শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

হরতাল না ডেকে গণকারাবরণ শুরু করুন


আদালত প্রাঙ্গণ থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে বিরোধীদলীয় ৩৩ নেতাকে
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে বিরোধীদলীয় ৩৩ নেতাকে

মশিউল আলম | তারিখ: ১৯-০৫-২০১২


মুখোমুখি
মনে হচ্ছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যেন রাজপথ থেকে পাততাড়ি গোটান এবং তারপর ‘বাটি চালান’ দিয়েও যেন তাঁদের আর রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে খুঁজে পাওয়া না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে সরকার ‘হামলা-মামলা’র কৌশলকে প্রধান রণকৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই দেখা যাচ্ছে, বিরোধী জোটের ৩৩ জন নেতাকে একসঙ্গে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সোজা কারাগারে পাঠানোর পর পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এখন আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের টুঁটি চেপে ধরছেন। গ্রেপ্তারের চেষ্টায় বেপরোয়া পুলিশসদস্যদের সাঁড়াশি হাতে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যাচ্ছে বিরোধী নেতাদের পরনের জামাকাপড়। 
কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা এতে ঘাবড়ে যাননি। তাঁরা বলছেন, হামলা-মামলা দিয়ে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন থামাতে পারবে না। বরং তাঁদের আন্দোলন আরও বেগবান হবে, শেষে এমন কঠিন পরিস্থিতি তাঁরা সৃষ্টি করবেন যে সরকার পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
অর্থাৎ, সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক। উভয় পক্ষ পরস্পরকে সমূলে পর্যুদস্ত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ।

কী আছে সরকারের মনে
বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় এ যাবৎ যে দক্ষতা দেখিয়ে এসেছে, বিরোধী দল হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামে পারঙ্গমতা দেখিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। স্বাধীনতার আগের দিনগুলোতে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্যের স্মৃতি তারা সম্ভবত ভুলতে পারে না। স্বৈরাচারী এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা বিরাট ছিল। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের নির্বাচিত প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারকেও তারা পূর্ণ মেয়াদে শাসন করতে দেয়নি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির সরকারকে তারা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের অনড় দাবিতে তাদের সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিল। বিএনপি সরকার বাধ্য হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে এবং ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।
আন্দোলন-সংগ্রামে এসব সাফল্যের স্মৃতি আওয়ামী লীগ ভুলতে পারে না; নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পরেও তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে রাজপথে নামে। বিএনপির প্রথম মেয়াদে দেখা গেছে, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করার ঝোঁকটাই বেশি ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের ক্ষেত্রে পুলিশ-গোয়েন্দা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করার স্টাইলটা ছিল বিএনপির বিশেষ স্টাইল। আওয়ামী লীগের স্টাইল ছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগের ব্যবহার। মনে আছে, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগের সরকারের আমলেই প্রথম চালু হয়েছিল হরতালবিরোধী শান্তি মিছিলের নামে সরকারি দলের অশান্তি মিছিল। বিরোধী দল বিএনপির ডাকা হরতাল প্রতিহত করতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা নিজ নিজ মহল্লায় বের করতেন ‘হরতালবিরোধী শান্তি মিছিল’। সেসব যুদ্ধংদেহী মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্রও বহন করা হতো; তেমনই একটি মিছিল থেকে সরকারদলীয় এক সাংসদের গুলি করার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হলে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। আরেকটি হরতালবিরোধী শান্তি মিছিলে সরকারের এক মন্ত্রীর আশ্রিত এক সন্ত্রাসীর শটগান বহনের ছবিও সংবাদপত্রে ছাপা হলে দেশজুড়ে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
আওয়ামী লীগের এই ‘বেসরকারি স্টাইল’ সম্ভবত প্রাচীন হয়েছে। এবার তারা হাতে তুলে নিয়েছে প্রতিপক্ষ দমনের বিএনপির স্টাইল। প্রায় তিন দশকের রাজনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, বিএনপির সরকার মন্দ যা কিছু শুরু করে, আওয়ামী লীগের সরকার এসে সেই মন্দটাকেই আগে হাতে তুলে নেয় এবং সেটাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সম্ভবত মনে করে, মন্দের সঙ্গে লড়তে হলে মন্দ হতে হয়। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত সর্বত্র দলীয়করণের চূড়ান্ত অবস্থা করা হয়েছে এই যুক্তিতে যে আগের সরকার এসব জায়গায় নিজেদের লোক বসিয়েছে, আমাদের করণীয় হচ্ছে তাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নিজেদের লোক বসানো।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশ, গোয়েন্দা ও আইন-আদালতকে ব্যবহার করার বিএনপির স্টাইল এবারের আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করেছে বেশ ভালোভাবেই। এর একটা সেরা উদাহরণ: বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের প্রথম সারির ৩৩ জন নেতাকে অবিশ্বাস্য এক অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় জামিন না দিয়ে সোজা কারাগারে পাঠানো। এই নেতারা আগাম জামিন চাওয়ার জন্য আদালতে সশরীরে হাজির হবেন বলে আদালত প্রাঙ্গণকে সরকার যেভাবে ‘পুলিশি-রাজ্যে’ পরিণত করেছিল, সেটিও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আর এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে বিরোধী নেতা-কর্মীদের টুঁটি চেপে ধরছেন, জামা-কাপড় ছিঁড়ে প্রায় চ্যাংদোলা করে পুলিশভ্যানে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, সেসব দৃশ্যের কথা বলাই বাহুল্য।

কী করতে পারে বিরোধী দল
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রথম সারির অনেক নেতাকে কারাগারে পাঠানোর পর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অন্য নেতাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন: এই নেতাদের একটা অংশ রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন, অন্য অংশ আইনি লড়াই লড়বেন। বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালন করার পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট শুক্র-শনি ছুটির দিন বাদ দিয়ে অচিরেই আবার হরতাল ডাকবে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। হরতাল অত্যন্ত অজনপ্রিয় কর্মসূচি—এ কথা তাঁরা ইতিমধ্যে জানেন। কিন্তু হরতালের মতো সহজ কর্মসূচি আর নেই। ডাক দিলেই হরতাল হয়ে যায়, হরতাল আহ্বানকারীরা ঘরে বসে থাকলেও। কিন্তু তাঁরা ঘরে বসে থাকতে রাজি নন। রাজপথের আন্দোলন তাঁরা চালিয়ে যাবেন।
কিন্তু হরতালের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচি নিয়ে যে সমস্যা, সেটা এখন বিরোধী দলকেই আক্রান্ত করছে সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, জনগণ হরতাল পছন্দ করছে না। দ্বিতীয়ত, হরতালের সময় যেসব নাশকতামূলক ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর দায় বর্তাচ্ছে বিরোধী দলের ওপর। বিরোধী দল মুখে বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার, তথা আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কিন্তু কোনো কিছুই শান্তিপূর্ণ হচ্ছে না। হরতালের সময় বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীরা যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালাচ্ছেন, পুলিশের বাধার মুখে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ের কথাটা এভাবে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
মূল প্রশ্নটা হলো, শক্তি প্রদর্শনের এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধী জোট কী অর্জন করতে চাইছে? এ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করা? বা এখনই এই সরকারের পতন ঘটানো? বিএনপি একটি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল, খালেদা জিয়ার অভিজ্ঞতা আছে দুই মেয়াদে সরকার পরিচালনার। তাঁরা জানেন, এভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো বিরোধী দল সরকারকে একটুও দুর্বল করতে পারে না। আওয়ামী লীগ ক্রমাগত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আর লগি-বৈঠার শক্তি দেখিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ একটি ঘণ্টাও হ্রাস করতে পারেনি। বিএনপিসহ বিরোধী জোট যদি মনে করে বলপ্রয়োগে মাধ্যমেই এ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা সম্ভব, অথবা তার পতন ঘটানো সম্ভব, তাহলে ভুল করবে। কারণ বলপ্রয়োগের সামর্থ্য বিরোধী দলের চেয়ে সরকারের অনেক অনেক বেশি।
তাহলে বিএনপির এখন কী করা উচিত? আন্দোলন-সংগ্রাম বাদ দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া? ঘরে বসে বসে এ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গোনা?
না। সেটা কোনো রাজনৈতিক দলের কাজ হতে পারে না। যে নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখা উচিত। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে—এই প্রস্তাবে সরকারকে রাজি করাতে বিএনপিসহ বিরোধী জোটের অবশ্যই তৎপর থাকা উচিত। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করাই সর্বোত্তম পন্থা। এই দাবিতে সংসদে গিয়ে কিছু উত্তেজনা দেখালেও মন্দ হবে না। আর, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাটি ফিরিয়ে আনার পক্ষে যে জনসমর্থন টের পাওয়া যাচ্ছে, এই দাবিতে নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে জনমত সংগঠিত করার চেষ্টা করা উচিত বিএনপির। এখনো পর্যন্ত তাদের সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রাম জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। এসব দলীয় স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। দুই বড় দলের লড়াইকে মানুষ দেখছে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে: একদল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়, আর অন্য দল তাকে টেনে নামিয়ে নিজে ক্ষমতায় যেতে চায়।
এ কারণে বিএনপির এসব আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে জনসাধারণ একাত্ম বোধ করে না। যদি করত, তাহলে তাদের মিছিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে দলে যোগ দিত নির্দলীয় সাধারণ মানুষ। হরতালের দিন গাড়িতে আগুন দিতে হতো না, দোকানপাট ভাঙচুর করতে হতো না। পরিবহন-শ্রমিকেরা নিজেরাই গাড়ি বের করতেন না, দোকানিরা নিজের ইচ্ছাতেই বন্ধ করে রাখতেন দোকানপাট। কিন্তু হরতালের নামে এখন যা হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, জনসাধারণের জীবিকা, শান্তি, নিরাপত্তা ইত্যাদিকে জিম্মি করে দলীয় রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা।
কিন্তু এটাই তো রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি আজ হঠাৎ করে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে কী করে?
তাহলে আর কী করার থাকে?
হরতালের চেয়ে শতগুণ নিরাপদ একটা কৌশলের কথা বিএনপির নেতারা ভেবে দেখতে পারেন। ৩৩ জন নেতাকে সরকার কারাগারে ঢুকিয়েছে, এর প্রতিবাদে, এবং ওই নেতাদের মুক্তির দাবিতে আর হরতাল না ডেকে গণহারে কারাবরণ শুরু করুন। তেত্রিশ কেন, তেত্রিশ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে প্রবেশ করুন। সরকারের কারাগারগুলোতে কতজন রাজবন্দীর জায়গা হয়—সেটাই এবার দেখা যাক! 

 মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন