অর্থাৎ উপদেষ্টা হিসেবে) থাকাকালে মোজাফফর আহমদ বিশ্বাস করতেন, পাট ও বস্ত্রশিল্প খাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটা করেছেন, তা আমার জানা নেই। তবে যারা তার কাজের সাথে পরিচিত, তারা এটা স্বীকার করেছেন যে, উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের সময় তিনি সম্পূর্ণ সততার সাথে ব্যাপক ও কঠিন পরিশ্রম করেছেন।’ রেহমান সোবহান তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মোজাফফর আহমদের ভূয়সী প্রশংসা করা স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের প্রথম বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম কর্ণধাররূপে এই বন্ধু কী অবদান রেখেছেন, তা ‘জানেন না’ এটা অস্বাভাবিক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান মরহুম মোজাফফর আহমদের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং তার নানা গুণের উল্লেখ করেছেন এক লেখায়। তিনি বলেছেন, ‘মোজাফফর স্যারকে দেখি সামরিক শাসক জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য হতে, যেমনটি হয়েছিলেন ‘বাংলার বিবেক’ হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক আবুল ফজল। জিয়ার সাথে খাল কাটতে গিয়েছিলেন এ দেশের অনেক বামপন্থী নেতা।
অধ্যাপক আবদুল মান্নান আওয়ামী মহলের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট। তিনি একই লেখায় বলেছেন, ‘সামরিক শাসকদের সাথে ভদ্র এবং স্বাধীনচেতা মানুষদের কাজ করতে পদে পদে অসুবিধা হয়। সম্ভবত প্রথম দিকে তারা গিয়েছিলেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের হতাশার কারণে।’
জিয়া ছিলেন সামরিক শাসক। তার সাথে মোজাফফর আহমদ মাসের পর মাস কাজ করেছেন। উপদেষ্টাদের অনেকেই দুই বছরের মতো জিয়ার সাথে কাজ করেছেন। এমনকি বামপন্থী ও সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়, অধ্যাপক আবুল ফজলও বছর দেড়েক জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর তিনি সেখানকার ভাইস চ্যান্সেলরের পদ ছেড়ে স্বেচ্ছায় জিয়ার উপদেষ্টা হন। তারা তো অভদ্র ও নতজানু ছিলেন না। অথচ এ ধারণা হতে পারে পূর্বোক্ত উদ্ধৃতি থেকে। জিয়া যে তাদের মতো ব্যক্তিদের মনেও আশাবাদ জাগিয়েছিলেন, তা ওই বিরূপ মন্তব্যেও স্পষ্ট।
মোজাফফর আহমদ যে সার্কেলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার। কিন্তু তিনি সব সময়ই ছিলেন ধর্মনিষ্ঠ। নামাজ আদায়ে তিনি কী রকম আন্তরিক ছিলেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি। সম্ভবত ১৯৯০-৯১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সেমিনার ধরনের বড় অনুষ্ঠান। মাগরিবের সময় হলো। টিএসসিতে যে নামাজের পরিবেশ নেই, তা বলা বাহুল্য। মঞ্চ থেকে নেমে এলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও অধ্যাপক শামসুল হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি)। তাদের সাথে আমিও নামাজের জায়গার সন্ধানে। গেটের পাশে দেখা গেল পুরনো ও ছেঁড়া চাটাই, এসব পড়ে আছে। সেই নোংরা জায়গায় মোজাফফর সাহেবসহ আমরা কয়েকজন জামাতে নামাজ পড়লাম।
১৯৭৫ সালের শেষ দিকে মোজাফফর আহমদ ও রেহমান সোবহান একসাথে গবেষণা করেছেন নরওয়ের বার্জেনে। বিষয় ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সরকারনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। সে প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান লিখেছেন, এই দুই মাসে তার সম্পর্কে অনেক জানতে পারলাম।... দেখলাম, তিনি গভীর ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। লোক দেখানো ছাড়াই তিনি ধর্মবিশ্বাস চর্চা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মকর্ম নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়। বরং নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তার ধর্মবিশ্বাসের প্রভাবের মাত্রা নিরূপিত হবে।... রমজান মাস এলো। মোজাফফর একটা রোজাও কাজা করলেন না।’
আমেরিকায় পুরনো সহকর্মী অর্থনীতিবিদ মাহফুজুর রহমানের বাসায় উঠেছিলেন মোজাফফর আহমদ। সে সময়ের কথা জানিয়ে মাহফুজুর রহমান লিখেছেন, তিনি সব অবস্থায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় বের করে নিতেন। এমনকি বোস্টনে গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনগুলোতেও ব্যতিক্রম হতো না। তার কাছে, ঈমান ও বুদ্ধিবৃত্তি পরস্পরের সাথে চমৎকারভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
মোজাফফর আহমদের প্রতিবেশী অধ্যাপক আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, তিনি বৃদ্ধ ও অসুস্থ অবস্থায়ও রমজানে নিয়মিত খতম তারাবি আদায় করতেন। মসজিদে গিয়ে। লোডশেডিংয়ের দৌরাত্ম্যে যখন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় সবাই গরমে অস্থির, তখন মোজাফফর সাহেব গায়ের জামাটি খুলে নামাজ পড়তেন। তবুও মসজিদ ছেড়ে আসতেন না।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যখন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন, তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনকাল। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকারের সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার কত বেশি অবনতি হয়েছিল, তা ফুটে উঠেছে মোজাফফর আহমদের ওপর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখায়।
পূর্বোক্ত মাহফুজুর রহমান জাতিসঙ্ঘের সাবেক অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন। তিনি অধ্যাপক মোজাফফরের সহকর্মী ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনে। গত ২৯ মে ডেইলি স্টারে তিনি লিখেছেন তখনকার একটি ঘটনা। ‘দীর্ঘ কর্মদিবস শেষে এক বিকেলে তিনি (মোজাফফর আহমদ) তার পুরনো ভক্সওয়াগন গাড়িতে আমাকে লিফট দিলেন। গাড়ির কোনো ‘ইগনিশন কি’ নেই। সেই দিনগুলো ছিল আইনহীনতা, ছিনতাই, রাহাজানির। তখন গাড়ির দরজা ভেঙে চুরি এবং অন্যান্য অপরাধ ঘটত খুব। আমার এক সহকর্মীর গাড়ির উইন্ডশিল্ড চুরি হয়ে গেলে তিনি এর বদলে স্বচ্ছ প্লাস্টিক লাগিয়েছিলেন। সম্ভবত মোজাফফর আহমদের গাড়িও দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছিল। দেখলাম, তার গাড়িটির ড্যাশবোর্ডের একাংশ উধাও; তারগুলো বেরিয়ে আছে। সেদিন গাড়িটি পথে বারবার থেমে যাচ্ছিল।
আশির দশকের মাঝামাঝি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। সেবার বার্ষিক সভা হয়েছিল ফার্মগেটের কৃষি গবেষণা পরিষদ (বিএআরসি) মিলনায়তনে। উদ্বোধন পর্বে হাজির ছিলাম পেশাগত প্রয়োজনে। সেখানে পরিচিত এক সরকারি কর্মকর্তার দেখা। তার সাথে আলাপে বুঝতে পারি, সমিতির নির্বাচন কেন্দ্র করে ‘একাডেমিশিয়ান বনাম ব্যুরোক্র্যাট’ মেরুকরণের চেষ্টা চলছে। কারণ, এক জাঁদরেল আমলা ছিলেন মোজাফফর আহমদের প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনে তিনি সেই আমলাকে হারিয়ে রেহমান সোবহানের পরবর্তী সভাপতি হলেন অর্থনীতি সমিতির। এ দিকে পরাজিত প্রার্থী রাজনীতির সুবাদে পরে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষনেতা হতেও সক্ষম হয়েছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন