॥ বিদ্যুত খোশনবীশ ॥
ডিনামাইট একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক। তার এই শক্তি ধ্বংসের। তবে ধ্বংস সব সময় নেতিবাচক নয়, কখনো কখনো সৃজনশীলও। ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যেমন এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ধ্বংসের মধ্য দিয়েই তার বিলুপ্তি ঘটবে। আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট নামক যে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন সেটা ধ্বংসাত্মক হলেও এই আবিষ্কারের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের মহৎ আকাক্সা। তার এই আকাক্সা যে বাস্তবায়িত হয়নি তা নয়, কিন্তু জীবদ্দশাতেই তাকে দেখে যেতে হয়েছিল নিজ আবিষ্কারের অবাঞ্ছিত অপপ্রয়োগে। তার সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার অল্প দিনেই হয়ে উঠেছিল মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, ধ্বংস, তথা অশান্তি। এই অশান্তিই শান্তিকামী নোবেলকে ব্যথিত করেছিল। তিনি প্রবর্তন করেছিলেন পাঁচটি পুরস্কারেরÑ সৃজনশৈলীতায় চারটি এবং শান্তির জন্য একটি। তিনি চেয়েছিলেন, তার এই শান্তি পুরস্কার বিশ্বসভ্যতায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। মৃত্যুর আগে লেখা উইলে নোবেল বলেছিলেন, যিনি বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক ভূমিকা রাখবেন, তিনিই এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তার এই আশা দুরাশায় পরিণত হয়নি। হানাহানির এই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল শান্তি পুরস্কারের অবদান এখন একটি ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, আলফ্রেড নোবেলের এই শান্তি পুরস্কার এখন শুধু শান্তিরই নয়, অশান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অশান্তির উষ্ণ হলকা পশ্চিমের শীতল ভূখণ্ডে নয়, বয়ে চলেছে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের বাংলাদেশে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তির ক্ষেত্রে অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০০৬ সালে। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এই পুরস্কার পেতে পারেন, এমন চিন্তা করাটাও হাস্যকর বলে বিবেচিত হতো। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যকিষ্ট একটি দেশের মানুষের কিই বা থাকে নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বসেরা পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম লেখাতে। কিন্তু ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি প্রমাণ করে দিয়েছিল, একটি ছোট দেশেও জন্ম নিতে পারেন বড় মাপের মানুষ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এককভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি, তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও এই পুরস্কারের অংশীদার। নোবেল কমিটি ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তি পুরস্কার দেয়ার কারণ হিসেবে বলেছিল, ‘তারা উভয়েই ুদ্রঋণের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।’ নোবেল কমিটির এই বক্তব্যকে ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূসের ুদ্রঋণ ধারণার ৩০ বছরের অভিযাত্রার একটি সারসংক্ষেপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। অবশ্য তার ুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে আমাদের দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। সমালোচকেরা দারিদ্র্যবিমোচনের এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে যেমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তেমনি সুদের হার এবং ঋণ আদায়ের ‘অমানবিক’ পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রীয় ও বৈদেশিক সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই ড. ইউনূসের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারণা একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত।
গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ সম্পর্কে আগে যেসব সমালোচনা হয়েছে, তার সবই ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থনীতির ধারণা থেকেই অনেক বিজ্ঞ সমালোচক ুদ্রঋণ প্রকল্পকে ‘পুঁজিবাদী সমাজের শোষণের হাতিয়ার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যদিও জীবন ও সমাজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, তবুও ুদ্রঋণ যেহেতু একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম, তাই এর সমালোচনা অর্থনীতির মানদণ্ডে হবে এটাই স্বাভাবিক। যেসব সমালোচক ুদ্রঋণকে ‘পুঁজিবাদের আদর্শ সন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তাদের সমালোচনা করার যোগ্যতা বা ইচ্ছা আমার নেই। কারণ এই লেখাটি সে উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের পর বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ নিয়ে যেসব সমালোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক এবং অনেকাংশে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যার সর্বশেষ সংস্করণ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অনভিপ্রেত মন্তব্য। একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ড. ইউনূস ও তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে যা বলেছেন তা এক কথায় বেপরোয়া ও অশোভন। তিনি বলেছেন, ইউরোপের কিছু কিছু হোটেলে স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেলেই জনপ্রিয়তা ও নোবেল পুরস্কার দুটোই পাওয়া যায়। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। সেই সাথে তিনি জানতে চেয়েছেন, ড. ইউনূস পৃথিবীর কোনো দেশে যুদ্ধ থামিয়েছেন কিংবা শান্তি এনেছেন কি না।
সৈয়দ আশরাফের এসব মন্তব্য আমাদের ধারণা দেয় যে, ড. ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে তার গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণের কোনো অবদানই নেই। কারণ এটি একটি ‘ব্যর্থ তত্ত্ব’, আগামী এক হাজার বছরেও এই তত্ত্ব দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করা যাবে না। তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন ‘স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেয়ে।’ আর আশরাফের কথা যদি সত্য হয়, তা শুধু ড. ইউনূসের ক্ষেত্রেই নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অন্যসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সত্য। তারা কারা? বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার, মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সাং সু চি, দক্ষিণ আফ্রিকার ধর্মযাজক ডসমন্ড তুতু, কেনিয়ার পরিবেশবাদী নেত্রী ওয়াংগারি মাথাই, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জনাব আশরাফ কি বিশ্বাস করেন এই ব্যক্তিরাও শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন নিছক স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেয়ে? কী বিস্ময়কর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের বিশ্বাস। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ড. ইউনূস কোনো যুদ্ধ থামাতে পারেননি। ড. ইউনূস ট্যাংক, কামান আর বন্দুকের কোনো যুদ্ধ থামাননি। কিন্তু যেসব বরেণ্য ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছি তারা কি কোনো যুদ্ধ থামিয়েছিলেন? কিংবা তারা অন্যরকম যে যুদ্ধ থামিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের সাথে ড. ইউনূসের যুদ্ধের কোনো তফাৎ আছে কি?
শান্তির জন্য কারা নোবেল পুরস্কার পাবেন সেটা বিচার করার ভার নোবেল পিস কমিটির। এই কমিটির প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, যার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার এর নেই। অনেকে বাঁকা চোখে দেখে বলে থাকেন, কিনটন পরিবারের কারণেই ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, যেকোনো ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে, বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির সুপারিশ। সুপারিশ ছাড়া নোবেল কমিটি কাউকেই এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করে না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন একবার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস যত দিন নোবেল পুরস্কার না পাবেন তত দিন বলব, এই পুরস্কার তার পাওয়া উচিত।’ বিশ্ববাসীর মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে নোবেল পিস কমিটি যদি মনে করে, আর্তমানবতার সেবায় কাজ করা একটি যুদ্ধ, শান্তির বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া একটি যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও একটি যুদ্ধ, তবে সেটা ভুল হবে না। আশরাফ কি শুধু বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করাকেই যুদ্ধ মনে করেন? যদি তা-ই মনে করেন, তবে এটা তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অন্য কারো নয়। এক কোটি গাছ লাগিয়ে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন কেনিয়ার ওয়াংগারি মাথাই, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব জনমত গড়ে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন আল গোর, মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন মাদার তেরেসা, তেমনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে একই পুরস্কার জিতেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর তাদের প্রত্যেকেই সৈনিক, একেকজন শান্তিকামী যোদ্ধা। তারা সফল না ব্যর্থ তা মুখ্য বিষয় নয়, লড়াই করাটাই সৈনিকের বীরত্ব। জয়-পরাজয় দিয়ে কখনো বীরত্বকে মূল্যায়ন করা যায় না। ড. ইউনূস সেই বীরত্বেরই স্বীকৃতি পেয়েছেন। সুতরাং ড. ইউনূস দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে পেরেছেন কী পারেননি, আগামী এক হাজার বছরে পারবেন কি না তা বিবেচ্য হতে পারে না। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং সবাই তা চালিয়ে যেতে হবে, এটাই মুখ্য।
শুরুতেই বলেছি, যুদ্ধ সব সময় নেতিবাচক নয়। ড. ইউনূসের এই যুদ্ধ দারিদ্র্য নামক এক গুপ্তঘাতককে পরাজিত করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধ। এই বিবেচনা শুধু আমার নয়, সমাজবিজ্ঞানীদের ও নোবেল কমিটিরও। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কারণে জনাব আশরাফের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আশরাফের এই খেদের কারণ কী? কেন শান্তির নোবেল তার এত অশান্তির কারণ? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পুরস্কার পেলে তা জাতির জন্য কম আনন্দের হতো না। বাস্তবতা হলো, প্রধানমন্ত্রী সে পুরস্কার পাননি। কিন্তু এই না পাওয়ার জন্য কি ড. ইউনূস দায়ী? জনাব আশরাফ কি তাই মনে করেন? এ জন্যই কি তার এই বেসামাল বক্তব্য! নাকি এর পেছনে দ্বিতীয় কোনো রাজনৈতিক কারণ রয়েছে? তেমন কোনো কারণ থাকুক আর নাই থাকুক, মনে রাখা উচিত, এ ধরনের বেপরোয়া ও অসার উক্তি তার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেনি, বরং প্রকাশ করে আমাদের মানসিকতার অন্ধকার দিক। আমরা সাধারণ মানুষ এতে লজ্জিত হই। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ভবিষ্যতে এমন লজ্জা থেকে আমাদের রেহাই দেবেন।
লেখক : শিক্ষক, অনুবাদক
Biddut.khoshnobish@gmail.com
ডিনামাইট একটি শক্তিশালী বিস্ফোরক। তার এই শক্তি ধ্বংসের। তবে ধ্বংস সব সময় নেতিবাচক নয়, কখনো কখনো সৃজনশীলও। ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যেমন এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ধ্বংসের মধ্য দিয়েই তার বিলুপ্তি ঘটবে। আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট নামক যে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন সেটা ধ্বংসাত্মক হলেও এই আবিষ্কারের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের মহৎ আকাক্সা। তার এই আকাক্সা যে বাস্তবায়িত হয়নি তা নয়, কিন্তু জীবদ্দশাতেই তাকে দেখে যেতে হয়েছিল নিজ আবিষ্কারের অবাঞ্ছিত অপপ্রয়োগে। তার সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার অল্প দিনেই হয়ে উঠেছিল মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, ধ্বংস, তথা অশান্তি। এই অশান্তিই শান্তিকামী নোবেলকে ব্যথিত করেছিল। তিনি প্রবর্তন করেছিলেন পাঁচটি পুরস্কারেরÑ সৃজনশৈলীতায় চারটি এবং শান্তির জন্য একটি। তিনি চেয়েছিলেন, তার এই শান্তি পুরস্কার বিশ্বসভ্যতায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। মৃত্যুর আগে লেখা উইলে নোবেল বলেছিলেন, যিনি বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক ভূমিকা রাখবেন, তিনিই এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তার এই আশা দুরাশায় পরিণত হয়নি। হানাহানির এই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল শান্তি পুরস্কারের অবদান এখন একটি ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, আলফ্রেড নোবেলের এই শান্তি পুরস্কার এখন শুধু শান্তিরই নয়, অশান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অশান্তির উষ্ণ হলকা পশ্চিমের শীতল ভূখণ্ডে নয়, বয়ে চলেছে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের বাংলাদেশে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তির ক্ষেত্রে অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০০৬ সালে। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক এই পুরস্কার পেতে পারেন, এমন চিন্তা করাটাও হাস্যকর বলে বিবেচিত হতো। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যকিষ্ট একটি দেশের মানুষের কিই বা থাকে নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বসেরা পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম লেখাতে। কিন্তু ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি প্রমাণ করে দিয়েছিল, একটি ছোট দেশেও জন্ম নিতে পারেন বড় মাপের মানুষ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এককভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি, তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও এই পুরস্কারের অংশীদার। নোবেল কমিটি ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তি পুরস্কার দেয়ার কারণ হিসেবে বলেছিল, ‘তারা উভয়েই ুদ্রঋণের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।’ নোবেল কমিটির এই বক্তব্যকে ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূসের ুদ্রঋণ ধারণার ৩০ বছরের অভিযাত্রার একটি সারসংক্ষেপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। অবশ্য তার ুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে আমাদের দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। সমালোচকেরা দারিদ্র্যবিমোচনের এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে যেমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তেমনি সুদের হার এবং ঋণ আদায়ের ‘অমানবিক’ পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রীয় ও বৈদেশিক সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই ড. ইউনূসের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারণা একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত।
গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ সম্পর্কে আগে যেসব সমালোচনা হয়েছে, তার সবই ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থনীতির ধারণা থেকেই অনেক বিজ্ঞ সমালোচক ুদ্রঋণ প্রকল্পকে ‘পুঁজিবাদী সমাজের শোষণের হাতিয়ার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যদিও জীবন ও সমাজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, তবুও ুদ্রঋণ যেহেতু একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম, তাই এর সমালোচনা অর্থনীতির মানদণ্ডে হবে এটাই স্বাভাবিক। যেসব সমালোচক ুদ্রঋণকে ‘পুঁজিবাদের আদর্শ সন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তাদের সমালোচনা করার যোগ্যতা বা ইচ্ছা আমার নেই। কারণ এই লেখাটি সে উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের পর বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণ নিয়ে যেসব সমালোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক এবং অনেকাংশে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যার সর্বশেষ সংস্করণ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অনভিপ্রেত মন্তব্য। একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ড. ইউনূস ও তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে যা বলেছেন তা এক কথায় বেপরোয়া ও অশোভন। তিনি বলেছেন, ইউরোপের কিছু কিছু হোটেলে স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেলেই জনপ্রিয়তা ও নোবেল পুরস্কার দুটোই পাওয়া যায়। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। সেই সাথে তিনি জানতে চেয়েছেন, ড. ইউনূস পৃথিবীর কোনো দেশে যুদ্ধ থামিয়েছেন কিংবা শান্তি এনেছেন কি না।
সৈয়দ আশরাফের এসব মন্তব্য আমাদের ধারণা দেয় যে, ড. ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে তার গ্রামীণ ব্যাংক ও ুদ্রঋণের কোনো অবদানই নেই। কারণ এটি একটি ‘ব্যর্থ তত্ত্ব’, আগামী এক হাজার বছরেও এই তত্ত্ব দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করা যাবে না। তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন ‘স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেয়ে।’ আর আশরাফের কথা যদি সত্য হয়, তা শুধু ড. ইউনূসের ক্ষেত্রেই নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অন্যসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সত্য। তারা কারা? বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার, মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সাং সু চি, দক্ষিণ আফ্রিকার ধর্মযাজক ডসমন্ড তুতু, কেনিয়ার পরিবেশবাদী নেত্রী ওয়াংগারি মাথাই, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জনাব আশরাফ কি বিশ্বাস করেন এই ব্যক্তিরাও শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন নিছক স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেয়ে? কী বিস্ময়কর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের বিশ্বাস। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ড. ইউনূস কোনো যুদ্ধ থামাতে পারেননি। ড. ইউনূস ট্যাংক, কামান আর বন্দুকের কোনো যুদ্ধ থামাননি। কিন্তু যেসব বরেণ্য ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছি তারা কি কোনো যুদ্ধ থামিয়েছিলেন? কিংবা তারা অন্যরকম যে যুদ্ধ থামিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের সাথে ড. ইউনূসের যুদ্ধের কোনো তফাৎ আছে কি?
শান্তির জন্য কারা নোবেল পুরস্কার পাবেন সেটা বিচার করার ভার নোবেল পিস কমিটির। এই কমিটির প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, যার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার এর নেই। অনেকে বাঁকা চোখে দেখে বলে থাকেন, কিনটন পরিবারের কারণেই ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, যেকোনো ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে, বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির সুপারিশ। সুপারিশ ছাড়া নোবেল কমিটি কাউকেই এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করে না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন একবার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস যত দিন নোবেল পুরস্কার না পাবেন তত দিন বলব, এই পুরস্কার তার পাওয়া উচিত।’ বিশ্ববাসীর মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে নোবেল পিস কমিটি যদি মনে করে, আর্তমানবতার সেবায় কাজ করা একটি যুদ্ধ, শান্তির বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া একটি যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও একটি যুদ্ধ, তবে সেটা ভুল হবে না। আশরাফ কি শুধু বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করাকেই যুদ্ধ মনে করেন? যদি তা-ই মনে করেন, তবে এটা তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অন্য কারো নয়। এক কোটি গাছ লাগিয়ে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন কেনিয়ার ওয়াংগারি মাথাই, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব জনমত গড়ে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন আল গোর, মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করে শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন মাদার তেরেসা, তেমনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে একই পুরস্কার জিতেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর তাদের প্রত্যেকেই সৈনিক, একেকজন শান্তিকামী যোদ্ধা। তারা সফল না ব্যর্থ তা মুখ্য বিষয় নয়, লড়াই করাটাই সৈনিকের বীরত্ব। জয়-পরাজয় দিয়ে কখনো বীরত্বকে মূল্যায়ন করা যায় না। ড. ইউনূস সেই বীরত্বেরই স্বীকৃতি পেয়েছেন। সুতরাং ড. ইউনূস দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে পেরেছেন কী পারেননি, আগামী এক হাজার বছরে পারবেন কি না তা বিবেচ্য হতে পারে না। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং সবাই তা চালিয়ে যেতে হবে, এটাই মুখ্য।
শুরুতেই বলেছি, যুদ্ধ সব সময় নেতিবাচক নয়। ড. ইউনূসের এই যুদ্ধ দারিদ্র্য নামক এক গুপ্তঘাতককে পরাজিত করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধ। এই বিবেচনা শুধু আমার নয়, সমাজবিজ্ঞানীদের ও নোবেল কমিটিরও। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কারণে জনাব আশরাফের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আশরাফের এই খেদের কারণ কী? কেন শান্তির নোবেল তার এত অশান্তির কারণ? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পুরস্কার পেলে তা জাতির জন্য কম আনন্দের হতো না। বাস্তবতা হলো, প্রধানমন্ত্রী সে পুরস্কার পাননি। কিন্তু এই না পাওয়ার জন্য কি ড. ইউনূস দায়ী? জনাব আশরাফ কি তাই মনে করেন? এ জন্যই কি তার এই বেসামাল বক্তব্য! নাকি এর পেছনে দ্বিতীয় কোনো রাজনৈতিক কারণ রয়েছে? তেমন কোনো কারণ থাকুক আর নাই থাকুক, মনে রাখা উচিত, এ ধরনের বেপরোয়া ও অসার উক্তি তার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেনি, বরং প্রকাশ করে আমাদের মানসিকতার অন্ধকার দিক। আমরা সাধারণ মানুষ এতে লজ্জিত হই। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ভবিষ্যতে এমন লজ্জা থেকে আমাদের রেহাই দেবেন।
লেখক : শিক্ষক, অনুবাদক
Biddut.khoshnobish@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন