শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

সাগরের তেল-গ্যাস : মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত কী শিক্ষা দেয়


॥ মীযানুল করীম ॥


মিয়ানমার এখন আর আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের কাছে ‘নিষিদ্ধ দেশ’ নয়। শাসক সামরিক জান্তার নমনীয়তা ও সংস্কার; অপর দিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জগতের স্বার্থপ্রণোদিত আগ্রহের ফলে দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতি, উভয় অঙ্গনেই খোলা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এত দিন প্রধানত চীন-ভারত মিয়ানমারে বিনিয়োগ ও ব্যবসায় প্রাধান্য লাভ করে আসছিল। এখন ইউরোপ-আমেরিকার বড় কোম্পানি দেশ দুটোর এই বিশেষ সুবিধা ুণœ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চীন, ভারত, কোরিয়া ও পাশ্চাত্য দেশগুলোÑ সবাইকে মিয়ানমার আকৃষ্ট করছে প্রধানত বিপুল জ্বালানি সম্পদের কারণে। আর এই তেল-গ্যাস লুকিয়ে আছে বঙ্গোপসাগরের গভীর গর্ভে।
বঙ্গোপসাগর অর্থ বঙ্গসমীপবর্তী উপসাগর। শাব্দিকভাবে উপসাগর হলেও এটি বিশ্বের অনেক সাগরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের দীর্ঘ তটরেখা এই সাগরের উত্তরপ্রান্ত বরাবর। বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগে বঙ্গোপসাগর ছাড়া বাংলাদেশ অচল। ফানেল আকৃতির কারণে এটি বিশ্বের সর্বাধিক ঘূর্ণিঝড়প্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি। তবে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগই শেষ কথা নয়; এর প্রাকৃতিক সম্পদ বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের জন্য।
সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রহীনতার কারণে প্রায় দুই দশক মিয়ানমারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত ছিল না। তবে ওয়াশিংটন নিয়মিত সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মনিটরিং করেছে এবং অর্থনীতির সমস্যা-সম্ভাবনার নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজখবর রেখেছে। সিআইএ শুধু রাজনীতি ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনীতির অঙ্গনেও তৎপর। তাদের আপাত হিসাবে, মিয়ানমারের এলাকায় ৫০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ২৮৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এর বেশির ভাগই উপকূল থেকে কিছু দূরে সমুদ্রের নিচে।
বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের প্রায় দেড় শ’ কিলোমিটার সীমান্ত কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায়। ওপারে সাবেক বার্মা রাষ্ট্রের আরাকান। এটা বর্তমান মিয়ানমারের ‘রাখাইন স্টেট’ নামের প্রদেশ। এর রাজধানী বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছুটা দক্ষিণে। ওই শহরটি আমাদের কাছে আকিয়াব নামে বহুলপরিচিত হলেও মিয়ানমারে সরকারিভাবে এর নাম সিত্তুই। বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও পরিবহনের বিদেশী কার্যক্রমে বন্দরশহর সিত্তুই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের টেকনাফে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এর উপকূল থেকে কিছু দূরে বঙ্গোপসাগরের কোনো কোনো দ্বীপে অতীত থেকেই তেল উত্তোলন করা হচ্ছে দেশীয় পদ্ধতিতে। স্থানীয় লোকজন নিজস্ব প্রয়োজনে ও সীমিত উদ্যোগে তিন শ’ বছর ধরে এটা করে আসছে বলে জানানো হয়েছে। এএফপির প্রতিনিধি শুয়েরি চাই নামের এমন একটি দ্বীপ ঘুরে এসে জানালেন, মিয়ানমার আসলেই বিশ্বের এমন দেশগুলোর একটি, যে সবার আগে জ্বালানি তেল উত্তোলন করেছিল। আর ১৮৫০ সালে তার তেল রফতানির সূচনা।
বিগত নব্বইয়ের দশকে এবং এই শতাব্দীর পয়লা ১০ বছর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রচণ্ড বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তদুপরি আরোপ করেছিল দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অবরোধ। অপর দিকে চীন তখন মিয়ানমারের মিত্র হয়ে দেশটির জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করে নিজ স্বার্থ এগিয়ে নিয়েছে। বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান, উত্তোলন ও পরিবহনের ব্যাপক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে বেইজিং। যদিও এই সাগরসংলগ্ন একাধিক প্রদেশ রয়েছে মিয়ানমারের; তবে আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের নামই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে এ বিষয়ে। এখানকার সাগর থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে চীনে নেয়ার জন্য ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন এবং এর সমান্তরাল করে তেলের সরবরাহ লাইন নির্মাণের ব্যয়বহুল মহাপ্রকল্প চীন হাতে নিয়েছে। এই জ্বালানি তেল আরব দেশগুলো, ইরান, আফ্রিকা প্রভৃতি স্থান থেকে জাহাজে করে আরাকানের উপকূলে আনা হবে। সেখান থেকে পাইপলাইনে মিয়ানমার পাড়ি দিয়ে যাবে চীনে। এই রুট চীনের জন্য অনেক সংক্ষিপ্ত বলে অর্থ ও সময় দুটোই বাঁচবে। এখন অতিব্যস্ত মালাক্কা প্রণালী দিয়ে সিঙ্গাপুর হয়ে এবং গোটা ইন্দোচীন ঘুরে তেলবাহী জাহাজ চীনে পৌঁছতে হয়। এ ছাড়া চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে ভবিষ্যতে আমেরিকা মালাক্কা প্রণালী অবরোধ করলে তখন চীনকে মারাত্মক বিপদে পড়তে হবে।
ওপরে উল্লিখিত পাইপলাইন দু’টির প্রধান শরিক চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম সংস্থা (সিএনপিএন)। এটি চালু হলে ২০১৩ সাল থেকে বার্ষিক ১০-১৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস এবং ২২ মিলিয়ন টন তেল চীনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি গ্রুপ মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিদেশী কর্তৃত্বের আশঙ্কায় এর বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে চীনের সুযোগ কমে গেলে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ফায়দা লুটবে। মিয়ানমারের জনগণের বেশির ভাগই চায়, তাদের গ্যাস-তেল তারা নিজেরাই উত্তোলনের সামর্থ্য অর্জন করুক এবং এই সম্পদের ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হোক। অন্যথায় মিয়ানমারের দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন অব্যাহত থাকবে বলে তাদের অভিমত। আরাকান অয়েল ওয়াচ নামের একটি প্রতিবাদী সংগঠন জানায়, (বাংলাদেশের অদূরবর্তী) শুয়ে এলাকার গ্যাস থেকে ৩০ বছরে ২৯ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে। বিপুল গ্যাস ও তেলভাণ্ডার যত রাজস্বই অর্জন করুক না কেন, সরকারের অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনা মিয়ানমারকে আজো অনেক পিছিয়ে রেখেছে। স্বীকৃত উন্নয়ন সূচকের মাপকাঠিতে দেশটি নিচে পড়ে আছে। তাই প্রকৃতির সম্পদকে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে রূপান্তরের দাবি হচ্ছে জোরদার। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিরাট মিয়ানমার দেশটায় ৮৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত আজো। বিশ্বব্যাংকের ২০০৯ সালের পরিসংখ্যানে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের সাথে বৈরিতার দুই দশকে মিয়ানমার জান্তা বঙ্গোপসাগরের গ্যাস উত্তোলনের কাজ প্রধানত চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে দিয়েছে। তবে কত অর্থের বিনিময়ে তারা এ সুযোগ পেয়েছে, অর্থাৎ মিয়ানমারের জাতীয় আর্থিক লাভের পরিমাণটি সরকার প্রকাশ করেনি। এ জন্য অনেকের মাঝে ক্ষোভও আছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আগামী দিনে জ্বালানিসম্পদ হবে মিয়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগের প্রধান টার্গেট। এ ক্ষেত্রে তেলের চেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে গ্যাস। ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ফ্রান্সের ‘টোটাল’ কোম্পানি এখান থেকে ফায়দা লুটতে কাজ শুরু করেছে। তার সহযোগী মার্কিন ‘জ্বালানি দানব’ শেভরন কোম্পানি এবং মালয়েশিয়ার পেত্রোনাস।
বঙ্গোপসাগরের তেলের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে মিয়ানমার এখন বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র। অথচ মাত্র কয়েক দিন আগেও খবর বেরিয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা উত্তর কোরিয়া থেকে পারমাণবিক বোমার প্রযুক্তি আনছেন। কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া হচ্ছে পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ। অতি সম্প্রতি দুই দেশের মাঝে আবারো যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। মিয়ানমারের সাথে উত্তর কোরিয়ার সামরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে নিঃসন্দেহে চুশূলের মতো। এমনকি এই মিয়ানমারেই ১৯৮৩ সালে উত্তর কোরীয় এজেন্টরা সফররত দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্টকে হত্যার লক্ষ্যে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট চুন দু-হুয়ান তখন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও দক্ষিণ কোরিয়ার তিনজন মন্ত্রীসহ সে দেশের ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন। আর এই নাশকতা ঘটেছিল অং সান সু চির পিতার সমাধিতে। সেই দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ এবং অতীত ভুলে তারা মিয়ানমারের সাথে অর্থনৈতিক প্রগাঢ় মৈত্রী গড়তে চায়। এর মূল কারণ, বঙ্গোপসাগরের জ্বালানি তেল ও গ্যাস। এই অমূল্য সম্পদ উত্তোলনে ব্যাপকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। সামরিক জান্তার ঘনিষ্ঠ ভারত ও চীনের মতো ওই দেশের প্রতিষ্ঠানও তেল ও গ্যাস উত্তোলনের বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। দক্ষিণ কোরীয় বিখ্যাত কোম্পানি দাইউ মিয়ানমারের আরাকান উপকূলের অদূরে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস উত্তোলন করছে। জায়গাটা আমাদের সেন্টমার্টিন থেকে খুব দূরে নয়।
এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়ার খোদ প্রেসিডেন্ট লি মিউং-বাক গত সোমবার (১৪ মে) মিয়ানমারে সফরে এসেছেন। ইয়াঙ্গুনে তার এক পূর্বসূরিকে হত্যা প্রচেষ্টার পর তিন দশকে সিউল থেকে আর কোনো দক্ষিণ কোরীয় নেতা মিয়ানমার আসেননি। তার নিরাপত্তার জন্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উত্তর কোরিয়ার সাথে বিতর্কিত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও মিয়ানমার দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহায়তা চায়। তেমনি দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ নজর বঙ্গোপসাগরের জ্বালানি সম্পদের দিকে। মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে, জ্বালানি ও সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে কোরীয় প্রেসিডেন্ট লি মিউং-বাক মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সাথে বৈঠক করেছেন।
বাংলাদেশের সাথে এবার মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে। দীর্ঘ দিন ধরে এ নিয়ে দুই প্রতিবেশীর বিরোধ চলে আসছিল। এ দিকে আরেক প্রতিবেশী ভারতের সাথে আমাদের সমুদ্র সীমানা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। মিয়ানমারের সাথে এই বিরোধের অবসানকে ‘সমুদ্র বিজয়’ বলা না গেলেও তা জাতির জন্য বিরাট স্বস্তির কারণ বৈকি। বিশেষ করে হাইড্রোকার্বন সম্পদ অর্থাৎ তেল-গ্যাসের মতো জ্বালানিভাণ্ডারের জন্য বঙ্গোপসাগর এত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমার তার প্রাপ্য এলাকায় তো বটেই, এর বাইরে বাংলাদেশের সমুদ্রগর্ভ থেকেও জ্বালানি সম্পদের ভাগ চেয়েছিল। অবশ্য এবারের নিষ্পত্তি মোতাবেক বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মিয়ানমারও তার প্রকৃত প্রাপ্য অর্জন করেছে। বঙ্গোপসাগরের পানির মৎস্যসম্পদের ওপর পূর্বের মিয়ানমার ও পশ্চিমের ভারতের শ্যেন দৃষ্টি। তাদের তীè নজর এর চেয়েও বেশি এই সাগরের ভূগর্ভস্থ তেল-গ্যাসের দিকে। দুই পড়শির সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে এত বিরোধ; কেননা তারা আমাদের এলাকা থেকেও অন্যায়ভাবে জ্বালানি উত্তোলন করতে চায়।
শুধু মিয়ানমার নয়, ভারতও বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পেয়ে তার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ২০০৫-০৬ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখানে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পায়। সেই সাথে খোঁজ মিলেছে ‘কালো সোনা’র, অর্থাৎ জ্বালানি তেলের।
তাই ভারতের লোভাতুর দৃষ্টি বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকার দিকে। আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তির চেয়ে শক্তি এবং ন্যায়নীতির চেয়ে জবরদস্তিকে গুরুত্ব দেয়ার মজ্জাগত মানসিকতা তো তার আছেই। তাই বাংলাদেশকে সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হবে, যেন সমুদ্রসম্পদের ন্যায্য হিস্যা থেকে কানাকড়িও বঞ্চিত হতে না হয়। মনে রাখতে হবে, জাতীয় স্বার্থ আদায়ের বেলায় বন্ধু বা অবন্ধু রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতাসীন কোনো নেতানেত্রীর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ও কৃতজ্ঞতা মূল্যহীন। 
মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন হলো ২০১২ সালে এসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার আমলে, যা পূর্ণতা পেয়েছে শেখ হাসিনার সময়ে। বঙ্গবন্ধু বাস্তব সীমাবদ্ধতার মাঝেও মেনে নেননি সাগরে ভারতের অন্যায় কর্তৃত্ব। এটা তার কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকারকে মনে রাখতে হবে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের সময়ে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। মুজিব আমলে ভারতীয় নৌবাহিনী সাগরে বাংলাদেশী মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে বাধা দিয়েছিল। তখন শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, এই ঔদ্ধত্য সহ্য করা হবে না। 
আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব দেখা দেবে এবং তা উত্তরোত্তর বাড়তে পারে। আর এটা হবে প্রথমত এখানকার জ্বালানিসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের বিষয়ে কর্তৃত্ব নিয়ে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও পরিবহনসংক্রান্ত নিজ নিজ স্থাপনা ও নেটওয়ার্কের নিরাপত্তার অজুহাতে পরবর্তী পর্যায়ে বিশেষ করে আমেরিকার বঙ্গোপসাগরে প্রতিরক্ষা কার্যক্রম শুরু করা বিচিত্র নয়। মিয়ানমারের পক্ষে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র, কাউকে জ্বালানিতে বিনিয়োগ থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে না। চীন তার দুঃসময়ের বন্ধু। অন্য দিকে আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যকে নাখোশ রেখে যে চলা যায় না, গত ২১ বছরে তা মিয়ানমার সরকার টের পেয়েছে। যা হোক, বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগর নিয়ে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে আত্মমর্যাদার সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। চীন নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধু। তার অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা আর কোনো দেশকে শত্রু বানাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। সমুদ্রে হোক কিংবা মূল ভূখণ্ডে হোক তেল-গ্যাস-কয়লাসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জাতীয় কর্র্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা চাই। না হয় বন্ধুত্বের বাগাড়ম্বর কিংবা প্রতারণার প্রপঞ্চে এমন চুক্তি, সমঝোতা বা অঙ্গীকারের বেড়াজালে আমরা আবদ্ধ হয়ে যাবো, যা হবে দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর এবং মহাক্ষতির কারণ। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন