॥ আলফাজ আনাম ॥
কোন জাতি কতটা সভ্য বা কোন দেশে আইনের শাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা কতটা রয়েছে তা বোঝা যায় সে দেশের পুলিশের কর্মকাণ্ড ও আচরণের ওপর। যে দেশের মানুষ পুলিশের ওপর যত নির্ভরশীল, সে দেশের মানুষ ততটা সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তিতে বসবাস করছে বলে মনে করা হয়। যে দেশের মানুষ পুলিশ দেখলে ভয় পায় কিংবা শত হাত দূরে থাকার চেষ্টা করে, সে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ততটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও প্রগতিÑ এই হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের স্লোগান। এ দেশের নাগরিককে যদি প্রশ্ন করা হয় পুলিশের কর্মকাণ্ডের মধ্যে এসব নীতিবাক্যের কোনো লক্ষণ কি তারা দেখছেন? গত এক সপ্তাহে সংবাদপত্রে পুলিশের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে কোনো মানুষই বলবে না পুলিশ কোনো নীতির ওপর পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের পরিচয় হয়ে উঠেছে একটি ‘অপরাধী’ বাহিনী হিসেবে। হত্যা, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, রাজপথে প্রকাশ্যে নির্যাতনসহ হেন অপরাধ নেই যার সাথে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশ যে কতটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে তা পুলিশের দায়িত্বে নিয়োজিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে দায়িত্ব পালন করতে। তার এই পরামর্শের অর্থ কী? সাংবাদিক দেখলে কি পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে যায়? তাদের পেটানোর জন্য হাত নিশপিশ করে? এ কারণে কি রাজপথে তিন ফটোসাংবাদিককে পিটিয়েছে পুলিশ? আমরা দেখছি, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দেখলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বুকের ওপর বুট উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, গলা চেপে ধরে, থানায় ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে সিলিং ফ্যানের সাথে বেঁধে পেটানো হয়। লাঠিপেটা আর থানায় ধরে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। বাবা-মায়ের সাথে ধরে নিয়ে দুই পুলিশ সদস্য এই নারীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে। এ ঘটনার সাথে একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতিতা মেয়েটি যখন সাংবাদিক ও আইনজীবীদের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ চড়াও হয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে লোকজনকে ধরে নিয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি গাজীপুরে এক বালু ব্যবসায়ীকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার প্রতিপক্ষ লোকজনের কাছে তাকে দেয়া হয়। তারা পুলিশের সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর হাতকড়া খুলে নেয়া হয়। দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের সাথে পুলিশের গভীর সংযোগ গড়ে উঠেছে। সন্ত্রাসীদের হয়ে পুলিশ কাজ করছে। এর আগেও নোয়াখালীতে এভাবে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে এক যুবককে হত্যা করা হয়েছিল। রাজধানীতে ডাকাত বলে একসাথে পাঁচ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার সাথেও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে এগুলো হচ্ছে পুলিশের কাজ। পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে নাগরিকদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। কী ভয়ঙ্কর কথা! দুনিয়ার সব দেশে পুলিশ প্রতিষ্ঠা করা হয় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা আর অপরাধীদের দমনের জন্য। আর বাংলাদেশে পুলিশ একের পর এক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। হত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধ করার পর মন্ত্রী পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের হাত থেকে বাঁচতে নাগরিকদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে। মন্ত্রীর কথা শুনলে মনে হবে কোনো বাড়িতে ডাকাতি শেষে পাবনার দুর্গম চরের কোনো ডাকাত সরদার চলে যাওয়ার সময় বলছেÑ বাড়িতে এত ধনসম্পদ থাকলে তো আমরা আসবই।
মন্ত্রীর বক্তব্যর অর্থ দাড়াচ্ছে, পুলিশের সামনে ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে তো পিটুনি খেতেই হবে। কোনো নারী যদি পুলিশের সামনে দিয়ে চলাচল করে তাহলে পুলিশের মনে কুমতলব চাপতেই পারে। অতএব পুলিশের সামনে দিয়ে না চললেই হয়। আর মিছিল-সমাবেশ করলে পুলিশ ধরে নিয়ে মারবে বা টাকা আদায় করবে, এটা তো জানা কথা। মিছিল-মিটিং করার দরকার কী?
পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধের এত সব অভিযোগের পর প্রতিমন্ত্রীকে ছাড়িয়ে মন্ত্রী আরো এক কাঠি সরেস মন্তব্য করেছেন। তিনি সাফাই গাইছেন, পুলিশ নাকি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। মন্ত্রীর বক্তব্যের গুরুত্ব বা ওজন তো প্রতিমন্ত্রীর চেয়ে কম হতে পারে না। তিনি বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই সার্টিফিকেট আপনাদের দিতেই হবে। তবে সবাই ভালো হবে, এমন কোনো কথা নয়। পুলিশ ভালো হয়েছে মন্ত্রী শুধু এ কথাই বলেননি; সাংবাদিকদের এই ভালো হওয়ার সার্টিফিকেট দিতে বলেছেন। অর্থাৎ মারধর, কিলঘুষি যা-ই খান না কেন সাংবাদিকদের বলতেই হবে পুলিশ ভালো হয়েছে। আল্লাহই জানেন, সাংবাদিকদের সার্টিফিকেট নিতে আবার তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নেয়? শেষ পর্যন্ত পুলিশ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারেÑ এসব খবর প্রকাশের জন্য মাফ চাওয়া, সাংবাদিকেরা পুলিশের গুণগান না লেখা পর্যন্ত তাদের পেটানো অব্যাহত থাকবে। তাহলে সাংবাদিকদের কাজ মোটামুটি দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার এই ঘোষণার ফল হিসেবে সাগর-রুনি মামলা এখন হিমাগারে চলে গেছে। এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সাংবাদিকেরা এখন বেডরুম, অফিস ও রাজপথ কোথাও নিরাপদ নয়। রাজপথে সাংবাদিক পেটানোর এক সপ্তাহ না যেতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রবল সমর্থক বার্তা সংস্থা বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম কার্যালয়ে স্থানীয় যুবলীগ কর্মীরা হামলা চালিয়ে তিন সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম করেছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, পুলিশের সাংবাদিক পেটানো ষড়যন্ত্রের অংশ। সরকারেরতো উচিত এই ষড়যন্ত্র উদঘাটন করা। যেসব পুলিশ সদস্য সাংবাদিক পেটানোর সাথে জড়িত তারা কোন আমলে নিয়োগ পেয়েছেন, কোন আমলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে রাজধানীতে বদলি হয়েছেন এবং ছাত্রজীবনে তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না তাও প্রকাশ করা হোক। তাহলে বোঝা যাবে ষড়যন্ত্রকারী এই পুলিশ কর্মকর্তারা কেন সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন।
তবে পুলিশের ভালো হওয়া সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন, পুলিশের সবাই ভালো হবে এমন কোনো কথা নেই। অর্থাৎ পুলিশে কিছু খারাপ সদস্য আছেন আর কিছু ভালো সদস্য আছেন। এখন প্রশ্ন হলো পুলিশ প্রশাসন কারা এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন? সৎ, যোগ্য, অপরাধপ্রবণ নন এমন পুলিশ কর্মকর্তা, না অপরাধের সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা? এ পর্যন্ত পুলিশের অপরাধের সাথে জড়িত থাকার যেসব অভিযোগ উঠেছে তাতে দেখা যাচ্ছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসির কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। সাংবাদিক বা বড় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে পেটানোর মতো কাজের সাথে অবশ্য আরো ওপর পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমনÑ সহকারী পুলিশ কমিশনারেরা জড়িত থাকছেন। কিন্তু এসব অপরাধের পর যখন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় বা তোলপাড় করা কোনো ঘটনা ঘটে তখন শাস্তি হয় কন্সটেবলের। অথচ কন্সটেবল বা নিম্নপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা শুধু নির্দেশ পালন করেন মাত্র।
রাজধানীতে বেশির ভাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসির বাড়ি গোপালগঞ্জে। আঞ্চলিকতার দাপটে পুলিশের শৃঙ্খলা তো দূরে থাক, কাউকেই তারা পরোয়া করেন না। গোপালি পুলিশ বলে একটা কথা এখন পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে চালু হয়েছে। সহকারী কমিশনার পর্যায়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এখন দায়িত্ব পালন করছেন রাজনৈতিক পরিচয় বা কোনো না কোনোভাবে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা নেই এমন কেউ দায়িত্বে নেই। ২৬ মে সাংবাদিক পেটানোর সাথে জড়িত ছিলেন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলাম। এর আগে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পেটানোর সাথে জড়িত ছিলেন আরেক সহকারী পুলিশ কমিশনার হারুন। ঊর্ধ্বতন এসব পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধের কোনো বিচার হয় না, বরং তাদের পুরস্কৃত করা হয়। চিফ হুইপকে পেটানোর পর হারুনের পদোন্নতি হয়েছে।
পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পুলিশকে দলীয়ভাবে ব্যবহার। যেসব পুলিশ এসব অপরাধের সাথে জড়িত তাদের রাজনৈতিক পরিচয় মন্ত্রীদের অজানা নয়। এ কারণে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। মন্ত্রীদের এসব সাফাই বক্তব্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বিভাগকে রক্ষার কোনো উদ্দেশ্য নেই। পুলিশ বিভাগকে রক্ষা করা যেত যদি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও বদলি বন্ধ করা হতো। বরং এসব বক্তব্যের মাধ্যমে পুলিশকে আরো দলীয়করণে উৎসাহিত করা হয়। এর ফল হিসেবে দেশে সাধারণ অপরাধীদের সাথে পুলিশের অপরাধ আরো বাড়বে। পুলিশ আতঙ্কের কারণে মানুষ মন্ত্রীর পরামর্শ পুরোপুরি মেনে নিয়ে পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে। মন্ত্রীদের এই সুপরামর্শের জন্য পুলিশের হাত থেকে রক্ষা না পাওয়া পর্যন্ত তাদের স্মরণ করবে।
alfazanambd@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন