মহিউদ্দিন আহমদ
দেশের নাগরিকদের মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একদল মনে করে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, তরক্কিও হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হবে। আরেক দল মনে করে, কিছুই ঠিকঠাক চলছে না, মানুষের অবস্থা খুব খারাপ, দেশ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অন্য আরেকটি জনগোষ্ঠী মনে করে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন আছে, অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার পাহাড় জমছে, সবকিছু সামলে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য দরকার দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, প্রণোদনা ও শৃঙ্খলা। কোন দল সংখ্যায় ভারী তা বলা মুশকিল। এটা নির্ভর করে আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন, আপনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী, আপনার পছন্দের লোকেরা ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে না বাইরে। গণমাধ্যম অনেক সময় তার নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতির আলোকে জনমত জরিপ করে এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিনিধিত্বমূলক হয় অথবা হয় না।
এ রকম একটি পটভূমিতে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আলাপ-সংলাপ করেছেন এবং আমরা সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের আকাঙ্ক্ষা ও সুপারিশের কথা জানতে পারছি।
গত কয়েক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করে আমি বেশ কিছু উপসংহারে পৌঁছেছি। এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করতে চাই।
বাজেট একটি আমলাতান্ত্রিক অনুশীলন বা কার্যক্রম। সরকার বদল হলেও এর মূল কাঠামো বদলায় না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এটা মুসাবিদা করেন। কম্পিউটারের স্প্রেডশিটের কল্যাণে সংখ্যাতত্ত্বের অনেক জটিল অঙ্ক এখন অল্পসময়ে সহজেই বয়ান করা যায়। তবে বাজেটের ভূমিকা আর উপসংহারে যেসব কথাবার্তা লেখা থাকে, সেটাকে পরিপ্রেক্ষিত, দর্শন, মিশন, ভিশন, ইত্যাদি লেবাসে চালানো হয়। সরকার যে দলের, তার নেতা বা নেত্রীর বন্দনা থাকে।
দ্বিতীয়ত, বাজেট উপস্থাপন করলে এর বিরোধিতা করার বিষয়টি প্রায় ধর্মীয় অনুষঙ্গের মতোই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। যেদিন বাজেট উপস্থাপন করা হবে, তার আগের দিন কাঁটাবন বা মহাখালীতে ব্যানারের অর্ডার দেওয়া থাকে। তাতে লেখা হয়, ‘এই গণবিরোধী বাজেট মানি না।’ আর একটি মন্তব্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং কোনো কোনো বিশ্লেষক মুখস্থ বলেন এবং লেখেন, এই বাজেট ধনীকে আরও ধনী করিবে, গরিবকে আরও গরিব করিবে।
তৃতীয়ত, বাজেট তৈরি এবং সংসদে আলোচনা চলাকালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লবিং চলতে থাকে। শুল্কহার কমানো কিংবা বাড়ানো নিয়ে দেনদরবার চলে, চলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উঁচু পদের কর্তাদের কাছে তদ্বির ইত্যাদি। কারও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, কারও ভাগ্যে ছেঁড়ে না।
আগামী বাজেট সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল আমি যে রকম বুঝি এবং আমি বাজেট তৈরিতে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখতে পারলে কী কী প্রস্তাব রাখতাম, সে সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে চাই।
শুরুতেই যে কথাটি লিখেছিলাম, সেই প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান স্বরূপটি কেমন এবং গত তিন বছরে আমাদের অর্থমন্ত্রীকে কেমন স্কোরকার্ড দেওয়া যেতে পারে, এখানে তা উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার, আলোচনাটা হতে হবে আপেক্ষিক, আমার আয় যদি ১০ টাকা বাড়ে, আমি বলব, আমার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমার প্রতিবেশীর আয় যদি একই অবস্থানে থেকে পাঁচ টাকা কিংবা পনেরো টাকা বাড়ে তাহলে আমি বলব, আমার অবস্থার অবনতি হয়েছে, বা আমার অবস্থার আরও উন্নতি হতে পারত। আমি এ প্রসঙ্গে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবার কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য কিছু সূচক ব্যবহার করে দেখাতে চাই আমরা কোথায় আছি।
২০১১-১২ সালের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৬ শতাংশ। জাতিসংঘের এসকাপ প্রকাশিত প্রতিবেদনে (মে ২০১২) এই অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে ১৪তম। অবশ্য মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে নাজুক। মাত্র তিনটি দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার বাংলাদেশ থেকে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল পাকিস্তানই বাংলাদেশ থেকে খারাপ অবস্থানে আছে।
বাজেট ঘাটতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ গত বছরও বাংলাদেশ থেকে বেশি ছিল। পাকিস্তানে ছিল জিডিপির ৬.৩ শতাংশ, ভারতে ৫.৯, শ্রীলঙ্কায় ৬.৯ আর বাংলাদেশে ৪.৪ শতাংশ। এই ঘাটতি অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে হতে পারে, আবার মাত্রাতিরিক্ত অপচয়ের কারণেও হতে পারে।
গত ১০ বছরে শ্রমশক্তি রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে অনেক। মোট আয় বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় (ভারতের পরেই) এবং জিডিপির শতাংশ হিসাবেও দ্বিতীয় (নেপালের পরেই)। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ও আনুষঙ্গিক খাতে বাংলাদেশের অবস্থান একদিক থেকে যেমন অনেক উঁচুতে, অন্যদিক থেকে বেশ নাজুক। আমাদের মোট রপ্তানির (শ্রমশক্তি ছাড়া) ৬৩ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। যত দিন এ দেশের শ্রম সস্তায় কেনা যাবে, তত দিন এ অবস্থা বজায় থাকবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের চিরদিনই কম মজুরিতে কাজ করে যেতে হবে। যদি কোনো কারণে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক বাজার হারায় কিংবা বাজার সংকুচিত হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
যাঁরা বলছেন দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তারা ঠিক বলছেন না। আবার দেশে উন্নয়নের বান ডেকেছে, এটাও ঠিক না। তবে আমাদের অর্থনীতি নাজুক প্রধানত দুটো কারণে। এক. শ্রমশক্তি রপ্তানি ও পোশাকশিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা। কোনো কারণে চাহিদার ঘাটতি হলে আমাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। এ জন্য যত শিগগিরই সম্ভব উচিত হবে পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা। একশ্রেণীর গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শ্রমিক শোষণ করে এবং নানা রকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভর্তুকির সুযোগ নিয়ে যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তা একসময় দেশে সর্বনাশ ডেকে আনবে। অর্থনীতিতে মুফতে কামানো বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে রপ্তানি আয় বেড়ে গেছে ১৪-১৫ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। লাভ হলে রপ্তানিকারকেরা চুপচাপ থাকেন, আর একটু প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়লেই ভর্তুকির জন্য হইচই করেন। আমার অনুরোধ থাকবে, আগামী বাজেটে গার্মেন্টস রপ্তানিতে যেন কোনো রকমের আর্থিক প্রণোদনা না দেওয়া হয়। তবে কেউ যদি প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশনে যায়, অর্থাৎ যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা খোলে, তাকে সমর্থন দেওয়া উচিত। আমরা চাই এই শিল্প ভর্তুকি নয়, প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববাজারে টিকে থাকুক।
সরকার কয়েক বছর ধরেই বলে আসছে, তাদের বাজেট কৃষিবান্ধব। আসলে তা নয়। আমাদের বাজেট কৃষককে যতটা না প্রণোদনা দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেয় ভোক্তাকে। অনুৎপাদনশীল শহুরে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ভিত এতই মজবুত যে তাকে তুষ্ট করে দেশ চালাতে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় যদি কৃষকের জন্য কিছু করতে যায়, তাহলে দেখা যায় খাদ্য মন্ত্রণালয় জনতুষ্টির কার্যক্রম নিয়ে কৃষকের লাভের ফসল লুট করে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কৃষি ও খাদ্য একই মন্ত্রণালয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়।
মানুষের আয় কম। তাই সঞ্চয় এবং বিনিয়োগও কম। যা-ও বা সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগ আশানুরূপ হয় না অনুকূল পরিবেশের অভাবে। এখানে আমি দুটো বিষয় উল্লেখ করতে চাই।
এত দিন বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যক্তি-আয় করের আওতামুক্ত ছিল। গত জুলাই থেকে এই সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। কার পরামর্শে এটা করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এখন ফল দাঁড়াবে অন্য রকম। অনেকেই বিদেশে ব্যাংকে টাকা জমা রাখবে। প্রয়োজনে হুন্ডি করে টাকা দেশে আনবে। অথচ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও তা চাপমুক্ত রাখা দরকার। অর্থমন্ত্রী বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, কালো আর সাদা টাকা নিয়ে বাহাস হচ্ছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই তর্ক অর্থহীন। সাদা টাকা যদি বিনিয়োগ করা না হয়, তাহলে তা অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না। ‘কালো’ টাকা যদি বিনিয়োগ করা হয়, যদি তাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে, বাজারের সম্প্রসারণ হয়, তাহলে অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তথাকথিত ‘কালো’ টাকা যাতে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে না যায়, যাতে তা দেশেই বিনিয়োগ হয়, তার জন্য সরকারের উচিত নানা রকম প্রণোদনা দেওয়া। এখানে মূল কথাটি হচ্ছে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।
দেশের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সম্পদের জোগান বাড়ানো। করের আওতা আরও বিস্তৃত করা। আমাদের দেশের কর ব্যবস্থাপনার সুফল পায় মূলত দুটো শ্রেণী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আয়কর উকিল। এই ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো দরকার, দরকার কর দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা। অর্থমন্ত্রী কর দিয়েছেন ‘অনলাইন’ প্রক্রিয়ায়। তিনি যদি সত্যি সত্যিই একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভিভাবক হতেন, তাহলে এই অনলাইন ব্যবস্থা সবার জন্য করে নিজে সবার শেষে এই সুযোগটি নিতেন।
করের পরিমাণ অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। অনেকে কর ফাঁকি দেয়। এটা তাদের খাসলত। আবার অনেকে মনে করেন, করের টাকা লুটপাট হয়, অপচয় হয়, সরকারের অর্থ ব্যয়ের কোনো জবাবদিহি নেই, এতএব কর দিয়ে লাভ কী? ধরুন, যদি নাগরিকেরা যদি আশ্বস্ত হতে পারেন যে তাদের দেওয়া কর রাষ্ট্র স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করবে এবং নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা দেবে, তাহলে সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর দিতেন। যদি প্রত্যেক করদাতা আনুপাতিক হারে নির্দিষ্ট সময়ের পরে পেনশন পায়, তাহলে কর দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যাবে।
আগামী বছরের জন্য আমি আরেকটি গতানুগতিক বাজেট দেখতে পাচ্ছি। ভূমিকায় কথার ফুলঝুরি থাকবে বিস্তর, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ভিশন ২০২১, সোনার বাংলা, এই সব বাগাড়ম্বর থাকবে, কিন্তু অর্থনীতির ও মানুষের জীবনযাত্রার গুণগত মান পরিবর্তনের ব্যবস্থাপত্র থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ দেশে যেসব গোষ্ঠী চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিকারক গোষ্ঠী, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক গোষ্ঠী, তারা তাদের সাধ্যমতো সুবিধা আদায় করে নেবে। কিন্তু সাধারণ নাগরিক থেকে যাবে নেপথ্যেই। আরেকবার ভোটের আগে তাদের মন জয় করার মতো কথামালা সাজানো এবং বাজেটে তার প্রতিফলনের আশা খুব একটা নেই।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
এ রকম একটি পটভূমিতে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আলাপ-সংলাপ করেছেন এবং আমরা সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের আকাঙ্ক্ষা ও সুপারিশের কথা জানতে পারছি।
গত কয়েক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করে আমি বেশ কিছু উপসংহারে পৌঁছেছি। এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করতে চাই।
বাজেট একটি আমলাতান্ত্রিক অনুশীলন বা কার্যক্রম। সরকার বদল হলেও এর মূল কাঠামো বদলায় না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এটা মুসাবিদা করেন। কম্পিউটারের স্প্রেডশিটের কল্যাণে সংখ্যাতত্ত্বের অনেক জটিল অঙ্ক এখন অল্পসময়ে সহজেই বয়ান করা যায়। তবে বাজেটের ভূমিকা আর উপসংহারে যেসব কথাবার্তা লেখা থাকে, সেটাকে পরিপ্রেক্ষিত, দর্শন, মিশন, ভিশন, ইত্যাদি লেবাসে চালানো হয়। সরকার যে দলের, তার নেতা বা নেত্রীর বন্দনা থাকে।
দ্বিতীয়ত, বাজেট উপস্থাপন করলে এর বিরোধিতা করার বিষয়টি প্রায় ধর্মীয় অনুষঙ্গের মতোই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। যেদিন বাজেট উপস্থাপন করা হবে, তার আগের দিন কাঁটাবন বা মহাখালীতে ব্যানারের অর্ডার দেওয়া থাকে। তাতে লেখা হয়, ‘এই গণবিরোধী বাজেট মানি না।’ আর একটি মন্তব্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং কোনো কোনো বিশ্লেষক মুখস্থ বলেন এবং লেখেন, এই বাজেট ধনীকে আরও ধনী করিবে, গরিবকে আরও গরিব করিবে।
তৃতীয়ত, বাজেট তৈরি এবং সংসদে আলোচনা চলাকালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লবিং চলতে থাকে। শুল্কহার কমানো কিংবা বাড়ানো নিয়ে দেনদরবার চলে, চলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উঁচু পদের কর্তাদের কাছে তদ্বির ইত্যাদি। কারও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, কারও ভাগ্যে ছেঁড়ে না।
আগামী বাজেট সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল আমি যে রকম বুঝি এবং আমি বাজেট তৈরিতে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখতে পারলে কী কী প্রস্তাব রাখতাম, সে সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে চাই।
শুরুতেই যে কথাটি লিখেছিলাম, সেই প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান স্বরূপটি কেমন এবং গত তিন বছরে আমাদের অর্থমন্ত্রীকে কেমন স্কোরকার্ড দেওয়া যেতে পারে, এখানে তা উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার, আলোচনাটা হতে হবে আপেক্ষিক, আমার আয় যদি ১০ টাকা বাড়ে, আমি বলব, আমার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমার প্রতিবেশীর আয় যদি একই অবস্থানে থেকে পাঁচ টাকা কিংবা পনেরো টাকা বাড়ে তাহলে আমি বলব, আমার অবস্থার অবনতি হয়েছে, বা আমার অবস্থার আরও উন্নতি হতে পারত। আমি এ প্রসঙ্গে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবার কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য কিছু সূচক ব্যবহার করে দেখাতে চাই আমরা কোথায় আছি।
২০১১-১২ সালের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৬ শতাংশ। জাতিসংঘের এসকাপ প্রকাশিত প্রতিবেদনে (মে ২০১২) এই অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে ১৪তম। অবশ্য মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে নাজুক। মাত্র তিনটি দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার বাংলাদেশ থেকে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল পাকিস্তানই বাংলাদেশ থেকে খারাপ অবস্থানে আছে।
বাজেট ঘাটতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ গত বছরও বাংলাদেশ থেকে বেশি ছিল। পাকিস্তানে ছিল জিডিপির ৬.৩ শতাংশ, ভারতে ৫.৯, শ্রীলঙ্কায় ৬.৯ আর বাংলাদেশে ৪.৪ শতাংশ। এই ঘাটতি অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে হতে পারে, আবার মাত্রাতিরিক্ত অপচয়ের কারণেও হতে পারে।
গত ১০ বছরে শ্রমশক্তি রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে অনেক। মোট আয় বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় (ভারতের পরেই) এবং জিডিপির শতাংশ হিসাবেও দ্বিতীয় (নেপালের পরেই)। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ও আনুষঙ্গিক খাতে বাংলাদেশের অবস্থান একদিক থেকে যেমন অনেক উঁচুতে, অন্যদিক থেকে বেশ নাজুক। আমাদের মোট রপ্তানির (শ্রমশক্তি ছাড়া) ৬৩ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। যত দিন এ দেশের শ্রম সস্তায় কেনা যাবে, তত দিন এ অবস্থা বজায় থাকবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের চিরদিনই কম মজুরিতে কাজ করে যেতে হবে। যদি কোনো কারণে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক বাজার হারায় কিংবা বাজার সংকুচিত হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
যাঁরা বলছেন দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তারা ঠিক বলছেন না। আবার দেশে উন্নয়নের বান ডেকেছে, এটাও ঠিক না। তবে আমাদের অর্থনীতি নাজুক প্রধানত দুটো কারণে। এক. শ্রমশক্তি রপ্তানি ও পোশাকশিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা। কোনো কারণে চাহিদার ঘাটতি হলে আমাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। এ জন্য যত শিগগিরই সম্ভব উচিত হবে পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা। একশ্রেণীর গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শ্রমিক শোষণ করে এবং নানা রকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভর্তুকির সুযোগ নিয়ে যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তা একসময় দেশে সর্বনাশ ডেকে আনবে। অর্থনীতিতে মুফতে কামানো বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে রপ্তানি আয় বেড়ে গেছে ১৪-১৫ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। লাভ হলে রপ্তানিকারকেরা চুপচাপ থাকেন, আর একটু প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়লেই ভর্তুকির জন্য হইচই করেন। আমার অনুরোধ থাকবে, আগামী বাজেটে গার্মেন্টস রপ্তানিতে যেন কোনো রকমের আর্থিক প্রণোদনা না দেওয়া হয়। তবে কেউ যদি প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশনে যায়, অর্থাৎ যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা খোলে, তাকে সমর্থন দেওয়া উচিত। আমরা চাই এই শিল্প ভর্তুকি নয়, প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববাজারে টিকে থাকুক।
সরকার কয়েক বছর ধরেই বলে আসছে, তাদের বাজেট কৃষিবান্ধব। আসলে তা নয়। আমাদের বাজেট কৃষককে যতটা না প্রণোদনা দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেয় ভোক্তাকে। অনুৎপাদনশীল শহুরে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ভিত এতই মজবুত যে তাকে তুষ্ট করে দেশ চালাতে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় যদি কৃষকের জন্য কিছু করতে যায়, তাহলে দেখা যায় খাদ্য মন্ত্রণালয় জনতুষ্টির কার্যক্রম নিয়ে কৃষকের লাভের ফসল লুট করে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কৃষি ও খাদ্য একই মন্ত্রণালয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়।
মানুষের আয় কম। তাই সঞ্চয় এবং বিনিয়োগও কম। যা-ও বা সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগ আশানুরূপ হয় না অনুকূল পরিবেশের অভাবে। এখানে আমি দুটো বিষয় উল্লেখ করতে চাই।
এত দিন বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যক্তি-আয় করের আওতামুক্ত ছিল। গত জুলাই থেকে এই সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। কার পরামর্শে এটা করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এখন ফল দাঁড়াবে অন্য রকম। অনেকেই বিদেশে ব্যাংকে টাকা জমা রাখবে। প্রয়োজনে হুন্ডি করে টাকা দেশে আনবে। অথচ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও তা চাপমুক্ত রাখা দরকার। অর্থমন্ত্রী বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, কালো আর সাদা টাকা নিয়ে বাহাস হচ্ছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই তর্ক অর্থহীন। সাদা টাকা যদি বিনিয়োগ করা না হয়, তাহলে তা অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না। ‘কালো’ টাকা যদি বিনিয়োগ করা হয়, যদি তাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে, বাজারের সম্প্রসারণ হয়, তাহলে অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তথাকথিত ‘কালো’ টাকা যাতে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে না যায়, যাতে তা দেশেই বিনিয়োগ হয়, তার জন্য সরকারের উচিত নানা রকম প্রণোদনা দেওয়া। এখানে মূল কথাটি হচ্ছে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।
দেশের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সম্পদের জোগান বাড়ানো। করের আওতা আরও বিস্তৃত করা। আমাদের দেশের কর ব্যবস্থাপনার সুফল পায় মূলত দুটো শ্রেণী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আয়কর উকিল। এই ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো দরকার, দরকার কর দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা। অর্থমন্ত্রী কর দিয়েছেন ‘অনলাইন’ প্রক্রিয়ায়। তিনি যদি সত্যি সত্যিই একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভিভাবক হতেন, তাহলে এই অনলাইন ব্যবস্থা সবার জন্য করে নিজে সবার শেষে এই সুযোগটি নিতেন।
করের পরিমাণ অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। অনেকে কর ফাঁকি দেয়। এটা তাদের খাসলত। আবার অনেকে মনে করেন, করের টাকা লুটপাট হয়, অপচয় হয়, সরকারের অর্থ ব্যয়ের কোনো জবাবদিহি নেই, এতএব কর দিয়ে লাভ কী? ধরুন, যদি নাগরিকেরা যদি আশ্বস্ত হতে পারেন যে তাদের দেওয়া কর রাষ্ট্র স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করবে এবং নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা দেবে, তাহলে সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর দিতেন। যদি প্রত্যেক করদাতা আনুপাতিক হারে নির্দিষ্ট সময়ের পরে পেনশন পায়, তাহলে কর দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যাবে।
আগামী বছরের জন্য আমি আরেকটি গতানুগতিক বাজেট দেখতে পাচ্ছি। ভূমিকায় কথার ফুলঝুরি থাকবে বিস্তর, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ভিশন ২০২১, সোনার বাংলা, এই সব বাগাড়ম্বর থাকবে, কিন্তু অর্থনীতির ও মানুষের জীবনযাত্রার গুণগত মান পরিবর্তনের ব্যবস্থাপত্র থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ দেশে যেসব গোষ্ঠী চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিকারক গোষ্ঠী, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক গোষ্ঠী, তারা তাদের সাধ্যমতো সুবিধা আদায় করে নেবে। কিন্তু সাধারণ নাগরিক থেকে যাবে নেপথ্যেই। আরেকবার ভোটের আগে তাদের মন জয় করার মতো কথামালা সাজানো এবং বাজেটে তার প্রতিফলনের আশা খুব একটা নেই।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন