কাজী জহিরুল ইসলাম
ফজলুল হক প্রায়ই বলতেন, স্যার, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার চেয়ে বেশি বলতেন, মুক্তিযুদ্ধচালাকালীন সময়ের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। পালিয়ে বেড়ানোর গল্প। ফজলুল হকের যে বয়স, তাতে আমার সব সময়ই কিছুটা সন্দেহ হতো, সত্যিই সে মুক্তিযুদ্ধ করেছে কিনা। ১৯৭১ সালে তার বয়স বড়জোর ১৪/১৫ হবে। অবশ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার নাম জড়িয়ে আছে। তাদের একজনের নামতো ফজলুল হক হতেই পারে। এরই মধ্যে আমাদের অফিসে একজন কনসালটেম্লট যোগদান করলেন। লিফটে নামতে নামতে ফজলুল হক আমাকে বলেন, স্যার, উনি ক্যাপ্টেন তৌফিক- ই-এলাহী না? আমি বলি, উনি ক্যাপ্টেন ছিলেন কিনা জানি না, তবে এইটুকু জানি উনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলেন, অবসর গ্রহণ করেছেন। তার আরও একটি পরিচয় আছে, তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা। আমাদের গাড়িচালক ফজলুল হক জোর দিয়ে বলেন, না স্যার, উনি ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, আমার কমান্ডার। আমি উনার অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। বিষয়টি এবার আমাকে খুব আগ্রহী করে তোলে।
একদিন কথাটা তৌফিক ভাইয়ের কাছে তুলে ধরি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হককে ডাকেন। আমার অফিসে বসে তিনি ফজলুল হককে তার অধীনস্থ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার প্রশংসা করেন। ফজলুল হক সঙ্গে সঙ্গে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলেন। মনে হয় আমি এই প্রথম দেখলাম এতবড় দাড়িঅলা একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পা ছুঁয়ে সালাম করছেন। কতখানি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ফজলুল হকের মাথা নুয়ে এসেছিল তা ভেবে আমার চোখে পানি এসে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও একবার অহঙ্কারে আমার বুক স্ফীত হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, ভালোবাসা, বিনয় এবং শ্রদ্ধাবোধ তাদের মধ্যে অন্যতম।
আমি তখন কবি জসীমউদ্দীন পরিষদের মহাসচিব। তৌফিক ভাই অনেকদিন বলেছিলেন, আপনার দল নিয়ে একদিন আমার বাসায় আসেন, আমার শাশুড়ি খুব খুশি হবেন। যাওয়া হয়নি। এর জন্য আমি আমার তখনকার বস জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের আবাসিক প্রতিনিধি সুনিতা মুখার্জিকে খানিকটা দায়ী করব। এই ভদ্র মহিলা অনেকটা অপ্রয়োজনীয় কাজেও আমাকে ব্যস্ত রাখতেন। জোর করে শুক্রবারগুলোতে গুরুদুয়ারায় নিয়ে যেতেন। ওখানে ভারতীয় হাইকমিশনার বিনা সিক্রিসহ আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হতো, আড্ডা হতো। আমার যে এসব ভিন্ন ধরনের আড্ডা খুব একটা খারাপ লাগত তা বলব না। কিন্তু আমার প্রাণের ঠিকানা তখন ছিল কবি জসীমউদ্দীন পরিষদ, এর পারিষদবর্গ। তাদের কাছ থেকে আমি ক্রমেই ওই সময়টাতে দূরে সরে যেতে থাকি।
আসলে অনেক লম্বা ভূমিকা করে ফেললাম। যে কথা লিখতে বসেছি তা হলো, অল্প সময়ের পেশাগত সম্পর্ক এবং পরিচয়ের মধ্য দিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে যতখানি চিনেছি, তাতে করে এই ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে। তিনি এখন সরকার প্রধানের উপদেষ্টা যদিও, আমি তাকে এখনও পুরোপুরি রাজনীতির লোক মনে করি না। সরকারি দলের অন্য যে ক’জন রাজনীতিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের অন্যতম। খানিকটা জেনে, খানিকটা না জেনে দীলিপ বড়ুয়াকেও পছন্দ করতাম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দীলিপ বড়ুয়ার কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি মন্ত্রিত্বের কাছে নিজের সারা জীবনের অর্জন বলি দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আমি এখনও আওয়ামী লীগের অন্য অনেকের চেয়ে উন্নত রাজনীতিবিদ মনে করি। এখনও আশা করি তিনি দায়িত্বশীল আচরণ ও বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে গুণগত উত্তরণ ঘটাবেন। দীলিপ বড়ুয়ার মতো মন্ত্রিত্বের কাছে সত্তর বছরের অর্জন বিসর্জন দেবেন না। তিনি যখন বলেন, মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি করলে তার দায় মন্ত্রী নেবে কেন এবং ঘটনাটা যখন সবাই জানে যে তারই পিএস কাজটি করেছে, তখন তার এই বক্তব্য শুনে মনে হয় তিনি আর দশজন দিশেহারা মন্ত্রীর মতো মনে করেন বাংলাদেশের মানুষ অতিশয় বোকা।
আমাদের মন্ত্রীরা কোনো ব্যর্থতারই দায়দায়িত্ব নিতে চান না। সাহারা খাতুন যখন বলেন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এবং ইলিয়াস আলীর সন্ধানে পুলিশি তত্পরতায় তিনি সন্তুষ্ট তখন খোদ পুলিশ বিভাগের বড় কর্তারাও টিস্যু পেপারে মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসেন। আমাদের বুঝতে একটু সময় লাগে তিনি কি জোক করছেন না সত্যি সত্যি বলছেন। ব্যর্থতার দায় না নিলেও সফলতার কৃতিত্ব তারা পুরোটাই বুক চিতিয়ে নিয়ে নেন এবং টিভি ক্যামেরার সামনে নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে বলেন, আমি এই করেছি সেই করেছি। কাজ তো করেছে সরকারের কর্মীবাহিনী, মন্ত্রী কেন কৃতিত্ব নেবেন, যদি কর্মীদের ব্যর্থতার দায় মন্ত্রী নিতে না পারেন?
লেখক : কবি, কলাম লেখক
একদিন কথাটা তৌফিক ভাইয়ের কাছে তুলে ধরি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হককে ডাকেন। আমার অফিসে বসে তিনি ফজলুল হককে তার অধীনস্থ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার প্রশংসা করেন। ফজলুল হক সঙ্গে সঙ্গে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলেন। মনে হয় আমি এই প্রথম দেখলাম এতবড় দাড়িঅলা একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পা ছুঁয়ে সালাম করছেন। কতখানি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ফজলুল হকের মাথা নুয়ে এসেছিল তা ভেবে আমার চোখে পানি এসে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও একবার অহঙ্কারে আমার বুক স্ফীত হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, ভালোবাসা, বিনয় এবং শ্রদ্ধাবোধ তাদের মধ্যে অন্যতম।
আমি তখন কবি জসীমউদ্দীন পরিষদের মহাসচিব। তৌফিক ভাই অনেকদিন বলেছিলেন, আপনার দল নিয়ে একদিন আমার বাসায় আসেন, আমার শাশুড়ি খুব খুশি হবেন। যাওয়া হয়নি। এর জন্য আমি আমার তখনকার বস জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের আবাসিক প্রতিনিধি সুনিতা মুখার্জিকে খানিকটা দায়ী করব। এই ভদ্র মহিলা অনেকটা অপ্রয়োজনীয় কাজেও আমাকে ব্যস্ত রাখতেন। জোর করে শুক্রবারগুলোতে গুরুদুয়ারায় নিয়ে যেতেন। ওখানে ভারতীয় হাইকমিশনার বিনা সিক্রিসহ আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হতো, আড্ডা হতো। আমার যে এসব ভিন্ন ধরনের আড্ডা খুব একটা খারাপ লাগত তা বলব না। কিন্তু আমার প্রাণের ঠিকানা তখন ছিল কবি জসীমউদ্দীন পরিষদ, এর পারিষদবর্গ। তাদের কাছ থেকে আমি ক্রমেই ওই সময়টাতে দূরে সরে যেতে থাকি।
আসলে অনেক লম্বা ভূমিকা করে ফেললাম। যে কথা লিখতে বসেছি তা হলো, অল্প সময়ের পেশাগত সম্পর্ক এবং পরিচয়ের মধ্য দিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে যতখানি চিনেছি, তাতে করে এই ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে। তিনি এখন সরকার প্রধানের উপদেষ্টা যদিও, আমি তাকে এখনও পুরোপুরি রাজনীতির লোক মনে করি না। সরকারি দলের অন্য যে ক’জন রাজনীতিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের অন্যতম। খানিকটা জেনে, খানিকটা না জেনে দীলিপ বড়ুয়াকেও পছন্দ করতাম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দীলিপ বড়ুয়ার কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি মন্ত্রিত্বের কাছে নিজের সারা জীবনের অর্জন বলি দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আমি এখনও আওয়ামী লীগের অন্য অনেকের চেয়ে উন্নত রাজনীতিবিদ মনে করি। এখনও আশা করি তিনি দায়িত্বশীল আচরণ ও বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে গুণগত উত্তরণ ঘটাবেন। দীলিপ বড়ুয়ার মতো মন্ত্রিত্বের কাছে সত্তর বছরের অর্জন বিসর্জন দেবেন না। তিনি যখন বলেন, মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি করলে তার দায় মন্ত্রী নেবে কেন এবং ঘটনাটা যখন সবাই জানে যে তারই পিএস কাজটি করেছে, তখন তার এই বক্তব্য শুনে মনে হয় তিনি আর দশজন দিশেহারা মন্ত্রীর মতো মনে করেন বাংলাদেশের মানুষ অতিশয় বোকা।
আমাদের মন্ত্রীরা কোনো ব্যর্থতারই দায়দায়িত্ব নিতে চান না। সাহারা খাতুন যখন বলেন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এবং ইলিয়াস আলীর সন্ধানে পুলিশি তত্পরতায় তিনি সন্তুষ্ট তখন খোদ পুলিশ বিভাগের বড় কর্তারাও টিস্যু পেপারে মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসেন। আমাদের বুঝতে একটু সময় লাগে তিনি কি জোক করছেন না সত্যি সত্যি বলছেন। ব্যর্থতার দায় না নিলেও সফলতার কৃতিত্ব তারা পুরোটাই বুক চিতিয়ে নিয়ে নেন এবং টিভি ক্যামেরার সামনে নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে বলেন, আমি এই করেছি সেই করেছি। কাজ তো করেছে সরকারের কর্মীবাহিনী, মন্ত্রী কেন কৃতিত্ব নেবেন, যদি কর্মীদের ব্যর্থতার দায় মন্ত্রী নিতে না পারেন?
লেখক : কবি, কলাম লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন