জিবলু রহমান :
গুপ্তহত্যার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। গুপ্তহত্যা চলছে এ ধরনের খবর আমি সাংবাদিকদের এবং পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি।
-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন।
গুম-অপহরণ-হত্যা অপরাধীদের এক অভিনব কৌশল।। আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে তারা এসব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে...আইন-শৃক্মখলা বাহিনী নিষ্ঠার সাথে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে... গুম হত্যার পেছনে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে... এর আগেও এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে।
-পুলিশের মহাপরিচালক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার।
কয়েকটি ঘটনা এরই মধ্যে গোয়েন্দা তদন্ত করেছে। এখন পর্যন্ত আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে এসব ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি..তবে ব্যক্তিগত বিরোধ বা জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রতিপক্ষের লোকজনও অপহরণ করতে পারে।
-ঢাকা মহানরগ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি দক্ষিণ মনিরুল ইসলাম।
কিছুদিন ধরেই র্যাবের নামে অপহরণ বা আটক করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। একটি এলিট ফোর্সের নামে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় র্যাব গোয়েন্দারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত চালাচ্ছে। র্যাবের নাম ভাঙিয়ে কোনো চক্র এ কাজ করছে কিনা তাও তদন্ত চলছে।
-র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম. সোহায়েল। (সূত্র : দৈনিক আমার দেশ ২০ এপ্রিল ২০১২)
বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর গুম হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। বিগত ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে সাদা পোশাকধারী ও কালো পোশাকধারীদের হাতে গ্রেফতারের নামে আটক হওয়ার ঘটনা অপরাধের এক নতুন মাত্রা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ধরে নেয়ার সময় নিজেদের কখনও র্যাব, কখনও গোয়েন্দা পুলিশ, আবার কখনও আইনপ্রযোগকারী সংস্থার সিভিল টিমের সদস্য পরিচয় দিলেও আটকের পর তাদের খোঁজ মেলে না। কোনো সংস্থা এর দায়দায়িত্ব স্বীকারও করে না।
এনকাউন্টারের পর বর্তমানে বেশি আলোচিত হচ্ছে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। কেউ কেউ বলছেন, আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ধারীরা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অপহরণ করছে। মাঝেমধ্যে র্যাব বা পুলিশ হেফাজত থেকে দীর্ঘদিন আটক থাকার পর এদের কেউ কেউ ফিরে আসছে। ছেড়ে দেয়ার সময় হুমকি দেয়া হচ্ছে-গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে।
জমিজমা সংক্রান্ত, ব্যবসায়িক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং র্যাব-পুলিশ সোর্সদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পারলে অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আবার র্যাব-পুলিশের দুর্নীতিবাজ সদস্যরা ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে মোটা অংকের টাকা কামিয়ে নিচ্ছে।
নিখোঁজদের পরিবার এখনও পথ চেয়ে আছেন, আপনজন ঘরে ফিরবে-বলবে ‘আমি এসেছি', কিন্তু তাদের খোঁজ নেই। স্থান ও সময় পৃথক হলেও নিখোঁজ প্রত্যেকের ঘটনার বিবরণ একই। সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক, এরপর নিখোঁজ-গুম। কী অপরাধে আটক করা হলো এবং কেনই বা তাদের গুম করা হলো এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কয়েকদিন পর নিখোঁজ ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় বিভিন্ন ঝোপঝাড়, ডোবা-বেরিবাঁধ বা নির্জন স্থানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তি ‘নিখোঁজই' থেকে যাচ্ছেন, তার লাশও উদ্ধার হচ্ছে না। ওইসব ব্যক্তির পরিণতি আসলে কী হয়েছে, মাসের পর মাস অপেক্ষায় থেকেও জানতে পারছেন না আত্মীয়-স্বজনরা। ভুক্তভোগীরা নানা দেনদরবার করে একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন।
শেখ মুজিবের শাসনামলে তথা আওয়ামী লীগের প্রথম পর্বে (১৯৭২-১৯৭৫) রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, মুজিব বাহিনী ভিন্ন মতাবলম্বীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যেত। তাদের কাউকে পাওয়া যেত আবার কাউকে পাওয়া যেত না। তবুও তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর নাম ছিল ‘নকশাল দমনের' জন্য এ ধরনের গ্রেফতার।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) দুঃশাসনের ৫ বছরে দেশে অন্তত ৫০ হাজার লোক নৃশংস খুনের শিকার হয়েছে। ২৩ জুন ১৯৯৬ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে নোয়াখালীর মাইজদীতে ছাত্রদল নেতা জাফরুল্লাহ সুমনকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে। চট্টগ্রামে ধর্ষণের পর খুন করা হয় সীমা চৌধুরীকে, সাতক্ষীরায় পত্রদূত পত্রিকার সম্পাদক আলহাজ্ব স. ম. আলাউদ্দিন, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপায় মোসলেম কাজল, জিয়া, চট্টগ্রাম এমইউএইচ কলেজের ছাত্র ইয়ার মোহাম্মদ, যশোর ইউপি মেম্বার ডাক্তার ইজ্জম আলী, ঢাকার লালবাগে এরশাদুল হক, কেরানীগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যান তরিক উল্লাহ, জিয়াউর রহমান, সবুজবাগে রবিউল, নারায়ণগঞ্জে রুবেল, ডেমরায় আনোয়ারা বেগম, তেজগাঁও এলাকায় আমির হোসেন রানা, বরিশালের বাংলা বাজারে দোকানদার ধনু মিয়া, গাজীপুরে আমান উল্লাহ, যাশোরের সাজিয়ালী গ্রামে আব্দুল জলিল ও আনিসুর রহমান, রমনায় আনিসুর রহমান, পটুয়াখালীর গলাচিপায় নূরু মুন্সী, বাগেরহাটের রামপালে কবির, ময়মনসিংহে নাজমুল ইসলাম নাজু, সবুজবাগে আয়নাল হক, ডেমরায় মামুন, গুলশানে সিরাজ সরদার, ফজলুল হক, মিরপুরে ফারুক হোসেন, টঙ্গিতে ইলিয়াস আহমদ, লালবাগে মাকসুদ, রমনায় রুহুল আমীন, তেগাঁওয়ে সৈয়দ সাদেকুর রহমান, পল্লবিতে নাহিদ খান পলাশ, জোহরা বেগম ও মিজানুর রহমান, রমনা থানা এলাকায় সৈয়দ শফিকুল হক খোকন, মতিঝিল থানা এলাকায় ডলি, সবুজবাগে মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জ বিহারী, আজিমপুর কোয়ার্টারে কলেজ ছাত্র ও সিনিয়র সহকারী সচিব পুত্র ফয়সল, মোহাম্মদপুরে কলেজ ছাত্র হিমেল সুজন, পলাশ, ইউনুস, ফরিদ, দু'ভাই জুয়েল ও রুবেল, বাড্ডার খিলক্ষেতে দু'বন্দু টিপু-ইমরান, গুলশানের রসুলবাগে তিন বন্ধু রাসেল, সেলিম, বাবর, লালবাগে মুরাদ, ডেমরার ইকবাল, সূত্রাপুরে এডভোকেট হাবিবুর রহমান মন্ডল, মাইকেল সেন্টু, ফারুক, শ্যামপুরে ব্যবসায়ী সুমন, দুলাল, সেলিম যশোর রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল, জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামসুর রহমান, উদীচী হত্যাকান্ড, কুষ্টিয়ার জাসদ নেতা কাজী আরেফসহ ৬ জন খুলনার মেয়র প্রার্থী আব্দুর রব, চট্টগ্রামে ৮ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী, বনানীর ব্যবসায়ী শিপু, রমনা কলেজ ছাত্রী বুশলা ফুল, বাগেরহাটে এডভোকেট কালিদা রায় প্রমুখ। এই হলো আওয়ামী আমলে সংঘটিত মানবতা বিরোধী কাজের সংক্ষিপ্ত চিত্র।
রাজধানী ছিল অপরাধীদের অবাধ অঞ্চল। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি-সবদিক থেকেই ১৯৯৬-২০০১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘনের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ‘এ যেন এক মৃত্যুর উপত্যকা।' কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। গণতন্ত্র আছে, সংসদ আছে, সর্বোচ্চআদালত কাজ করছে। অথচ মানুষ দেখছে তারা নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোই মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সংবিধানের গ্যারান্টিকে পদদলিত করেছে। নাগরিক জীবন অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়েছিল। পাড়া-মহল্লায় শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনী গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনার বান্ধবীর ছেলে রাজধানীতে সায়েম ও মহসিনকে হত্যা করে ১২ টুকরো করে নৃশংসতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এমপি ইকবাল বিরোধী দলের মিছিলে গুলী করে পুলিশ ও জনগণকে হত্যার পরও বিচার হযনি।
১৯৯৮-এর মাঝামাঝি রাজধানীতে দুই তরুণ অরুণ ও রুবেলের মৃত্যু সমাজের বিবেকবান মানুষ ও গণমাধ্যমকে নাড়া দেয়। কিন্তু বহুল আলোচিত এই দুই মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব নিয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি। ১৯৯৮ সালে নির্মম হত্যার সর্বশেষ শিকার হয় তেজগাঁও থানার শাহীনবাগে মেধাবী ছাত্র আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী।
৯ মার্চ ১৯৯৮ যাত্রাবাড়ী সন্ত্রাসীদের ছোরার আঘাতে দু'কিশোর উজ্জ্বল ও তৌহিদ নিহত হয়। ১০ মার্চ পল্লবিতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি কর্মী আলমগীরকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করে। ১৪ মার্চ গুলশানে সুমন, ১৫ মার্চ সূত্রাপুর শ্রমিক নেতা গাজী লিয়াকত ওরফে কালা লিয়াকত, ১৬ মার্চ ডেমরায় হযরত আলী, ১৭ মার্চ বনানীতে নৈশপ্রহরী শেখ জামাল ও জহির খুন হয়। ২৪ মার্চ সবুজবাগের গোড়ানে মামুন সরোয়ার, দীপু, ২৫ মার্চ শান্তিনগর বাজারে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, ৩০ মার্চ গুলশানে শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মেয়ে শাহনীন তাসনীম, ১ এপ্রিল মতিঝিলে ব্রাদার্স ক্লাব কর্মকর্তা আসলাম সরকার খুন হয়।
২২ মে ১৯৯৮ রাতে গুলশানের রামপুরা ওমর আলী লেনে ফজলুল হককে কুপিয়ে গুলী করে খুন করা হয়। ২ জুন রাতে ডেমরার কোনাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির দু'জন কনস্টেবল আসাদুজ্জামান ও নূর হোসেনকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা ২টি রাইফেল এবং ১০ রাউন্ড গুলী লুট করে পালিয়ে যায়। ১ জুন তেজগাঁও থানা অদূরে সকালে সৈয়দ সাদেকুর রহমান মাসুমকে গুলী করে খুন, ২ জুন রাতে আইন, বিচার সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব এটিএম মুসার ৪/২০, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে একটি রিভলবার, ২৯ হাজার টাকা, সোনার অলংকার ডাকাতি হয়।
২৭ জানুয়ারি ১৯৯৯ দেশব্যাপী আহূত ১৮ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে যশোরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিনা উস্কানিতে পুলিশ, বিডিআর ও আওয়ামী লীগ সশস্ত্র সন্ত্রাসীর তান্ডবে জাতীয় পার্টির কর্মী রাজকুমার নিহত ও অর্ধশত নেতা-কর্মী, পথচারী আহত হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কয়েকজন নেতা-কর্মীও আহত হন। রাজকুমারের লাশের ময়নাতদন্ত কড়া পুলিশ প্রহরায় করার পর পুলিশ লাশ নিয়ে রাজকুমারের খোপস্থ বাড়িতে যায়। সেখানে আত্মীয়ের বাড়িতে লাশ দেখিয়ে নীলগঞ্জ শ্মশানঘাটে দাহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। জনতা নীলগঞ্জ ব্রিজের উপর পুলিশকে ব্যারিকেট দিয়ে লাশ নিযে মিছিল করে, পরে শ্মশানঘাটে পুলিশ লাশ মাটি চাপা দিয়ে রেখে দেয়। রাজকুমার গুলী ও বোমার আঘাতে নিহত হলেও ২৬ জানুয়ারি কোতোয়ালী থানায় হত্যা মামলার পরিবর্তে অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। রাজকুমার নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে চৌরাস্তায় জাতীয পার্টি, বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে লিয়াজোঁ কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অপরদিকে টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কড়া নিরাপত্তায় বিকেলে দড়াটানা ভৈরব চত্বরে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভা করে আওয়ামী লীগের মাগরিবের নামাযের আগে সভাপতি সমাবেশ শেষ করে মিছিল না করার আহবান জানালেও যুবলীগ, ছাত্রলীগ শহরে মিছিল বের করে। মিছিলটি জঙ্গিভাবে হাজী মোহাম্মদ মহসিন সড়ক, জামে মসজিদ সড়ক, চিত্র মোড়, বারের মোড় ও মুজিব সড়ক হয়ে দড়াটানায় পৌঁছলে বিরোধী দলের নামে উস্কানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। মিছিল থেকে একটি বোমা ও গরীবশাহ সড়কের বাঁশপট্টির দিকে রাস্তার উপর তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে পড়ে। মানুষ, পথচারী, রিকশা, ভ্যান দিক-বিদিক হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। শহরে কড়া পুলিশ পাহারায় প্রকাশ্য মিছিল থেকে বোমা হামলা করে শাসক দলের সোনার ছেলেরা। (দৈনিক জনতা ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৯)
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ বিরোধী দল আহূত হরতালের শেষ দিনে বিজয়নগরে সকাল সাড়ে ১১টায় জাগপার মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। এ সময় জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান মাথায়, ঘাড়ে ও পিঠে ১৪টির বেশি ছররা গুলীবিদ্ধ হন। তার সঙ্গে জাগপার আরো ৬ জন কর্মী গুলীবিদ্ধ হন।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ চার দফার দাবিতে দেশব্যাপী বিরোধী দলসমূহের ৬০ ঘণ্টা হরতালের শেষ দিনে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে শান্তিপূর্ণ হরতালের সমর্থনে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনসমূহের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ-সুশৃক্মখ মিছিলটি যখন থানা সদরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সে মুহূর্তে টিএনওর অফিসের সামনে পার্শ্ববর্তী দ্বিতল মার্কেটের আওয়ামী নেতার দোকান থেকে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতিতে মিছিলকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলী চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এতে মাথায়, ঘাড়ে ও পিঠে বেশ কয়েকটি গুলীবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ। মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাঁশখালী থানা সদরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। সতীর্থের লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সহকর্মীরা। বাঁশখালীতে এই প্রথম রাজনৈতিক নৃশংসতা হতবাক করে দেয় এলাকাবাসীকে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ প্রকাশ্য দিবালোকে মঞ্চের উপর গণনা করে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর গ্রামে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফসহ তার সহকর্মীবৃন্দকে। সরকারের শরিক দলের নেতাদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা দেখে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন জেগেছে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে কে?
৬ মার্চ যশোর টাউন হলের সামনে সাংস্কৃতিক সংগঠক উদীচীর দ্বাদশ সম্মেলন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ দিনে উন্মুক্ত মঞ্চে রাত ১টা ১৫ মিনিটে দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মন্তব্য করেছেন, এ রকম বোমা নাকি সেনাবাহিনী ছাড়া কারও কাছে নেই। অপরদিকে ৯ মার্চ দৈনিক মানবজমিনে বলা হয়েছে, ‘যশোরে বোমা হামলা হতে পারে এ রকম আশঙ্কার কথা গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে জানিয়েছিল। গোয়েন্দাদের রিপোর্টে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়, অথচ সরকার ও প্রশাসন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। শুধু তাই নয়, ১০ মার্চ যশোরের ঘটনা ও কুষ্টিয়ার কাজী আরেফসহ ছয় জাসদ নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গণঅনশন কর্মসূচিতে সরকার সমর্থক কবীর চৌধুরী প্রকৃত হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি না জানিয়ে ঘটনার জন্য বিরোধী দলকে অভিযুক্ত করে গৃহযুদ্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছেন।
৩১ আগস্ট রাতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জাতীয় সম্মেলন '৯৯-এর পোস্টারিংকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে যুবলীগের ১০/১২ জন সন্ত্রাসী মজলিসের কর্মী মো. জিয়াউল হক, শামসুল ইসলাম ও হেলালউদ্দিনের উপর নগ্ন হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা মজলিস কর্মীদের কাছ থেকে পোস্টার ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের মারধর করে। পোস্টারে ট্রানজিট বিরোধী শ্লোগান লেখার কারণে তারা ২ জন মজলিস কর্মীকে আটকে রেখে নির্যাতন করে। রাত ১টায় খবর পেয়ে মজলিস অফিস থেকে অন্যান্যরা ছুটে গেলে যুবলীগ সন্ত্রাসীরা আটককৃতদের ছেড়ে দেয়।
১৪ ডিসেম্বর বরিশালে বিএনপির উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিকাল ৩টায় বিএনপির সভাপতি পৌর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব কামালের সভাপতিত্বে নিজস্ব কার্যালয়ে আলোচনা সভা চলছিল। সভা চলাবস্থায় বিকাল সোয়া ৩টায় আওয়ামী লীগের একদল ক্যাডার সভায় হামলা করে নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলী ও বোমা নিক্ষেপ করে সভাটি পন্ড করে দেয়। হামলার কিছু পরে স্থানীয় লোকজন আহতদের হাসপাতালে নেয়ার সময় তারা পুনরায় হামলা করে। এ সময় মারাত্মক আহত বিএনপির নেতা আব্দুল মান্নানকে টাউন হলের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হামলাকালে আহত হন বিএনপি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি আব্দুর রশিদ খান, নগর বিএনপি নেতা এডভোকেট জসিম উদ্দিন, এডভোকেট আব্দুল মান্নান মৃধা, এডভোকেট মজিবুর রহমান সবুজ, আবুল কালাম আজাদ, মো. বাবুল, মহানগর ছাত্রদল নেতা জিএম আতারে রাববী, খান মো. আনোয়ার, বিএনপি মহানগর যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট আলী হায়দার বাবুল, বিএনপি নেতা আব্দুল কাদের সিকদার, মহানগর বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদুল্লাহ কবির, পথচারী ডা. রণজিৎ কুমার বড়াল প্রমুখ।
পুলিশ যে সরকারের আমলে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে তাদের দেশ শাসন করার কোন যোগ্যতা দেশবাসীর কাছে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দেশবাসীর সঙ্গে একই মনোভাব পোষণ করে। পরবর্তী অ্যাকশনের কথা চিন্তা না করে সত্য কথাটি উচ্চারণ করেন ঢাকা মহানগরীর নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনার মতিউর রহমান। মতিউর রহমান ১৮ জানুয়ারি ২০০০ ঢাকার ২১টি সহকারী কমিশনার এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘নগরবাসীর মতো আমি নিজেও আতঙ্কিত। সন্ধ্যার পর নগরবাসী বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।' তিনি স্বীকার করেছেন, শিশু-কিশোরদের বাবা-মা এবং অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল কিংবা বাইরে পাঠিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্যে কাটান। ছেলে-মেয়ে বাসায় আসার আগ পর্যন্ত তারা ওদের জীবন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করেন ছেলেমেয়েদের সুস্থভাবে বাসায় ফেরার জন্য। (সূত্র : দৈনিক মানবজমিন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০০)।
২০ ও ২১ জানুয়ারি দু'টি মামলায় হাজিরা দিতে এসে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুসহ ২৪ জন ছাত্র নেতা সাংবাদিকদের কাছে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও নিবর্তনমূলক আচরণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘কারাগারে তারা অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন। তাদের ঠিকমত খাবার দেয়া হচ্ছে না, চিকিৎসার অভাবে কারারুদ্ধ ছাত্রদলের সব নেতাকর্মী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।' (সূত্র দৈনিক দিনকাল ২২ জানুয়ারি ২০০০)।
আওয়ামী যুবলীগের সশস্ত্র একদল কর্মী ২৯ জুন ২০০০ নগরীর পূর্ব গোড়ানে একজন উপমন্ত্রীর নীলনকশা মোতাবেক জাতীয়তাবাদী যুবদলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক বি এম মাহবুবুল হক সজলকে হত্যা করে। ১৪৮ পূর্ব গোড়ানের বাড়ি থেকে সকালে সজল গোড়ান বাজারে যায়। বাজার শেষে রিকশাযোগে বাসার গেটের কয়েক হাত দূরে পৌঁছা মাত্র উপমন্ত্রীর আর্মড ক্যাডার খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মতিঝিল থানা এলাকার খুনসহ বহু অপরাধে জড়িত মানিকের নেতৃত্বে কানা রিপনসহ ৪ জন সশস্ত্র যুবলীগ কর্মী সজলের রিকশার গতি রোধ করে। কোনো রকম প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে তারা সজলকে গুলী করে দেহ ঝাঁঝরা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। সজলের লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে বাড়ির তৃতীয় তলায় দাঁড়িয়ে তার ভাই মাজহারুল হক মঞ্জু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে চিৎকার করতে করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। গুলীবিদ্ধ অবস্থায় সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার সজলের মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন। (সূত্র : দৈনিক দিনকাল ৩০ জুন ২০০০)।
৪ জুন ১৯৯৮ মালিবাগ অভিযাত্রীক ক্লাবের সামনে সৈয়দ শফিকুল হক খোকন, লালবাগে শিশু পিংকি ও রাজা, ৭ জুন বিকালে ডেমরার জুরাইনে সেলিনা আক্তারকে তিন যুবক ধর্ষণ করে। ১০ জুন রাতে দক্ষিণ বাড্ডায় সিরাজ সরদারকে পিটিয়ে হত্যা, এদিনই সহকারী কর কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনের ৩০/২ চামেলীবাগের বাসায় সকালে ডাকাতি হয়। ২৮ জুন রাতে গুলশানের বাগিচারটেকে নানী বকুল বেগম এবং নাতনী মুর্শিদাকে ধর্ষণ করা হয়।
২৩ জুন ১৯৯৮ লালবাগের সোয়ারীঘাটে পিঠা বিক্রেতা মাকসুদকে খুন করা হয়। ২৪ জুন সবুজবাগের মানিকনগর খালপাড়া মামুনকে, ২৫ জুন তেজগাঁও থানার দুধ ফ্যাক্টরির মাঠে প্রেমিক বাবুলের হাতে জামেলী খুন হয়।
২৮ জুন রাত ১০টায় মিরপুরে ফারুক হোসেন গীটার খুন হয়। ২ জুলাই বাড্ডা সোনালী ব্যাংকে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে এবং মতিঝিলে উত্তর কমলাপুরে শিশু নাঈমকে জবাই করে, ১৩ জুলাই কোতোয়ালী থানা এলাকায় শাহজাহান, শাহ আলম এবং নাককাটা বাবুল, ২৯ আগস্ট ডেমরার পূর্ব জুরাইনে আব্দুর রব ও বাবুল, ২৭ সেপ্টেম্বর মধুবাজারে এডভোকেট সাহিদাকে খুন করা হয়। ২১ নবেম্বর মনিপুর কনসার্ট দেখতে গিয়ে দুই কলেজ ছাত্র আক্তার ও রিমন, ৩০ নবেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ডাবলু, ১৭ ডিসেম্বর রাতে বনানীতে নিহত হন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী।
শেখ হাসিনা প্রথম শাসনামলের সংবাদপত্রে তাকালে শরীরের রোম শিউরে ওঠে। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের ঢাকা জেলা পুলিশ কন্ট্রোলরুমে শিশু তানিয়া এবং সূত্রাপুর থানা এলাকায় গোপাল সাহা লেনে শিশু মৌসুমী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ১০ মার্চ তানিয়া ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ওবায়দুল মাতববর মরাকে গ্রেফতার করে।
১৭ জুন ১৯৯৮ মতিঝিলের ৩২৬/১, গুলবাগের বাসায় গৃহকর্ত্রী নিলুফা আজিজ গৃহপরিচারিকা ডলিকে পিটিয়ে, ২৯ জুন সূত্রাপুরের হাটখোলায় পুলিশের গুলীতে হাতকাটা বাবু, ২২ জুন সন্ধ্যায় শেওড়াপাড়া এলাকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে ৯/১০ জন দুর্বৃত্ত স্ত্রী আসিয়া বেগমকে গণধর্ষণ করে।
২৯ ডিসেম্বর ১৯৯৮ ধানমন্ডিতে ফেরদৌসী এবং হাজারীবাগের মনেশ্বর রোডে রুমা নামের দু'যুবতী ধর্ষণের শিকার হয়।
৮ জানুয়ারি ২০০০ কিশোরগঞ্জে চাচার বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় একটি মেয়ে। এ ঘটনায় মামলা হয় থানায় ৯ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার ইটনার ধানক্ষেতে সাত বছরের এক শিশুকে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়, একই দিন রাজফুলবাড়িয়া বাজারের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় ১২ বছরের অজ্ঞাত একটি শিশুকে, ১১ জানুয়ারি বিস্কুট কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে ময়মনসিংহ জেলার সরেরচর নীলক্ষিয়া বাড়ির পাশের বেগুন ক্ষেতে নিয়ে একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, ১৬ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে আড়াই বছরের একটি মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করার পর ধর্ষণ করা হয়, ১৯ জানুয়ারি দাউদকান্দি থানার মাদলা গ্রামের বাঁশঝাড়ে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, ২০ জানুয়ারি রাণীনগর সাধুর মোড়ে একটি ধর্ষণ করা হয়, ২৬ জানুয়ারি শেরপুর থানার চন্ডীপুর গ্রামে তের বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করা হলে ধর্ষণকারীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
একই দিনে পাবনা শহরের নবাবপুর এলাকার একটি বাড়িতে ৫ বছরের ১টি শিশুকে ধর্ষণ করা হলে থানায় মামলা হয়, ৩ ফেব্রুয়ারি কোটবাড়িয়া গ্রামের হাসেন গাজীর বাড়িতে ১০ বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ৯ ফেব্রুয়ারি নাটোরের নারায়ণপুর গ্রামের হাইস্কুলের কাছে গম ক্ষেতে ধর্ষিত হয় নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ধর্ষণকারীরা ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে, ১১ ফেব্রুয়ারি বন্দর শাহী মসজিদ এলাকার খালপাড়ে ১০ বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ১২ ফেব্রুয়ারি মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ২ নং এফ ব্লকের একটি রুমে ৬ বছরের এক মেয়ে ধর্ষিত হয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি সাভার পৌর এলাকার রাজাসনের মন্ডলপাড়ায় ৬ বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি হরিণাকুন্ডু থানার খালিসাকুন্ডু গ্রামের পানের বরজে ধর্ষিত হয় ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী। ধর্ষণের পর তার চোখ উৎপাটন করা হয়। এ ব্যাপারে হরিণাকুন্ডু থানায় একটি মামলা হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারি এক পুলিশ কর্তৃক পুলিশের শিশু কন্যা ধর্ষিত হয়, ১ মার্চ শ্রীনগর থানার বাড়ৈগাঁও গ্রামে ৭ বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ১২ মার্চ লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার আলেকজান্ডার পাইলট হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী জেবল হকের বাড়িতে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়, একই দিনে কাপাসিয়া থানার চাঁদপুর ইউনিয়নের কলখোলা মাঠের পাশে গজারী জঙ্গলে ধর্ষিত হয় একটি শিশু। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়, ১৮ মার্চ নবাবগঞ্জ থানায় একটি শিশু ঘর্ষিত হয়, ২০ মার্চ বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার বড়ইবাড়িয়া ইউনিয়নের বাদুড়গাছা গ্রামে ধর্ষণ করা হয় ৫ বছরের একটি শিশুকে, ২১ মার্চ লালমনিরহাটের আদিতমারীর বিডিআর ক্যাম্পের সাথে ক্যান্টিনের কাছে ১৪ এবং ১৫ বছরের দুই কিশোরী পরপর দু'বার ধর্ষিত হয়, একই দিন ঝিগাতলা ধোপাপাড়ায় একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
২৩ মার্চ বান্দরবান এলাকায় গোসল করতে গিয়ে একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ২ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় চকলেটের লোভ দেখিয়ে একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, ৬ এপ্রিল নীলফামারীতে সিনেমা দেখানোর কথা বলে নিয়ে গিয়ে একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, ২৩ এপ্রিল কড়াইলের টিএন্ডটি অফিসের মুক্তিযোদ্ধা অফিসে একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ২৯ এপ্রিল সৈয়দপুরে ঘুমন্ত অবস্থায় একটি শিশু ধর্ষিত হয়, একই দিনে বাগেরহাটে বিস্কুট খাওয়ার লোভ দেখিয়ে আরো একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, ৬ মে বরগুনা শহরের থানাপাড়া এলাকায় একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ৭ মে ইসলামপুরে ধর্ষিত হয় একটি শিশু, ৮ মে বাগেরহাটে একটি শিশুকে অপহরণ করে পরে ধর্ষণ করা হয়, ২০ মে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভাটাপরাণী গ্রামে একটি শিশু ধর্ষিত হলে থানায় একটি মামলা হয়।
২৫ মে ২০০০ গোদাগাড়ী উপজেলার চর নওশেরী গ্রামে ধর্ষিত হয় একটি শিশু, ৩১ মে মিরপুর বুদ্ধিজীবী মাজারে ধর্ষিত হয় একটি শিশু, ১ জুন পৌর নদীর ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডে একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ৩ জুন ফেনীর ফুলগাজী থানায় একটি শিশু ধর্ষিত হয়, একই দিন তেজগাঁও রেল গেট এলাকায় একটি শিশুকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়, ৬ জুন ঠাকুরগাঁওয়ের বক্ষাপুর গ্রামে একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ৭ জুন ধানমন্ডিতে একটি শিশু ধর্ষিত হয়, ১৮ জুন কুমারখালী শহরে মজনুর বাড়িতে একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হলে তাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়, ২৪ জুন পঞ্চগড়া সদর থানায় পুলিশ কর্তৃক শিশু ধর্ষণের একটি মামলা হয়।
১৫ জুলাই ১৯৯৮ সন্ত্রাসীরা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলী ছুঁড়ে মৌলভীবাজার শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত জেলা ও দায়রা জজ একেএম ফজলুল করিমের বাসভবনে ঢোকার সাহস করেছে। পরের দিন সংবাদ সম্মেলনে জজ জানিয়েছেন, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বেআইনি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী তাজউদ্দিন ওরফে তাজ, উজ্জ্বল এবং অপর একজন মিলে তাদের প্রতিদ্বনদ্বী গ্রুপের সঞ্জিতকে ধাওয়া করলে উক্ত সঞ্জিত জজের বাসভবনে ঢুকে পড়ে। পেছন দিক থেকে সন্ত্রাসীরা সঞ্জিতকে লক্ষ্য করে জজের বাসভবনের ভিতর একাধিক গুলীবর্ষণ করে। সঞ্জিত আত্মরক্ষার জন্য বাসভবনের নীচতলায় একটি কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে সন্ত্রাসীরা দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। বাসভবনে কর্তব্যরত কর্মচারীরা বাধা দিলে তাদের সন্ত্রাসীরা মারধর করে। পুলিশ আসার খবর পেয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
প্রকাশ হবার আগেই মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টুর ‘আমার ফাঁসি চাই' বইটি ১৯৯৬-২০০০ সময়কালে সরকারকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। এর জন্য ঘাতকরা হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর হামলা করেছিল। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার দেশে আগমন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোগী রেন্টু ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে বইটি প্রকাশ করেন ৫ জুন ২০০০। বাজারে যাওয়ার পর বইয়ের সব কপি রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায়। ২০ জুন ২০০০ সূত্রাপুর থানার ফরাশগঞ্জে ৯ বিকে দাস রোডের একটি দোকানে গুলী করে তাঁর শরীরের অংশবিশেষ ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়। পায়ে ৪টি স্থানে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন। দীর্ঘদিন পর ৭৫ বছর বয়স্ক মাকে দেখতে গিয়ে তিনি ঘাতকদের কবলে পতিত হন। এ সম্পর্কে ২১ জুন ২০০০ দৈনিক দিনকালের সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তাকে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামী, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস (২) বাহাউদ্দিন নাসিম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান নজিব আহমেদ ও চীফ হুইপ পুত্র সাদেক আবদুল্লাহ-এই চারজনকে দায়ী করে বলেন, ‘নিরাপত্তার অভাবে থানায় গিয়ে মামলা করতে পারছে না বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করিতে পারে।' রেন্টু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নিতে প্রেসিডেন্টের প্রতি আবেদনও জানান। এই ছিল শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের চিত্র।
প্রতিবাদ সত্ত্বেও কিছুতেই থামছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নির্যাতন ও তাদের নামে অপহরণ ঘটনা। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলেও মিডিয়ার চোখ ফাঁকি দিতে পারছে না অনেক ঘটনা। র্যাব কর্তৃক কলেজ ছাত্র লিমনকে গুলী করে পঙ্গু করে দেয়া, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুকের ওপর পুলিশী হামলা, কমিশনার চৌধুরী আলম গুম, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় র্যাবের গুলীতে স্কুলছাত্র স্বাধীন আহমেদ শুভর মৃত্যু, র্যাবের গ্রেফতারের পর হাসপাতালে আদাবরের বিল্লাল হোসেন নামে এক যুবকের মৃত্যু, ভৈরবে রহিমা বেগমের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে র্যাবের গুলী ঘটনার দায় এড়াবে কিভাবে সরকার। এসবের চিত্রতো মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশ পেয়েছে।
শুধু হত্যাকান্ডই নয়, আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে নৃশংস খুনের ঘটনা। লাগেজের ভেতরে লাশ, ব্যাগের ভেতরে লাশ, ডাস্টবিনে, ঝোপঝাড়ে ও খাল-বিল থেকে পুলিশ উদ্ধার করছে মানুষের খন্ড-বিখন্ড দেহ। নৃশংসভাবে টুকরো টুকরো করে হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য চলে নানা অপচেষ্টা। পরিচয় মুছে ফেলতে পৈশাচিকভাবে চেহারা বিকৃত করা হচ্ছে। কখনও মুখে এসিড ছুঁড়ে চেহারা ঝলসে দেয়া হয়। কখনও মাটির নিচে পুঁতে রেখে গুম করা হয় মৃতদেহ। পুলিশ বিভিন্ন স্থান থেকে এ ধরনের টুকরো লাশ উদ্ধার করলেও অনেকেরই পরিচয় উদঘাটন করা সম্ভব নয়। পচে-গলে চেহারা বিকৃত হওয়ায় স্বজনদের কাছেও প্রিয় ব্যক্তি হয়ে যায় অপরিচিত। দীর্ঘদিন মর্গে পড়ে থাকার পর অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে দাফন করা হয়। আর এ কাজটি হয়ে থাকে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের বদৌলতে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমেই নৃশংস ও জঘন্যতম হত্যাকান্ডের ঘটনা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিরাপত্তা বাহিনীর গুম-হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। চলমান মানবাধিকার বিরোধী কর্মকান্ড বন্ধ করার আহবান জানিয়ে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছে এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট এনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বিশেষ প্রতিনিধি মো. আবদুল হান্নানের কাছে সংগঠনটি এ চিঠি দেয় বলে ১২ জুলাই ২০১১ দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশ।
এশিয়ান ফেডারেশনের চেয়ারপার্সন মুগিয়াস্তো ও মহাসচিব ম্যারি এলিড ডি, বাকালসো চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে গুম-হত্যার ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার জনগণ এ নিয়ে কোথাও আশ্রয় পাচ্ছে না। ভিকটিমের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ নিয়ে গেলে থানা তা গ্রহণ এবং রেজিস্টারভুক্ত করছে না। এটা নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হলে মানবাধিকার রক্ষা করা আবশ্যক উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, আমাদের সদস্য মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার' গুম-হত্যা নিয়ে অনুসন্ধানের পর তথ্য প্রকাশ করছে। এতে অধিকারকেও নিগৃহীত হতে হচ্ছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এশিয়ান ফেডারেশন কর্মকর্তারা বলেন, হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তারা। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা সংস্কারেরও দাবি জানান।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবাদ সত্ত্বেও কিছুতেই থামছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নির্যাতন ও তাদের নামে অপহরণ ঘটনা। দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও খোঁজ মিলছে না নিখোঁজ ব্যক্তিদের।
এ ধরনের নৃশংসতা বাড়তে থাকলে মনে করতে হবে আইনশৃক্মখলার চরম অবনতি ঘটছে। এতে জনমনে অস্থিরতা বাড়বে। সঠিক তদন্ত ও ঘাতকের কঠোর শাস্তি দেয়া হলে এ রকম হত্যাকান্ড অনেকাংশে কমে যাবে।
-লেখক পরিচিতি : সদস্য সচিব, শামসুর রহমান ফাউন্ডেশন, সিলেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন