শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অসংযত আচরণ

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অসংযত আচরণ

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের পর হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন এক মেরুকরণ হতে শুরু করেছে। মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার ডাকসাইটে মন্ত্রী ও নেতারা একের পর এক অত্যন্ত অশালীন ও নোংরাভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বগৌরবের অন্যতম আসনে যিনি অলঙ্কৃত, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্য করেছেন। বিনা কারণে অশালীন ভাষায় আক্রমণ, নানা কটূক্তি দেখে সাধারণ জনগণ বিস্মিত না হয়ে পারেনি। ভেবে হতবাক হই খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে, এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের মতো দায়িত্বশীল নেতা কেমন করে অসংলগ্ন, বস্তাপচা মন্তব্য করতে পারলেন? সৈয়দ আশরাফের এমন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের পথ অনুসরণ করে তারই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। গায়ে পড়ে ইউনূসকে নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন আওয়ামী নেতারা। আর জনসমর্থনহীন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়া ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদকে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে সাবেক আমলা, অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে আরো কঠোর মন্তব্য করেছেন।
সবার প্রশ্ন, হঠাৎ করে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ড. ইউনূসকে নিয়ে এত েেপ গেলেন কেন? সংবাদপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এই সময় তো ড. ইউনূসের সরকারবিরোধী কিংবা সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়Ñ এমন কোনো কাজের বা কথার বর্ণনা কিংবা ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। হিলারি কিনটনের সাথে সৌজন্যমূলক বৈঠকেও সরকারবিরোধী কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয় না। তাহলে ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অন্যায় ও অপমানজনকভাবে বের করে দেয়ার পরও তাকে নিয়ে সরকারের মাথাব্যথার কারণ কী? হিলারির সফরের পরও ড. ইউনূস কোথাও সরকারবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি বা লবিং করতে দেখা যায়নি। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যখন প্রশ্ন তুলেছে প্রকাশ্যে, তখনো ড. ইউনূসকে এ ধরনের কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। বিএনপি ও তার মিত্ররা যখন ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনায় সোচ্চার, ড. ইউনূসকে সে েেত্রও একেবারে চুপ থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাহলে সরকার ইউনূসকে নিয়ে দিশেহারা ও এত ্যাপা কেন?
২. সৈয়দ আশরাফ দেশে-বিদেশে একজন সজ্জন হিসেবে পরিচিত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আবদুল জলিলের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে পরিমিত বক্তব্য প্রদান করে দল এবং দলের বাইরে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ইতিবাচক ভাবমূর্তি। ইংল্যান্ডের মতো গণতন্ত্রের সূতিকাগার ও মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে থেকে এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টির সদস্য হওয়ার সুবাদে সৈয়দ আশরাফের চালচলন-কথাবার্তায় মুনশিয়ানা পরিলতি হতো। তার বিশেষ পরিচয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্যতম কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে।
কিন্তু পত্রিকার পাতায় সেই আশরাফের ড. ইউনূসকে নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনে হতবাক হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল অন্য কেউ কথা বলছিলেন। কারণ আমরা যে ‘আশরাফ ভাই’কে চিনি, তিনি তো এমন অশালীন বক্তব্য আগে দেননি। সৈয়দ নজরুলের সন্তান এমন অরুচিকর বক্তব্য অন্তত দেশের একজন স্বনামধন্য প্রথিতযশা ব্যক্তিকে নিয়ে দিতে পারেন না।
৩. হিলারি কিনটন এবং প্রণব মুখার্জির সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণের জন্য সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সৈয়দ আশরাফও সংলাপের বিরোধী নন। ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ নিরপে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন ওই বৈঠকে। শুধু কি সে জন্য সরকার ইউনূসের ওপর েেপছেন? যদি তাই হতো, তাহলে আবেদের ওপরও সরকারের চটার কথা,কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
হিলারি কিনটন এবং প্রণববাবু সংলাপের সাথে গ্রহণযোগ্য সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারপ্রধানের এখানেই যত আপত্তি। সরকার দেখেছে, তাদের তৈরি করা ফর্মুলায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং দাতা ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপে শিতি, মার্জিত, নোবেল বিজয়ী এই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমজই থাকে ওপরে সরকার তখন আগেভাগেই ইউনূসবিরোধী স্রোত এবং বৈরী বলয় তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে মনে হচ্ছে।
সরকার নানা কসরত ও ফন্দিফিকির করে বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনের বাইরে রাখার যে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে ‘দাফন’ করে নিজেদের অন্তর্বর্তী সরকারের যে ফর্মুলা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, বহু তদবির করে হিলারি ও প্রণব বাবুকে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিল, তা যখন পণ্ড হয়ে যেতে বসেছে, তা দেখে কি সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? তাই ইউনূসের বিরুদ্ধে এত বিষোদগার।
তাই বলে কি নোংরা-অশ্লীল ভাষায় ইউনূসকে আক্রমণ করতে হবে? সিডনি প্রবাসী ফজলুল করিম যথার্থই বলেছেন, ওয়াইন, স্যান্ডউইচে যখন নোবেল পাওয়া যায়, তাহলে একটা নোবেল এনে দিন না আশরাফ সাহেব। শান্তির জন্য নোবেল উপাধিকে আশরাফ যখন প্রশ্ন তোলেন তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না তাদের কি উদ্দেশ্য কিংবা কি মেসেজ তাদের মতো নেতারা জাতি ও সমাজকে দিতে চান?
ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, দণি আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, বর্ণবাদী নেতা ডি কার্ক, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসসহ অনেক পণ্ডিত, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন কিন্তু কেউ কখনো ওয়াইন আর স্যান্ডউইচ খাইয়ে নোবেল পেয়েছেন বলে তো শুনিনি। আর ড. ইউনূস যে নোবেল পেয়ে গোটা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে অনেক ওপরে তুলেছেন, তা পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় মাতাল হয়ে পড়ে থাকা রাজনৈতিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিরা না মানলেও ইউনূসের কিছুই আসে যায় না। কারণ গোটা বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্ব জানে ইউনূসের অবদান, মর্যাদা ও প্রতিভা। রাজনৈতিক ফেরিওয়ালারা ইউনূসকে হেয় করতে পারেন, কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় ইউনূসকে যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করছে, তা থেকে নামাবেন কী করে? আপনাদের অশালীন বক্তব্য শুনে বানরের তেল মেখে গাছে ওঠার গল্পের কথাই বারবার মনে পড়ে, বারবার ওপরে যতটুকু ওঠে, ততবার ঠিক ততটুকু নিচে নেমে আসে।
৪. কিছু দিন আগে প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরের এক লেখায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক শিষ্টাচার একেবারে নিচে নেমে গেছে। আসলেই তাই, কারণ সরকারের নেতানেত্রীদের কথাবার্তা এত অসংলগ্ন ও অশালীন যে, রীতিমতো তা নষ্টবাজারের খিস্তিখেউড়ির পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তা, দলে যখন অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ধ্যান-ধারণার লালন ও চর্চা করা হয়, দলটিতে যখন একেবারে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পচন ধরে, তখন বাংলাদেশের মানুষ শঙ্কিত হয়। সরকারের পায়ের তলায় যে মাটি সরতে শুরু করেছে, তা যে কেউই সহজে অনুমান করতে পারছেন। যে কারণে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ভীত হয়ে পাগলের মতো আবোলতাবোল বলা শুরু করে দিয়েছেন।
৫. সম্মান পেতে হলে অপরকেও সম্মান দিতে হয়। আপনি নিজে যদি কাউকে সম্মান না দেন, তাহলে অপরের কাছ থেকে কী করে সম্মান আশা করেন? মনে রাখবেন, একদিন অন্যের অমর্যাদা করাই আপনার জন্য অপমানের কারণ হয়ে দেখা দেবে। কিছু দিন জোর করে মতায় থাকা যায়, যা খুশি করা যায়, মতার দাপটে যা খুশি বলা যায়, করা যায় কিন্তু কখনো স্থায়িত্ব পায় না, মানুষের এসব শ্রদ্ধার আসনে বসা যায় না এভাবে। যে জাতি তার গুণীজনদের সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির কপাল থেকে দুর্ভোগের কালিমা কখনো সরে না। যুগে যুগে মানবসভ্যতার ইতিহাস এটাই বলে। 
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী
Salim932@googlemail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন