বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

সাদা-কালো সমাচার


মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রায় প্রতি বছরই দেশে বাজেট পেশের সময় সাদা টাকা কালো টাকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়। এক প¶ কালো টাকাকে মূল ধারায় বিনিয়োগের জন্য ফিরিয়ে আনার সুযোগ প্রদানের কথা বলেন। আবার অপর প¶ তার বিরোধিতা করে বলেন, এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে। তারা জোর দিয়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গ সামনে এনে অপ্রদর্শিত টাকা যেহেতু কালো টাকা, তাই তাকে বৈধতা দিতে না করেন। কারও কারও মতে, দেশে এই অপ্রদর্শিত বা কালো টাকার পরিমাণ ল¶ কোটি টাকা। আবার কারও মতে, লাখ লাখ কোটি কালো টাকা দেশে নেই। কারণ অতীতে এসব টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়ায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা থাকলেও থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এখন প্রশ্ন হল, এই অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকার পরিমাণ যা হোক, এ টাকার উৎস বা কারণ কি? দেশে এই কালো টাকা তৈরির কারখানা কোথায়? কি করেই বা কালো টাকা তৈরি হয়? দরিদ্র এই দেশে হাজার কোটি কালো টাকাই বা আসে কোত্থেকে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, যারা সরকার চালান তারাই বরং ভালোভাবে এসবের জবাব দিতে পারবেন। হতে পারে এই কালো টাকার একটি উৎস, যারা জুৎসই সরকারি চেয়ারে বসে টাকা কামানোর ধান্ধা করেন তারা। কারণ তাদের হাতেও এই কালো টাকা জমা হয়। কিন্তু তাতে করে যে হাজার হাজার কোটি টাকা তারা হাতে পান, এমনটি বোধহয় ঠিক নয়। সরকারের একশ্রেণীর এমপি, মন্ত্রী, আমলা চক্র, বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এদেশে অবৈধ পথে অনেক আয়-রোজগার করে থাকেন এবং তার একটি অংশ তারা আমোদ-ফুর্তি, দান ইত্যাদির মাধ্যমে খরচ করে কিছু অংশ জমাও করেন। আর সে জমা দিয়ে ¯^নামে-বেনামে সম্পত্তি ক্রয় করে সে সম্পত্তির ট্যা· দিয়ে অথবা আয়কর বিভাগে ঘুষ দিয়ে সাদা করে তার অধিকাংশই তারা জায়েজ করে ফেলেন। সে অবস্থায় ওই চক্রের হাতে বিরাট অংকের কালো টাকা অবশিষ্ট থাকে বলে মনে হয় না। তারপরও ধরে নেয়া যায় তাদের হাতে পাইপলাইনে সব সময় কিছু কালো টাকা থেকেই যায়। কিন্তু সিংহভাগ কালো টাকার উৎস খুঁজতে গেলে হয়তো অন্য চিত্রই বেরিয়ে আসবে। কারণ এ দেশে যত বড় বড় আমদানি-রফতানি হয়, তার একটি বিরাট অংশই আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এভাবে বিপুল অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। আবার হুন্ডির মাধ্যমে সেসব টাকা তাদের হাতে ফেরত আসে। দেশের একশ্রেণীর ছোট বড় অনেক ব্যবসায়ীই অনুরূপ কাজে জড়িত। আবার চট্টগ্রাম, মংলা পোর্ট বা ঢাকা বিমানবন্দরে অস্ত্রসহ যেসব বড় বড় আš—র্জাতিক চোরাচালান কার্যক্রম সংঘটিত হয়, সে¶েত্রেও একশ্রেণীর চোরাচালানি ব্যবসায়ীর হাতে প্রচুর কালো টাকা জমা হয়। আর ওই চোরাকারবারি ব্যবসায়ীর সে ব্যবসাটি সাদা না হওয়ায়, তার আয়-রোজগারও সাদাভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় দেশে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি কালো টাকার সৃষ্টি হলেও ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং, চোরাকারবার ইত্যাদির মাধ্যমে যে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় সৃষ্টি হয়, তা বলাই বাহুল্য। তবে এসব খাত ছাড়াও আমাদের দেশে অপ্রদর্শিত আয়ের আরও একটি বিরাট খাত আছে। সেখানেও হাজার হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। আর সে খাতটি হল ভ‚মি, বাড়ি বা সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন। ধরা যাক, ধানমÊি আবাসিক এলাকায় কেউ এক বিঘা জমি বিক্রি করবেন। সেখানে এখন এক বিঘা জমির মূল্য কমপ¶ে একশ’ কোটি টাকা। কিন্তু বিক্রেতা যদি মাথা কুটে মরেনও, তবুও একশ’ কোটি টাকার দলিল করার ক্রেতা পাবেন না। আবার সরকারি দফতরে সেই জমিরই বুক ভ্যালু হয়তো দুই বা পাঁচ কোটি টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা মূল্যের দলিল প্রস্তুত করলেই সে জমি রেজিস্ট্রি করা সম্ভব। সে¶েত্রে কে যাবেন অতিরিক্ত আরও ৯৫ কোটি টাকার রেজিস্ট্রি ফিস গুনতে? সুতরাং বিক্রেতার হাজার ইচ্ছা সত্তে¡ও তিনি ওই জমি বিক্রি করে ১০০ কোটি টাকা সাদা করতে পারবেন না। তিনি যদি বিক্রয় মূল্যে ৫-১০ কোটি টাকা ছাড় দিয়ে কমও নেন, তাহলেও সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকার ওপরে দলিল করাতে পারবেন না। তার কাছে বাকি ৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত থেকেই যাবে। তাহলে তার এই ৫০ কোটি টাকা কি কালো টাকা? কখনও না! কারণ তার জমিটুকু তো আর কালো নয়। তাই তার অবশিষ্ট টাকাকে কালো টাকা বলা অন্যায়। সে টাকাকে অপ্রদর্শিত টাকা, ওই পর্যš—ই বলা যায়। প্রশ্ন হল, একবার জমি বিক্রি করার সময় তিনি ৫০ কোটি টাকার দলিলে বেশ বড় অংকের টাকা গেইন ট্যা· প্রদান করেছেন। আবার অপ্রদর্শিত অর্থ যদি সরকার বৈধ করার সুযোগ দেয়, তাহলে সে¶েত্রেও পুনরায় তাকে ট্যা· দিয়েই বাদবাকি টাকা বৈধ করাতে পারবেন। এভাবে দেশে যে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার দলিল রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিক্রেতাদের প্রচুর টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যাচ্ছে, সেই খাতটিও বোধহয় কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থের বিরাট উৎস। অতএব এসব টাকা বালিশের মধ্যে, বিছানার তোষকে, ঘরের মেঝেতে গর্তে বা সিন্ধুক আলমারিতে না রেখে সে অর্থের বন্দিত্ব মোচন করাও অর্থনীতির ¯^ার্থে অপরিহার্য। এ¶েত্রে যারা দেশ চালান না বা দেশের পুঁজিবাজার হতে শুর“ করে অন্যান্য বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে নেই, তাদের চিš—ার সঙ্গে সরকারের চিš—ার মিল নাও ঘটতে পারে। তাই সংশি­ষ্ট সবারই বাগাড়ম্বর পরিহার করে বা¯—ববাদী হওয়াই শ্রেয়। পৃথিবীর বহু শি¶িত এবং উন্নত দেশ ও জাতি শিল্প খাতে কালো টাকার বিনিয়োগ অবারিত করেই শিল্পসমৃদ্ধ হয়েছে, এ কথাও সবার মনে রাখতে হবে। 
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন