রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

এক পা আগে দুই পা পিছে



ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ নুরাল হক্, পিএসসি
বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নানা পেশার বিজ্ঞজনদের মন্তব্য হলো, ‘রাজনীতি নাকি এক পা এগুচ্ছে, দুই পা পিছুচ্ছে।’ এহেন মন্তব্যে হঠাত্ করে গ্রামবাংলার সেই দুরন্ত বালকের তাত্ক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার কথাই মনে পড়ে গেল। হয়তো সবার জানা। তবুও পুনরুল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। বৃষ্টির মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তায় খেলা করতে করতে দেরিতে স্কুলে পৌঁছে বালকটি। রাগান্বিত শিক্ষক ধমক দিয়ে বালকটিকে বললেন, ‘স্কুলে এত দেরিতে এলে কেন?’ বালকটির তাত্ক্ষণিক উত্তর, ‘স্যার, বৃষ্টিতে রাস্তা খুবই পিচ্ছিল ছিল। এক পা এগুচ্ছিলাম, দুই পা পিছুচ্ছিলাম। তাই এত দেরি।’ শিক্ষক চোখ বড় বড় করে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘এক পা আগে, দুই পা পিছে গেলে, তুমি স্কুলে পৌঁঁছলে কী করে?’ বালকটির নির্লিপ্ত উত্তর, ‘স্যার, অবস্থাদৃষ্টে আমি বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।’ এরপর বোধ হয় ওই শিক্ষক মহোদয় বিষয়টি আর সামনে নেননি।
আবার এও প্রচলিত আছে যে, ভূতের পা নাকি পেছনের দিকে। তাই ভূত নাকি পেছনের দিকেও হাঁটতে পারে। তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কি ভূত হয়ে গেল নাকি, যার ফলে দিনশেষের হিসেবে আমাদের সব রকমের গতি-প্রকৃতি এখন পেছনের দিকে। নানা রঙের ও নানা ঢঙের বাগাড়ম্বর ও চোখধাঁধানো আনুষ্ঠানিকতার বিপরীতে বাস্তবতায় যাবতীয় সামাজিক পরিস্থিতির সব সূচক নিম্নমুখী কেন?
কিন্তু এমন তো কথা ছিল না। নিপীড়িত-নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্য স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। পেয়েছি একটি পতাকা। আজ স্বাধীন দেশে গৌরবে গৌরবান্বিত আমরা বাংলাদেশীরা। পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার ফল তারা হাড়ে হাড়ে এখনও ভোগ করছে। তাহলে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতায় নিজেদের-সহ সবাইকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন? পাকিস্তানি শাসকরা তদানীন্তন পাকিস্তানের সব সংখ্যাগরিষ্ঠ মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অতীত থেকে অদ্যাবধি ভোগান্তির প্রায় শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছে। তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন আমাদের সব রাষ্ট্রীয় উপাত্তের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে অবস্থান নিচ্ছেন? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেন এহেন আত্মঘাতী মনোভাব তথা সিদ্ধান্তসমূহ?
যেমন, বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সারা বিশ্বে সুবিদিত। তাহলে কেন ধর্ম নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো সন্দেহের চোখে দেখছে? নানামুখী বিতর্কের অবতারণা হচ্ছে? ধর্ম হলো মানুষের জীবনের সব ক্রিয়াকর্মের মৌলিক ভিত্তি। সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহের দোলাচাল কেন? কেন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে যেনতেন প্রকারে নির্বাসনে পঠানোর অব্যাহত অপচেষ্টা? এহেন অপচেষ্টা কেন ও কাদের বা কোন শক্তির স্বার্থে? কোনো রকমের বিতর্কে না গিয়ে নিঃসন্দেহে এই হলো বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধি (Perception)।
বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষেরই ভাষা হলো বাংলা। এখানে মাতৃভাষা বাংলার বিপরীতে বিদেশি ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজির প্রতি এত আদিখ্যেতার কী প্রয়োজন? বারংবার বাংলা-ইংরেজি এবং ইংরেজি-বাংলার রশি টানাটানিতে বিগত চল্লিশ বছরে আমরা শুধু পিছিয়েই গেলাম। সমালোচকদের ভাষায় আমরা নাকি ‘বাংলিশ’ হয়ে যাচ্ছি। অর্থাত্, না ইংরেজি আয়ত্ত করতে পারছি, না বাংলায় উত্কর্ষ অর্জন করছি। বাংলা ভাষা নিয়ে শুধু বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে গালভরা বুলি ছাড়া আমাদের সামনে প্রকৃতই কোনো আলোর দেখা আছে কি?
আমাদের মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানেই আলোকিত বাংলাদেশ হয় না। ল্যাপটপসহ আধুনিক থেকে আধুনিক যন্ত্রের ঠাসাঠাসিতেই শুধু আলোকিত বাংলাদেশ হয় না। আলোকিত বাংলাদেশের জন্য জ্ঞান আহরণ করতে হবে। জ্ঞানের চর্চা করতে হয়। জ্ঞানের লালন করতে হয়। জ্ঞানী-গুণীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। তবেই তো বাংলাদেশ আলোকিত হবে। এক্ষেত্রে মাতৃভাষার মতো মাধ্যমই তো একমাত্র অবলম্বন হতেই হবে। বিদেশি ভাষার প্রতি অতি প্রীতি আত্মঘাতী কাজ ছাড়া তো আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষই জীবনধারণ করে কৃষিকাজ তথা কৃষিসম্পর্কিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অথবা লেনদেনের ওপর। তাহলে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও কৃষকরা অবহেলিত কেন? মধ্যস্বত্বভোগী স্যুটেড-বুটেডদের ফুলে-ফেঁপে ওঠা এহেন জয়জয়কার কেন? এই তো সেদিন, সামান্য নয় হাজার টাকা কৃষিঋণ খেলাপি অশীতিপর মনোরঞ্জন রায়ের হাতে হাতকড়া ও কোমরে ইয়া মোটা রশিসহ সংবাদপত্রের (৯ জুলাই ২০০৭, প্রথম আলো) প্রথম পাতায় খবর ছেপে চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করা হয়। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেকো দানবদের জন্য বারংবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগের পর সুযোগ দেয়ার জন্য নীতিনির্ধারকরা মুখিয়ে থাকেন। আর সংশ্লিষ্ট চাটুকারদের সে কী তোষামদি! এহেন আচরণ কেন?
তবে কর্তাব্যক্তিরা সবাই কি ভুলে গেছেন যে, ‘কয়লা ধুলে, ময়লা যায় না?’ প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ভাষায় তাই বারংবার বলতেই ইচ্ছা করে, ‘অল রাবিশ!’ আর এই ‘অল রাবিশ’দের জন্যই নীতিনির্ধারকদের দিন-রাত্রির ঘুম হারাম ও যতসব আদিখ্যেতা। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও দোষীদের নাম মুখে আনতেও কর্তাব্যক্তিরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ও ভয়ে কুঁকড়ে যান। লজ্জা কাকে বলে? বিজ্ঞাপনের মাছ বিক্রেতার ভাষায়ই বলতে ইচ্ছে করে, ‘এরা সবাই লজ্জার ওপর প্রিজারভেটিভ দিয়েই মাঠে নেমেছে।’ কী লজ্জা, কী লজ্জা, তা-ই না?
আমরা নিঃসন্দেহে গর্বিত জাতি। কারণ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ পরিচালিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তথা স্বাধীনতার চেতনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষার সম-অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা স্বাধীনতার চেতনা বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ তা-ই বোঝে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা স্বাধীনতার চেতনা দুর্বৃত্তায়িত হতে হতে এখন দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমনে না হলেও অন্তত নাজেহাল করতে বর্তমান প্রশাসনযন্ত্র অগ্রপথিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কি অদ্ভুত আমাদের নীতিনির্ধারকদের চেতনাবোধ? বিষয়টি জ্ঞাত-অজ্ঞাত যেভাবেই হোক, তা নিতান্তই লজ্জাকর ও যে কোনো মানে অগ্রহণীয়।
তাই আজ দুঃখজনক হলেও সত্য, এহেন রোগাক্লিষ্ট-পক্ষপাতদুষ্ট চেতনাবোধের নিরাময় ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে ওরা সব, যারা একসময় অসভ্য ছিল। আর তখন আমরা ছিলাম সভ্য জাতি। আর আজ আমাদের হাজার বছরের সভ্যতার কৃতিত্ব নিঃশেষিত হয়ে ভূলুণ্ঠিতপ্রায়। আমরা এখন একসময়ের অসভ্যদের মুখাপেক্ষী। দয়া-দাক্ষিণ্য ও করুণার পাত্র। সারাক্ষণ সামান্য ডলার-ইউরোসহ একটু-আধটু উচ্ছিষ্টসদৃশ লেনদেনের প্রত্যাশী।
আজকের বাংলাদেশে যে বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে তা হলো, আমাদের স্বকীয়তা। বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অতীতের ওপর ভিত্তি করেই সামনে এগুতে হবে। ভিনদেশিদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত করপোরেট কালচার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। এই করপোরেট কালচার মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ককে বিষিয়ে দিচ্ছে। যে কালচারে নারী জাতিকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে সমাজে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নারীর মর্যাদা প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। নারীর সম্মান পদে পদে পদদলিত হচ্ছে। করপোরেট কালচারে নারী যে কোনো ভোগ্যপণ্য সমতুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ করপোরেট কালচারের মূল বক্তব্যই হচ্ছে, ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করা। এখানে মানুষের মর্যাদা গৌণ। মানুষে মানুষে সম্পর্কও তুচ্ছ। তাই নারী তো কোন ছাড়!
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হতদরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকেই সংগঠিত হয়ে মাঠে নামতে হবে। বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর বিবেকমান মানুষদেরই পথ দেখাতে হবে—স্বাধীনতার চেতনার পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্বল করে। সহিংস নয়, অহিংস পথেই তা সম্ভব। এ ব্যাপারে অতীতের ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল। শুধু প্রয়োজন ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ তথা ব্যক্তি দাম্ভিকতা-অহমিকা ছেড়ে সবাইকে নিয়ে পথ চলা। এক্ষেত্রে একাধিক পথ হতে পারে, তা কোনো সমস্যার নয়। একাধিক মতও হতে পারে। তাও কোনো সমস্যার নয়। প্রয়োজন সততার, সমন্বয়ের, সহযোগিতার, সহনশীলতার তথা সহমর্মিতার। অর্থাত্ সত্যকে সত্য, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতেই হবে।
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ‘এক পা আগে এবং দুই পা পিছে’ ভেবে পিছে হাঁটার মতো চতুরতার যেমন সুযোগ নেই, তেমনই, ‘ভূতের পা গজিয়েছে’ বলারও কোনো উপায় নেই। একাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের উপর্যুপরি সংগ্রামের ইতিহাস। আত্মত্যাগের ইতিহাস। জনগণই যদি ক্ষমতার উত্স হয়, তাহলে এহেন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকে বৃথা হতে দেয়া যায় না। কখনোই না। আর এ কাজটি করতে হবে বর্তমান বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে- যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বয়স এখন চল্লিশ বছরের নিচে- অ্যানালগ-ডিজিটালের মারপ্যাচে না গিয়ে এ কাজটি করতে হবে সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও সততাভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আজ এই হোক আমাদের জন্য একমাত্র আশার বাণী।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন