অ জ য় দা শ গু প্ত
দেশপ্রেম আর নির্মোহ স্বদেশ অবলোকন ভিন্ন বিষয়। দ্বিতীয়টির ব্যাপারে জোর না দিলে বা মোহহীন হতে না পারলে দেশপ্রেম আবেগসর্বস্ব ও কার্যত অকেজো এক বায়বীয় ধারণা হয়ে পড়ে। বায়ান্ন থেকে একাত্তরÑ ভাষা, গণসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও আদৌ কেউ কান দেয় না। এ ব্যাপারে মিডিয়ার ভূমিকা যথাযথ বা পজিটিভ বলতে পারলে খুশিই হতাম। কিš‘ আসলে কি তাই? একদা ফেব্র“য়ারি মাসে দেশে থাকার কারণে একুশে নিয়ে অতি জনপ্রিয় মিডিয়ার বলগাহীন আবেগ আর কল্পনার ফানুস ওড়ানো দেখে সত্যিই দুঃখ পেয়েছিলাম। যারা এগুলো করছেন বা করেন, তারা সবই জানেন ও বোঝেন। দুনিয়া চষে বেড়ানো এরাই জাতিকে অন্ধ আবেগে চুবিয়ে রাখতে পছন্দ করেন।
বিশ্বকাঁপানো একুশে ফেব্র“য়ারি বা ওই দিনটিতে সারা দুনিয়া আমাদের স্মরণ করে বা মনে করে থমকে দাঁড়ায়Ñ এ ধরনের প্রচারণা ভাবাবেগের দিক থেকে ঠিক থাকলেও বাস্তবে অসত্য। মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ তার দায় চুকিয়েছে, তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে দিয়েছে বটে; একে ধরে রাখতে হলে এবং দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা দিতে হলে ধনে-মানে, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অন্যতম হয়ে উঠতে হবে। সে চেষ্টা নেই, নেই কোন স্বপ্নও। গত মাতৃভাষা দিবসের সকালে বাংলাদেশের এক সরলপ্রাণ সাংবাদিক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আজ আপনাদের ছুটি, তাই না?’ আমি কিছু বলিনি। তার দেশপ্রেম বা আবেগকে আহত করতে ই”েছ হয়নি। আমি ঠিক তখনই কাজের চাপে বেহাল দশা থেকে সরে গিয়ে গরম চায়ের কাপে চুমুক দি”িছলাম। মনে মনে ভাবলাম, পৃথিবীর বহু দেশে মে দিবসেই যেখানে ছুটি বা বন্ধের রেওয়াজ নেই, সেখানে মাতৃভাষা দিবসের ছুটি!
আসল কথায় ফিরে আসি। ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ কিংবা ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ যেমন কবিতা আর গানেই সত্য, আমাদের দেশপ্রেমের বাস্তবতা তেমনই খোলা চোখে প্রশ্নবিদ্ধ। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছাড়ার পর এশিয়ার বিভিন্ন দেশের এয়ারপোর্টগুলোয় যে ব্যবহার বা তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি ও ট্রিটমেন্ট পেয়েছি, দু’ বছরের মাথায় তার উল্টোযাত্রায় ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যাওয়া অযাচিত ভদ্রতা আর সৌজন্যের ব্যবহারে চমকে উঠেছি বারবার। একটাই তফাৎÑ সেই আমি, সেই বাঙালি চেহারা, চুল-নাক-কান-দাঁত, একই চাকরি একই মানুষ, কিš‘ পৃথিবীর ব্যস্ততম এয়ারপোর্টেও বদলে যাওয়া ব্যবহারের ম্যাজিকটি ছিল ক্যাঙ্গার“-মার্কা পাসপোর্ট। হাতে পড়লেই অপর প্রান্তে বসা অথবা দণ্ডায়মান মানুষটির চেহারায় পরিবর্তন আসতে শুর“ করে। এই একই ব্যক্তি আমার চেয়ে হাজার গুণ মেধাবী, সৎ ও প্রতিষ্ঠিত মানুষকেই হয়তো ই”েছমতো শাসা”েছন অথবা হয়রান করিয়ে ছাড়ছেন; কারণ তার হাতে ধরা সবুজ পাসপোর্ট।
এই বিড়ম্বনা শুধু সবুজের ওপর চাপালেও ভুল হবে। দেশের এয়ারপোর্টে লাল পাসপোর্টের কারণে হম্বিতম্বি করে ছড়ি ঘোরানো কর্তা কিংবা যে কোন আইন বা নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পার হয়ে যাওয়া তথাকথিত ক্ষমতাবানদেরও বেহাল দশা দেখেছি। সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে আমাদের দেশের এক উ”চপদ¯’ আমলাকে যেভাবে অপমান ও অপদ¯’ হতে দেখেছি, তাতে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হওয়ার বিকল্প থাকে না। ফলে লাল বা সবুজ বা কালো যা-ই হোক না কেন, আমাদের পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন কাস্টমস বা অন্য বৈতরণী পারে সহায়ক কিছু নয়। বরং পদে পদে ভোগান্তির কারণ। বলা বাহুল্য, নিরীহ পাসপোর্ট বইটি বা বাহক-বাহিকা এজন্য একটুও দায়ী নন। দায়ী আমাদের রাজনীতি, আমাদের সরকার ও অনুসৃত নীতিমালার আন্তর্জাতিক ফলাফল। আমাদের চেয়ে অনগ্রসর দেশের মানুষকেও সম্মানের সঙ্গে আগমন-নির্গমন করতে দেখেছি। আবার পাকিস্তান বা এ ধরনের কিছু দেশের পাসপোর্টধারীদের অব¯’া সত্যিই কর“ণ। পৃথিবীর যে কোন বিমানবন্দরে পা রাখামাত্রই এদের পেছনে জোঁকের মতো লেগে থাকা সিকিউরিটি অফিসার বা নিয়ম দেখে মনে হয়, তারা এইমাত্র খুন-জখম বা বড় কোন অপরাধ করে এসেছেন।
সে যাই হোক, আমাদের পাসপোর্টের আরেক বড় গলতি হস্তলিপি। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলংকা, মিয়ানমার এমনকি পাকিস্তানেও হাতের লেখার দিন শেষ। একমাত্র নেপাল ও আমরাই আছি আদিম জগতে। হাতের লেখায় অস্পষ্টতা, বানান ভুল থাকে। আমাদের লেখা ইংরেজি অন্যরা পড়তে পারেন না। তাছাড়া কাটাকুটি হলে তো কথাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাসযোগ্যতা, হাতে লেখা পাসপোর্ট দেখলেই বিদেশীরা ভ্র“-কুঁচকে ফেলেন, এমনভাবে তাকান মনে হয়, পাসপোর্টটি এইমাত্র বানানো বা সম্পূর্ণ নকল কিছু। দীর্ঘকাল পর এ ব্যাপারে কাজ হ”েছ খবর পেলাম। সরকারের উপর মহলের পদ¯’রা আসছেন এ দেশে। উপলক্ষ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার উদ্বোধন। উদ্বোধন হোক আর যাই হোক, আমরা আশা করছি ত্র“টিমুক্ত-দুর্নীতিমুক্ত স্ব”ছ প্রক্রিয়ায় মেশিনজাত আধুনিক সবুজ পাসপোর্ট। মনে রাখতে হবে, হস্তাক্ষরের দুর্নীতির চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী মেশিনারি দুর্নীতি। একবার তা ধরা পড়লে বা কোন ত্র“টিবিচ্যুতি প্রকাশ পেলে সবুজ পাসপোর্টের ভোগান্তি ইহজীবনেও শেষ হবে না। তারপরও আশায় বসতি। ধারণা করি, অচিরেই মেশিনজাত পাসপোর্টে আমাদের নিরীহ যাত্রী ও পর্যটক বা অন্যদের ভোগান্তি দূর হবে। যদিও জাতীয় স্তরে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিক হয়ে স্ব”ছ হতে না পারলে কোন পাসপোর্টই জাতে উঠতে পারবে না।
অজয় দাশগুপ্ত : সিডনি প্রবাসী
ফধংমঁঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন