বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

তথ্যের স্বাধীনতা, দায়বদ্ধতা এবং তথ্যের রাজনীতি

শেখ হাফিজুর রহমান | তারিখ: ১৮-০৫-২০১২



তথ্য কী? তথ্যের কি কোনো আকার বা অবয়ব আছে? স্থান-কাল-পাত্রভেদে তথ্য কি ভিন্নভাবে পরিবেশিত হয়? তথ্যের কি কোনো রাজনীতি আছে? তথ্যের রাজনীতি কি ওলট-পালট করে দিতে পারে সুশৃঙ্খল কোনো সমাজকে? তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তথ্য সংগ্রহ, তথ্যের প্রকাশ বা প্রচার ও তথ্যের বিতরণকে ঘিরে এ প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে। আর এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তথ্যের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার বিষয়।
তথ্যের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি অধিকার। তথ্যের স্বাধীনতা বলতে জনগণের তরফে তথ্য পাওয়ার অধিকারকে বোঝায়। এ তথ্য ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে পারে অথবা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও এবং করপোরেট বডির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করেছে। একই অনুচ্ছেদ প্রেসের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দিয়েছে। প্রেস বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ এবং তা বিতরণের স্বাধীনতাকে বোঝায়। তবে তথ্য প্রকাশ ও বিতরণের স্বাধীনতা কিন্তু অবাধ ও নিঃশর্ত নয়। অনেক শর্তসাপেক্ষে তথ্যের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। যেসব শর্তসাপেক্ষে প্রেসকে তথ্য প্রকাশ ও বিতরণের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, শান্তিশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি ও কোনো অপরাধ সংঘটনে উসকানি প্রদান করা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথ্য প্রকাশ ও বিতরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও অন্যান্য বিষয়ের কোনো ক্ষতি করবে না—এমন শর্তেই তথ্যের স্বাধীনতাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পত্র-পত্রিকা তথা গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে রেখেই সংবিধানপ্রণেতারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সিবিএস বনাম ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি (৪১২ ইউএস ৯৪) মামলায় বলা হয়েছে, যুক্তিসংগত শর্তসাপেক্ষে পত্র-পত্রিকায় যেকোনো কিছু প্রকাশ বা প্রকাশ না করার স্বাধীনতা রয়েছে এবং সরকার এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নিউইয়র্ক টাইমস বনাম ইউএস (৪০৩ ইউএস ৭১৩) মামলায় বলা হয়েছে, প্রেসের স্বাধীনতা সংবাদ, সম্পাদকীয় মন্তব্য, সরকার ও সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড, সরকার কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার আলোচনা ও সমালোচনা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বৃহত্তর অর্থে তথ্যের স্বাধীনতা বলতে জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বোঝায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম থেকে আমরা প্রতিদিন নানা তথ্য পাই, যা আমাদের নানা রকম তথ্যের চাহিদা মেটায়। আবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য প্রয়োজন হয়। গণমাধ্যম বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য পাওয়ার যে নাগরিক অধিকার, তাকেই তথ্যের স্বাধীনতা বলে। সংকীর্ণ অর্থে তথ্যের স্বাধীনতা বলতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের দিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং তার প্রকাশ ও বিতরণকে বোঝায়। নানা বিষয়ের তথ্য, সংবাদ ভাষ্য ও বিশ্লেষণ প্রকাশ ও বিতরণের সময় গণমাধ্যমকে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়। এ দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তথ্যের দায়বদ্ধতার বিষয়।
তথ্যের দায়বদ্ধতা বলতে তথ্য প্রকাশ ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা বোঝায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম যে তথ্য পরিবশেন করছে, তাতে যেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। প্রকাশিত খবর যেন শান্তিশৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত না করে, নৈতিকতাকে ধসিয়ে না দেয়, আদালত অবমাননা না করে এবং কোনো অপরাধ সংঘটনে উসকানি না দেয়। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননার সংজ্ঞা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শান্তিশঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে কি না, নৈতিকতা লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সে বিষয় কি রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর আত্মগত ধারণার (সাবজেকটিভ কনসিডারেশন) ওপর নির্ভর করবে, নাকি তার বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড (অবজেকটিভ ক্রাইটারিয়ন) থাকবে, যার ওপর ভিত্তি করে গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে—সে বিষয়ও গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টি যদি শাসকগোষ্ঠীর আত্মগত ধারণা বা মনগড়া অজুহাতের ওপর নির্ভর করে, তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হতে বাধ্য। অতীতে আমরা সামরিক ও অনির্বাচিত শাসকদের দিয়ে তাদের মনগড়া অজুহাতে গণমাধ্যমের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ হতে দেখেছি, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ ছাড়াও তথ্য প্রকাশ ও পরিবেশনের ব্যাপারে গণমাধ্যমের নিজস্ব দায়বদ্ধতা রয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এমন কোনো খবর পরিবেশন করবে না এবং এমন কোনো ছবি ছাপবে না বা দেখাবে না, যা অশ্লীল ও নৈতিকতার পরিপন্থী। গণমাধ্যমের এ দায়বদ্ধতার বিষয় মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় নৈতিকতা ও আচরণবিধি দিয়ে। সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো অশ্লীল ছবি বা বীভৎস দৃশ্য দেখানো উচিত নয়। কিন্তু কখনো কখনো আমরা পত্রিকায় ট্রেনে কাটা লাশ বা দুর্ঘটনায় ছিন্নভিন্ন শরীর বা এমনতরো নিষ্ঠুর ও বীভৎস দৃশ্য ছাপা হতে দেখি, যা সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী। অনেক সময় আমরা পত্রিকায় এমন ছবি ছাপা হতে দেখি বা টেলিভিশনে এমন দৃশ্য দেখি, যাকে শ্লীল বা রুচিশীল—কোনোটিই বলা যায় না। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা যেমন আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত, তেমনি রাষ্ট্রের তরফেও বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে কেউ অশ্লীল ও বীভৎস খবর ও ছবি পরিবেশন করতে না পারে।
গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার আলোচনায় যে বিষয় জোর দিয়ে উল্লেখ করতে চাই সেটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতা। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে গণমাধ্যম অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু অনেক সময় আমরা গণমাধ্যমকে করপোরেট পুঁজির দাসত্ব করতে দেখি। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও করপোরেট পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আমরা করপোরেট পুঁজিকে জয়লাভ করতে দেখি; সামাজিক দায়বদ্ধতা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। এ জায়গা থেকে গণমাধ্যমের বেরিয়ে আসা উচিত।
আমরা যে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা বলি, যে তথ্যের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অনেক ক্ষেত্রে সে তথ্যের স্বাধীনতা যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি তথ্যের অবাধ প্রবাহকেও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তথ্য রাজনীতির কারণে, তথ্যকে পণ্যে পরিণত করার কারণে অনেক সময় যে তথ্য পরিবেশিত হয়, সেটি হয় খণ্ডিত ও অর্ধসত্য। পূর্ণাঙ্গ তথ্য জনগণের কাছে আর পৌঁছায় না। খণ্ডিত, অর্ধসত্য বা অসত্য তথ্য ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদ ও তার সহযোগী বিশ্ব গণমাধ্যম ইরাক আক্রমণের আগে সারা বিশ্বে সুনিপুণভাবে প্রচার চালাল যে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এ অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ইরাক আক্রমণ করল। পরে আমরা জানলাম, সাদ্দাম হোসেনের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমের ভুল প্রচারণার ওপর ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করে নিল অত্যন্ত প্রাচীন একটি সভ্যতার পীঠস্থান ইরাক। ইরাকে আজ কারও কোনো নিরাপত্তা নেই। মিথ্যা তথ্যের কারণে একটি সক্রিয় ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো! আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেমন, জাতীয় পর্যায়েও তেমন তথ্যের রাজনীতি পূর্ণাঙ্গ তথ্যের প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার তথ্যকে পণ্যে পরিণত করলেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিক লাভই যদি তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ ও বিতরণের মূল বিবেচনা হয়, তাহলে পুর্ণাঙ্গ তথ্য কীভাবে প্রকাশিত হবে? তথ্যের স্বাধীনতা ও তথ্যের দায়বদ্ধতার কথা নানা আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে বলা হলেও তথ্যের শৃঙ্খলই আজকের দুনিয়ার কঠিনতর এক বাস্তবতা।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
harkarzon@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন