রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

অন্তর্বর্তীকালীন বৈধ সরকার না নির্দলীয় অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার



 ড. ইশা মোহাম্মদ  
ম হাকালের নির্মম পরিহাস বলে একটা কথা আছে। এক সময় বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল। তিনি সেদিন শিশু এবং পাগলের উদাহরণ দিয়েছিলেন। আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবৈধ বিল অবৈধ সংসদে পাস করিয়েছিলেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরারের অধীনে নির্বাচনও করেছিলেন। সেদিন যেমন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে হাস্যকর ও শিশু কিংবা পাগলের প্রলাপ বলেছিলেন আজকেও তেমনি বলতে পারতেন। কিন্তু তা না বলে সেদিনের আদলেই এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছেন প্রকাশ্য দিবালোকে। মহাকালের কি নির্মম পরিহাস। সেদিন আর এদিন একই দিন নয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে শেষ কথা বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শ বলেও শেষ কথা নেই। তবে এটি কেবলমাত্র গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে। ধনতন্ত্রে নিত্য পরিবর্তনশীলতা বর্তমান। তাই খুব সহজে ধনতন্ত্র মরে না। তার প্রমাণ তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মূলত ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র। তাই এর মধ্যেও নিত্য পরিবর্তনশীলতা আছে। সেই পরিবর্তনশীল চরিত্রের কারণেই হয়ত নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমতের অবতারণা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসংখ্য বিকল্পের একটি। কিন্তু বিভ্রান্তিমূলক। যখন ভুলটা ধরা পড়েছে, তখন তো শোধরাতেই হবে। আওয়ামী লীগ মহাজোট সরকার গঠন করে  ভ্রম সংশোধনীর কাজটা করেছে। একটি অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নিয়মতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা সংবিধান সম্মতভাবে অনুশীলন করার ব্যাপারে সকল সংসদ সদস্যই একমত হয়েছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়েছে।
বারবার বলা হচ্ছে নির্দলীয় সরকার হতে হবে। কেন নির্দলীয় সরকার হবে। অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও রাজনৈতিক হবে। গণতন্ত্রে কোন অরাজনৈতিক শব্দের স্থান নেই। যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অরাজনৈতিক ভাবেন তারা মূলত খালেদা জিয়া কথিত শিশু কিংবা পাগলের দলভুক্ত। কোন গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি নিরপেক্ষ ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে না। থাকা উচিতও নয়। প্রাচীনকালে গণতন্ত্রের সূতিকাগার গ্রীসের গণতন্ত্রের মূল ভাবের আবিষ্কর্তা প্লেটো বলেছিলেন, নাগরিক মাত্রই রাজনীতি করবেন। যিনি রাজনীতি করবেন না তার নাগরিকত্ব থাকবে না। কথাটা তিনি উচ্চাঙ্গের রসিকতা করেই বলেছিলেন হয়ত। তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, সব নাগরিকই রাজনীতি করেন। সবাই কোন না কোনভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। বাস্তাবেও তাই দেখা যায়। প্রত্যেকেরই একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে। কিংবা আছে কোন একটি ধর্মে বিশ্বাস। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিও আছে। তাই কাউকেই আর রাজনীতিহীন বলা যাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছিল তারা কেবলমাত্র রাজনীতি নিরপেক্ষ হবেন তাই নয়, স্বার্থনিরপেক্ষও হবেন। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থের ব্যাপারে স্বার্থহীনতা দেখাবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্যরকম কারবার। এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই অসংখ্য বদলিকাণ্ড ঘটালেন। বললেন, তিনি হোমওয়ার্ক করেই রেখেছিলেন। তার সেই হোমওয়ার্কের ফল কি হয়েছিল তা সবারই জানা আছে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ধর্মাশ্রয়ীদের সাথে সখ্য করে রাষ্ট্র  দখল করেছিল এবং বাংলাদেশে বাংলা ভাইয়ের জন্ম দিয়েছিল। দেশটাকে মৌলবাদী দেশে পরিণত করার চেষ্টা করেছিল। আর একজন উপদেষ্টা ক’দিনের জন্যে ক্ষমতায় গিয়েই একটি মন্ত্রণালয়ের অনেকজনকে বদলি করে বিপুল অংকের অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। অন্য আর একবার একজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা একটি বিশেষ মিটিং-এ বিনা নেমন্তন্যে হাজির হয়েছিলেন এবং জাপানের একটি কোম্পানিকে একটি কাজ দেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই জাপানী কোম্পানি কাজ পেয়ে বাংলাদেশের কি বিশেষ উপকার করেছিল তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। কিন্তু বিশিষ্ট উপদেষ্টা কোন একটি কোম্পানির জন্যে দালালি করেছিল কি স্বার্থে? তা জানা যায়নি। তবে সাধারণ জনগণ ঠিকই সন্দেহ করেছিল। এবং যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেলে দেয়াতে তারা বেজায় খুশি হয়েছে।
দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। যার দেশপ্রেম নেই তার ইমানও নেই। রোজ হাশরের দিনে আল্লাহ তায়ালা বেইমানদের বিচার করবেন এবং নেকি বদির হিসাব করে যার নেকি বেশি তাকে বেহেশতে পাঠাবেন এবং যার বদি বেশি তাকে জাহান্নামে পাঠাবেন। পাপ-পুণ্যের হিসাব করার একতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই এবং কার পুণ্য বেশি তা একমাত্র তিনিই জানবেন। পাপ-পুণ্যের বিচার করে যেমন তিনি জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাবেন কিংবা তাঁর আদেশে ফেরেশতারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে তেমন মানুষের বিচারে এই পৃথিবীতেই ভালো বা খারাপ কাজের জন্যে মানুষেরা বিচার করেই খারাপদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে অনেকটা সেরকম ব্যাপারই ঘটেছে। কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেকি-বদির হিসেব করে জনসাধারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে। সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ক আইন পাস করা হয়েছে গণমানুষের মনোবাঞ্ছা বুঝে, গণমানুষের সাথে অবস্থান নিয়েই। শেখ হাসিনাই নয় কেবল, তাবত্ সাংসদরাই তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আইন পাস করেছেন। ফলে দেশব্যাপী একটা সন্তোষের সুবাতাস বয়ে গেছে। বিরোধীদলীয় কতিপয় নেতা কিংবা পাতিনেতা ছাড়া এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কেউই নেই।
তত্ত্বাবধায়ক, তাও আবার নির্দলীয়, সেই প্রাচীনকালে ভূতের রাজ্যের ‘সোনার পাথর বাটির’ দিন আর কখনই ফিরে আসবে না। সোনার পাথর বাটি যেমন বাস্তবে অসম্ভব, তেমনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারও অসম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা না গেলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা পদ্ধতির প্রবর্তন করা যায়। তবে সেক্ষেত্রেও হুঁশিয়ার থাকতে হবে, যেন কোনক্রমেই অরাজনৈতিক ব্যক্তির হাতে দেশটা চলে না যায়। সেজন্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীও করা যেতে পারে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে সামান্য অপূর্ণতা আছে। যেমন এখানে কোন উপরাষ্ট্রপতি নেই। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একাধিক উপরাষ্ট্রপতির পদ আছে। রাষ্ট্রীয় সংকটে ক্ষেত্রে উপরাষ্ট্রপতির পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়। বাংলাদেশেও কয়েকবার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। কিন্তু কেউই এই বিকল্প পদটির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি।
যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজন হয়, তবে অবশ্যই একজন উপরাষ্ট্রপতিও থাকতে হবে। প্রয়োজন দু’জন উপরাষ্ট্রপতি। একজন উপরাষ্ট্রপতি হবেন রাজনৈতিক। তিনি সরকারের সাথে অঙ্গীভূত হবেন। দ্বিতীয়জন থাকবেন রাষ্ট্রীয়। তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে দায়িত্ব পালন করবেন। যিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হবেন। তবে তাদের গণগ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। অর্থাত্ তাদের সবাইকে কোন না কোন সময় সংসদ সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে শর্ত থাকবে যে, তারা কেউই তাদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। খুবই ভালো হবে যদি বর্তমান সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপদেষ্টা হতে রাজি হন। এই ত্যাগ স্বীকার তারা যদি করেন তবে সংসদের বর্তমান সদস্যদের মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতে উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনরূপ প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু বর্তমান সংসদে অনেক বনেদী রাজনৈতিক দলের কোন সদস্যই নেই। কিন্তু যেহেতু তারা তিরিশ-চল্লিশ বছর কিংবা তারচেয়েও বেশিদিন রাজনীতি করছেন এবং তাদের রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত একটি রাজনৈতিক দল আছে, তাদের মধ্য থেকেও উপদেষ্টা নেয়া যেতে পারে।
তবে যেহেতু তারা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি কিন্তু সাংসদ নন, সেহেতু তারা অবশ্যই সরকারি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তারা উপ-উপদেষ্টা হবেন এবং নির্বাচন সংক্রান্ত মিটিংয়ে মতামত দিতে পারবেন। উপদেষ্টাদের সংখ্যা ১০ জন হতে হবে এমন কোন কথা নেই। অবশ্যই উপদেষ্টা এবং উপ-উপদেষ্টাসহযোগে ২০/২৫ জন হতে হবে। যেভাবেই হোক না কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণপ্রতিনিধিত্বশীল হতে হবে। যেসব রাজনৈতিক দলের ঐতিহ্য আছে, তাদের অপমান করা ঠিক হবে না। আবার কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের জন্যে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখানোও ঠিক হবে না। তবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্যে যদি বিএনপি এবং জামায়াত জেদ ধরে তবে বর্তমান সংবিধানে যেমন আছে তেমনভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনের দিনক্ষণকে এগিয়ে আনতে হবে। নির্বাচনের জন্য দেশকে কোনমতেই অরাজকতার মধ্যে ফেলা বা ফেলতে দেয়া ঠিক হবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই একমাত্র বিকল্প। তবে যদি আমরা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং পরস্পরকে বিশ্বাস করি তাহলে বর্তমানে সংবিধানে যে বিধান আছে তাই উত্তম। এখন সবাইকে শান্ত করার জন্যে বিকল্প খোঁজা হচ্ছে। হয়ত একদিন এমন হবে যে, বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হবে এবং সবাই গণতান্ত্রিক হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান সম্মতভাবেই নির্বাচন করতে দ্বিধা-সংকোচ করবে না। আশা করি সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই সমস্যার গভীরতাটা বুঝতে পারবে এবং প্রস্তাবিত বিষয়ে একমত হয়ে একটা গ্রহণযোগ্য ‘প্রস্তাব’ সংসদে পাস করাবেন এবং নির্বিঘ্নে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
n লেখক: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন