ড. জাহাঙ্গীর আলম
রূপকল্প ২০২১ তথা প্রেক্ষিত্ পরিকল্পনা ২০১০-২১ এর মূল কথা হলো গতিশীল ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে একটি মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে এই হার ১০ শতাংশে উন্নীত করে ২০২১ সাল পর্যন্ত তা ধরে রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) প্রণীত হয়েছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। এ পরিকল্পনার মেয়াদে বছরে গড়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার কথা ৭.৩ শতাংশ। শেষ দুটো বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার দেখানো হয়েছে ৮ শতাংশ। বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম দুই বছর অর্থাত্ ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ সালে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে যথাক্রমে ৬.১ এবং ৬.৭ শতাংশ হারে । ২০১১-১২ সালে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হলো ৭ শতাংশ। দেশের বর্তমান উন্নয়নের গতি ও প্রকৃতি দেখে ইতিমধ্যেই কিছুটা হতাশা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকে ধারণা করছেন, চলতি অর্থ বছরের জন্য নির্ধারিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৬.২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে, শেষ পর্যন্ত ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হ্রাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুত্ সংকট, বিশাল অংকের ভর্তুকি, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস এবং রাজনৈতিক সমস্যা প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য আমাদের অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, প্রবৃদ্ধির এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। কিন্তু অর্থনীতির নিয়ামকগুলি অধিকাংশই যেখানে নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে সেখানে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা খুবই দুরূহ হবে। সংখ্যাতত্ত্বের মারপ্যাচে তা অর্জিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হলেও সাধারণ মানুষের মনে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। তবে আবহাওয়া ভাল থাকার কারণে এবছর কৃষির উত্পাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাতে সর্বোচ ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতে পারে।
২। চলমান বৈশ্বিক মন্দা, তারল্য সংকট, বিনিয়োগ হ্রাস, জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য ও উচ্চ মাত্রায় খাদ্য মূল্য-স্ফীতির কারণে এবার বিশ্বেও গড় প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৪.৫ শতাংশ। এশিয়ায় গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কালিত হয়েছে ৭.৭ শতাংশ, চীনে ৯.২ শতাংশ এবং ভারতের ৮.৮ শতাংশ। সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে একটি মাঝারিগোছের প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আর উচ্চ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে হলে আমাদেরকে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাই আগামী ২০১২-১৩ সালে ৭.৫ শতাংশ এবং ২০১৪-১৫ সালে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে যুক্তিযুক্ত। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি ও গ্রামীণ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অবশ্য বৈশ্বিক মন্দা কেটে গেলে এবং আমাদের মূল্যস্ফীতি অবদমিত হয়ে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে ২০১৫-১৬ সাল থেকে যথাক্রমে ৯ ও ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সমীচীন হবে।
৩। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বর্তমান নাজুক প্রেক্ষাপটে আমাদের বহির্বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হচ্ছে। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বিদেশী ঋণ ও অনুদান। ঘন ঘন লোডশেডিং, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তারল্য সংকটের কারণে নির্মাণ ও শিল্প খাতের অবস্থাও ভাল যাচ্ছে না। শেয়ার মার্কেট ধ্বসের কারণে ছোট বিনিয়োগকারীরা সেখানে আর কোন আস্থা খুঁজে পাচ্ছে না। এমন এক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের একটি নির্ভরযোগ্য খাত হচ্ছে চিরায়ত কৃষি ও গ্রামীণ খাত । খাদ্যে সয়ম্ভরতা অর্জন, পরনির্ভরতা হ্রাস, কর্মসৃজন ও দারিদ্র্যবিমোচনের জন্যে এ খাতের উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে অন্তত আরো এক দশক পর্যন্ত। রূপকল্প ২০২১ অনুসারে আমাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের নীতিমালা গ্রহণের ও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এ খাতটিকেই।
৪। আমাদের বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো উন্নয়ন বাজেট। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে শতকরা ৩৪ ভাগ অর্থ খরচ করা হয়েছিল কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে। এরপর ক্রমেই তা হ্রাস পেয়ে ২০১১-১২ সালের সংশোধিত বাজেটে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭.৯৫ শতাংশে (সারণি-২)। এর মধ্যে স্থানীয় সরকারের বরাদ্দ হলো ১২.৬৬ শতাংশ অর্থ, যার সংগে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের পরোক্ষ সম্পর্ক থাকলেও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম। এটাকে বাদ দিয়ে হিসেব করলে কৃষির মূল খাত এবং সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মিলে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা দাঁড়ায় মাত্র ৫.২৯ শতাংশ। কৃষি ও গ্রামীণ খাতের উন্নয়ন ব্যয়ের এই ক্রম হ্রাসের সংগে জিডিপিতে কৃষি খাতের শরিকানা ক্রম হ্রাসের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়ে গেছে। এ সময়ের ব্যবধানে মোট জাতীয় আয়ে কৃষির শরিকানা স্থির মূল্যে ৪৯.৭৬ শতাংশ থেকে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯.৩০ শতাংশে (সারণি-৩)। অবশ্য একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে জাতীয় আয়ে কৃষির শরিকানা কমে যাওয়ার সংগে শিল্পের শরিকানা আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটেনি। তৈরি পোশাক শিল্পে সামপ্রতিককালে যে আয় হচ্ছে তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চলে যাচ্ছে বিদেশী কাপড় আমদানির খরচ মেটাতে। বাণিজ্য খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হলেও এর সংগে জড়িত আছে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং। সেবা খাতে অর্জিত প্রবৃদ্ধি বেশ উচু মাত্রার কিন্তু তা উত্পাদন নির্ভর নয়। স্বাধীনতার পর গত ৪ দশক ধরে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে লুইস তত্ত্বের অবিরাম অনুকরণ প্রকারান্তরে অর্থনীতির সুস্থ বিকাশকেই বিঘ্নিত করেছে। উন্নয়নের এই গতিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য মোট উন্নয়ন বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় কৃষি ও গ্রামীণ খাতের জন্য নির্ধারণ করা দরকার।
৫। সামপ্রতিককালে কৃষি ও গ্রামীণ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এটা একটা কথার কথা মাত্র। বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দ নির্ধারণের বেলায় তার প্রতিফলন ঘটছে না। ২০১১-১২ সালের বাজেটে কৃষির মূল খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৭.৬৫ শতাংশ অর্থ। এর আগের বছরের তুলনায় দেশের মোট বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২৫.৮২ ভাগ। কৃষি বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৪.২৩ ভাগ। অর্থাত্ অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষি খাতের বরাদ্দ আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। শস্য খাতে বাজেট হ্রাস পেয়েছে ১২.১৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার বিবেচনা করা হলে কৃষিতে প্রকৃত ব্যয় প্রায় সিকি ভাগ কমে গেছে। এর প্রতিকার দরকার।
৬। বর্তমানে কৃষিতে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে কৃষি জিডিপিতে শস্য খাতের শরিকানা ছিল ৭৫.৫৪ শতাংশ। প্রাণী, মত্স্য ও বনজসম্পদের শরিকানা ছিল যথাক্রমে ৭.৬৬ , ১০.৪৮ এবং ৬.৩৯ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে কাঠামোগত পরিবর্তন সাধনের ফলে শস্য খাতের শরিকানা কমে গিয়ে ৫৬.৩১ শতাংশে ঠেকেছে। প্রাণী, মত্স্য ও বনজসম্পদের শরিকানা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১২.৯, ২২.২১ এবং ৮.৫৬ শতাংশে । মানুষের আয় বৃদ্ধির সংগে তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে এবং অপেক্ষাকৃত অধিক পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে। আমাদের বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন থাকা দরকার । বর্তমানে কৃষির আন্তঃউপখাত বাজেট বন্টনে কিছু অসংগতি আছে, তা দূর করতে হবে (সারণি-৪)। ৭। ২০১০-১১ সালে শস্য খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪ শতাংশ। মত্স্য ও বনজসম্পদ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৫.৪ ও ৫.৩ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৫ শতাংশ। এর আগের দু’বছরও এ খাতটির অগ্রগতি ছিল মন্থর। ২০১১-১২ সালে মত্স্য ও বনজসম্পদের প্রবৃদ্ধি ন্যূনপক্ষে ৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বিপর্যয় ঘটেছে প্রাণিসম্পদ খাতে। ইতিমধ্যেই পোল্ট্রি শিল্পের উত্পাদন প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। ছয় মাস আগেও ডিমের দাম ছিল প্রতি হালি ২৪ টাকা। এখন তা ৩৪ টাকা। জীবন্ত ব্রয়লার মুরগির কেজি প্রতি মূল্য ছিল ১১০ টাকা, এখন তা ১৬০ টাকা। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত্। পোল্ট্রি খামারিদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ঘোষণা করা উচিত্। সেই সংগে কৃষি খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের গতিকে ইতিবাচক ধারায় পরিচালনার জন্য উন্নয়ন খাতে আর্থিক সমর্থন প্রয়োজন।
৭। কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ধারণ উত্সাহিত করার জন্য প্রদান করা হয় উপকরণ ভর্তুকি। স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। এরপর তা দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। গত ৩ বছরে কৃষি ভর্তুকি খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা (সারণি-৫)। বছরে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭ শত কোটি টাকা। এটা মোট বাজেটের ৪.২৩ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপির ৪.৫৫ শতাংশ। বর্তমানে রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে শ্রমিকের মজুরি। তথাপি মোট বাজেট বৃদ্ধির সংগে তুলনা করা হলে কৃষি ভর্তুকি বৃদ্ধির হার কমই মনে হয়। এটা কৃষি জিডিপির ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত্।
৮। বর্তমানে জ্বালানি তেল, বিদ্যুত্ ও কুইক রেন্টাল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে ভর্তুকির জন্য। কিন্তু এ নাগাদ ঘন ঘন লোডশেডিং এর কোন সুরাহা হয়েছে বলে মনে হয় না। এ খাতে সাধারণভাবে ভর্তুকি কমিয়ে কেবল কৃষি খাতে ব্যবহারের জন্য ভর্তুকি বাড়ানো হোক, যাতে তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দায় কৃষকদের উপর না বর্তায়। বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য কয়লা-ভিত্তিক বৃহত্ প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া উচিত্। এ কাজটি শুরু করতে হবে আমাদের নিজস্ব কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারের মাধ্যমে। তাছাড়া সৌরশক্তির ব্যবহার সমপ্রসারণের লক্ষ্যে এ খাতে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে।
৯। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে ভরণপোষণ পর্যায়ে। এ খাতে পুঁজির অভাব। উত্পাদনের মৌসুমে কৃষি উপকরণ কেনার মতো প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান থাকে না কৃষকদের। সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণের গুরুত্ব খুবই বেশি। ২০০৯-১০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৫ শত ১২ কোটি টাকা (সারণি-৬)। বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার ১ শত ১৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৬.৬ শতাংশ। ২০১০-১১ সালে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬ শত ১৭ কোটি টাকা। যার ৯৬.৬ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। চলতি ২০১১-১২ অর্থ বছরে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৮ শত কোটি টাকা। গত মার্চ মাস পর্যন্ত ৬৬.৫৯ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে, বছর শেষে তা ৯৭ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মোট কৃষি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শস্য খাত এবং কৃষি বহির্ভূত গ্রামীণ খাতে সিংহভাগ ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। মত্স্য, পশুসম্পদ, কৃষি সরঞ্জাম এবং কৃষি পণ্য বিপণন ও সংরক্ষণ খাতে ঋণের হিস্যা অপেক্ষাকৃত কম। এসকল খাতে কৃষি ঋণের পরিমাণ আরো বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে কৃষি পণ্য বিপণন ও সংরক্ষণ কাজে বেশি ঋণ দিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্য গুদাম নির্মান ও কোল্ডস্টোরেজ স্থাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। সেই সংগে মসলা ফসলের জন্য ৪ শতাংশ হারে ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া এনজিওদের মাধ্যমে পিকেএসএফ প্রদত্ব কৃষি ঋণের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। সার্বিক কৃষি ঋণের সুদের হার কমিয়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশে নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে কৃষি ঋণের সুদের উপর। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে, বাজারে ও গ্রোথ সেন্টারে কৃষি ব্যাংকের শাখা খুলতে হবে। তাতে কৃষি ও গ্রামীণ খাতে বিনিয়োগের জন্য অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। গ্রামের মানুষগুলো ব্যাংকে তাদের আমানত রেখে নিরাপদ বোধ করবে।
হ্যারল্ড লাস্কির মতে রাষ্ট্র হচ্ছে কোন ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের একটি সংগঠন। সরকার তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সরকারের মাধ্যমেই জনগণের আশা আকাংখার প্রতিফলন ঘটে। সরকার জনগনকে স্বপ্ন দেখায়, সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সদস্য হিসেবে জনগণ সরকারকে সহযোগিতা করে, ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মনোবল যোগায়। এ দুটো পক্ষের সেতুবন্ধন দৃঢ় হলে কাংক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়। বর্তমান সরকার আমাদের সামনে উন্নয়নের লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছে। সেটি হলো দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন। এ লক্ষ্য অর্জনে ইতিমধ্যেই আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। ভবিষ্যতে আমরা উত্পাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই। হটাতে চাই দারিদ্র্য । এর জন্য অতি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য স্থান হচ্ছে গ্রাম। সেখানে আমাদের নাড়ির সর্ম্পক। তাই এই গ্রামকে, গ্রামীণ কৃষি ও অকৃষি পেশাকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে সূচিত হোক আগামী দিনের পথ চলা। এ লক্ষ্যে সকল হানাহানি, প্রতিহিংসা, দুবৃত্তায়ন ও সন্ত্রাস ভুলে গিয়ে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত্।
n লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন