আহমদ আশিকুল হামিদ :
এসবই অবশ্য জল্পনা-কল্পনা, যদিও প্রতিটির পেছনেই রয়েছে তথ্যনির্ভর নানা খবরাখবর। এগুলোর ভিত্তিতে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করা যেতে পারে। প্রথমত, গুম হয়ে যাওয়া নেতা ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালনের ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে মিস্টার সেনগুপ্তদের সরকার উল্টো বিরোধী দলকেই উৎখাত করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীনদের কৌশলের দিকটিও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। প্রথম দিনটি থেকেই সরকার পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে লাঠিপেটা করিয়ে নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলন দমন করার পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দায়ের এবং ঢালাও গ্রেফতারের পথে পা বাড়িয়েছে। এখানে পরিষ্কার উদ্দেশ্য, যাতে বিএনপির পক্ষে আন্দোলনকে আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব না হয়। মামলা দায়ের করেও বসে থাকেনি সরকার, নেতাদের বাসাবাড়িতেও পুলিশকে দিয়ে অভিযান চালিয়েছে। পুলিশ কোনো রকম ওয়ারেন্ট ছাড়া তো গেছেই, বাসাবাড়িতে ঢুকেছে এমনকি রাতের বেলাতেও। এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সেটাও করে দেখিয়েছে সরকার। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসেছে নির্যাতনের বিষয়টি। পুলিশ এমনকি নারী নেত্রীদের গায়েও হাত তুলেছে, তাদের পিটিয়েছে যথেচ্ছভাবে।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি আলোচিত হয়েছে নেতাদের সংশ্লিষ্টতার দিকটি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং কর্নেল (অব.) অলি আহমদের মতো কেন্দ্রীয় প্রধান নেতাদের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি ভাঙচুর করা, গাড়িতে আগুন দেয়া কিংবা সচিবালয়ে ককটেল নিক্ষেপ করার যে প্রশ্ন উঠতে পারে না সে কথা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। কিন্তু তাদেরকেও মামলার আসামী হতে হয়েছে। মাত্র ১১ দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশও জবরই দেখিয়েছে। ১৮ দলীয় জোটের প্রায় সব প্রধান নেতার নামই ঢুকিয়ে দিয়েছে চার্জশিটে। ঠিক কোন কোন নেতা হরতালে গাড়ি পোড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তাদের সবার নাম এমনভাবেই বসিয়ে দেয়া হয়েছে যেন কল্পিত গোপন বৈঠকে পুলিশের ওই ইন্সপেক্টরও হাজির ছিলেন! এর পর এসেছে তাদের নাম যারা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছাকাছি গিয়ে গাড়িতে আগুন দিয়েছিলেন। তালিকায় এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নামও রয়েছে- যিনি রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে একই সময়ে একাধিক স্থানে অবস্থানের ‘আধ্যাত্মিক ক্ষমতা' অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘দোয়া' চেয়েছেন। কারণ, ঘটনার দিন তিনি সপরিবারে কক্সবাজারে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে দিয়ে ঢাকায় গাড়ি পুড়িয়েছে! সাধারণভাবে একই কথা বলা চলে অন্য সবার বেলায়ও। কারণ, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা নিজেরা গিয়ে গাড়ি পোড়াবেন, তাও প্রধানমন্ত্রীর একেবারে নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে- কথাটা বিশ্বাস করানো কঠিনই বটে! কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ বলে কথা! এজন্যই মাত্র ১১ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। সময়ের হিসাবে এটাও একটি বড় ধরনের রেকর্ড বটে। কারণ, একই পুলিশ কিন্তু মাস পেরিয়ে গেলেও ইলিয়াস আলীর কোনো হদিস দিতে পারেনি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের মতো অন্য অসংখ্য ঘটনার কথা না হয় না-ই উল্লেখ করা হলো!
সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পথ বন্ধ করার মাধ্যমেও সরকার ন্যক্কারজনকভাবে নিজের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে। গত ২ ও ৩ মে'র ঘটনায় দেখা গেছে, এ দুটি দিনেই সুপ্রিম কোর্টের চারদিকে শত শত পুলিশ ছিল প্রস্তুত হয়ে যাতে নেতাদের কেউ জামিন নেয়ার জন্য যেতে না পারেন। মাননীয় বিচারপতিরাও নিরাশই করেছেন। জনগণের আশা ছিল, উচ্চ আদালতে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়ার কারণে মাননীয় বিচারপতিরা হয়তো সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। কোনো নেতার পক্ষেই আদালতে যাওয়া সম্ভব হয়নি, নেতারা আগাম জামিনও পেতে পারেননি। জামিনের জন্য আবেদন করা হালেও একটি বেঞ্চ বিব্রত বোধ করেছেন, অন্য এক বেঞ্চ এখতিয়ার নেই বলে আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছেন। ফলে নেতাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। এমন অবস্থা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না সে কথাটা ক্ষমতাসীনরাও জানেন। কিন্তু প্রথম থেকেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিছুতেই কিছু যায় আসে না তাদের। মুখে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা বরং ফ্যাসিবাদের পথই ধরেছেন। বিরোধী নেতাদের জেলের ভাত খাওয়ানোর জেদও পূরণ করে ছেড়েছে সরকার। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী গত ১৬ মে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতারা নিম্ন আদালতে গিয়েছিলেন আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু তাদের জামিন দেয়া হয়নি। এমনকি আদেশটি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন নেতারা। বিচারক সোজা তাদের কারাগারে পাঠানোর হুকুম দিয়েছেন। পুলিশও জাতীয় পর্যায়ের ডজন তিনেক নেতাকে প্রিজন ভ্যানে করে কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নেতাদের সাড়ে চার বছর পর্যন্ত জেল খাটতে হতে পারে।
৩৩ জন নেতাকে এক সঙ্গে কারাগারে ঢোকানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সরকারের ফ্যাসিবাদী চেহারারই উন্মোচন ঘটেছে। মামলা জামিন অযোগ্য ছিল ধরনের যুক্তি দেখানো হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি না যে, সরকার আদালতকে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে নিয়েছে। বিচারকের হুকুমের মধ্যেও সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। সবকিছুর পেছনে রয়েছে বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালানোর উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে চলেছে সরকারের নিপীড়নমূলক কর্মকান্ডে। পুলিশের প্রচন্ড ধাওয়ার মুখে বিরোধী দল এমনকি সমাবেশ করতে পারছে না। শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ নির্বিচারে লাঠি পেটা করছে। গ্রেফতার ও গুমের আতংকে নেতাকর্মীরা নিজেদের অফিসে পর্যন্ত বসতে পারছেন না। এ ধরনের কর্মকান্ড কেবল ফ্যাসিস্ট কোনো সরকারই চালাতে পারে। বস্তুত সব মিলিয়েই সরকার এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যখন আর বলার উপায় নেই যে, দেশে গণতন্ত্রের লেশ মাত্রও অবশিষ্ট আছে। একই কারণে বিরোধী দলকেও হরতাল ডাকতে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার যদি মিছিল-সমাবেশের মতো গণতন্ত্রসম্মত সাধারণ কর্মসূচিও ভন্ডুল না করতো তাহলে বিরোধী দলকেও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হতো না।
বলাবাহুল্য, বানোয়াট মামলা এবং গুম-খুনসহ দমন-নির্যাতন অবশ্যই গণতন্ত্রসম্মত পন্থা নয়। এগুলো বরং পরিস্থিতিকে সংঘাতমুখী করে তোলে। সরকারের জন্য সংঘাত এড়িয়ে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার সময় ও সুযোগ এখনও রয়েছে। সরকারের উচিত দমন-নির্যাতন এবং মামলা ও গ্রেফতারের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ড চালানোর বদলে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া। এমন উদ্যোগ অনেক বেশি দরকার এজন্য যে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সংঘাতমুখী হয়ে ওঠায় জনগণের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রশ্নে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিদেশীরা সম্প্রতি জোরালো তাগিদও দিতে শুরু করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু নয়, ক্ষমতাসীনদের ‘বন্ধুরাষ্ট্র' ভারতও ঘোষণা করেছে, একতরফা কোনো নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কথাটার মধ্যে সরকারের জন্য সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলেই সংলাপ শুরু করার পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সরকারকে একই সঙ্গে যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাও দিতে হবে। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সে সরকারের রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের যে রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে সে রায়টিতেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনার ভিত্তিতেও সরকার পদক্ষেপ নিতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে নয়, যে নামেই হোক না কেন, এমন কোনো সরকারের বিধান করতে হবে যার অধীনে নির্বাচনের মাঠে সব দলের জন্যই সমানভাবে তৎপরতা চালানোর সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।
অন্যদিকে সরকার কিন্তু এখনো পর্যন্ত সুর নরম করার লক্ষণ পর্যন্ত দেখাচ্ছে না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে ১৭ মে'র হরতালেও। সেদিনও সরকার যথারীতি পুলিশকে ‘মাঠে' নামিয়েছিল। রাজধানীসহ দেশের কোনো স্থানেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মিছিল-সমাবেশ করতে পারেননি। বিচ্ছিন্নভাবে পিকেটিং করেছেন তারা। এটাও শান্তিপূর্ণভাবে করতে দেয়নি পুলিশ। পুলিশের ভয়ংকর অ্যাকশনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় গাড়ি ভাংচুর করার ঘটনা ঘটেছে। অথচ পুলিশ ঝাঁপিয়ে না পড়লে নেতাকর্মীরাও গাড়ি ভাংচুরের ধারেকাছে যেতেন না বলা যায়। এখানে রাজশাহীর সাবেক মেয়র এবং বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনুর উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তিনি পায়ে হেঁটে নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসে যাওয়ার সময় তাকে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, তার পরনের কাপড় পর্যন্ত ছেঁড়ে ফেলেছে। মিনু অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগের ক্যাডাররাই পুলিশের পোশাক গায়ে চড়িয়ে তাকে লাঠিপেটা ও লাঞ্ছিত করেছে। অর্থাৎ সরকার শুধু পুলিশকেই যথেষ্ট মনে করছে না, ‘মাঠে' নামানোর আগে দলীয় ক্যাডারদের গায়েও পুলিশের পোশাক চাপিয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতাসীনরাও যথেষ্টই দেখিয়েছেন। হরতালের আগের দিন বিশেষ করে আইন ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে ভাষায় হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন তা শুনেই বোঝা গিয়েছিল, পুলিশ কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও দলীয় কর্মীদের প্রতি ‘মাঠ' দখলে রাখার হুকুম জারি করেছিলেন। কর্মীরা সে হুকুমই অক্ষরে অক্ষরে তামিল করেছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ একটি কথায়ও সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়েছে। ঠিক হরতালের দিনটিতেই তিনি ঘোষণা করেছেন, বিরোধী দলকে কিভাবে ‘সঠিক পথে' ফিরিয়ে আনা যায় তা নাকি তার জানা আছে! এ পর্যন্ত এসেই থেমে যাননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলে বসেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নামের ‘দানবকে' তারা আর দেখতে চান না। কথা উঠেছে এজন্য যে, তত্ত্বাবধায়ক নামের যে সরকারকে তারা আজ ‘দানব' হিসেবে চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন, মইন-ফখরুদ্দিনদের সে সরকার ছিল আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার ফসল। শেখ হাসিনা নিজেও একে তাদের ‘আন্দোলনের ফসল' হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ভোটার তালিকা ও আইডি কার্ড তৈরিসহ নানা কার্যক্রমের জন্য ওই ‘দানবের' প্রশংসায়ও তারা পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। তাছাড়া ইতোমধ্যে প্রমাণিত সত্য হলো, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার পেছনেও একই ‘দানবের'ই অবদান রয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘দানবের' সমালোচনা যেমন মানায় না তেমনি সে ‘দানবের' অপকর্মের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই অস্বীকার করার সুযোগ থাকতে পারে না।
এখানেই এসেছে চলমান আন্দোলনের ইস্যু প্রসঙ্গ। ইসূু্যটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সংক্রান্ত। দাবিটি মেনে নেয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ১০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী দায়িত্ব যেখানে ছিল নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা সরকার সেখানে আন্দোলন দমনের আড়ালে বিরোধী দলকেই উৎখাতের কার্যক্রমকে জোরদার করেছে। উস্কানিও কম দেয়নি সরকার। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেজন্য ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হয়েছে বিরোধী দলকে। এরপর এসেছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করার এবং বন্দি নেতাদের মুক্তি দেয়ার দাবি। কিন্তু কোনো একটি বিষয়েই প্রধানমন্ত্রীকে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে দেখা যায়নি। তিনি বরং যথারীতি উস্কানিমূলক কথাবার্তাই বলে চলেছেন। পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে লাঠিপেটা করার মাধ্যমে বিরোধী দলকে ‘সঠিক পথে' ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েই তিনি থেমে যাচ্ছেন না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিটিকেও সোজা নাকচ করে দিচ্ছেন।
বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। কারণ, দাবি আদায়ের জন্য হরতালসহ আন্দোলন করার একশভাগ অধিকার রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকার সংবিধানসম্মত সে অধিকার পদদলিত তো করছেই, আন্দোলন দমনের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোকে স্থবির করে ফেলার ভয়ংকর কৌশলও নিয়েছে। অথচ এ ধরনের কৌশল বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার প্রয়াত পিতার অভিজ্ঞতাও স্মরণ করতে পারেন। পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব' আইয়ুব খান এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা চাপিয়েও দেখেছেন। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝোলাতে যেমন পারেননি, তেমনি পারেননি তার মুক্তির আন্দোলনকেও দমন করতে। মাঝখান দিয়ে এত যে ডাকসাঁইটে ‘লৌহ মানব', সে আইয়ুব খানকেই উল্টো পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। বাংলাদেশে আওয়ামী মহাজোটের শরিক জেনারেল (অব.) এরশাদের স্মৃতিও তো মোটেও মধুর নয়। গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে তাকেও বিদায়ই নিতে হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমা চাপিয়ে এবং গোপনে-প্রকাশ্যে এর-ওর সমর্থন নিয়েও টিকে থাকতে পারেননি তিনি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তো আন্দোলনের পথ বেয়েই এ পর্যন্ত এসেছেন। তাকেও তো মামলার ধকল কম সইতে হয়নি। তিনি কি তাই বলে আন্দোলন ফেলে কেটে পড়েছিলেন? তাহলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগগুলোই বা মামলার ভয়ে রাজপথ ছেড়ে যাবে কেন?
এত কথা বলার কারণ নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বানোয়াট মামলা এবং গুম-খুনসহ দমন-নির্যাতন অবশ্যই সমাধানের কোনো পন্থা নয়, গণতন্ত্রসম্মত তো নয়ই। সুতরাং গণতন্ত্রের ব্যাপারে আদৌ সদিচ্ছা থেকে থাকলে সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে সব মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া। বর্তমান পর্যায়ে এটা অনেক বেশি দরকার এজন্য যে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রশ্নে সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দেশের ভেতরে শুধু নয়, বিদেশীদের পক্ষ থেকেও ইদানীং তাগিদ জোরালো হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নও সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপ শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ‘বন্ধুরাষ্ট্র' ভারত পর্যন্ত সংলাপের তাগিদ দিয়েছে। এমন এক অবস্থায় দায়িত্ব যেখানে ছিল সংলাপের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা, সরকার সেখানে উল্টো মামলা দায়েরের মাধ্যমে সমঝোতার সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করার অশুভ পদক্ষেপ নিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা আশা করতে চাই, এ ধরনের কৌশল ও পদক্ষেপের ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে অনুধাবন করতে ক্ষমতাসীনরা কোনো ভুল করবেন না এবং মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পথে অচিরেই যাত্রা শুরু করবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের বদৌলতে সবকিছুর হিসাবেই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। প্রথমে অবশ্যই বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের ডজন তিনেক নেতাকে জেলের ভাত খাওয়ানোর বিষয়টিকে সামনে আনা দরকার। আনতামও। কিন্তু মাঝখানে আবারও ঝামেলা বাধিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাজনীতিতে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বেছে বেছে ঠিক সেই দিনটিতেই ঘোষণা দিয়েছেন ১৮ দলের নেতারা যেদিন নিম্ন আদালতে গিয়েছিলেন জামিনের জন্য। একে কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ আছে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, প্রধানত বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর গুমকেন্দ্রিক যে ইস্যুটির জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্প্রতি সংকট ঘনীভূত হয়েছে, হরতালের পর হরতাল এসেছে এবং সবশেষে অন্তত জনা চল্লিশেক নেতাকে কারাগারে ঢুকতে হয়েছে সে ইস্যুর সঙ্গে মিস্টার সেনগুপ্তর নাম জড়িয়ে রয়েছে প্রথম থেকেই। বিরোধী দল অভিযোগ করেছে, ইলিয়াস আলীকে গুম করার পেছনে রয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর ৭০ লাখ টাকার কেলেংকারিকে আড়াল করার উদ্দেশ্য। অভিযোগ সত্য কি সত্য নয় সে ব্যাপারে জানার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে সত্য। তবে ইলিয়াস আলীর গুমকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে আসলেও আড়ালে চলে গিয়েছিল মিস্টার সেনগুপ্তর অর্থ কেলেংকারি। তিনি নিজে অবশ্য সরাসরি জড়িত ছিলেন না, ৭০ লাখ টাকা নিয়ে তার এপিএস তারই বাসার দিকে যাচ্ছিলেন বলে ফেঁসে গিয়েছিলেন মিস্টার সেনগুপ্ত। অন্যদের ‘খবর' বানানোর কর্মকান্ডে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠা মিস্টার সেনগুপ্তকে তাই ‘তীরবিদ্ধ' হতে হয়েছিল। গুজবও যথেষ্টই ডালপালা মেলেছিল সে সময়। যেমন, শোনা গিয়েছিল, ৭০ লাখ নাকি ছিল একটি মাত্র চালানের অংশ, রেলওয়ের সাত হাজার পদে চাকরি দেয়ার নাম করে আদায় করা মোট অর্থের পরিমাণ নাকি চারশ কোটি টাকারও বেশি। শুধু তা-ই নয়, খবরে আরো বলা হয়েছিল, লন্ডন ও ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন দেশে কারো কারো সুপুত্র ও ভগিনীসহ বিশিষ্টজনেরা বসবাস করেন বলে সেনগুপ্তর মতো কারো একার পক্ষে এত বিপুল পরিমাণ টাকা হজম করাটা মোটেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ ধরা না পড়লে ওই টাকার ভাগ চলে যেতো এদিকে-সেদিকেও। সুদূর লন্ডন ও ওয়াশিংটন পর্যন্তও। কিন্তু সহজবোধ্য কারণেই অন্য সকলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন, মাঝখান দিয়ে ‘ধরা' খেয়ে ‘খবর' হয়েছেন বেচারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন