মোঃ বে লা য়ে ত হো সে ন
অসহিষ্ণু, বেপরোয়া ও মারমুখী আচরণের ফলে রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠছে। হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মতো একটি মামলায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের প্রায় অর্ধশত শীর্ষ নেতাকে জামিন বাতিল করে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনায় বিএনপি। ধৈর্য ধরে গণঅনশনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করায় বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বৃদ্ধি পা”েছ। দেশে-বিদেশে মিডিয়ায়ও একচেটিয়া ‘কাভারেজ’ পা”েছ বিএনপি। সরকারের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও দমন-পীড়নের ফলে দেশের রাজনীতিতে যে পরি¯ি’তির উদ্ভব হ”েছ, তার পুরোপুরি সুফল যা”েছ বিএনপির ঘরে; ধৈর্যের সঙ্গে সার্বিক পরি¯ি’তি মোকাবেলা করতে পারলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হবে বিএনপি।
সরকারের বেপরোয়া ও মারমুখী আচরণের ফলে দেশে-বিদেশে একটা ব্যাপার অত্যন্ত পরিষ্কার হ”েছ যে, সরকার সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের কোন ঝুঁকি নিতে চা”েছ না। তারা যেনতেনভাবে দেশে একটি নির্বাচন করতে চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব মহল থেকেই অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যব¯’া করার জন্য সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পা”েছ। এটি রাজনৈতিকভাবে বিএনপির জন্য এক ধরনের বিজয় বলা যায়।
দৃশ্যত রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের ফলে প্রাথমিকভাবে সরকারি দল পরিতৃপ্তি বোধ করলেও আলটিমেটলি এর চূড়ান্ত ফল যাবে বিরোধী দলের ঘরে। বিএনপি প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তির একটি। এ দলের প্রায় অর্ধশত শীর্ষ নেতাকে হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় জামিন বাতিল করে জেলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একসঙ্গে এত রাজনীতিবিদকে কখন, কবে জেলে নেয়া হয়েছিলÑ তার উত্তর মেলা ভার! এ তালিকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা রয়েছেন। রয়েছেন একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমও! এখন প্রশ্ন হল, বিরোধী দলের কিছু নেতা-কর্মীকে মামলা-হামলার মাধ্যমে জেলে আটকে রাখলেই কি দলগুলো নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে? না, কোনভাবেই নয়। এভাবে রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্বশূন্য করা যায় না, তখন কর্মীরা নেতৃত্ব হাতে তুলে নেবেন। সমর্থক নীরব ভোটাররা সরব হয়ে কর্মীর দায়িত্ব পালন করবেন। তখন র্যাব-পুলিশসহ প্রশাসনের সব শক্তি নিয়োগ করেও কোন লাভ হবে না।
একসঙ্গে এত শীর্ষ নেতাকে জেলে নেয়ার ব্যাপারটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে মির্জা ফখর“ল ইসলাম আলমগীরের ব্যাপারটি সবার হƒদয়কেই নাড়া দি”েছ। কেননা তিনি একজন নিখাদ ও আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। তার নৈতিকতা প্রশ্নাতীত। তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি একজন অমায়িক ও সজ্জন ব্যক্তি। তাকে বিনা অপরাধে ও অন্যায়ভাবে জেলে যেতে হবে, এটি ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সৎ রাজনীতিবিদদের জন্য এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এর ফলে কোন সৎ মানুষ রাজনীতিতে আসতে শতবার চিন্তা করবেন।
কী অপরাধ ছিল তার এবং অন্য শীর্ষ নেতাদের? তারা কি সবাই একত্রিত হয়ে একটি গাড়ি পোড়াতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে? যদি বলা হয় তারা ফোনে গাড়ি পোড়াতে উৎসাহিত করেছিলেন কাউকে, এটিও কি বিশ্বাসযোগ্য? একটি গাড়ি পোড়াতে কি একসঙ্গে অর্ধশত শীর্ষ নেতার ফোনের দরকার হয় বা সুযোগ থাকে? নাকি এটি ‘বিরোধী দলকে কীভাবে পথে আনতে হয় তা আমরা জানি’Ñ সে তত্ত্বের মাজেজা? হামলা-মামলা ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? এটি অতীতে কোন শাসক পেরেছেন? অন্তত আওয়ামী লীগের মতো একটি পুরনো দলের তো এটি জানা থাকা বাঞ্ছনীয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় সচেতন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ”েছ। তাতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন বিএনপি; সব মহলেই বিএনপির প্রতি সহানুভূতি তৈরি হ”েছ, এমনকি খোদ সরকারি দলের ভেতরও এসব নিয়ে লেজে-গোবরে অব¯’ার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। এ থেকে সরকার কোনভাবেই লাভবান হবে না। উপরš‘ বিএনপির শীর্ষ নেতারা যত দিন জেলে থাকবেন, সরকার তত ডুবতে থাকবে।
তবে এসবের ফলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হ”েছ। একটি রফতানিমুখী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন মারাÍক প্রশ্নের সম্মুখীন। এ দেশের রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ বর্তমানে বি”িছন্ন কোন দেশ নয়, বিশ্ববাণিজ্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দ্বারপ্রান্তে এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিল্প ‘তৈরি পোশাকে’ চীনের পরই বাংলাদেশের অব¯’ান। ওষুধ শিল্পে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করছে।
লক্ষণীয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি ও খ্যাতনামা ব্যবসায়ীর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ। বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ এখন ব্যাপক কাভারেজ পা”েছ। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এক প্রান্তের খবর এখন মুহূর্তের মধ্যেই অন্য প্রান্তে চলে যায়। কোন নেতিবাচক খবর বাংলাদেশে প্রচার হওয়ার আগেই ভারতসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে প্রচার হতে থাকে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জেলে নেয়ার ফুটেজ বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছে।
বিবিসি, আলজাজিরা ও এনডিটিভিসহ আরও বিভিন্ন চ্যানেলে শীর্ষ নেতাদের জেলে নেয়ার খবর শিরোনাম হয়েছে। পুলিশের বেপরোয়া আচরণও প্রচার হয়েছে এসব চ্যানেলে। একজন কনিষ্ঠ পুলিশ সদস্য কীভাবে লাঠিপেটা করছেন একজন বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদকে এবং আরেকজন পুলিশ সদস্য একজন রাজনৈতিক কর্মীকে কীভাবে গলা টিপে ধরেছেনÑ এসব দৃশ্যও প্রচার হয়েছে চ্যানেলগুলোয়। তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা বলাই বাহুল্য। এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ আর আছে কি না তা-ও এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। এসবের ফলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নির“ৎসাহিত হবে এবং রফতানি বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনৈক্য, বিভাজন ও সংঘাতময় পরি¯ি’তি বিরাজ করছে, নিকট অতীতে এর নজির নেই। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাজনীতিতে সুনামির মতো অব¯’া অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করছেন। এরই মধ্যে একজন গুর“ত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলেছেন, ‘যে পরি¯ি’তি তৈরি করা হ”েছ তাতে এক-এগারোর চেয়ে আরও ভয়াবহ পরিণতি রাজনীতিবিদদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ মন্ত্রী হয়তো সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পারছেন। তাই তিনি আগেভাগেই সতর্ক করছেন।
কিš‘ অন্যরা তো ক্ষমতার মোহে অন্ধ। তারা তো দেখছেন সব ফকফকা। এক-এগারোর দায় যেমন বিএনপির ঘাড়ে পড়েছিল, এখনও এ ধরনের কিছু ঘটলে তার দায় বর্তমান সরকারের ওপরই পড়বে। কেননা যারা ক্ষমতায় থাকেন, মানুষের দৃষ্টি তাদের দিকেই থাকে বেশি। দায়িত্বও তাদেরই বেশি থাকে। কাজেই রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ক্ষেত্র তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। দেশের মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয় এমন বিপজ্জনক রাজনৈতিক কৌশল থেকে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই বিরত থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
নেতৃত্বের পরিসীমা হল আকাশের মতো প্রসারিত ও সমুদ্রের মতো গভীর। যোগ্য নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত হয় যুগান্তকারী ও কল্যাণকর। দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট সুস্পষ্ট। এর সঙ্গে দেশ এবং দেশের মানুষের ভাগ্য জড়িত। অনৈক্য, অসহিষ্ণু ও বিভাজনের রাজনীতি চূড়ান্তভাবে দেশকে নিয়ে দাঁড় করাবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই সময় থাকতে পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের দিকে সবাইকেই মনোনিবেশ করতে হবে। আলাপ-আলোচনার জন্য চারদিক থেকেই তাগিদ লক্ষ্য করা যা”েছ। রাজনীতিবিদরা এটা উপেক্ষা করতে পারেন না। সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক মনোভাব উভয় দলকেই পরিহার করতে হবে। অনিবার্য সংঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
মাঘ মাস একবার নয়, প্রতিবারই আসে। এটি সরকারকে বুঝতে হবে। রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়, রাজনীতিবিদরা গুম হবেন এবং অহেতুক ও অন্যায়ভাবে জেলে যাবেন, এটিও মেনে নেয়া যায় না। কেননা খোদ রাজনীতিবিদদের জন্যই তা ভয়ংকর, আগে-পরে রাজনীতিবিদরাই এর শিকার হবেন।
প্রতীয়মান হয়, শাসকদের আগামী দিনগুলো হবে অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ। সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে; হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে এ কঠিন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময় অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা করা। শাসকদের উচিত দমন-পীড়ন, জেল-জুলুমের পথ পরিহার করে, শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দিয়ে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা। হিংসা-বিদ্বেষ-অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি কোন কিছুরই সমাধান দিতে পারে না, এ থেকে কোন পক্ষই লাভবান হয় না। এর ফলে যে পরি¯ি’তির উদ্ভব হয়, তা থেকে লাভবান হয় বাইরের কোন শক্তি।
মোঃ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধুবঃ-১@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন