বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

মানুষ গড়ার কারিগর

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম | তারিখ: ১৮-০৫-২০১২



চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করছেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ১৫ মে শহীদ মিনার থেকে মিছিল বের করে তাঁরা যাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে, তাঁকে একটি স্মারকলিপি দিতে। কিন্তু জাতীয় জাদুঘরের সামনে তাঁদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় পুলিশ এবং পুলিশ যখন কোনো মিছিলের সামনে অবস্থান নেয়, তখন এক চিরাচরিত রসায়ন-ক্রিয়ার সূত্রপাত হয়। মিছিলকারীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং পুলিশও সম্ভাব্য হামলা চালানোর জন্য তৈরি হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে যুক্তি পালায়। কিন্তু এ মিছিলটি ছিল আর দশটা মিছিল থেকে পৃথক—এ মিছিলে ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা, যাঁদেরকে আমরা বস্তুগত কোনো কিছু দিতে না পেরে বেশ বাহারি একটি অভিধা দিয়েছি—মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরা শান্তি বজায় রেখেই পথ চলছিলেন, যদিও তাঁদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত স্মারকলিপি দিতেই হচ্ছে—এ বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মধ্যে হতাশাও ছিল। 
মিছিলকারীদের অনেকেই আগের রাতটি শহীদ মিনারেই কাটিয়েছেন। তাঁদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে একটুখানি আশ্বাস দিতে সরকারের কেউ শহীদ মিনারে যাননি। তাঁরা ক্লান্ত ছিলেন, অভুক্তও ছিলেন। অনেকের চোখে রাত জাগার শ্রান্তি ছিল। দুদিনের পুরোনো খোঁচা খোঁচা দাড়িও ছিল অনেকের গালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের সামনের গেট থেকে মিছিলটি দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আমার গন্তব্য ছিল শাহবাগ। কিছুক্ষণের জন্য আমিও মিছিলে শামিল হই। খুব বেশি হলে মিনিট দশেক, কিন্তু এই ১০ মিনিট নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। মানুষ গড়ার এসব কারিগরের পাশে কত সুবিধাভোগী আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আমরা কত সহজে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেনদরবার করতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দাবি জানাতে পারি, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারি, কলাম লিখতে পারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা অথবা কনসালট্যান্সি করতে পারি। সবাই নয়, কিন্তু অনেকেই। আর আমাদের যদি বাদ দিই, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, করপোরেট জগতের কর্মসম্পাদকেরা, যাদের ভিত্তিমূল রচনা করে দিয়েছেন এই শিক্ষকেরা, তাদের কথা যদি বলি, তাহলে তাদের তুলনায় সামাজিক সিঁড়ির কত নিচের ধাপেই না এই শিক্ষকদের অবস্থান। অথচ সামান্য কিছু দাবিদাওয়ার জন্য তাঁদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে কত দূর, সেই তেজগাঁও। 
আমার এক পাশে এক শিক্ষক, তিনি এসেছেন নাটোর থেকে। বাঁ পাশের শিক্ষক সম্ভবত চৌমুহনী থেকে, যেহেতু তিনি নিচু স্বরে কথা বলছিলেন, অতিশয় ক্লান্ত ছিলেন বলে। নাটোরের শিক্ষক তাঁদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে কথা বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ ছিল। চারটি শিক্ষক সংগঠন একযোগে কর্মসূচিটি দেওয়ায় তিনি আশাবাদী ছিলেন, তাঁকে একদিনের বেশি ঢাকা থাকতে হবে না। কথা বলার এক ফাঁকে তাঁর কাছে কেউ একজন ফোন করল। খুব সস্তা দামের মোবাইল ফোন। মেয়ে জানতে চেয়েছে বাবা কেমন আছেন। ফোনে তাঁর হাসিমুখে কথা বলতে দেখে কেন জানি বেশ আশ্বস্ত লাগল; মনে হলো, না, এই শিক্ষক যা আশা করে এতটা দূর এসেছেন, তা তিনি সবটা না হলেও অনেকটা পাবেন। তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার গন্তব্যে পা চালালাম। কিন্তু শাহবাগের কাজ শেষ করে ফেরার পথে বুঝতে পারলাম, পুলিশি রসায়নটা তার কাজ শুরু করেছে। মিছিলটি বাধা পেয়ে গণগ্রন্থাগারের সামনে বসে পড়েছে। কিন্তু যে মিছিলের মানুষগুলোকে একটু আগে শান্ত দেখেছি, এখন তাঁদের মধ্যে দেখলাম প্রবল উত্তেজনা। তাঁরা বুঝেছেন, পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখা মানে স্মারকলিপি আর প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছাবে না। আমার ধারণা হয়েছিল, হয়তো শিক্ষক নেতাদের একটা গাড়িতে করে তেজগাঁও নিয়ে যাওয়া হবে—ততক্ষণে তাঁদের সহকর্মীরা পথে বসে বিশ্রাম নেবেন। একসময় নেতারা ফিরে আসবেন, কিছু সুসংবাদ জানাবেন এবং যাঁর যাঁর শহরে, গ্রামে ফিরে যাবেন।
সন্ধ্যার দিকে শুনলাম, পুলিশ হামলা করেছিল, গরম পানি ফেলা হয়েছে শিক্ষকদের ওপর। বুধবার সকালের প্রথম আলোতে দেখলাম এক হূদয়-বিদারক ছবি, সাজিদ হোসেনের তোলা। এক ভূপাতিত শিক্ষককে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই সদস্য হয়তো ভুলে গেছেন, তিনি ছোটবেলায় এ রকম একজন শিক্ষকের কাছেই নিয়েছিলেন প্রথম পাঠ।’
১৭ মে সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখি, অনেক দূর এক গ্রাম থেকে আসা এক শিক্ষক জলকামানের গরম পানি গায়ে লেগে এবং পুলিশের টানাহেঁচড়ায় আহত হয়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে আবার অসুস্থ হয়ে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। একটি বেদনাদায়ক, কষ্টকর, কিন্তু সম্পূর্ণ অনাবশ্যক মৃত্যু। দেখা গেল, তিনি জীবনের বিনিময়ে খবরের কাগজে একটু ঠাঁই করে নিলেন। অথচ কত মানুষকে তিনি গড়ে দিয়েছেন।

২.
পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম, সার্কে আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকাতেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। যুক্তি তো তা-ই বলে। একটা দালানের ভিত্তিটা দুর্বল করে ওপরে বাহারি স্থাপনা বানিয়ে দিলে যেটির ভেঙে পড়তে সময় লাগে না।
গত মাসে গুলশানে একটি বাড়ির ভিত্তি তৈরি হতে দেখলাম, যে ভিত্তিটি এত মজবুত, ২০ তলা একটা দালান এর ওপর দাঁড়াতে পারে। তবে আপাতত আটতলা হবে। অবশ্য বাংলাদেশে শহুরে আবাসনের যে অবস্থা, তাতে হয়তো বছর দশেক পরে ওই ২০ তালাই তুলতে হবে। দালানে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এবং সবাই নির্মাতাকে বলছেন, ভূমিকম্পরোধক ভিত্তি দিতে হবে। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যে প্রাথমিক শিক্ষা, তা সুদৃঢ় করার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কোনো উদ্যোগ নেন না, অথবা এ ব্যাপারে নিতান্তই নিষ্পৃহ থাকেন। কিন্তু শিক্ষা নামক আমাদের প্রধান স্থাপনার প্রতি আমরা যুগ যুগ ধরে যে অবহেলা দেখাচ্ছি, আমরা তার অবসান চাই। আমরা দাবি করি, জাতির মেরুদণ্ড বলে কথিত শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেখানো হোক। একজন দুর্বল মেরুদণ্ডের ব্যক্তির যেমন মেরুদণ্ডের পরিচর্যার আগে তার হাত-পা পেশি শক্তিশালী করাটা হবে অর্থহীন; কারণ যে লোক ভালো করে দাঁড়াতে পারে না, তার হাত-পায়ের পেশিই বা কী কাজে আসবে, চুল বাহারি করাতেই বা কী তার উপকার। আমাদের এমন কত খাতেই তো বিনিয়োগ হয়, যেখান থেকে দৃশ্যমান কোনো লাভই উঠে আসে না। কত অপচয় আমরা করি, কত অকারণ বাজেট বরাদ্দ হয়, কত চুরি-ডাকাতি হয়। এক স্টক মার্কেট থেকে লুটেরারা হাতিয়ে নিল শত শত কোটি টাকা। শুনেছি, পদ্মা সেতুর কোনো কাজ শুরু না হতেই নানা কারণে মোটা অঙ্কের হাতবদল হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের যেসব খাতে নয়-ছয় করার সুযোগ বেশি, সেসব খাতের প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ হয় দ্রুত। হয় না শুধু মানুষ গড়ার কারিগরদের মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানে। এ দেশে একজন ক্রিকেটার তিন টেস্টে তিন সেঞ্চুরি করলে প্লট, গাড়ি পান, কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগরেরা শামুকের মতো নিজের শরীর ক্ষয় করে করে অন্যের জন্য পথ করে দিলেও তাঁদের দিকে কেউ তাকায় না। উল্টো সাজিদ হোসেনের তোলা ছবিটার মতো তাঁদের লাটিপেটার শিকার হতে হয়।
এ দেশটাতে রাজনীতিই সব নিয়ন্ত্রণ করে এবং একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেটাই কাম্য বটে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি এমনই রগচটা আর পথভ্রষ্ট যে এর নিয়ন্ত্রণ এখন পুলিশি নিয়ন্ত্রণের মতোই। দেশের সবার দৃষ্টি এখন আঠারো দলীয় জোটের দিকে, তারা ১৭ তারিখের হরতালের পর আর কী কর্মসূচি দেয়, তা জানতে এবং বুঝতে; আবার সরকারের দিকেও বিরোধীদের আন্দোলনের মোকাবিলায় আর কী কঠিন পদক্ষেপ তারা নেয়, তা দেখার এবং বোঝার জন্য। সরকারের দৃষ্টি এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর, আন্দোলনরত শিক্ষকদের দিকে নয়। ১৬ তারিখ শিক্ষকদের সঙ্গে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর আলাপের পর আন্দোলন প্রত্যাহারের একটা ঘোষণা এসেছিল বটে, কিন্তু একটি টিভি চ্যানেল অনেক রাতে সচিত্র প্রতিবেদনে দেখাল, শিক্ষকেরা কয়েক ঘণ্টা পর এই ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তাঁদের ক্ষোভ, প্রতিমন্ত্রীর আগে অনেকেই অনেক আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কখনো হয়নি। এবার তাঁরা একটা বিহিত করে ঘরে ফিরে যাবেন।
বেচারা প্রাথমিক শিক্ষকেরা। ঢাকায় আসা-যাওয়াতেই অনেকে কয়েক মাসের সঞ্চয় খুইয়েছেন। অবশ্য যদি সঞ্চয় বলে কোনো কিছু তাঁরা করতে পেরে থাকেন। পরিচিত হওয়া সেই নাটোরের শিক্ষক অবশ্য কিছুটা স্বস্তিতে আছেন; এবার চলনবিলজুড়ে বোরো ধানের বাম্পার ফলনে তাঁর সামান্য অংশগ্রহণ আছে। এই টাকা তিনি মেয়ের শিক্ষার পেছনে খরচ করবেন। কিন্তু চৌমুহনীর শিক্ষকের বিমর্ষতা তাঁর সম্পর্কে এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে উৎসাহী করেনি।
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। তাঁদের চাকরি দ্রুত জাতীয়করণ করে তাঁদের বেতনভাতা বাড়ানো হোক, যাতে তাঁরা আনন্দের সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারেন।

৩.
আমার এক শ্রীলংকান বন্ধু আমাকে জানিয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা এমনই এক ক্ষেত্র, যেখানে ভালো বিনিয়োগ হলে এক প্রজন্মেই বিরাট সাফল্য পাওয়া যায়। তার সঙ্গে মধ্য শ্রীলংকার পাহাড়ঘেরা একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কী সুন্দর টালির ছাদ লাগানো স্কুলঘর। ঝকঝকে, তকতকে। আলো-বাতাসের খেলা স্কুলজুড়ে। সামনে মাঠ, ফুলের বাগান, একটু দূরে শিক্ষকদের কোয়ার্টার, তবে শিক্ষিকাই বেশি। তাঁদের দেখে মনে হলো, কাজে প্রচুর আনন্দ পাচ্ছেন। সুন্দর ইংরেজিতে কথা বললেন আমার সঙ্গে। আমার সেই বন্ধুটি মারা গেছে, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার বিনিয়োগের ফল দেখে গেছে। একবার চট্টগ্রামে শ্রীলংকার ক্রিকেট দলের দুই তারকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমি ও আমার দুই সহকর্মী। আমাদের তিনজনেরই মনে হয়েছিল, শ্রীলংকান দল যে এত ভালো খেলছে তার কারণ তাদের উন্নত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা।
আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, বাইরে থেকে পাঠানো টাকার পরিমাণ বাড়ছে, করের জাল বিস্তৃত হচ্ছে। আমরা কয়েক বছর অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে, নানা উপায়ে তহবিল সংগ্রহ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় যদি ব্যাপক বিনিয়োগ করি, এক প্রজন্মের পরই এর ফেরত পাওয়া শুরু হবে এবং তিন প্রজন্মের পর দেশটা কোথায় যে যাবে, কত দূর দৌড়ে যাবে, তা খুব একটা অনুমানের বিষয় নয়।
এখন শিক্ষার ভিত্তিটা শক্ত করার জন্য যা প্রয়োজন, তা আমাদের করতে হবে। এখন এই উদ্যোগে শামিল হতে হবে সরকারি ও বিরোধী সব দলকে, সব মত ও পথের মানুষকে, কিন্তু উদ্যোগের সূচনাটা করতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন