॥ বদরুদ্দিন আহমদ ॥
ভারতবর্ষের পার্টিশনের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের আমলে বিলেত থেকে এলেন স্টাফোর্ড ক্রিপস, আলেকজান্ডার ডাব, প্যাথিক লরেন্স। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতেই এদের আগমন। সফল আলোচনা হয় কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সাথে। ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে। আলোচনা অন্তে ১৬ মে ১৯৪৬ সালে ভারত বিভাজনের প্ল্যান ঘোষণা করেন তারা। এই প্ল্যানই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অথবা গ্রুপিং সিস্টেম নামে খ্যাত। কংগ্রেস প্রথম তা মেনে নেয়। জিন্নাহ এই সিস্টেম মেনে নিয়ে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তান পেয়ে গেছি।’ এতে বোধ হয় খটকা লাগল নেহরুর মনে। প্রেস কনফারেন্সে বললেন তিনি, কংগ্রেস গ্রুপিং সিস্টেম মেনে নিয়েছে ঠিক, কিন্তু গণপরিষদের সদস্যদের ওপর আমাদের এখতিয়ার নেই। এই উক্তির পর জিন্নাহ গ্রুপিং সিস্টেম বাতিল করে দিয়ে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করলেন। সোহরাওয়ার্দী তখন বঙ্গদেশের চিফ মিনিস্টার। সংগ্রাম দিবসে কলকাতা শহরে ভয়াবহ দাঙ্গা হলো। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সেই দাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর দাঙ্গা হয় নোয়াখালীতে, তারপর বিস্তার লাভ করে। বিহারে দাঙ্গা হয় ব্যাপক। বিচলিত বোধ করেন লর্ড ওয়াভেল। নেহরুর সাথে তার বচসা হয়। এই সময় তিনি ওয়াভেলকে বদলি করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বলতে কৃষ্ণ মেননকে নির্দেশ দেন। এটলি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। লেবার পার্টির প্রধান হিসেবে আগে থেকেই কংগ্রেসের সাথে তার ছিল গভীর সম্পর্ক। হঠাৎ লর্ড ওয়াভেলের বদলির আদেশ এলো। তাকে এই বদলির ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। মাউন্ট ব্যাটেন এলেন ভারতে, ওয়াভেলের কাছ থেকে দায়িত্বভার বুঝে নিতে। লর্ড ওয়াভেল অবাক, এটা তার জন্য ভীষণ অপমানকর ব্যাপার। তিনি ুব্ধ হলেন। মাউন্ট ব্যাটেন ভাইসরয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর নেহরুর বাসভবনে ডিনারে যোগদান করেন। ব্যাপারটা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং নেহরু আর বল্লভভাই প্যাটেলের সাথে তিনি আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। এরপর কংগ্রেসের মাওলানা আজাদ ও সর্দার বলদেব সিং আর মুসলিম লীগের লিয়াকত আলী খান এবং সর্দার আবদুর রব নিশতারের সাথেও আলাপ করেন। শেষ পর্যন্ত পার্টিশনের একটা খসড়া ম্যাপ তৈরি করে এটলির কাছে বিলেতে পাঠান। মাউন্ট ব্যাটেন কয়েক দিনের বিশ্রাম নিতে গেলেন বড়লাটের শৈলাবাস সিমলায়। এখানে ১১টি প্রদেশের গভর্নরের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্স। পার্টিশন প্ল্যানের খসড়া প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে গেছে। ১১ জন গভর্নরকে বেছে নিতে হবে ভারত অথবা পাকিস্তান, কোন পরিবারভুক্ত হবেন তারা। কোনো প্রদেশের হিন্দু-মুসলমানের বেশির ভাগ যদি চায়, তবে কোনো তরফে যোগ না দিয়ে স্বতন্ত্র থাকতে পারেন। অবশ্য ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন তখনো ভাইসরয় জলাঞ্জলি দেননি। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে ব্রিটেনের চেষ্টার কথাটা সারা পৃথিবীকে জানাতে হবে। যদি ব্রিটেন ব্যর্থ হয় সে দায় তার নয়। পার্টিশন বেছে নেয়া হয়েছে, কারণ এটা ভারতের জনগণের অভিমত। মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, ‘এত ক্ষীণ জীবনীশক্তি নিয়ে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের টিকে থাকা যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ। সুতরাং স্বখাত সলিলে তাকে ডুবে মরতে হবে। সেই সুযোগ তাকে দেয়া উচিত যাতে ঐক্যবদ্ধ ভারতের মধ্যে সসম্মানে ফিরে আসতে পারে মুসলিম লীগ।’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের ছাড়াও সেনাবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে একান্তে আলোচনাও করতে হয়েছে। পূর্বসূরি কঠোর পরিশ্রম করে বছরের পর বছর যা করতে পারেননি, তিনি মাত্র দু’সপ্তাহে সেই অসাধ্য কাজ সমাধা করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারত বিভাজনের খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অবশ্য এটলি সরকারকে ভরসা দিতে হয়েছে যে, প্রস্তাবিত খসড়া ভারতীয় নেতারা বিনাদ্বিধায় মেনে নেবেন। তার আত্মবিশ্বাস এত দৃঢ় ছিল যে, সিমলার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই মাউন্ট ব্যাটেন ঘোষণা করেছিলেন, ১৭ মে দিল্লিতে ফিরে এসে খসড়া প্রস্তাবটা সবার অবগতির জন্য পেশ করবেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা যদি প্রস্তাব মন দিয়ে যাচাই করেন তাহলে দেখতে পাবেন, খসড়ার মধ্যে দুটো নয়, তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব আছে। মাউন্টব্যাটেন ধারণাটি প্ল্যানের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। এর ফলে ভারতের যেকোনো প্রদেশ স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে। এই শর্তটা অন্তর্ভুক্ত করার আসল লক্ষ্য হলো বঙ্গদেশ। এখানকার সাড়ে ছ’কোটি হিন্দু-মুসলিম অধিবাসী যদি ইচ্ছা করে তাহলে কলকাতাসহ স্বশাসিত থাকতে পারে। এই ভাবনাটি তার মাথায় ঢুকিয়ে দেন বঙ্গদেশের মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। মাউন্ট ব্যাটেনের মতে, জিন্নার প্রস্তাবের চেয়ে এটা অনেকটা বাস্তবসম্মত। বাংলার কংগ্রেস নেতারাও এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন সবার স্বার্থেই। জিন্নাহও আপত্তি করবেন না এই প্রস্তাবে। পাছে ব্যাপারটা বানচাল হয়ে যায় তাই নেহরু ও প্যাটেলের কাছে ফাঁস করেননি প্রস্তাবটা। আর এই ভুলটাই এখন তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তার মনে হচ্ছে, রাজধানী কলকাতা আর নৌবন্দর হাতছাড়া করতে কি রাজি হবেন ওরা? কলকাতা ঘিরে থাকা অতগুলো পাট ও সুতার কলও হাতছাড়া হয়ে যাবে এক সাথে। সুতা আর পাট কলের মালিক শিল্পপতিরা কংগ্রেসের আর্থিক সহায়। মাউন্ট ব্যাটেনের মনে হলো, মাত্র একজনই আছেন যার সাথে গোপনে আলোচনা করে তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারেন। সহকর্মীদের প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়ে নেহরুকে এক দিনের ছুটি কাটাতে আমন্ত্রণ জানালেন সিমলায়। তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য এই উপমহাদেশে তার একমাত্র নির্ভরতা। মাউন্ট ব্যাটেন লক্ষ করেছেন, তার স্ত্রীর সাথেও ‘প্রীতির সম্পর্ক’ গড়ে উঠেছে নেহরুর। তিনি ছাড়া আর কেউই বোধ হয় নেহরুকে সংশয়ের খোলস ভেঙে বের করতে পারবেন না। এই মহিলাই তাকে ‘সান্নিধ্যের উষ্ণতা’ দিয়েছেন। প্রায়ই তারা আলাপ করতেন কিংবা বড়লাট বাহাদুরের খাস পুকুরে দু’জনে সাঁতার কাটতেন, তখন তার সান্নিধ্য দিয়ে এডুইনা যেন নেহরুকে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতেন। এই বন্ধুত্বের মাধ্যমে অনেক ‘বিরূপ অবস্থা’ কেটে গেছে এবং নিপুণভাবে এডুইনা তার স্বামীর চেষ্টাগুলো সফল করেছেন।
মাউন্ট ব্যাটেন সহকর্মীদের একদিন ডেকে পাঠালেন। পরবর্তী সঙ্কল্পের কথাটা বুঝিয়ে বললেন। সবাই হতবাক। তারা বুঝালেন, জিন্নাহকে না দেখিয়ে লন্ডন থেকে অনুমোদিত পার্টিশন প্ল্যানটা যদি নেহরুকে দেখানো হয়, তা হলে মুসলিম লীগ নেতার সাথে প্রতারণা করা হবে। জিন্নাহ যখন ব্যাপারটা জানবেন, তখন মাউন্ট ব্যাটেনের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ধুলায় গড়াগড়ি যাবে। দেশময় তার নামে বিরূপ প্রচারণা চালাবে মুসলিম লীগ। সুতরাং যেন এ কাজটি না করেন।
তাদের যুক্তি শুনলেন তিনি। বললেন, আপনাদের যুক্তি অকাট্য। কিন্তু এটা আগে নেহরুকে দেখাবই। হয়তো এটা আমার সংস্কার। সেই রাতেই নেহরুকে আমন্ত্রণ করলেন। দু’জনের হাতেই পানীয়ের গ্লাস। লন্ডন থেকে সংশোধিত হয়ে আসা প্ল্যানটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে নেহরুর হাতে দিলেন। নেহরু কিছুটা অবাক। মাউন্ট ব্যাটেন মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনার বেডরুমে গিয়ে পড়বেন। কাল মতামত দেবেন।’ মাউন্ট ব্যাটেনের দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন নেহরু, খুব খুশি তিনি। বোধ হয় কৃতার্থও। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। অন্য দিকে নেহরু, শোয়ার ঘরে গিয়ে প্ল্যানটার পাতা ওল্টাছেন আর স্তম্ভিত হচ্ছেন। প্ল্যানটা যেন ‘আদ্যন্ত প্রতারণা’। এই প্ল্যান থেকে যে মূর্তি বেরিয়ে আসছে, তা অখণ্ড ভারতের মূর্তি নয়, ডজনখানেক ছোট ছোট রাষ্ট্রের চিত্রপট। বাংলার জন্য যে দরজাটা হঠাৎ করে খুলে দিয়েছেন মাউন্ট ব্যাটেন, নেহরু ভাবলেন, এতে শুধু কলকাতা বন্দর নয়, সেই সাথে হাতছাড়া হয়ে যাবে অনেক কলকারখানা আর বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চল। সব চেয়ে বেদনাদায়ক হলো যে, কাশ্মির আর ভারতের অঙ্গীভূত থাকছে না। বিশাল হায়দরাবাদ অঞ্চল। স্বশাসিত এই অঞ্চলকে বরদাস্ত করা যাবে না। তা ছাড়া অন্তত আধা ডজন নেটিভ স্টেট স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনবরত দাবিদাওয়ার দৌরাত্ম্যে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় এ কী খেলায় মেতেছে ব্রিটেন। ফ্রাগমেন্ট অ্যান্ড কুইট অর্থাৎ ভেঙেচুরে দেশ থেকে চলে যেতে চাইছে ওরা। এমন কিছু ঘটতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। এসব ভেবে রাগে থরথর করে কাঁপছেন নেহরু। খসড়া প্ল্যান নিয়ে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করলেন রাগে ক্ষোভে কৃষ্ণ মেননের শোয়ার ঘরে চুপ করে ঢুকে পড়লেন। এই বিশ্বস্ত মানুষটিকে সাক্ষী করে নিয়ে এসেছিলেন। এমন উ™£ান্তের মতো নেহরুকে ঘরে ঢুকতে দেখেন স্তম্ভিত কৃষ্ণ মেনন। নেহাত হাতের কাগজখানা সজোরে ছুড়ে মারলেন ওর দিকে। চিৎকার করে বলে উঠলেন, সব শেষ।
মাউন্ট ব্যাটেন যে প্রতিক্রিয়া শুনতে চেয়েছিলেন, তা নেহরুর পত্রের মাধ্যমে পেয়ে গেলেন, এর ভাষা ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
তিনি ছ’সপ্তাই ধরে এত যতœ করে যে তাসের ঘর বানিয়েছিলেন, তা এক ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ। নেহরু লিখেছেন, প্রায় অঙ্ক কষে প্ল্যানটা তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভারত ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে দেশটাকে ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দেয়া যায়। কংগ্রেস দলের কাছেও প্ল্যানটা অপছন্দের।
যিনি সদম্ভে বলে এসেছেন যে, ১০ দিনের মধ্যেই সঙ্কট মোচনের সমাধান ঘোষণা করবেন, তিনি চুপসে গেলেন। হয়তো আজই এটলি ক্যাবিনেটে তার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তিনি এটলি সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমর্থন আদায় করে দেবেনই। এখন মনে হচ্ছে, যারা মেনে নিলেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, সেই কংগ্রেস দলের স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে প্রস্তাবটা। ভাবলেন, ভাগ্যক্রমে প্ল্যানটা নেহরুকে দেখিয়েছিলাম। নইলে প্ল্যানটা শুধরে নিতে খুবই অসুবিধা হতো। মাউন্ট ব্যাটেনের অনুরোধে আরো একটি রাত থাকতে রাজি হলেন নেহরু। স্থির হলো, এরই মধ্যে খসড়া প্ল্যানের সংস্কার করে সেটাকে ‘কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্য’ করবেন মাউন্টব্যাটেন। এদিকে বঙ্গদেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তবে মাউন্ট ব্যাটেন তখন নিঃসন্দেহ, জিন্নার ‘দুই মাথাবিশিষ্ট কল্পলোকের মুসলিম রাষ্ট্র’ কিছুতেই টিকবে না। এই কথাটি তিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজা গোপাল চারিয়াকে আগেই বলেছিলেন। নতুনভাবে প্ল্যানের খসড়ার মুসাবিদা করে ফেললেন ভিপি মেননকে দিয়ে। যা হলো নেহরুর নির্দেশ মোতাবেক। ফ্রিডম এট মিডনাইটসের লেখক ল্যারি কলিন্স এবং ডোমিনিক ল্যাপিয়ার ভারত বিভক্তির সময় মাউন্ট ব্যাটেনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন। মাউন্ট ব্যাটেনের নির্দেশে নিজেদের সত্তা বিসর্জন দিয়ে ভারতে যোগদান করতে বাধ্য হলেন দেশীয় রাজারা।
বিলেতে এসেছেন মাউন্ট ব্যাটেন। এটলি উদ্বিগ্ন। মাউন্ট ব্যাটেনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু পালন বা আদৌ কোনো কাজ করতে পেরেছেন কি না এটা জানার জন্য বিলেতে ডেকে পাঠিয়েছেন। পার্টিশন প্ল্যানের খসড়া ম্যাপটি তার ব্রিফকেসে। তার কাজ, পুরনো প্রস্তাব চেয়ে নিয়ে নতুন খসড়া প্রস্তাবটি এটলির হাতে সঁপে দেয়া। নেহরুকে তিনি কথা দিয়েছিলেন নতুন প্রস্তাবটি অনুমোদিত হবে। মাউন্ট ব্যাটেন নতুন প্ল্যানটা এটলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘সর্ব সম্মতিক্রমে এই প্ল্যানটি গৃহীত হয়েছে। আগেরটিতে কংগ্রেসের অনুমোদন ছিল না। ওটি বাতিল বলে গণ্য হবে। আলেকজান্ডার ডাব, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস প্রমুখ প্ল্যানের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করে বললেন, ‘প্ল্যানটি গ্রহণ করা যেতে পারে। ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেল’। ‘পোকায় কাটা’ পাকিস্তান উপহার দিলেন মাউন্ট ব্যাটেন। এরূপ নির্লজ্জ পক্ষপাত ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে ভারত বিভাজন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলো। মাউন্ট ব্যাটেন সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব করেছেন কংেগ্রেসের পক্ষে। অথচ বিবদমান দু’টি জাতির মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি নিয়েই ভারতের ভাইসরয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার উলঙ্গ পক্ষপাতিত্ব গোটা ব্রিটিশ জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিপুলভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। তেমনিভাবে সিলেট জেলা থেকে মুসলিম অধ্যুষিত করিমগঞ্জ থানাকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। ভারত বিভাজন প্ল্যানের মূল নীতি লঙ্ঘন মাউন্ট ব্যাটেন নিজেই করেছেন। বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের মহারাজাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভারতের সাথে যোগদানে বাধ্য করেছেন। মাউন্ট ব্যাটেনের বিরুদ্ধে সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়ার কাছে বক্তব্য পেশ করেছিলেন কনরাড করফিল্ড। তিনি ছিলেন ভাইসরয়ের রাজনৈতিক সচিব। নেহরু আর কংগ্রেসের সাথে ভাইসরয়ের বেশি ঘনিষ্ঠতা ভালো লাগেনি তার। তিনি ভারত সচিবকে বলেছিলেন, দেশীয় রাজন্যবর্গ যখন ব্রিটিশ ক্রাউনের হাতে তাদের অধিকার অর্পণ করেছিলেন, তখন ভারত পরাধীন ছিল। সুতরাং ভারত স্বাধীন হলে সেই অধিকার রাজাদের কাছেই ফিরে আসা উচিত। এরপর রাজারা ইচ্ছামতো স্থির করবেন, পাকিস্তান না ভারত, কার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবেন, না স্বাধীন থাকবেন, ব্রিটেন ও দেশীয় রাজাদের মধ্যে এই চুক্তিই হয়েছিল।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ভারতবর্ষের পার্টিশনের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের আমলে বিলেত থেকে এলেন স্টাফোর্ড ক্রিপস, আলেকজান্ডার ডাব, প্যাথিক লরেন্স। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতেই এদের আগমন। সফল আলোচনা হয় কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সাথে। ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে। আলোচনা অন্তে ১৬ মে ১৯৪৬ সালে ভারত বিভাজনের প্ল্যান ঘোষণা করেন তারা। এই প্ল্যানই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অথবা গ্রুপিং সিস্টেম নামে খ্যাত। কংগ্রেস প্রথম তা মেনে নেয়। জিন্নাহ এই সিস্টেম মেনে নিয়ে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তান পেয়ে গেছি।’ এতে বোধ হয় খটকা লাগল নেহরুর মনে। প্রেস কনফারেন্সে বললেন তিনি, কংগ্রেস গ্রুপিং সিস্টেম মেনে নিয়েছে ঠিক, কিন্তু গণপরিষদের সদস্যদের ওপর আমাদের এখতিয়ার নেই। এই উক্তির পর জিন্নাহ গ্রুপিং সিস্টেম বাতিল করে দিয়ে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করলেন। সোহরাওয়ার্দী তখন বঙ্গদেশের চিফ মিনিস্টার। সংগ্রাম দিবসে কলকাতা শহরে ভয়াবহ দাঙ্গা হলো। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সেই দাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর দাঙ্গা হয় নোয়াখালীতে, তারপর বিস্তার লাভ করে। বিহারে দাঙ্গা হয় ব্যাপক। বিচলিত বোধ করেন লর্ড ওয়াভেল। নেহরুর সাথে তার বচসা হয়। এই সময় তিনি ওয়াভেলকে বদলি করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বলতে কৃষ্ণ মেননকে নির্দেশ দেন। এটলি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। লেবার পার্টির প্রধান হিসেবে আগে থেকেই কংগ্রেসের সাথে তার ছিল গভীর সম্পর্ক। হঠাৎ লর্ড ওয়াভেলের বদলির আদেশ এলো। তাকে এই বদলির ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। মাউন্ট ব্যাটেন এলেন ভারতে, ওয়াভেলের কাছ থেকে দায়িত্বভার বুঝে নিতে। লর্ড ওয়াভেল অবাক, এটা তার জন্য ভীষণ অপমানকর ব্যাপার। তিনি ুব্ধ হলেন। মাউন্ট ব্যাটেন ভাইসরয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর নেহরুর বাসভবনে ডিনারে যোগদান করেন। ব্যাপারটা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং নেহরু আর বল্লভভাই প্যাটেলের সাথে তিনি আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। এরপর কংগ্রেসের মাওলানা আজাদ ও সর্দার বলদেব সিং আর মুসলিম লীগের লিয়াকত আলী খান এবং সর্দার আবদুর রব নিশতারের সাথেও আলাপ করেন। শেষ পর্যন্ত পার্টিশনের একটা খসড়া ম্যাপ তৈরি করে এটলির কাছে বিলেতে পাঠান। মাউন্ট ব্যাটেন কয়েক দিনের বিশ্রাম নিতে গেলেন বড়লাটের শৈলাবাস সিমলায়। এখানে ১১টি প্রদেশের গভর্নরের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্স। পার্টিশন প্ল্যানের খসড়া প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে গেছে। ১১ জন গভর্নরকে বেছে নিতে হবে ভারত অথবা পাকিস্তান, কোন পরিবারভুক্ত হবেন তারা। কোনো প্রদেশের হিন্দু-মুসলমানের বেশির ভাগ যদি চায়, তবে কোনো তরফে যোগ না দিয়ে স্বতন্ত্র থাকতে পারেন। অবশ্য ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন তখনো ভাইসরয় জলাঞ্জলি দেননি। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে ব্রিটেনের চেষ্টার কথাটা সারা পৃথিবীকে জানাতে হবে। যদি ব্রিটেন ব্যর্থ হয় সে দায় তার নয়। পার্টিশন বেছে নেয়া হয়েছে, কারণ এটা ভারতের জনগণের অভিমত। মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, ‘এত ক্ষীণ জীবনীশক্তি নিয়ে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের টিকে থাকা যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ। সুতরাং স্বখাত সলিলে তাকে ডুবে মরতে হবে। সেই সুযোগ তাকে দেয়া উচিত যাতে ঐক্যবদ্ধ ভারতের মধ্যে সসম্মানে ফিরে আসতে পারে মুসলিম লীগ।’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের ছাড়াও সেনাবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে একান্তে আলোচনাও করতে হয়েছে। পূর্বসূরি কঠোর পরিশ্রম করে বছরের পর বছর যা করতে পারেননি, তিনি মাত্র দু’সপ্তাহে সেই অসাধ্য কাজ সমাধা করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারত বিভাজনের খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অবশ্য এটলি সরকারকে ভরসা দিতে হয়েছে যে, প্রস্তাবিত খসড়া ভারতীয় নেতারা বিনাদ্বিধায় মেনে নেবেন। তার আত্মবিশ্বাস এত দৃঢ় ছিল যে, সিমলার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই মাউন্ট ব্যাটেন ঘোষণা করেছিলেন, ১৭ মে দিল্লিতে ফিরে এসে খসড়া প্রস্তাবটা সবার অবগতির জন্য পেশ করবেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা যদি প্রস্তাব মন দিয়ে যাচাই করেন তাহলে দেখতে পাবেন, খসড়ার মধ্যে দুটো নয়, তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব আছে। মাউন্টব্যাটেন ধারণাটি প্ল্যানের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। এর ফলে ভারতের যেকোনো প্রদেশ স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে। এই শর্তটা অন্তর্ভুক্ত করার আসল লক্ষ্য হলো বঙ্গদেশ। এখানকার সাড়ে ছ’কোটি হিন্দু-মুসলিম অধিবাসী যদি ইচ্ছা করে তাহলে কলকাতাসহ স্বশাসিত থাকতে পারে। এই ভাবনাটি তার মাথায় ঢুকিয়ে দেন বঙ্গদেশের মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। মাউন্ট ব্যাটেনের মতে, জিন্নার প্রস্তাবের চেয়ে এটা অনেকটা বাস্তবসম্মত। বাংলার কংগ্রেস নেতারাও এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন সবার স্বার্থেই। জিন্নাহও আপত্তি করবেন না এই প্রস্তাবে। পাছে ব্যাপারটা বানচাল হয়ে যায় তাই নেহরু ও প্যাটেলের কাছে ফাঁস করেননি প্রস্তাবটা। আর এই ভুলটাই এখন তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তার মনে হচ্ছে, রাজধানী কলকাতা আর নৌবন্দর হাতছাড়া করতে কি রাজি হবেন ওরা? কলকাতা ঘিরে থাকা অতগুলো পাট ও সুতার কলও হাতছাড়া হয়ে যাবে এক সাথে। সুতা আর পাট কলের মালিক শিল্পপতিরা কংগ্রেসের আর্থিক সহায়। মাউন্ট ব্যাটেনের মনে হলো, মাত্র একজনই আছেন যার সাথে গোপনে আলোচনা করে তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারেন। সহকর্মীদের প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়ে নেহরুকে এক দিনের ছুটি কাটাতে আমন্ত্রণ জানালেন সিমলায়। তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য এই উপমহাদেশে তার একমাত্র নির্ভরতা। মাউন্ট ব্যাটেন লক্ষ করেছেন, তার স্ত্রীর সাথেও ‘প্রীতির সম্পর্ক’ গড়ে উঠেছে নেহরুর। তিনি ছাড়া আর কেউই বোধ হয় নেহরুকে সংশয়ের খোলস ভেঙে বের করতে পারবেন না। এই মহিলাই তাকে ‘সান্নিধ্যের উষ্ণতা’ দিয়েছেন। প্রায়ই তারা আলাপ করতেন কিংবা বড়লাট বাহাদুরের খাস পুকুরে দু’জনে সাঁতার কাটতেন, তখন তার সান্নিধ্য দিয়ে এডুইনা যেন নেহরুকে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতেন। এই বন্ধুত্বের মাধ্যমে অনেক ‘বিরূপ অবস্থা’ কেটে গেছে এবং নিপুণভাবে এডুইনা তার স্বামীর চেষ্টাগুলো সফল করেছেন।
মাউন্ট ব্যাটেন সহকর্মীদের একদিন ডেকে পাঠালেন। পরবর্তী সঙ্কল্পের কথাটা বুঝিয়ে বললেন। সবাই হতবাক। তারা বুঝালেন, জিন্নাহকে না দেখিয়ে লন্ডন থেকে অনুমোদিত পার্টিশন প্ল্যানটা যদি নেহরুকে দেখানো হয়, তা হলে মুসলিম লীগ নেতার সাথে প্রতারণা করা হবে। জিন্নাহ যখন ব্যাপারটা জানবেন, তখন মাউন্ট ব্যাটেনের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ধুলায় গড়াগড়ি যাবে। দেশময় তার নামে বিরূপ প্রচারণা চালাবে মুসলিম লীগ। সুতরাং যেন এ কাজটি না করেন।
তাদের যুক্তি শুনলেন তিনি। বললেন, আপনাদের যুক্তি অকাট্য। কিন্তু এটা আগে নেহরুকে দেখাবই। হয়তো এটা আমার সংস্কার। সেই রাতেই নেহরুকে আমন্ত্রণ করলেন। দু’জনের হাতেই পানীয়ের গ্লাস। লন্ডন থেকে সংশোধিত হয়ে আসা প্ল্যানটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে নেহরুর হাতে দিলেন। নেহরু কিছুটা অবাক। মাউন্ট ব্যাটেন মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনার বেডরুমে গিয়ে পড়বেন। কাল মতামত দেবেন।’ মাউন্ট ব্যাটেনের দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন নেহরু, খুব খুশি তিনি। বোধ হয় কৃতার্থও। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। অন্য দিকে নেহরু, শোয়ার ঘরে গিয়ে প্ল্যানটার পাতা ওল্টাছেন আর স্তম্ভিত হচ্ছেন। প্ল্যানটা যেন ‘আদ্যন্ত প্রতারণা’। এই প্ল্যান থেকে যে মূর্তি বেরিয়ে আসছে, তা অখণ্ড ভারতের মূর্তি নয়, ডজনখানেক ছোট ছোট রাষ্ট্রের চিত্রপট। বাংলার জন্য যে দরজাটা হঠাৎ করে খুলে দিয়েছেন মাউন্ট ব্যাটেন, নেহরু ভাবলেন, এতে শুধু কলকাতা বন্দর নয়, সেই সাথে হাতছাড়া হয়ে যাবে অনেক কলকারখানা আর বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চল। সব চেয়ে বেদনাদায়ক হলো যে, কাশ্মির আর ভারতের অঙ্গীভূত থাকছে না। বিশাল হায়দরাবাদ অঞ্চল। স্বশাসিত এই অঞ্চলকে বরদাস্ত করা যাবে না। তা ছাড়া অন্তত আধা ডজন নেটিভ স্টেট স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনবরত দাবিদাওয়ার দৌরাত্ম্যে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় এ কী খেলায় মেতেছে ব্রিটেন। ফ্রাগমেন্ট অ্যান্ড কুইট অর্থাৎ ভেঙেচুরে দেশ থেকে চলে যেতে চাইছে ওরা। এমন কিছু ঘটতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। এসব ভেবে রাগে থরথর করে কাঁপছেন নেহরু। খসড়া প্ল্যান নিয়ে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করলেন রাগে ক্ষোভে কৃষ্ণ মেননের শোয়ার ঘরে চুপ করে ঢুকে পড়লেন। এই বিশ্বস্ত মানুষটিকে সাক্ষী করে নিয়ে এসেছিলেন। এমন উ™£ান্তের মতো নেহরুকে ঘরে ঢুকতে দেখেন স্তম্ভিত কৃষ্ণ মেনন। নেহাত হাতের কাগজখানা সজোরে ছুড়ে মারলেন ওর দিকে। চিৎকার করে বলে উঠলেন, সব শেষ।
মাউন্ট ব্যাটেন যে প্রতিক্রিয়া শুনতে চেয়েছিলেন, তা নেহরুর পত্রের মাধ্যমে পেয়ে গেলেন, এর ভাষা ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
তিনি ছ’সপ্তাই ধরে এত যতœ করে যে তাসের ঘর বানিয়েছিলেন, তা এক ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ। নেহরু লিখেছেন, প্রায় অঙ্ক কষে প্ল্যানটা তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভারত ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে দেশটাকে ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দেয়া যায়। কংগ্রেস দলের কাছেও প্ল্যানটা অপছন্দের।
যিনি সদম্ভে বলে এসেছেন যে, ১০ দিনের মধ্যেই সঙ্কট মোচনের সমাধান ঘোষণা করবেন, তিনি চুপসে গেলেন। হয়তো আজই এটলি ক্যাবিনেটে তার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তিনি এটলি সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমর্থন আদায় করে দেবেনই। এখন মনে হচ্ছে, যারা মেনে নিলেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, সেই কংগ্রেস দলের স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে প্রস্তাবটা। ভাবলেন, ভাগ্যক্রমে প্ল্যানটা নেহরুকে দেখিয়েছিলাম। নইলে প্ল্যানটা শুধরে নিতে খুবই অসুবিধা হতো। মাউন্ট ব্যাটেনের অনুরোধে আরো একটি রাত থাকতে রাজি হলেন নেহরু। স্থির হলো, এরই মধ্যে খসড়া প্ল্যানের সংস্কার করে সেটাকে ‘কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্য’ করবেন মাউন্টব্যাটেন। এদিকে বঙ্গদেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তবে মাউন্ট ব্যাটেন তখন নিঃসন্দেহ, জিন্নার ‘দুই মাথাবিশিষ্ট কল্পলোকের মুসলিম রাষ্ট্র’ কিছুতেই টিকবে না। এই কথাটি তিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজা গোপাল চারিয়াকে আগেই বলেছিলেন। নতুনভাবে প্ল্যানের খসড়ার মুসাবিদা করে ফেললেন ভিপি মেননকে দিয়ে। যা হলো নেহরুর নির্দেশ মোতাবেক। ফ্রিডম এট মিডনাইটসের লেখক ল্যারি কলিন্স এবং ডোমিনিক ল্যাপিয়ার ভারত বিভক্তির সময় মাউন্ট ব্যাটেনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন। মাউন্ট ব্যাটেনের নির্দেশে নিজেদের সত্তা বিসর্জন দিয়ে ভারতে যোগদান করতে বাধ্য হলেন দেশীয় রাজারা।
বিলেতে এসেছেন মাউন্ট ব্যাটেন। এটলি উদ্বিগ্ন। মাউন্ট ব্যাটেনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু পালন বা আদৌ কোনো কাজ করতে পেরেছেন কি না এটা জানার জন্য বিলেতে ডেকে পাঠিয়েছেন। পার্টিশন প্ল্যানের খসড়া ম্যাপটি তার ব্রিফকেসে। তার কাজ, পুরনো প্রস্তাব চেয়ে নিয়ে নতুন খসড়া প্রস্তাবটি এটলির হাতে সঁপে দেয়া। নেহরুকে তিনি কথা দিয়েছিলেন নতুন প্রস্তাবটি অনুমোদিত হবে। মাউন্ট ব্যাটেন নতুন প্ল্যানটা এটলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘সর্ব সম্মতিক্রমে এই প্ল্যানটি গৃহীত হয়েছে। আগেরটিতে কংগ্রেসের অনুমোদন ছিল না। ওটি বাতিল বলে গণ্য হবে। আলেকজান্ডার ডাব, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস প্রমুখ প্ল্যানের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করে বললেন, ‘প্ল্যানটি গ্রহণ করা যেতে পারে। ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেল’। ‘পোকায় কাটা’ পাকিস্তান উপহার দিলেন মাউন্ট ব্যাটেন। এরূপ নির্লজ্জ পক্ষপাত ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে ভারত বিভাজন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলো। মাউন্ট ব্যাটেন সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব করেছেন কংেগ্রেসের পক্ষে। অথচ বিবদমান দু’টি জাতির মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি নিয়েই ভারতের ভাইসরয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার উলঙ্গ পক্ষপাতিত্ব গোটা ব্রিটিশ জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিপুলভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। তেমনিভাবে সিলেট জেলা থেকে মুসলিম অধ্যুষিত করিমগঞ্জ থানাকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। ভারত বিভাজন প্ল্যানের মূল নীতি লঙ্ঘন মাউন্ট ব্যাটেন নিজেই করেছেন। বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের মহারাজাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভারতের সাথে যোগদানে বাধ্য করেছেন। মাউন্ট ব্যাটেনের বিরুদ্ধে সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়ার কাছে বক্তব্য পেশ করেছিলেন কনরাড করফিল্ড। তিনি ছিলেন ভাইসরয়ের রাজনৈতিক সচিব। নেহরু আর কংগ্রেসের সাথে ভাইসরয়ের বেশি ঘনিষ্ঠতা ভালো লাগেনি তার। তিনি ভারত সচিবকে বলেছিলেন, দেশীয় রাজন্যবর্গ যখন ব্রিটিশ ক্রাউনের হাতে তাদের অধিকার অর্পণ করেছিলেন, তখন ভারত পরাধীন ছিল। সুতরাং ভারত স্বাধীন হলে সেই অধিকার রাজাদের কাছেই ফিরে আসা উচিত। এরপর রাজারা ইচ্ছামতো স্থির করবেন, পাকিস্তান না ভারত, কার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবেন, না স্বাধীন থাকবেন, ব্রিটেন ও দেশীয় রাজাদের মধ্যে এই চুক্তিই হয়েছিল।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন