শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

আগুন : জার্মান রাইখস্ট্যাগে এবং ঢাকার বাসে : নেপথ্যে কারা?


 আসিফ আরসালান

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ৩৪ জন নেতাকে কারাগারে প্রেরণের ঘটনাকে কেউ যদি হালকাভাবে দেখেন তাহলে তিনি মারাত্মক ভুল করবেন। গত কয়েকদিন ধরে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব ‘টক শো' হচ্ছে সেসব টকশোর কোনো কোনো আলোচক ব্যাপারটাকে এভাবে হালকা করতে চাচ্ছেন যে, নিম্ন আদালত তাদেরকে জামিন দেয়নি বলে তাদেরকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এরপর তারা জামিনের জন্য জেলা দায়রা জজের কাছে আবেদন করবেন। সেখান থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসবেন। দায়রা জজও যদি জামিন না দেন তাহলে তারা হাইকোর্টে যাবেন। সেখান থেকে জামিন নিয়ে আসবেন। হাইকোর্টও যদি জামিন না দেয় তাহলে আপিল বিভাগে যাবেন। সেখান থেকে জামিন নিয়ে আসবেন। এসব কাজ বলা যত সোজা, করা তত সোজা নয়। প্রথম কথা হলো, এই ৪৫ জন নেতার বিরুদ্ধে এমন একটি মামলা দায়ের করা হলো কেন? ইতিমধ্যেই দেখা গেছে যে, একমাত্র আওয়ামী লীগের লোকজন ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে বাস পোড়ানোর অভিযোগ মোটেই গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তারপর সেই মামলাটি আবার দেয়া হয়েছে দ্রুত বিচার আইনের অধীনে। এটি এমন একটি আইন যেটির বিচার সম্পন্ন করতে হবে মামলা শুরুর দিন থেকে ১ মাসের মধ্যে অথবা ২ মাসের মধ্যে। যারা আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন তাদের বিচার শেষ করতে হবে এক মাসের মধ্যে। যারা আত্মসমর্পণ করবেন না তাদের বিচার শেষ করতে হবে দুইমাসের মধ্যে। এই মামলায় এই মুহূর্তে ৪৫ জনের মধ্যে একজন জামিনে মুক্ত আছেন। তিনি হলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মাহবুবউদ্দীন খোকন। ৮ জনকে আগে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ৩ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। আর ৩৩ জন সেদিন কারাগারে গেলেন। এই নিয়ে মোট ৪৫ জন। আমি একটু আগে উল্লেখ করেছে যে, দ্রুত বিচার আইনে এই মামলাটি দেয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো এই যে, মামলাটি দায়ের করার পর অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে অর্থাৎ মাত্র ৯ দিনের মধ্যে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। এই ধরনের মামলায় যেখানে চার্জশিট দাখিল করতে মাসের পর মাস লেগে যায়, সেখানে এই মামলায় মাত্র ৯ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দেয়া হলো। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট।
এই মামলাটি যে কতখানি পরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক সেটি বুঝতে হলে অনেক দিন আগে জার্মানিতে ঘটে যাওয়া একটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা আমাদেরকে স্মরণ করতে হবে। সেটি হলো জার্মান পার্লামেন্টে আগুন লাগা। জার্মানরা পার্লামেন্টকে তাদের ভাষায় ‘রাইখস্ট্যাগ' বলে। সংক্ষেপে রাইখ। এটি ছিল তাদের থার্ড রাইখ। বিশ্বের কুখ্যাত ডিক্টেটর এডলফ হিটলার ১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। তখন জার্মানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন পল হিল্ডেনবার্গ। ঐ বছরে অর্থাৎ ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থার্ড রাইখে অর্থাৎ পার্লামেন্টে আগুন লাগে। বিষয়টি নিষ্ঠুরভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে ক্ষমতা চান হিটলার। কাদেরকে দমন করা হবে? কাদেরকে শাস্তি দেয়া দেয়া হবে? কারা করেছে এই কাজ। তখনো কিন্তু এগুলোর তদন্ত হয়নি। হিটলারের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি। হিটলার শুরু করেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমন অভিযান। এই দমন অভিযান থেকে প্রতিপক্ষীয় পার্লামেন্টারিয়ানরাও নিষ্কৃতি পাননি। শুরু হয় তদন্ত ও বিচারের নামে প্রহসন। বিচারে একজনের প্রাণদন্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে স্বতন্ত্রভাবে একটি তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিকরা বলছেন, যে হিটলার যে প্রহসনমূলক বিচার অনুষ্ঠান করেন সেটি কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য না হলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার কোন সাহস বা পরিবেশ সেখানে ছিল না। এই পার্লামেন্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে এবং গণতন্ত্রের শত্রু নির্মূলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে হিটলারের নাজি শাসন জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে খর্ব করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হিটলারের দলটিকে বলা হতো নাৎসী পার্টি এবং ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তারা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরেরই পরের মাসে অর্থাৎ মার্চ মাসে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পার্লামেন্টকে ডিঙ্গিয়ে দেশ শাসনের ক্ষমতা হিটলারকে দেয়া হয়। পার্লামেন্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে জার্মানিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারে কমিউনিস্ট পার্টির মি. লুবেকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। পরবর্তীকালে প্রায় সব গবেষকই লিখেছেন যে, পার্লামেন্টে আগুন দেয়ার মত এমন ভয়ঙ্কর কাজটি করেছে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর প্রশিক্ষিত অন্তর্ঘাতকরা। তারা এই বীভৎস কাজটি করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দায় চড়িয়েছে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। জার্মান পার্লামেন্টে অগ্নিকান্ডের পর ৭৯ বছর গত হয়েছে। আজও কেউই বিশ্বাস করেন না যে, ঐ ভবনটিতে আগুন লাগিয়েছে সরকার বিরোধী দল। বরং সকলেই মনে করেন যে গণতন্ত্রেশুভ উদ্দেশ্যেই সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী ঐ ঘটনা ঘটিয়েছিল। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হিটলার এবং তার নাৎসীদল বারবার গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের হাতে প্রথম বলি হয়েছে সেই গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
\ দুই \
বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে কে বা কারা রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। সরকার কালবিলম্ব না করে বিএনপিসহ ১৮ দলের ৪৫ জন নেতাকে ঐ অগ্নিকান্ডের জন্য আসামী করে মামলা দায়ের করে। সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষিত সচেতন মানুষই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও বানোয়াট এবং হাস্যকর মনে হয়। কারণ একটি বাসে আগুন লাগানোর জন্য কি ৪৫ জন লোকের প্রয়োজন হয়? সরকারের তরফ থেকে তারা সরাসরি আগুন না লাগালেও তারা ছিলেন হুকুমের আসামী। একটি বাসে আগুন লাগানোর জন্য কি ৪৫ জনকে মিলে হুকুম দিতে হবে? একটি হরতাল অর্গানাইজ করার জন্য ঐ একটি বাসে আগুন লাগানো ছাড়া ঐ ৪৫ জনের কি আর কোনো কাজ ছিল না?
দ্বিতীয়ত: হরতাল শেষ হয় বিকেল ৬টায়। আর আগুন লেগেছে রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টায়। তাহলে হরতাল শেষ হওয়ার  আড়াই ঘণ্টা পর বাস পোড়ানো হলো কেন? এই কাজটি করতে হলে তো হরতাল চলাকালীন সময়েই করার কথা।
তৃতীয়ত: চার্জশীটে বলা হয়েছে যে, ৭টি মাইক্রোবাসে বোঝাই হয়ে নেতারা নাকি অকুস্থলে যান এবং বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। একটি বাসে আগুন লাগানোর জন্য কি ৭টি বাসে চেপে অকুস্থলে যেতে হবে? টেলিভিশনের ছবিতে আমরা দেখি যে, শুধুমাত্র ১৮ দল আহূত হরতাল নয়, অতীতে আওয়ামী লীগ আহূত হরতালেও বাসে আগুন লাগিয়েছে ২ থেকে ৩ ব্যক্তি। একজন পেট্রোল ছিটিয়ে দেয়, আরেকজন আগুন ধরিয়ে দেয়। আর তৃতীয় ব্যক্তি আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখে। সুতরাং ৭টি মাইক্রোবাসে ৪৫ ব্যক্তি এসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কাহিনী একেবারেই ছেলে ভুলানো কথা।
চতুর্থত: ঐদিন একজন আসামী কর্নেল অলি আহমেদ ছিলেন কক্সবাজারে। আরেক আসামী শফিউল আলম প্রধান ছিলেন দিনাজপুরে। আরেক আসামী রুহুল কুদ্দুস দুলু ছিলেন নাটোরে। কর্নেল অলি আহমেদ যথার্থই বলেছেন যে, এখন পর্যন্ত তিনি এমন আধ্যাত্মিক ক্ষমতা অর্জন করেননি, যে ক্ষমতার বলে তিনি কক্সবাজারে বসে থেকে ঢাকায় আগুন লাগাতে পারেন।
এর বিপরীত চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের এলাকাটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। মেইন গেটে ২৪ ঘণ্টার জন্য থাকে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের প্রহরা। উল্টোদিকে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে বিমানবাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টার। সামান্য উত্তরে সেনাবাহিনীর জাহাঙ্গীর গেট। এখানে সর্বক্ষণ সশস্ত্র সেনা প্রহরা আছে। এমন দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো যার অবস্থান, সেখানে ৭টি মাইক্রোবাস বোঝাই করে এসে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং আগুন লাগানোর পর নিরাপদে চলে যাওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার। এটি একমাত্র তারাই করতে পারে, যাদেরকে নিরাপত্তা প্রহরীরা দেখেও দেখবে না এবং চিনেও চিনবে না।
\ তিন \
এখন আসছে জামিনের প্রশ্ন। মোটামুটি সব আইনজীবীই মনে করেন যে, জামিন দেয়া না দেয়া একান্তভাবেই নির্ভর করে বিচারকের ওপর। তারা আরও বলেন যে, জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য বলে কোন মামলা নেই। কোনো আসামীর বিচার চলছে, চূড়ান্ত রায় হবে কয়েকদিন পর, এমন মামলাতেও জজ সাহেব জামিন দিতে পারেন। জামিন দেয়ার সময় জজ সাহেবরা খেয়াল রাখেন যে, যাকে বা যাদেরকে জামিন দেয়া হবে, সে বা তারা পালিয়ে যাওয়ার মত ব্যক্তি কিনা, বিবেচনা করা হয় তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের বয়স, তাদের স্বাস্থ্য প্রভৃতি। যে ৪৫ জন রাজনৈতিক নেতাকে এই মামলার আসামী করা হয়েছে তাদের সকলেই সমাজের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। এদের অনেকেই মন্ত্রী ছিলেন, মেয়র ছিলেন, অনেকে এখনও পার্লামেন্ট সদস্য এবং সকলেই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা। অনেকেই বয়োবৃদ্ধ, যেমন জনাব এম.কে আনোয়ার। তার বয়স ৭৮। সুতরাং জামিন দেয়ার মত সবগুলো পয়েন্টই তাদের অনুকূলে ছিল। তারপরেও জামিন দেয়া হয়নি। ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রমুখ বিখ্যাত আইনজীবীদের মতে এই মামলায় জামিন না দেয়ার কোনো কারণই তারা দেখতে পান না। তারপরও তাদের জামিন হয়নি। কেন হয়নি সেটি একমাত্র জজ সাহেব ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না।
শেষ করার আগে একটি কথা। জার্মানীয় পার্লামেন্ট ভবন রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা হয় এবং উত্থান ঘটে পৃথিবীর ভয়াবহ ডিক্টেটরশীপ একনায়কত্বের। ঢাকাতে পার্লামেন্ট বিল্ডিং নয়, বাসে আগুন লাগে। সে কারণে ১৮টি দলের প্রায় সমস্ত শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উত্তেজিত কণ্ঠে হুমকি দিয়েছেন, কিভাবে বিরোধী দলকে সোজা পথে আনতে হয় সেটি তার জানা আছে। তিনি আর সহ্য করবেন না। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তো তারা কোনো রকম বিরোধিতা সহ্য করছেন না। এমনকি মিছিলও সহ্য করছেন না। জামায়াতকে তো পার্টি অফিসেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ জামায়াত এবং শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর সেটি হ'ল ১৯৩৩ সালের হিটলারের মত পার্লামেন্টকে বাইপাস করে ‘ডিক্রি' বা নির্বাহী বিভাগের ফরমানের মাধ্যমে দেশ শাসন। বাংলাদেশ কি সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন