প লা শ কু মা র রা য়
আদালতপাড়ায় আইন জানাশোনা ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় আইনজীবী ও নেতার দাপট আর প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে সত্যি সত্যিই পৃথক হয়েছে কি না! গ্রেফতার অভিযুক্তদের জামিন, মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখ নির্ধারণ, কিছু মামলায় অযাচিত তদবির থেকে শুর“ করে হেন কাজ নেই, যা সরকার সমর্থিত আইনজীবীরা আদালতপাড়ায় করেন না। অবশ্য এ ধরনের নিয়ম-নীতিবির“দ্ধ কার্যকলাপ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই দৃশ্যমান নয়। বরং বিগত প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলেই আদালতপাড়া বিভিন্নভাবে ‘কলুষিত’ হওয়ার ঘটনা জনমনে নানা ধরনের শংকা তৈরি করেছে এবং করছে। আদালতপাড়ায় একদিকে সরকার সমর্থিত আইনজীবীদের নগ্ন হস্তক্ষেপ, অপরদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে দলীয় নেতাকর্মীদের মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় প্রত্যাহারসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সরকার বেশ সমালোচিত হ”েছ। সরকার সমর্থিত নেতাকর্মীদের মামলা যেভাবে প্রত্যাহার করা হ”েছ, এসব দেখে মনে হবে মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত গঠিত কমিটি সরকার সৃষ্ট একটি ‘দলীয় আদালত’।
মহাজোট সরকার এসে এক মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্র“য়ারি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার কমিটি গঠন করা হয়। ২২ ফেব্র“য়ারি আইন প্রতিমন্ত্রীকে সভাপতি এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সহসভাপতি করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর প্রথম দফায় ভুক্তভোগীদের আবেদন করার জন্য সাত মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার সমর্থিত দলীয় নেতাকর্মীদের নামে রাজনৈতিক বা অন্য কোনভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে ফৌজদারি মামলা করা হলে, তা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। কমিটির আহ্বানে সারা দেশের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরা হাজার হাজার আবেদন জমা দিলে জেলা কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে ১১ হাজার আবেদন জমা দেয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি ২৯টি বৈঠক করে দণ্ডবিধির আইনে ৬ হাজার ৭৮৫টি এবং দুদক আইনে ৩১৫টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের আদেশ দেয়। এর ফলে কম-বেশি ৮১ হাজার অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেয়েছেন বা খালাসের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। বর্তমানে কমিটির কাছে বিবেচনার জন্য ৭ শতাধিক আবেদন রয়েছে। এর মধ্যে একবার নাকচ হয়ে যাওয়ার পরও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে দ্বিতীয় দফায় কিছু আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে ৩১৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। কিš‘ ১৯৫৮ সালের সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১০(৪) ধারা অনুযায়ী দুদকের করা মামলা শুধু দুদকই প্রত্যাহার করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সুপারিশে দুদক কোন ব্যব¯’া নেয়নি। এ প্রসঙ্গে দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, যেসব মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহার করা ঠিক হবে না বলে দুদক মনে করে। তা ছাড়া ব্যক্তিবিশেষের পদমর্যাদা বিবেচনা করে কোন মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশও দুদক করবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, সরকারের সুপারিশকৃত ৫০ শতাংশ মামলাই বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলের। আর এক-তৃতীয়াংশ মামলার কার্যক্রমের ওপর উ”চ আদালতের ¯’গিতাদেশ রয়েছে।
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় জোড়া খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, রাহাজানি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে এসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বর্তমান সরকারের সময়ে বহুল আলোচিত কয়েকটি মামলা প্রত্যাহার করে সরকার বহু দুর্নাম কুড়িয়েছে।
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করতে দ্বিতীয় ধাপে কাজ শুর“ হয়েছে। প্রথম ধাপে ৬ হাজার ৭৮৫টি মামলা প্রত্যাহারের পর এবার প্রত্যাহারের সুপারিশ করছে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসর“র নেতৃতাধীন ‘রাজনৈতিক কমিটি’। এর আগে খুন-ডাকাতি-ধর্ষণ ও জোড়া খুনের মামলা প্রত্যাহারে আইন প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটির কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সাবেক আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ‘রাজনৈতিক কমিটি’ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক কমিটিও খুন, হত্যা, অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের পাঁচ শতাধিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। জাতীয় কমিটির এসব সুপারিশ যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে মামলার নথির বিষয়ে জানতে চেয়ে এ মাসের ১০ তারিখে ৩৪ জেলার জেলা প্রশাসককে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি দেয়। হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীন জেলা কমিটির কাছে আবেদনের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার প্রায় দুই বছর পর ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাঁচ শতাধিক মামলা প্রত্যাহারের নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জাতীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয় গত বছরের ২০ ডিসেম্বর। জাতীয় কমিটির ২৯তম ওই বৈঠকে ৩২০টির মতো মামলা প্রত্যাহারের জন্য উপ¯’াপন করা হলে ৬৮টি প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে ৫ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি থেকে আংশিক আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন অভিযুক্ত খালাস পান। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, সরকারের সুপারিশ করা যে কোন মামলা প্রত্যাহারের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা যায়। তবে ব্যক্তির করা কোন মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের এখতিয়ার সরকারের নেই।
প্রত্যাহার করার বিধান আছে বলে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক হয়রানির অজুহাত দেখিয়ে বিচারাধীন মামলার দায় থেকে চিরতরে মুক্তি পাবেন, সেটা হতে পারে না। ক্ষমতার মসনদে যে দলই থাকুক, খুন, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগের মতো গুর“তর অপরাধে অভিযুক্তদের (পুলিশ যখন ওই সব অভিযুক্তের বির“দ্ধে চার্জশিট দেয় তখন প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়া হয় বাদীর অভিযোগ কিছুটা হলেও সত্য প্রমাণিত হল) বির“দ্ধে আনীত মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিলে অপরাধীরা ভবিষ্যতে আরও অপরাধ সংঘটিত করার সাহস পাবে, যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধ করেও মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের আলোকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে জাতীয় এবং জেলা কমিটি গঠন করতে আইনি নিয়মনীতি অনুসরণ করা হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে যখন পাঁচ শতাধিক মামলা প্রত্যাহারসংবলিত সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় এবং মন্ত্রণালয় ওই সুপারিশের ভিত্তিতে মামলা প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিকতা শুর“ করে, তখন এসব বেআইনি কার্যকলাপ ও আইন পরিপš’ী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আমাদের অবশ্যই সো”চার হতে হবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে বিএনপি তাদের পছন্দসই লোকদের মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাহার করে নেবে, আর গরিব অসহায় মানুষের মামলা যুগের পর যুগ বিচারাধীন থেকেও বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার পাবেন না, তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এসব অনিয়ম ও অব্যব¯’াপনার বির“দ্ধে আমাদের অবশ্যই প্রতিবাদী হতে হবে। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে উপ¯ি’ত থেকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক হিসেবে কমিটির সভাপতি আইন প্রতিমন্ত্রী, সহসভাপতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ ১২ জন সম্মানীও নিয়েছেন। প্রতিটি সভায় অংশ নেয়ার জন্য সভাপতি ও সহসভাপতি ২ হাজার টাকা এবং অন্য সদস্যরা প্রতি বছর পাবেন এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে বৈঠকের জন্য ওই কমিটির সভাপতি, সহসভাপতি এবং সংশ্লিষ্ট সদস্যদের জন্য ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯০ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষে আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বরাবরই বলে আসছেন, তারা বিচার বিভাগকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাধীনতা দিয়েছেন। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত বা বিচারিক কাজে বিঘœ ঘটেÑ এমন কোন কাজ সরকার করছে না। মন্ত্রীদ্বয়ের কাছে প্রশ্ন, অবাধে দলীয় নেতাকর্মীদের নামে এবং মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসীদেরও ‘দলীয় নেতা’র সার্টিফিকেট দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার সংস্কৃতি কি মন্ত্রীবাহাদুরদের উপরোল্লিখিত গালগল্পসুলভ বক্তব্যকে সমর্থন করে?
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী
ঢ়ধষধংযৎড়ু২০১২@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন