মহিউদ্দিন খান মোহন
‘স্বর্ণলতা’ জিনিসটি আমাদের দেশে কারোরই অপরিচিত নয়। হলদে বর্ণের এ লতাটি গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। এর বিশেষত্ব হলো—এর কোনো পাতা নেই, ফুল হয় না, ফলের তো প্রশ্নই আসে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো—এর শিকড় মাটিতে থাকে না। এটা অন্য গাছের ওপর ভর করে বেঁচে থাকে। সহজে মরে না এ পরজীবী উদ্ভিদটি। একটি ছোট্ট লতা এনে কোনো গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলেই হলো, কয়েকদিনের মধ্যেই ওটা আশ্রয়দাতা গাছের শরীর আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠতে থাকবে। একপর্যায়ে ওটা এমনভাবে ছড়াবে যে, মূল গাছের পাতাই ঢাকা পড়ে যাবে স্বর্ণলতার চাদরের আড়ালে। স্বর্ণলতায় আচ্ছাদিত বৃক্ষ দূর থেকে দেখতে খারাপ লাগে না। এক ধরনের সোনালি সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হতে থাকে সেখান থেকে। তবে ক্ষতিটা হয় আশ্রয়দাতা গাছের। ফলদ বৃক্ষ হলে তাতে তার ফল আসে না, ফুল গাছ হলে ফুল ফোটে না। আর বনজ বৃক্ষের ওপর স্বর্ণলতা আস্তানা গাড়লে ওই বৃক্ষের আর বেড়ে ওঠা হয় না। ‘আগাছার ধর বেশি’ বলে গ্রামাঞ্চলে যে প্রবাদটি চালু আছে স্বর্ণলতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অর্থাত্ আগাছা বেড়ে ওঠে বেশি।
স্বর্ণলতা নিয়ে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো, তাতে সম্মানিত পাঠকবৃন্দ হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে, এই রচনাটির লেখক বোধকরি কোনো উদ্ভিদ বিজ্ঞানী; যিনি স্বর্ণলতার ‘জীবন প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে আমজনতাকে অবহিত করার পাশাপাশি নিজের জ্ঞান-গরিমার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর কসরত্ করছেন। আসলে ব্যাপারটি সেরকম নয়। এই সমাজে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলো সম্পর্কে কথা বলতে গেলে অতি প্রাসঙ্গিকভাবেই উপমা এসে সামনে হাজির হয়। আর সে জন্যই মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করার আগে গৌড়চন্দ্রিকা হিসেবে স্বর্ণলতাকে টেনে আনা হয়েছে।
উদ্ভিদ জগতে যেমন স্বর্ণলতা আছে, মনুষ্য সমাজেও কি সেরকম কিছু নেই? আছে, অবশ্যই আছে। মানুষের মধ্যেও স্বর্ণলতারূপী মানুষ আছে। এরা সমাজে নিজের কোনো অবস্থান না থাকায় বলশালী কারও ‘চামচাগিরি’ করে কল্কে পাওয়ার চেষ্টা করে। কোনো কোনো সময় এরা এমন ভাব প্রদর্শন করে যে, যার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে বেঁচে-বর্তে থাকে, তার চেয়েও স্বর্ণলতার দাপট বেশি দেখা যায়। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক জগতে স্বর্ণলতার কোনো অভাব নেই। এই জগতের দুটি বড় বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরে এসব স্বর্ণলতা বেঁচে-বর্তে থাকার চেষ্টা করে, কিছু একটা করে-টরে খাওয়ার মওকা পায়। এতে অবশ্য আপত্তির তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ ডোবা, নালা, নর্দমা কিংবা বনের ধারের জঙ্গলে যেভাবেই ভূমি ফুঁড়ে মাথা জাগিয়ে থাকুক, ওদের তো টিকে থাকতে হবে। আর বড় বৃক্ষরা যেহেতু অনেক ডালপালাসমৃদ্ধ, সেহেতু দু’দশটা শিকড়বিহীন লতাপাতা তাতে জড়িয়ে ঝুলতে থাকলে আপত্তি থাকবে কেন? বরং ‘আমার ডালে অতগুলো স্বর্ণলতা ঝুলছে’ বলে গর্ব করার একটা সুযোগ তারা পেয়ে যায়। আত্মম্ভরিতায় আচ্ছন্ন ‘বড় বৃক্ষরা’ তখন হিসাব কষতে ভুলে যায় যে, ডালে ঝুলতে থাকা শিকড়বিহীন লতাগুলো তার জন্য সম্পদ না দায়।
আগেই বলেছি, বড় গাছে লতা ঝুলতে থাকলে কারোরই কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কেননা, যার কাঁধে ভর করে আছে শিকড়বিহীন স্বর্ণলতা সে যদি আপত্তি না করে, তাহলে অন্যদের আপত্তি থাকবে কেন? আর তা নিয়ে কথাই বা উঠবে কেন? কিন্তু কারণ ছাড়া যেমন কর্ম হয় না, তেমনি কথা ওঠার মতো ঘটনা না ঘটলে কথাও ওঠে না। স্বর্ণলতা যদি নিজেকে মহীরুহ জ্ঞান করে কোনো সুবিশাল বৃক্ষকে উপড়ে ফেলার হুমকি দেয়, তখন কি কথা না বলে থাকা যায়?
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে একটি রাজনৈতিক দল জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রতিবেশী দেশটির একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ‘তা দেয়া ডিম’ থেকে দলটি ফুটে বেরিয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা, সীমাহীন লুটপাট, বিরোধী দলের প্রতি জুলুম-নির্যাতনে দেশবাসী যখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, তখনই ১৯৭২ সালের অক্টোবরে দলটি আত্মপ্রকাশ করে। মুজিব সরকারের বিরোধী হিসেবে দলটি নিজেকে প্রচার করলেও এর জন্মদাতাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মুজিব সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে সে সময় জনমনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুন যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেজন্য প্রতিবেশী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা জাসদের জন্ম দিয়েছিল। অর্থাত্ মুজিব সরকারের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই জাসদকে মাঠে নামানো হয়েছিল। কিন্তু ’৭৫-এ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আকস্মিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বিদেশি সেই সংস্থার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত হতে দেয়নি।
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামের এক ধরনের মুখরোচক স্লোগান দিয়ে তত্কালীন বাংলাদেশের যুব সমাজকে আকৃষ্ট করেছিল দলটি। নিজেদের ‘বামপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মদদে জন্ম নেয়ার ফলে দলটি বিশুদ্ধ বামপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এই দলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলাদেশের একজন বহু বিতর্কিত ব্যক্তির সম্পৃক্তি ছিল; যিনি দাদাভাই হিসেবে সমধিক পরিচিত। কেউ কেউ তাকে বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষও বলে থাকেন। রহস্যময় রাজনৈতিক দল জাসদের একটি গোপন শাখা বানানো হয়েছিল গণবাহিনী নামে। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য ওই কথিত গণবাহিনী সশস্ত্র বিপ্লব করবে এমন ধারণা প্রচার করা হয়েছিল। সমাজ বদলে আগ্রহী বহুসংখ্যক ছাত্র, যুবক অন্তর্নিহিত রাজনীতির রহস্য সম্পর্কে না জেনেই যোগ দিয়েছিল সেই গণবাহিনীতে। ফলে মুজিব সরকারের রক্ষী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল প্রায় ৩৭ হাজার তরুণ-যুবককে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুজিব সরকারকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিবাদী যুবশক্তিকে ধ্বংস করার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই জাসদের গণবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থটি একদিকে জাসদ-গণবাহিনী বানিয়েছিল, অন্যদিকে মুজিব সরকারকে তৈরি করে দিয়েছিল দানবীয় রক্ষীবাহিনী। ওই শক্তিটির চাণক্য পরিকল্পনার সর্বনাশা ফাঁদে পা দিয়ে এদেশের যুবসমাজের একটি বড় অংশ অকালে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। কালক্রমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ’৭২-এ প্রতিষ্ঠিত জাসদ এবং তাদের বাই-প্রোডাক্ট গণবাহিনী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এটা যে বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল সেটাও সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভিন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনায় গঠিত এই দলটি শিকড়বিহীন স্বর্ণলতারই প্রতিবিম্ব যেন।
জাসদের গোপন সংগঠন গণবাহিনী গঠনের পেছনে যারা জড়িত ছিল তাদের একজন হাসানুল হক ইনু। বর্তমানে বহুধাবিভক্ত জাসদের একটি ক্ষুদ্র অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের বদান্যে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য। রাজনৈতিক বিচারে তার আকৃতি মূষিক সমতুল্য হলেও পর্বত উপড়ে ফেলার হুমকি দিতে পিছ পা হন না। সম্প্রতি তিনি এই বলে হুমকি দিয়েছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া যদি ‘যুদ্ধাপরাধী’দের পরিত্যাগ না করেন তাহলে তাকে এদেশের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করবেন ইনু সাহেব। তিনি এও বলেছেন যে, এবার আর মাইনাস টু নয়, হবে মাইনাস ওয়ান—আর সেই মাইনাস হবেন খালেদা জিয়া।
গত ২৬ মে’র পত্রিকাগুলোতে হাসানুল হক ইনুর ওই হুমকির খবরে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। পরদিন পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ‘ফেসবুকে’ এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। ইনুর ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক কর্মী ও সচেতন ব্যক্তিরা নানা মন্তব্য করেছেন সেখানে। ফেসবুকে দেখলাম তিনি নানা ধরনের গালির শিকার হয়েছেন। ওইসব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার খবর ইনু সাহেব পেয়েছেন কি-না আমার জানা নেই। ওগুলো যদি তার নজরে পড়ে থাকে তাহলে হয়তো তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, কোথায় তিনি আঘাত করেছেন, আর তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে কী ভয়ঙ্কর!
‘মাইনাস’ শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অধুনা সংযুক্ত একটি বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত শব্দ। ২০০৭ সালে জাতির কাঁধে চেপে বসা অসাংবিধানিক জরুরি সরকারের আমলে এর প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শীর্ষ দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ফেলার যে চক্রান্ত তখন হয়েছিল, যার সঙ্গে বর্তমানেও রাজনীতিতে সক্রিয় অনেকে জড়িত ছিলেন, সে চক্রান্তই ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। বহু ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সত্ত্বেও সেই মাইনাস টু ফর্মুলা সফল হয়নি। কেন হয়নি, কারা তা ব্যর্থ করে দিয়েছে তা দেশবাসীর অজানা নয়। এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সে আলোচনায় প্রবেশ করছি না।
বিদেশি শক্তির মদদ ও পরিকল্পনায় সৃষ্ট জাসদ কখনোই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূমিতে শিকড় ছড়াতে পারেনি। আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য সঠিক না থাকায় অর্থাত্ ইতিবাচক রাজনীতির কোনো পরিকল্পনা না থাকায় দলটি অপাঙেক্তয় রয়ে গেছে। সময়ে সময়ে নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কারণে বিভক্ত হয়েছে। জাসদ ভেঙে হয়েছে বাসদ। আবার বিভক্ত জাসদ-বাসদও কয়েক টুকরা হয়েছে। এমনকি ‘পরকীয়া’ প্রেমের কারণেও এ দলটির একটি অংশ বিভক্ত হওয়ার নজির রয়েছে। বিগত চল্লিশ বছর ধরে দলটির ভগ্নাংশগুলো ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করেই টিকে আছে। আলোচ্য হাসানুল হক ইনু একাধিক নির্বাচনে তার দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু জামানত বাঁচাতে পারেননি কোনোবারই। ২০০৮ সালের মইন-ফখরুদ্দীন-হুদার ম্যাজিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের অধিবেশন কক্ষে পা রাখার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের নৌকা আর জরুরি সরকারের জাদুর কাঠির স্পর্শ না পেলে হাসানুল হক ইনুর পক্ষে কোনোদিনই যে ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’ পরিচিতি অর্জন সম্ভব হতো না, এ কথা গ্যারান্টি সহকারেই বলা যায়।
অতিপ্রাপ্তি মানুষের মাথা অনেক সময় খারাপ করে দেয়। তাছাড়া যার বা যাদের বদান্যে সে প্রাপ্তি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কিছু লাগাম ছাড়া কথাবার্তা— তাদের পক্ষে বলাটা কারও কারও কাছে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে হয়। হাসানুল হক ইনু বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে যে কথা বলেছেন তা যে তার প্রভুভক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর নিমিত্তেই করেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ইনুর হালের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ইদানীং যে ধরনের ভাষায় বেগম খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তাতে তার চামচা-ট্যাণ্ডলরা আরও ক’ধাপ এগিয়ে গিয়ে আবোল-তাবোল বকবে, তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। বোধকরি এদের মতো লোককে চিহ্নিত করেই কবিগুরু তার দুই বিঘা ‘জমি’ কবিতায় সে বিখ্যাত চরণ লিখেছিলেন—‘রাজা যত বলে/পারিষদ দলে/বলে তার শতগুণ।’
তো রাজা এবং পারিষদরা যা-খুশি তা-ই বলতে পারেন, হুমকি-ধামকি দিতে পারেন। মুখ যখন আছে, কথা বলবেন, অসুবিধা কী! তবে সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা হলো—অন্ধকারে ভয় পেলে মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলে, গান গায়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের শরিকরা ভবিষ্যত্ অন্ধকার এটা উপলব্ধি করতে পারছেন এটা ঠিক। আর সে জন্যই প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকির মাধ্যমে ভড়কে দিয়ে নিরাপদ প্রস্থানের মওকা তৈরির কষ্টকর প্রচেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়েছেন। অবশ্য তাদের এ প্রচেষ্টা যে বিফলে যাবে তার আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাসানুল হক ইনু বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটি সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ইনু সাহেব যখন ওইসব কথা বলেছেন তখন তিনি হয়তো বেহুঁশ ছিলেন। জনাব খানের কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তবে মানুষ বেহুঁশ হয় দু’ভাবে। এক. মানসিক আঘাত পেয়ে স্বাভাবিক জ্ঞান হারালে, দুই. বিশেষ কোনো পানীয় পান করলে। ইনু সাহেব কোন কারণে বেহুঁশ ছিলেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে হুঁশে বলুন আর বেহুঁশে বলুন, হাসানুল হক ইনু খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার খায়েশ ব্যক্ত করে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। কথাটা বলার সময় তিনি হয়তো তার আর বেগম জিয়ার মধ্যে বিরাজমান ব্যবধানের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। নইলে বেগম খালেদা জিয়ার দলের তৃতীয় সারির একজন কর্মীর সমতুল্য ইনু অমন মন্তব্য করতে পারতেন না।
রচনার শুরুতে স্বর্ণলতার কথা বলেছিলাম। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে স্বর্ণলতার অভাব নেই। এদের নিজেদের কিছু করার ক্ষমতা নেই, অন্যের কাঁধে চড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি হম্বিতম্বি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এরা সদা সচেষ্ট থাকে। এদেরই সার্থক প্রতিনিধি হাসানুল হক ইনু। রাজনীতির এসব পরগাছার সর্বশেষ পরিণতি যে শুভ হবে না তা হিসাব না করেও বলা যায়। আঁকড়ে ধরা গাছটি যখন ভূপাতিত হবে, তখন পরগাছারও অস্তিত্ব থাকবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
mohon91@yahoo.com
স্বর্ণলতা নিয়ে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো, তাতে সম্মানিত পাঠকবৃন্দ হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে, এই রচনাটির লেখক বোধকরি কোনো উদ্ভিদ বিজ্ঞানী; যিনি স্বর্ণলতার ‘জীবন প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে আমজনতাকে অবহিত করার পাশাপাশি নিজের জ্ঞান-গরিমার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর কসরত্ করছেন। আসলে ব্যাপারটি সেরকম নয়। এই সমাজে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যেগুলো সম্পর্কে কথা বলতে গেলে অতি প্রাসঙ্গিকভাবেই উপমা এসে সামনে হাজির হয়। আর সে জন্যই মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করার আগে গৌড়চন্দ্রিকা হিসেবে স্বর্ণলতাকে টেনে আনা হয়েছে।
উদ্ভিদ জগতে যেমন স্বর্ণলতা আছে, মনুষ্য সমাজেও কি সেরকম কিছু নেই? আছে, অবশ্যই আছে। মানুষের মধ্যেও স্বর্ণলতারূপী মানুষ আছে। এরা সমাজে নিজের কোনো অবস্থান না থাকায় বলশালী কারও ‘চামচাগিরি’ করে কল্কে পাওয়ার চেষ্টা করে। কোনো কোনো সময় এরা এমন ভাব প্রদর্শন করে যে, যার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে বেঁচে-বর্তে থাকে, তার চেয়েও স্বর্ণলতার দাপট বেশি দেখা যায়। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক জগতে স্বর্ণলতার কোনো অভাব নেই। এই জগতের দুটি বড় বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরে এসব স্বর্ণলতা বেঁচে-বর্তে থাকার চেষ্টা করে, কিছু একটা করে-টরে খাওয়ার মওকা পায়। এতে অবশ্য আপত্তির তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ ডোবা, নালা, নর্দমা কিংবা বনের ধারের জঙ্গলে যেভাবেই ভূমি ফুঁড়ে মাথা জাগিয়ে থাকুক, ওদের তো টিকে থাকতে হবে। আর বড় বৃক্ষরা যেহেতু অনেক ডালপালাসমৃদ্ধ, সেহেতু দু’দশটা শিকড়বিহীন লতাপাতা তাতে জড়িয়ে ঝুলতে থাকলে আপত্তি থাকবে কেন? বরং ‘আমার ডালে অতগুলো স্বর্ণলতা ঝুলছে’ বলে গর্ব করার একটা সুযোগ তারা পেয়ে যায়। আত্মম্ভরিতায় আচ্ছন্ন ‘বড় বৃক্ষরা’ তখন হিসাব কষতে ভুলে যায় যে, ডালে ঝুলতে থাকা শিকড়বিহীন লতাগুলো তার জন্য সম্পদ না দায়।
আগেই বলেছি, বড় গাছে লতা ঝুলতে থাকলে কারোরই কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কেননা, যার কাঁধে ভর করে আছে শিকড়বিহীন স্বর্ণলতা সে যদি আপত্তি না করে, তাহলে অন্যদের আপত্তি থাকবে কেন? আর তা নিয়ে কথাই বা উঠবে কেন? কিন্তু কারণ ছাড়া যেমন কর্ম হয় না, তেমনি কথা ওঠার মতো ঘটনা না ঘটলে কথাও ওঠে না। স্বর্ণলতা যদি নিজেকে মহীরুহ জ্ঞান করে কোনো সুবিশাল বৃক্ষকে উপড়ে ফেলার হুমকি দেয়, তখন কি কথা না বলে থাকা যায়?
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে একটি রাজনৈতিক দল জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রতিবেশী দেশটির একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ‘তা দেয়া ডিম’ থেকে দলটি ফুটে বেরিয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা, সীমাহীন লুটপাট, বিরোধী দলের প্রতি জুলুম-নির্যাতনে দেশবাসী যখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, তখনই ১৯৭২ সালের অক্টোবরে দলটি আত্মপ্রকাশ করে। মুজিব সরকারের বিরোধী হিসেবে দলটি নিজেকে প্রচার করলেও এর জন্মদাতাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মুজিব সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে সে সময় জনমনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুন যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেজন্য প্রতিবেশী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা জাসদের জন্ম দিয়েছিল। অর্থাত্ মুজিব সরকারের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই জাসদকে মাঠে নামানো হয়েছিল। কিন্তু ’৭৫-এ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আকস্মিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বিদেশি সেই সংস্থার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত হতে দেয়নি।
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামের এক ধরনের মুখরোচক স্লোগান দিয়ে তত্কালীন বাংলাদেশের যুব সমাজকে আকৃষ্ট করেছিল দলটি। নিজেদের ‘বামপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মদদে জন্ম নেয়ার ফলে দলটি বিশুদ্ধ বামপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এই দলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলাদেশের একজন বহু বিতর্কিত ব্যক্তির সম্পৃক্তি ছিল; যিনি দাদাভাই হিসেবে সমধিক পরিচিত। কেউ কেউ তাকে বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষও বলে থাকেন। রহস্যময় রাজনৈতিক দল জাসদের একটি গোপন শাখা বানানো হয়েছিল গণবাহিনী নামে। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য ওই কথিত গণবাহিনী সশস্ত্র বিপ্লব করবে এমন ধারণা প্রচার করা হয়েছিল। সমাজ বদলে আগ্রহী বহুসংখ্যক ছাত্র, যুবক অন্তর্নিহিত রাজনীতির রহস্য সম্পর্কে না জেনেই যোগ দিয়েছিল সেই গণবাহিনীতে। ফলে মুজিব সরকারের রক্ষী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল প্রায় ৩৭ হাজার তরুণ-যুবককে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুজিব সরকারকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে দেশের প্রতিবাদী যুবশক্তিকে ধ্বংস করার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই জাসদের গণবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থটি একদিকে জাসদ-গণবাহিনী বানিয়েছিল, অন্যদিকে মুজিব সরকারকে তৈরি করে দিয়েছিল দানবীয় রক্ষীবাহিনী। ওই শক্তিটির চাণক্য পরিকল্পনার সর্বনাশা ফাঁদে পা দিয়ে এদেশের যুবসমাজের একটি বড় অংশ অকালে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। কালক্রমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ’৭২-এ প্রতিষ্ঠিত জাসদ এবং তাদের বাই-প্রোডাক্ট গণবাহিনী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এটা যে বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল সেটাও সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভিন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনায় গঠিত এই দলটি শিকড়বিহীন স্বর্ণলতারই প্রতিবিম্ব যেন।
জাসদের গোপন সংগঠন গণবাহিনী গঠনের পেছনে যারা জড়িত ছিল তাদের একজন হাসানুল হক ইনু। বর্তমানে বহুধাবিভক্ত জাসদের একটি ক্ষুদ্র অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের বদান্যে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য। রাজনৈতিক বিচারে তার আকৃতি মূষিক সমতুল্য হলেও পর্বত উপড়ে ফেলার হুমকি দিতে পিছ পা হন না। সম্প্রতি তিনি এই বলে হুমকি দিয়েছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া যদি ‘যুদ্ধাপরাধী’দের পরিত্যাগ না করেন তাহলে তাকে এদেশের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করবেন ইনু সাহেব। তিনি এও বলেছেন যে, এবার আর মাইনাস টু নয়, হবে মাইনাস ওয়ান—আর সেই মাইনাস হবেন খালেদা জিয়া।
গত ২৬ মে’র পত্রিকাগুলোতে হাসানুল হক ইনুর ওই হুমকির খবরে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। পরদিন পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ‘ফেসবুকে’ এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। ইনুর ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক কর্মী ও সচেতন ব্যক্তিরা নানা মন্তব্য করেছেন সেখানে। ফেসবুকে দেখলাম তিনি নানা ধরনের গালির শিকার হয়েছেন। ওইসব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার খবর ইনু সাহেব পেয়েছেন কি-না আমার জানা নেই। ওগুলো যদি তার নজরে পড়ে থাকে তাহলে হয়তো তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, কোথায় তিনি আঘাত করেছেন, আর তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে কী ভয়ঙ্কর!
‘মাইনাস’ শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অধুনা সংযুক্ত একটি বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত শব্দ। ২০০৭ সালে জাতির কাঁধে চেপে বসা অসাংবিধানিক জরুরি সরকারের আমলে এর প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শীর্ষ দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ফেলার যে চক্রান্ত তখন হয়েছিল, যার সঙ্গে বর্তমানেও রাজনীতিতে সক্রিয় অনেকে জড়িত ছিলেন, সে চক্রান্তই ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। বহু ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সত্ত্বেও সেই মাইনাস টু ফর্মুলা সফল হয়নি। কেন হয়নি, কারা তা ব্যর্থ করে দিয়েছে তা দেশবাসীর অজানা নয়। এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সে আলোচনায় প্রবেশ করছি না।
বিদেশি শক্তির মদদ ও পরিকল্পনায় সৃষ্ট জাসদ কখনোই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূমিতে শিকড় ছড়াতে পারেনি। আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য সঠিক না থাকায় অর্থাত্ ইতিবাচক রাজনীতির কোনো পরিকল্পনা না থাকায় দলটি অপাঙেক্তয় রয়ে গেছে। সময়ে সময়ে নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কারণে বিভক্ত হয়েছে। জাসদ ভেঙে হয়েছে বাসদ। আবার বিভক্ত জাসদ-বাসদও কয়েক টুকরা হয়েছে। এমনকি ‘পরকীয়া’ প্রেমের কারণেও এ দলটির একটি অংশ বিভক্ত হওয়ার নজির রয়েছে। বিগত চল্লিশ বছর ধরে দলটির ভগ্নাংশগুলো ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করেই টিকে আছে। আলোচ্য হাসানুল হক ইনু একাধিক নির্বাচনে তার দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু জামানত বাঁচাতে পারেননি কোনোবারই। ২০০৮ সালের মইন-ফখরুদ্দীন-হুদার ম্যাজিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের অধিবেশন কক্ষে পা রাখার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের নৌকা আর জরুরি সরকারের জাদুর কাঠির স্পর্শ না পেলে হাসানুল হক ইনুর পক্ষে কোনোদিনই যে ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’ পরিচিতি অর্জন সম্ভব হতো না, এ কথা গ্যারান্টি সহকারেই বলা যায়।
অতিপ্রাপ্তি মানুষের মাথা অনেক সময় খারাপ করে দেয়। তাছাড়া যার বা যাদের বদান্যে সে প্রাপ্তি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কিছু লাগাম ছাড়া কথাবার্তা— তাদের পক্ষে বলাটা কারও কারও কাছে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে হয়। হাসানুল হক ইনু বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে যে কথা বলেছেন তা যে তার প্রভুভক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর নিমিত্তেই করেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ইনুর হালের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ইদানীং যে ধরনের ভাষায় বেগম খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তাতে তার চামচা-ট্যাণ্ডলরা আরও ক’ধাপ এগিয়ে গিয়ে আবোল-তাবোল বকবে, তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। বোধকরি এদের মতো লোককে চিহ্নিত করেই কবিগুরু তার দুই বিঘা ‘জমি’ কবিতায় সে বিখ্যাত চরণ লিখেছিলেন—‘রাজা যত বলে/পারিষদ দলে/বলে তার শতগুণ।’
তো রাজা এবং পারিষদরা যা-খুশি তা-ই বলতে পারেন, হুমকি-ধামকি দিতে পারেন। মুখ যখন আছে, কথা বলবেন, অসুবিধা কী! তবে সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা হলো—অন্ধকারে ভয় পেলে মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলে, গান গায়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের শরিকরা ভবিষ্যত্ অন্ধকার এটা উপলব্ধি করতে পারছেন এটা ঠিক। আর সে জন্যই প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকির মাধ্যমে ভড়কে দিয়ে নিরাপদ প্রস্থানের মওকা তৈরির কষ্টকর প্রচেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়েছেন। অবশ্য তাদের এ প্রচেষ্টা যে বিফলে যাবে তার আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাসানুল হক ইনু বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটি সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ইনু সাহেব যখন ওইসব কথা বলেছেন তখন তিনি হয়তো বেহুঁশ ছিলেন। জনাব খানের কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তবে মানুষ বেহুঁশ হয় দু’ভাবে। এক. মানসিক আঘাত পেয়ে স্বাভাবিক জ্ঞান হারালে, দুই. বিশেষ কোনো পানীয় পান করলে। ইনু সাহেব কোন কারণে বেহুঁশ ছিলেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে হুঁশে বলুন আর বেহুঁশে বলুন, হাসানুল হক ইনু খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার খায়েশ ব্যক্ত করে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। কথাটা বলার সময় তিনি হয়তো তার আর বেগম জিয়ার মধ্যে বিরাজমান ব্যবধানের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। নইলে বেগম খালেদা জিয়ার দলের তৃতীয় সারির একজন কর্মীর সমতুল্য ইনু অমন মন্তব্য করতে পারতেন না।
রচনার শুরুতে স্বর্ণলতার কথা বলেছিলাম। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে স্বর্ণলতার অভাব নেই। এদের নিজেদের কিছু করার ক্ষমতা নেই, অন্যের কাঁধে চড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি হম্বিতম্বি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এরা সদা সচেষ্ট থাকে। এদেরই সার্থক প্রতিনিধি হাসানুল হক ইনু। রাজনীতির এসব পরগাছার সর্বশেষ পরিণতি যে শুভ হবে না তা হিসাব না করেও বলা যায়। আঁকড়ে ধরা গাছটি যখন ভূপাতিত হবে, তখন পরগাছারও অস্তিত্ব থাকবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
mohon91@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন