বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

শিকড়ের, না ব্যবসায়ীদের আওয়ামী লীগ?


সোহরাব হাসান | তারিখ: ১৭-০৫-২০১২


বাটি চালান তত্ত্ব বনাম গণতন্ত্র
শূন্য কলস বাজে বেশি। কাজে জোর থাকলে কথার জোরের প্রয়োজন হয় না। সাম্প্রতিককালে মন্ত্রীদের উল্টাপাল্টা বিবৃতি ও বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তাঁদের কাজের জোর একেবারেই কমে গেছে।
ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা মহা-উৎসাহে দিনবদলের কথা বলতেন, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের খোয়াব দেখাতেন। কিন্তু তিন বছর চার মাস পর এখন আর তাঁদের মুখে সেসব আশার বাণী শোনা যাচ্ছে না। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, নেতা-পাতিনেতারা হররোজ বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন। যেকোনো ঘটনার পেছনে কষ্টকল্পিত ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। তাঁদের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব শুনে শৈশবে পড়া রাখাল বালক ও বাঘের গল্পটি মনে পড়ল। সেই রাখাল বালক ‘বাঘ আসছে বাঘ আসছে’ বলে প্রতিদিন গ্রামবাসীকে চিৎকার দিয়ে জাগাত। গ্রামবাসী ঘুম থেকে উঠে দেখত, বাঘের নাম-গন্ধ নেই। বালকটি আসলে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙিয়ে মজা পেত। কিন্তু এরপর সত্যি সত্যি যেদিন বাঘ এল, সেদিন তার শত চিৎকারেও কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে এল না। অগত্যা বালক বাঘের পেটে চালান হয়ে গেল।
মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার বদলে শঙ্কিত হয়। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ে। মঙ্গলবার একটি সমাবেশে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় সব নেতাকে বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে না।’ এটা কি রাজনীতির ভাষা? বহুদলীয় গণতন্ত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলও থাকে। সেই বিরোধী দলকে বাটি চালান দেওয়ার কথা বললে যে চিত্র আমাদের সামনে ভেসে আসে তা মোটেই সুখকর নয়। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলো অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য ছিল: ‘নির্বাচনের মাত্র দেড় বছর বাকি। নির্বাচনের পর কি আওয়ামী লীগের নেতাদের লাঠি চালান দিয়ে পাওয়া যাবে?’ 
এই লাঠি ও বাটি চালানের গণতন্ত্র দেশের মানুষ চায়নি। তারা চেয়েছিল একটু শান্তি, একটু স্বস্তি। গত চার দশকেও শাসকেরা সেই শান্তি ও স্বস্তিটুকু দিতে পারেনি।
বিএনপি-জামায়াতের আমলে আমরা গণতন্ত্রের নামে বোমা-গ্রেনেড ও হাতুড়ির মহড়া দেখেছি। এখন শুনছি দেশব্যাপী বাটিতন্ত্রের রণধ্বনি, দেখছি গুম আর ইত্যাদি লীগের দখলবাজি। 
বাটি চালান তখনই দিতে হয়, যখন চোর ধরার বৈজ্ঞানিক সব কৌশল অকেজো হয়ে যায়। মন্ত্রী মহোদয় বাটি চালান দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের না খুঁজে এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকার রহস্য বের করতে পারতেন, সাগর-রুনি হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে পারতেন। বাটি চালান দিয়ে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে পারতেন। মন্ত্রী আরও বলেছেন, মাত্র দুটি মামলায়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মাধ্যমে কি তিনি বিরোধী দলকে হুমকি দিলেন, না সরাসরি সম্মুখ সমরে আহ্বান করলেন? এর মাধ্যমে তিনি কী বার্তা দিলেন দেশবাসীকে? বার্তা দিলেন যে ভবিষ্যতে আরও মামলা আসছে। দুটি মামলায় অভিযুক্তদের বাটি চালান দিয়ে খোঁজার আগেই আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ১২ মার্চের সম্মুখ সমরে কিন্তু দুর্বল বিএনপির কাছে শক্তিধর আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। কোনো ক্ষমতাসীন দলই মাঠের লড়াইয়ে জিততে পারে না। অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বিরোধী দলের মতো আচরণ করতে পছন্দ করে। 
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও সোমবার ১৮ দলের সমাবেশে ১০ জুনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এর মধ্যে দাবি না মানলে সরকার পতনের আন্দোলন হবে। মঙ্গলবার তিনি গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর হুমকি দিয়েছেন। এই হুমকি-পাল্টা হুমকিতে দেশের মানুষ কোথায় যাবে? আর কতকাল গণতন্ত্রের নামে হুমকিতন্ত্র চলবে?
মন্ত্রী মহোদয় জানেন কি, মামলা ও হামলা দিয়ে আন্দোলন দমন করা গেলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায় না। জনগণের সমস্যার সমাধানও হয় না। সরকার যদি বিরোধী দলের নেতাদের নামে মামলা ও হামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তারা দেশের জন্য কাজ করবে কখন? দুই-আড়াই মাস ধরে সরকার শুধু বিরোধী দলের বিভিন্ন অ্যাকশনের রি-অ্যাকশন জানিয়ে আসছে। বিরোধী দলের এক নেতা কিছু বললে সরকারি দলের ১০ জন ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। তাঁদের দল লাভবান হয়নি। ঈশ্বর, রাজনীতিকদের সুমতি দাও।

শিকড়ের, না ব্যবসায়ীদের আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের একহাত নিয়েছেন। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের গালমন্দ করা এবং তাঁদের জ্ঞানদান করা রাজনীতিকদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকেরা ভুল করলে, অন্যায় কিছু লিখলে বা বললে অবশ্যই মন্ত্রীরা তার প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু তাঁদের পেশাগত মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না। মন্ত্রী বলেছেন, ‘টক শোর পণ্ডিতদের কথা ও লেখনী বাঙালি জাতির মুক্তি আনেনি। ...আমাদের দেশের পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যা প্রচার করা হয়, বিশেষ করে টক শোতে প্রতিপক্ষ হিসেবে যাঁরা আসেন এবং কথা বলেন, তাঁদের জ্ঞানের পরিধি এতই কম ও দুর্বল যে, এসব দেখে সুনামগঞ্জের মানজুড়া গানের মতো মনে হয়। ...পত্রিকা পড়লে, টক শো দেখলে মনে হয় আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাঁরা জানেন না আওয়ামী লীগের ভিত্তি ও শিকড় কোথায়?’( প্রথম আলো, ১৬ মে, ২০১২)
মন্ত্রী মহোদয়ের কথা সত্য হলে এই পেশার একজন কর্মী হিসেবে নিজে আহত বোধ করলেও তাঁর বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাতাম। কেননা দুই-চারজন সাংবাদিকের ভুল তথ্য ও ব্যাখ্যার জন্য বড়জোর কয়েক লাখ মানুষ বিভ্রান্ত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যম শতকরা ১০ ভাগ লোকের কাছেও পৌঁছেনি। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা ভুল করলে গোটা জাতিকেই কাফফারা দিতে হয়। সরকারের ভুলে কী পরিমাণ কাফফারা দিতে হয়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়ন আটকে যাওয়া। ৪০ বছর ধরেই জনগণ সেই কাফফারা দিয়ে আসছে। তারা প্রতি নির্বাচনেই পছন্দের দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে এবং প্রতারিত হয়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আওয়ামী লীগের শক্তি সম্পর্কে সাংবাদিক তথা দেশবাসীকে সজাগ করে দিয়েছেন। কোন আওয়ামী লীগ? যে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ গড়ে তুলেছিলেন, না এখন খালু-মামু-দরবেশরা (বিশেষণগুলো আমার নয়, সরকারেরই একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর) যে আওয়ামী লীগ চালাচ্ছেন? দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছেন? যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তাঁরা দলের ভেতরে থেকেও দলের চেয়েও শক্তিশালী, সরকারের বাইরে থেকেও সরকারের চেয়ে ক্ষমতাবান।
রাজনীতির দুর্গতির জন্য সাংবাদিকেরা দায়ী নন। দায়ী রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশকারী শক্তি। অনেক আগেই রাজনীতি রাজনীতিকদের হাত থেকে চলে গেছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে না হলেও সরকারের ‘কিচেন কেবিনেটে’ অরাজনীতিক ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেশি। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামে হয় না, হয় কিচেন কেবিনেটে কিংবা অন্য কোনোখানে, অন্য কোথাও।
একই দিনে জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বক্তব্য রেখেছেন কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্মিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভবন উদ্বোধনকালে। তিনি আক্ষেপ করেছেন, ‘বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্যদের ৮০ ভাগ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের সংখ্যা কম। যেখানে আইন তৈরি হয়, সেখানে আইনপ্রণেতারা না থাকলে সংসদ চলবে কীভাবে এবং সংসদ কার্যকরই বা হবে কীভাবে?... নির্বাচনে পয়সার জোরে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা জয়ী হন।’ (প্রথম আলো, ১৬ মে, ২০১২,)
এই পয়সার জোরওয়ালারা কি কেবল বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে? আওয়ামী লীগে পয়সার জোরে নির্বাচিত হওয়া সাংসদ নেই? অবশ্যই আছে। তাহলে আওয়ামী লীগের শিকড় কোথায়? 
স্পিকারের বক্তব্য সত্য হলে সৈয়দ আশরাফের শিকড়ের আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকে না। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের তেমন দেখা যায়নি, দেখা গেছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের। একসময় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে ব্যবসায়ীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এখন আওয়ামী লীগও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দলে পরিণত হয়েছে। স্পিকারের ভাষায় জাতীয় সংসদের যে ৮০ ভাগ সদস্য ব্যবসায়ী, তাঁরা কোন দলের? ৩৪৫ সদস্যের সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ২৭১। এর মধ্যে বেশির ভাগই ব্যবসায়ী।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে জানা যায়, ‘আওয়ামী লীগের মোট ২৩৫ জন সাংসদ আছেন, যার ১২১ জনই ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, আইনজীবী ও চাকরিজীবী ৬১ জন, কৃষিকাজে নিয়োজিত ২২ জন। বিএনপির ৩০ জন সাংসদের মধ্যে ব্যবসায়ী ১৩ জন এবং জাতীয় পার্টির ২৫ জন সাংসদের মধ্যে ব্যবসায়ী ১৪ জন। সংরক্ষিত ৪৫টি নারী আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৬, যার মধ্যে ১২ জন ব্যবসায়ী, বিএনপির পাঁচজনের মধ্যে ব্যবসায়ী তিনজন ও জাতীয় পার্টির চারজনের মধ্যে ব্যবসায়ী দুজন। (সূত্র: নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮: অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি, প্রথম আলো-সুজন, এপ্রিল ২০১২ ) 
আওয়ামী লীগের যে ২৩৫ জন নির্বাচিত প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় তিন কোটি ৩৫ লাখ নয় হাজার ৮৭১ টাকা এবং বিএনপির ৩০ জনের গড় আয় চার কোটি ৯০ লাখ ৩৮ হাজার ৬২১ টাকা এবং জাতীয় পার্টির ২৫ জনের গড় আয় পাঁচ কোটি ৬২ লাখ নয় হাজার ৩৯০ টাকা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের গড় আয় পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ দুই হাজার ২০৭ টাকা, যা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের চেয়ে বেশি। যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের গড় আয় সামান্য কম। 
তাহলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের শিকড়ের আওয়ামী লীগ কোথাও আছে কি? থাকলেও তাঁদের বেইলি রোড কিংবা সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার নেই। আগে মন্ত্রীদের আশপাশে তৃণমূলের ত্যাগী ও পোড়খাওয়া কর্মীদের দেখা যেত। এখন নব্য ধনী, নব্য মাস্তানের পদচারণা বেড়েছে।
সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগকে অন্য সব দল থেকে আলাদা বলে যে ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে চাইছেন, তা কাজির গরু কেতাবে আছে, বাস্তবে নেই। যে দলের ২৩৫ জন সাংসদের মধ্যে ১২১ জনই ব্যবসায়ী, সেই দল আর যা-ই হোক, গরিব ও সাধারণ মানুষের দল হতে পারে না। 
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন