॥ গোলাপ মুনীর ॥
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কথা হচ্ছেÑ দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের দানব আর দেখতে চায় না। দেশে আর অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল অপশাসনের দেশ। এমন কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ নেই, যারা সে সময় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হননি। তাছাড়া এ সরকার আরো মনে করে, হরতালের নামে বিরোধী দল নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। নাশকতা, ভাঙচুর, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি ও মানুষ হত্যাকারীদের কিভাবে সঠিক পথে আনতে হয়, তা এ সরকারের জানা আছে। এসব কথা প্রধানমন্ত্রীর নিজের।
এই বক্তব্য যদি সত্যি বলে ধরে নেয়া হয়, তবে এটুকু নিশ্চিত, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাপক অপশাসন আর অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে দেশের মানুষের ওপর। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এই অপশাসন ও অত্যাচার-নিপীড়নে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করল না? কেন সরকার মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন ও তাদের সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়নি? আর কেনইবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সে সরকারকে বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন? এ দেশের মানুষ দেখেছে, বর্তমান সরকারের আমলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্যাতিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের বিচারে ছিলেন সোচ্চার। তারপরও কেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ বর্তমান সরকার নেয়নি? এসব প্রশ্নের জবাব বর্তমান সরকারের কাছে আছে কি?
অপর দিকে, আজ বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে হরতালের পর হরতাল দিয়ে জানমালের বিপুল ক্ষতি করে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত এই বোধ-বুদ্ধি কোথায় ছিল? তখন কি গণতন্ত্র ও সংবিধান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান পরিপক্ব ছিল না? ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা শতবার, হাজারোবার বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তখন তারা বলেছিলেন, জনগণের ভোটের অধিকার কায়েম আর গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্যই ছিল তাদের সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের আন্দোলন। আর আজ বলছেন, ঠিক এর উল্টো। আজ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেনÑ আগামী নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে, কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। আর সে নির্বাচন হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু। সেই সাথে তারা এ-ও বলছেন, বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যারা এমনটি দাবি করেন, তাদের উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনের খবরের ভিডিও ফুটেজ ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলো আবার নতুন করে দেখতে বলব। তখন আন্দাজ-অনুমান করতে অসুবিধা হবে নাÑ এ সরকারের আমলে এসব নির্বাচন কতটুকু অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
এখন আওয়ামী লীগ বলছে, হরতালের নামে বিরোধী দল নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। এর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেনÑ নাশকতা, ভাঙচুর, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি ও হত্যাকারীদের কিভাবে সঠিক পথে আনতে হয় তা তার সরকারের জানা আছে। জানি না, এই সময়ে যেভাবে বিরোধী দলের শীর্ষ সারির নেতাদের নামে গণহারে মামলা দায়ের, বিদ্যুৎ গতিতে চার্জশিট দাখিল, রিমান্ডে নেয়ার জোরালো আবেদন, অমানবিক পুলিশি অ্যাকশন, বিরোধীদলীয় নেতাদের জামিন নাকচ করে গণহারে কারাগারে পাঠানো কি বিরোধীদলের নেতাদের সঠিক পথে আনার সে প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে? প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী ও মানুষ হত্যাকারী বলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। কিন্তু মানুষ দেখছে, বিরোধী দলের ডাকা হরতাল, সভা, সমাবেশ ও মিছিলে যোগদানকারী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায় না। বরং এর বিপরীতে পুলিশের প্রটেকশনে থেকে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী রাস্তায় নামে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ আর গণমিছিল পণ্ড করতে তাদের হাতে থাকে নানা ধরনের অস্ত্র। এসব দৃশ্য তো পত্রপত্রিকায় ছাপ হচ্ছে অহরহ। এদের সঠিক পথে আনার কোনো ব্যবস্থা কি আমাদের সরকারের হাতে আছে?
আসলে আওয়ামী লীগ সরকার এরই মধ্যে বিরোধীদলীয় জোটকে নিশ্চিহ্ন করার এক অশুভ তৎপরতায় নেমে পড়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক খবরে আভাস দেয়া হয়েছে, সরকার বিএনপিতে ভাঙন সৃষ্টির তৎপরতাও নাকি শুরু করে দিয়েছে। হয়তো বিরোধী দলের ৩৩ জন শীর্ষ সারির নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাদের কারাগারে পাঠানোই হচ্ছে এ তৎপরতার সূচনাপর্ব। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সচিবালয়ে বোমা ফাটিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়িতে আগুন দিয়েছেন। মামলা দায়েরের পর তাদেরকে ২৯ এপ্রিল উচ্চ আদালতে প্রবেশ ও বাইরে আসায় পুলিশি বাধা দেয়াটাও ছিল নজিরবিহীন। কারাগারে পাঠানো নেতাদের মধ্যে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৮ দলীয় জোটের আরো চারটি শরিক দলের দলীয় প্রধান। বলার অপেক্ষা রাখে না, তারা দেশের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আটক নেতাদের অনেকেই সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের জামিন না দেয়া কতটা যুক্তযুক্ত ছিল, সে প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক সাজানো এসব মামলায় এ ধরনের সম্মানিত ব্যক্তিদের জামিন দেয়া হচ্ছে না, অথচ দেশে চোর-ডাকাতেরা জামিন পাচ্ছে।
আমরা যদি পেছন ফিরে থাকাই, তাহলে দেখব বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ৫ জুন ঢাকা শেরাটন হোটেলের সামনে একটি দোতলা বাসে আগুন দিয়ে ৯ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং আহত হয়েছিল ১৫ জন। একই দিন ঢাকা শহরের আরো কয়েকটি স্থানে বাসে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। এসব ঘটনা ঘটানো হয় তৎকালীন বিরোধী দলের ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের আগের দিন। তখন কিন্তু বিএনপি সরকার বাস পোড়ানো ও মানুষ পুড়িয়ে মারার জন্য আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাকে এভাবে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়নি। বিএনপির তৎকালীন শাসনামলে আওয়ামী লীগ ১৭০ দিন হরতাল পালন করেছিল। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-নেত্রী হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। আজ বিএনপির ডাকা মাত্র কয়েক দিনের হরতালের পর তারা বলতে শুরু করেছেন, হরতাল হচ্ছে দেশ ধ্বংস করার জন্য। কী অবাক করা বৈপরীত্য আওয়ামী লীগ নেতাদের চরিত্রে। একবার হরতালের পক্ষে, আবার হরতালের বিপরীতে। জনগণ এ কথাও ভুলে যায়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিরোধী দলে গেলেও কোনো দিন হরতাল করবেন না। কিন্তু বিরোধী দলে যাওয়ার পর তিনি সে কথা রাখেননি। একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, আর এখন কথা বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে। জানি না, আগামী কোনো দিন তার মুখ থেকে এর বিপরীত কিছু শুনি কি না? আবার তিনি তত্ত্বাবধায়ক বা ভিন্ন নামের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের আন্দোলনে নামেন কি না, যখন তার অবস্থান থাকবে বিরোধী দলে।
আসলে আওয়ামী লীগ নেতারা হচ্ছেন বড়ই সংশয়বাদী। সব কিছুকেই তারা সংশয়ের চোখে দেখে থাকেন। তাই কোনো ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না তারা। একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে, আরেকবার এর বিরুদ্ধে। একবার বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, আরেকবার একদলীয় বাকশালী সরকারব্যবস্থার পক্ষে। একবার সংসদীয় সরকারব্যবস্থার পক্ষে, আরেকবার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পক্ষে। যখন যেটি সুবিধাজনক মনে হয়। নইলে বিরোধী দলে থাকলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা, আর সরকারে গেলে পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গুটিকয়েক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কেন অতীত আওয়ামী লীগ শাসনামলে?
প্রতিটা দিন শেষে আমরা যখন টেলিভিশনে খবর দেখতে বসি, তখন সরকারি দলের গুটিকয়েক নেতার বক্তব্যই মূলত আমরা শুনতে পাই। প্রতিদিনই তারা বিরোধী দল, বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে কিছু একটা না বললে মনে হয় তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। তাদের বক্তব্যে প্রধানত বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হননের প্রয়াস বেশ জোরালো। আরেকটি কথা তারা বেশ জোর দিয়েই বলে থাকেন, বিরোধী দলের কাউকে কোনো রকম ছাড় দেয়া হবে না। এ বক্তব্য কার্যত তারা বাস্তবে রূপ দিয়ে চলেছেন। বিরোধীদলীয় নেতাদের ওপর পুলিশের অমানবিক আচরণ, তাদের ওপর হামলা, মামলা, নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় সময়ের সাথে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও ছাত্রনেতাদের খুন-গুমের ঘটনাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকার বিরোধী দল দমন-পীড়নে শত ভাগ তৎপর হলেও দেশের বাইরে ও ভেতর থেকে মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির বিচারে একেবারে নির্বিকার। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি এবং রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পর্বতসমান নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগের কোনো বিচার নেই। দুর্নীতি এখন পরিব্যাপক রূপ নিয়েছে। গতকালের কাগজে দেখলাম অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি। বিচার প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা থেকে শুরু করে থানা পর্যন্ত এই দুর্নীতি বিস্তৃত’। তিনি আরো বলেন, দেশে সুশাসন না থাকার অন্যতম দুই কারণÑ দুর্নীতি ও আইনের শাসনের অভাব।’ এসব দিকে সরকার নজর না দিয়ে এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, মামলা ও হামলায়ই বেশি মনোযোগী। দুর্নীতি আজ দেশের বাইরে ও ভেতরে আমাদের জাতীয় ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করছে। এ ব্যাপারে সরকারের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত ৯ মে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এর কারণ রাজনৈতিক সঙ্ঘাত, হরতাল, দুর্নীতি ও গুম। কূটনীতিকদের দৃষ্টিতে অবাধে চলা এসব কর্মকাণ্ড বাইরের দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের উপায় উদ্ভাবনের তাগিদ দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন, জাপানি ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার কাটসুয়া ওকাদা এবং সেই সাথে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বাংলাদেশ সফর করে দুর্নীতি, রাজনৈতিক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি, গুম, হত্যা ও মানবাধিকার সম্পর্কে সমভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। তাদেরও অভিন্ন পরামর্শ ছিল, সরকার ও বিরোধী দলকে একসাথে বসে আগামী নির্বাচন প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। অবসান ঘটাতে হবে বর্তমান সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির। অবাধে চলা গুম, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। অপর দিকে দেশের সুশীলসমাজও দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছে দেশে চলমান হত্যা, গুম, খুন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। বিশেষত তারা বারবার বলছে, দেশে বিদ্যমান অসহিষ্ণু ও আস্থাহীনতার পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রয়োজন নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের একটা সর্বসম্মত উপায় খুঁজে বের করা। এ জন্য সরকারি ও বিরোধী দলকে সংলাপে বসতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাপান ও ভারতের কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে একই ধরনের পরামর্শ দেয়ায় দেশের মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল, খুব শিগগিরই সরকারি ও বিরোধী দল এক সাথে বসে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজনে উপায় খুঁজে বের করবে। দেশবাসী বাঁচবে বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে।
কিন্তু উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় অতিথিরা বিদায় হওয়ার পরপরই আমরা দেখলাম ভিন্ন রূপ। রাজনৈতিক সংলাপে বসার কোনো উদ্যোগই সরকার নেয়নি। যদিও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে বলা হলোÑ যে নামেই হোক নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি সরকার মেনে নিলে বিরোধী দল সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে সংলাপে যাবে। তাতে সরকার পক্ষ লা জওয়াব। এর বদলে দেখলাম অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও শিল্পমন্ত্রী বাক্যবাণে হামলে পড়েন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হোসেন আবেদের ওপর। কী তাদের অপরাধ? তাদের অপরাধ এই দুই জাতীয় ব্যক্তিত্ব সফররত হিলারি কিনটনের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এ বৈঠকে তারা বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। এ এম এ মুহিত ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে মন্তব্য করায় হিলারি কিনটনেরও সমালোচনা করেন। কেন সরকারের মন্ত্রী একযোগে প্রফেসর ইউনূস ও ফজলে হোসেন আবেদকে এভাবে আক্রমণ করলেন আর কেনই বা হিলারি কিনটনের সমালোচনায় নামলেন, এর জবাব শুধু তারা নিজেরাই জানেন। গতকালের ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের এক খবরে বলা হয়েছে, কূটনীতিক মহল বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেছে। তাদের আশঙ্কা, বাংলাদেশ এক সঙ্ঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, না দলীয় সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে দেশে এক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক মহল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছে। তারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সঙ্ঘর্ষ, গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতারে উদ্বিগ্ন।
আওয়ামী লীগ নেতারা এই সময়ে আরেকটি কথা বারবার বলছেন, হরতালে জনসমর্থন নেই, হরতাল ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি হরতাল শেষেই এ ধরনের বক্তব্য আসছে সরকারি দলের নেতাদের মুখ থেকে। তারা এ-ও বলছেন, হরতালে সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। তাই যদি হয়, তবে বিরোধী দলের হরতাল বন্ধের জন্য কেন আহ্বান জানানো হচ্ছে। তা ছাড়া বিএনপি অফিসের সামনে গুটিকয়েক নেতাকে ঘিরে রাখার জন্য যদি কয়েক শ’ নারী-পুরুষ পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়, নেতাকর্মীদের অফিসে ঢুকতে কিংবা অফিস থেকে বের হতে বাধা দেয়া হয়, তবে বিুব্ধ মানুষের রাজপথে নামার সুযোগ কোথায়? তারপরও শত শত পুলিশি বাধার মুখে মানুষ রাস্তায় নামছে। তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সরকার ঘোষণা দিক, একটি দিনের জন্য হরতালে বিুব্ধ মানুষকে রাজপথে নেমে শান্তিপূর্ণ মিছিল করতে কোনো পুলিশি বাধা দেয়া হবে না, নামানো হবে না সরকারি দলের ক্যাডারদের, তবেই দেখা যাবে হরতালের প্রতি মানুষের সমর্থন আছে কি নেই।
দেশবাসীর মনে এখন একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছেÑ দেশ কি ভয়াবহ কোনো সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? সরকার পক্ষের এক কথাÑ দানব তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক, তা আর ফিরিয়ে আনা হবে না। বিরোধী দলেরও এক কথাÑ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। সরকার পক্ষের সংলাপে বসায় কোনো আগ্রহ নেই। যাবতীয় আগ্রহ এখন বিরোধী দল দমন-পীড়ন ও নিশ্চিহ্নকরণে। সুজনেরা বলেন, এ পথ ভুল পথ। এই ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে আসতে সরকারি ও বিরোধী দলের কার কী ভূমিকা হওয়া উচিত দেশবাসী তা ভালো করেই জানে। সে ভূমিকা পালনে কার কত বড় মাপের ব্যর্থতা, তা সঠিকভাবে মাপার ক্ষমতাও এ দেশের মানুষের আছে। অতএব সুজন সাবধান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন