অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার
বিগত ৫.৫.২০১২ তারিখে হিলারি বাংলাদেশে আসেন ২৪ ঘণ্টার সফরে। ৬.৫.২০১২ তারিখ দুপুরে কলকাতা চলে যান তিনি। এ অঞ্চলে তার সফর শুরু হয় চীন থেকে। শেষ হয় পাকিস্তানে গিয়ে। চীন থেকে হিলারি বাংলাদেশে এসেছেন। বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিকে স্বাগত জানান। সফর শেষে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি। হিলারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেন। বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে ডিনার খেয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোজেনার বাসায় ড. মো. ইউনূস ও স্যার ফজলে হোসেন আবেদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট মিটিং করেছেন। ‘বাংলাদেশের সাথে আড্ডা’ নামক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বসুন্ধরার একটি স্কুলে। তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক মুন্নী সাহা। হিলারি যতক্ষণ বাংলাদেশে ছিলেন, মনে হচ্ছিল সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরে কালবৈশাখের অবিরাম বর্ষণ আর বজ্রপাত শুরু হলো। আজও বুঝতে পারলাম না কারণটা কি? তবে অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ মনে হয় দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লাঞ্চ বা ডিনারে না বসে বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে ডিনার খাওয়াটা একটা কারণ। প্রধানমন্ত্রীকে অবহেলা করেছেন মর্মে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতীয়মান হয়ে থাকতে পারে। তবে এ বিষয় নিয়ে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এখনও তেমন কিছু বলছে না। তা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার চার মন্ত্রী ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ মর্মে এমন আচরণ না করলেও পারতেন?
হিলারি বেগম খালেদা জিয়ার মেহমান হয়ে বাংলাদেশে আসেননি। ড. ইউনূস বা স্যার আবেদও দাওয়াত দেননি। মুন্নী সাহা তো দাওয়াত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে হিলারি এলেন কীভাবে এদেশে? নিশ্চয় ব্যবস্থা তো সরকারেরই করার কথা, করেছেন কিনা জানি না। খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে দিলেন সরকারের। কারণ হিলারির হয়তো মনে হয়েছে যাদের অনুদান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি, তাদের ওপর খরচের বোঝা চাপানো ঠিক হবে না। তাই সম্ভবত হিলারি ফুল ফ্রি ট্যুর উপহার দিয়ে গেলেন বাংলাদেশ সরকারকে। এমনকি নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পর্যন্ত আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা আর কি চাই?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে হিলারির। নানা ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। চুক্তি হয়েছে। হিলারির কাছে অনেক কিছু দাবি করেছেন। হিলারি কথাও দিয়েছেন। মোটামুটি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিটিং পুরোটাই জুড়ে ছিল প্রায় আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী সরকারের দাবি-দাওয়া। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে মনে হলো পাওয়ার আর কিছুই বাকি নেই। তাহলে হঠাত্ দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ তার ৪ মন্ত্রী হিলারি, ড. ইউনূস ও স্যার আবেদের এমন কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন কেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন সাধারণত একটু চাণক্য ধরনের মানুষ। যেমন ছিলেন পাকিস্তানের মি. ভুট্টো। যুক্তরাষ্ট্রের হিলারি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘যেটি’ আর ‘সেটি’ দিয়ে বক্তৃতা শুনলে তাকেও মনে হয় তিনিও কোনো অংশে কম কিছু নন। ইংরেজি বলা ভালো, একসেলেন্ট, তো চমত্কার বলতেই হবে। কিন্তু হিলারি এভাবে গোল দিয়ে চলে গেলেন, ধরতে পারলেন না বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তার পাণ্ডিত্য কোনো কাজেই লাগল না। এ কেমন কথা? হয়তো যা বোঝেন, তার চাইতে বলেন বেশি বলেই এমনটা হয়েছে। আবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন তার সরকার নাকি হিলারির সফরের কর্মসূচি কি কি তা জানতেই পারেননি। কোলকাতা প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, কেউ ঘোষণা দিয়েও সরকারকে অবহিত করেনি। নির্লজ্জ মানুষ দেখেছি। একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এমন নির্লজ্জ হয় এবং মূর্খের মতো কথা বলে এদেশে এই প্রথম দেখলাম বলে বিশ্বাস করছেন হয়তো মানুষ। সমাজের বিবেক ব্যারিস্টার রফিক উল হক তো বলেই দিলেন ইতিপূর্বে বিএনপি সরকারের আমলে ৬৩টি জেলায় বোমা ফাটিয়েছিল একটি জঙ্গি সংগঠন। সরকারের কোনো এজেন্সি তা ঘটানোর পূর্বে জানতে পারেনি। সরকারকে অগ্রভাগে অবহিত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট বাংলাদেশে সফরে এসে চলে গেলেন। কখন কোথায় কি করবেন তা সরকারের কোনো এজেন্সি সরকারকে অগ্রভাগে জানাতে পারল না। কি চমত্কার এদেশ, দেশের সরকার, আর দেশের সেইসব বিশেষ বিশেষ এজেন্সি। অথচ একথা বলতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এলজিআরডিমন্ত্রী মোটেও লজ্জা পেলেন না। এখন সব দোষ হলো ড. ইউনূসের আর স্যার আবেদের। বোবার মুখেও এবার কথা ফুটেছে। জনাব আশরাফ আরও বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায় না। নোবেল পেতে হলে স্যান্ডুইচ আর সাদা মদ খেতে হয় বিদেশে গিয়ে। বাবু অমর্ত্য সেন যদি এই খবর দেখে থাকেন বা পত্রিকায় পড়ে থাকেন তাহলে হয়তো কখনও এদেশে ‘মামার’ দাবি নিয়ে, মেহমান হয়ে আর আসবেন না ভবিষ্যতে। কারণ তিনিও তো অর্থনীতির লোক। প্রসঙ্গক্রমে দুই মহিলার নোবেলপ্রাপ্তির কথাও উল্লেখ করেছেন জনাব আশরাফ। আমি আসলেই এখনও বুঝতে পারলাম না যে, হিলারি বাংলাদেশে সফর করায় ড. ইউনূস বা স্যার আবেদ সরকারের কি এমন ক্ষতি করলেন? ভুল হয়তো হতে পারে তাদের। যেমন ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ হিলারির সঙ্গে আলাপকালে কেয়ারটেকার সরকারের কথা বলতে গেলেন কেন? কেন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন? কেন দলীয় সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে বসার কথা আলাপ করলেন? দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দল নির্বাচনে যাবেন না একথা বলতে গেলেন কেন? গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার তামাশা করছে, সে কথাগুলো বলার কি খুব দরকার ছিল? বরং হিলারির সফর শুধু সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সহযোগিতা করতে পারতেন দু’জনেই? এ সরকারের সময় হিলারিকে আনলেন বাংলাদেশে, আর লাভ করে নিলেন পরে পরে। এইটা একটা কথা হলো; ডা. ইউনূস ও স্যার আবেদের সরকারের কথা বা সরকারের প্রশংসা করার কথাটা এমনভাবে ভুলে যাওয়াটা বা এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হয় নাই হয়তো। সরকারের তো ক্ষ্যাপার নিশ্চয়ই এটাই একটা বড় কারণ। সরকারের কথা একবারও ভাবলেন না, ভাবলেন গিয়ে সেখানে তাদের মতো ‘হতভাগা দেশের, অকৃতজ্ঞ জনগণের কথা’। যে জনগণের চোখে বর্তমান সরকারের কোনো উন্নতিই ধরা পড়ছে না।! সেই জনগণের জন্যই কি সরকার হিলারির সফরে সম্মত হয়েছিলেন? আগে বুঝলে বাংলাদেশে আর আসা লাগতো না। কান মলে ধরে উঠতো সরকার। এটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সরকারকে এমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপর একটি গণতান্ত্রিক বন্ধুরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোকা বানিয়ে চলে যাবেন তা বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে কোনোভাবেই আমাদের সরকারের কাম্য ছিল না। ড. দীপু মনি তিনি কেন জানতে পারলেন না। সফরের সময় বাংলাদেশে হিলারি কি কি করবেন, কোথায় কোথায় যাবেন, কার কার সঙ্গে কথা বলবেন, কোথায় খাবেন আর কোথায় খাবেন না। সরকারের তত্ত্বাবধানে হিলারির এই সফর। আর কিনা সরকারই চরম অবজ্ঞার শিকার। এটা হয়তো ঠিক করেননি হিলারি। সরকার তো সে কারণে রাগ করে এত কথা বলছে।
তাছাড়া ধরে নিলাম সরকার বুঝতে পারেনি। বাংলাদেশের দুই গুণীজন ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ অন্তত সরকারের জন্য হিলারির কাছে একটু দালালি করলে খুব কি দেশের ক্ষতি হয়ে যেত? সরকারের তো তাদের ওপর এতটুকু দাবি আছে! তাই নিজের মানুষের ওপর সরকার রাগ করে একথাগুলো বলেছেন হয়তো। অর্থমন্ত্রী বলেছেন রাবিশ, আশরাফ বলেছেন সাদা মদ, আর সাদা স্যান্ডউইচ। দীলিপ বড়ুয়া বলেছেন রাজনীতিতে আসলেই পারেন। আর মতিয়া আপাও তাদের মতো করে সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সর্বদা বলতেন সুদখোরের কাছে দেশ নিরাপদ নয়। সরকারের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, হিলারি যা যা করেছেন বাংলাদেশের তা সবই ড. ইউনূস ও স্যার আবেদের কথামতোই করেছেন। তবে এটা অন্তত চেঁচামেচি থেকে প্রমাণিত যে, সরকারকে হিলারি তেমন গুরুত্ব দেন নাই, যেমনটা সরকার আশা করেছিল সফরের পূর্বে। আর তাই সরকারের পরে এত প্রতিক্রিয়া। সরকারের আচরণেই আজ এমনটা ভাবতে বাধ্য হয়েছে হয়তো দেশবাসী। বিচার-বিশ্লেষণেও এমনটাই প্রমাণিত। মনে হচ্ছে, এটাই সরকারের মনোকষ্টের সাময়িক কারণ। তাই ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ দিয়ে পার পেতে চাচ্ছে জনগণের সরকার।
এলেন ড. প্রণব মুখার্জি। ‘মামা’ তুল্য লোক। তিনিও এবার শরীরে হিলারির বাতাস লাগালেন। বেফাঁস কথা বলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিলেন। কি দরকার ছিল বলার যে, আমাদের বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নাই। বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে। ভীষণ মন খারাপ তাতেই এই সরকার আর তার মন্ত্রীদের। যেভাবে অতীতে দেখেছি। আমেরিকা আর ভারতের কোনো বড় নেতা বাংলাদেশ সফর করলে সরকারের কিছু রাজনৈতিক পুঁজি সঞ্চালন ঘটে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে হলে তো আর কথাই নাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এবার ঘটলো উল্টোটা। বোধ করি এ কারণে সরকার এতটা ঘাবড়ে গেছেন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মনে মনে হয়তো ভাবছেন কি দরকার ছিল এই সফরের? তাই হয়তো সরকারের অনেকেই বিড়বিড় করে গাইছেন ‘বন্ধু যখন আমার বাড়ির পাশ দিয়া হাঁইটা যায়, মনডা ফাইটা যায়।’ হিলারির স্বামী এ অঞ্চলে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তখন ট্যুর থেকে পাকিস্তানের নাম বাদ দেয়া হয়েছিল। কারণ ছিল পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকার তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায়। তিনি পরে অবশ্য পাকিস্তান গিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমেরিকা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। তবে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি হয় যে কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, ইচ্ছা না থাকলেও তা মেনে নিতে হয়। আমি আজও ভুলে যাই নাই ক্লিনটনের সেই বিশেষ উক্তিটি। আমেরিকার মতি-গতি বোঝা বড় কঠিন, বড়ই দুরূহ। কখন যে কি করে বসে বুঝে ওঠা বড় দায়। তাই বলতে চাই, ওদের ওপর নির্ভর করে হয়তো ক্ষমতায় থাকার দিন শেষ। আসুন এবার জনগণের কথা ভাবি, জনগণের ওপর নির্ভর করি। জনগণের দাবি মেনে নিই। ফল হয়তো খুব খারাপ হবে না। ওদের যা বলার তা কিন্তু বলে দিয়ে গেছে। বুদ্ধিমান আর ভদ্রলোকরা নাকি কিল চুরি করে। ৪ মন্ত্রী যখন নিজেদের ব্যর্থতাকে এভাবে দেশের মানুষের কাছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তুলে ধরেছেন, তখন মনে হয় এ যাবত্ যে যা বলেছেন এ সরকার সম্পর্কে তা সবই ঠিক। বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি এ সরকার হিলারি ও প্রণবের সফরকে বৈরীভাবে উপস্থাপন না করে বরং তাদের সম্পর্কে আন্তরিক মনোভাব পোষণ করতেন, তাদের প্রশংসা করলে ভালো করতেন, ফলও হয়তো ভালো হতো। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা যা করলেন তাতে সরকারের মান-ইজ্জত বোধ করি আর রক্ষার কোনো উপায় থাকল না।
শান্তিতে নোবেল পাওয়ার ঘটনাটা আশরাফ সাহেব ‘ম্যানেজড’ বলে উল্লেখ করেছেন। না হলে একজন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল না পেয়ে শান্তিতে পেলেন কেন? আশরাফ সাহেবের মতে শান্তির সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। একমাত্র যুদ্ধ থামাতে পারলেই ধরে নেয়া যায় যে, শান্তির জন্য কাজ করা হলো। আশরাফ সাহেবের বোঝা উচিত ছিল মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মানুষকে অনেক বড় যুদ্ধ করতে হয়। মানুষ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যুদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত। জীবনের এই যুদ্ধ, এই সংগ্রাম, যদি কারও কর্মের মাধ্যমে বা আদর্শের দ্বারা বা দর্শনের মাধ্যমে থেমে যায় বা অভাব জয় করে, তাহলে সেটা কি কোনো বড় যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার চাইতে ছোট কোনো ঘটনা? মনে রাখা দরকার অভাব জয় করা কোনো অংশে যুদ্ধ জয় করার চাইতে কম নয়। ড. ইউনূস মানুষকে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। স্যার আবেদ নিপীড়িত মানুষের সেবায় নিয়োজিত দেশে-বিদেশে। এ সহজ বিষয়টি আশরাফ সাহেবের বুঝতে এত কষ্ট হয় কেন? ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের মনোভাব দেখলে মনে হয় আগে নোবেল জেতার কারণে অন্যের জেতার পথ হয়তো বন্ধ করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। শুনেছি, মেহমান-ভগবান। মেহমানকে ছোট করে দেখতে হয় না। অপমান করতে হয় না। মেহমানের সেবা-যত্নের ওপরই নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষ, কে কতটা ঐতিহ্যের অধিকারী তা প্রমাণ করার। মূল কথা, যাদের ঐতিহ্য আছে তারা মেহমানকে অপমান করে না। তেমনি তারা গুণীজনেরও কদর করেন। গুণীজন মানুষের সবচাইতে বেশি আপনজন। একথা যারা ভুলে গেছেন, তারা অচিরেই অধপতিত হয়েছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, হিলারির সফর সরকার ক্যাচ করতে পারেনি। এটাতো হিলারির দোষ না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। নিজের ব্যর্থতা অপরের ওপর চাপানো ঠিক নয়। ড. ইউনূস সাহেব নোবেল জয়ী হওয়ায় আপনার সরকারের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। যেদিন নোবেল জয়ী হয়ে দেশে ফিরেছিলেন সেদিন তো গিয়ে বড় লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক তোষামোদ করেছিলেন ইউনূস সাহেবকে। সে কথা মনে করে তো তাহলে লজ্জা পাওয়ার কথা। এত তাড়াতাড়ি, এতটা নির্লজ্জের পরিচয় দেয়াটা ভালো চরিত্রের লক্ষণ নয়। গুণী মানুষকে সম্মান করা ভালো কাজ, আত্মসম্মান বেড়ে যায়। আল্লাহ সোবহান ওয়াতায়ালাও গুণী মানুষকে সম্মান করার কথা বলেছেন পবিত্র কোরআন শরীফে। তাই আসুন, সমালোচনার কালচার বন্ধ করি সবাই মিলে। আত্মসমালোচনা শুরু করি। ‘নিজেকে নিজের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত করি।’ ভালোর প্রশংসা করি। সমালোচনা করা পরিহার করি। ‘সত্যের সঙ্গে অসত্যকে সম্পৃক্ত করে সম্পূর্ণ সত্যকে অসত্যে রূপান্তর করা থেকে বিরত থাকি।’ সত্য উপলব্ধিতেই কেবল আমাদের মঙ্গল নিহিত, আসুন এ সত্য উপলব্ধি করি। এ সত্য আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার। আর তাহলে হয়তো গুনগুন করতে হবে না, ‘আমার বলার কিছু ছিল না।’ ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে।’ হিলারি কার মেহমান ছিলেন, তাও হয়তো ভুলে যেতে হবে না, আর অযথা গাল-মন্দের শিকার হবেন না ড. ইউনূস আর স্যার আবেদ।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
হিলারি বেগম খালেদা জিয়ার মেহমান হয়ে বাংলাদেশে আসেননি। ড. ইউনূস বা স্যার আবেদও দাওয়াত দেননি। মুন্নী সাহা তো দাওয়াত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে হিলারি এলেন কীভাবে এদেশে? নিশ্চয় ব্যবস্থা তো সরকারেরই করার কথা, করেছেন কিনা জানি না। খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে দিলেন সরকারের। কারণ হিলারির হয়তো মনে হয়েছে যাদের অনুদান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি, তাদের ওপর খরচের বোঝা চাপানো ঠিক হবে না। তাই সম্ভবত হিলারি ফুল ফ্রি ট্যুর উপহার দিয়ে গেলেন বাংলাদেশ সরকারকে। এমনকি নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পর্যন্ত আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা আর কি চাই?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে হিলারির। নানা ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। চুক্তি হয়েছে। হিলারির কাছে অনেক কিছু দাবি করেছেন। হিলারি কথাও দিয়েছেন। মোটামুটি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিটিং পুরোটাই জুড়ে ছিল প্রায় আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী সরকারের দাবি-দাওয়া। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে মনে হলো পাওয়ার আর কিছুই বাকি নেই। তাহলে হঠাত্ দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ তার ৪ মন্ত্রী হিলারি, ড. ইউনূস ও স্যার আবেদের এমন কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন কেন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন সাধারণত একটু চাণক্য ধরনের মানুষ। যেমন ছিলেন পাকিস্তানের মি. ভুট্টো। যুক্তরাষ্ট্রের হিলারি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘যেটি’ আর ‘সেটি’ দিয়ে বক্তৃতা শুনলে তাকেও মনে হয় তিনিও কোনো অংশে কম কিছু নন। ইংরেজি বলা ভালো, একসেলেন্ট, তো চমত্কার বলতেই হবে। কিন্তু হিলারি এভাবে গোল দিয়ে চলে গেলেন, ধরতে পারলেন না বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তার পাণ্ডিত্য কোনো কাজেই লাগল না। এ কেমন কথা? হয়তো যা বোঝেন, তার চাইতে বলেন বেশি বলেই এমনটা হয়েছে। আবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন তার সরকার নাকি হিলারির সফরের কর্মসূচি কি কি তা জানতেই পারেননি। কোলকাতা প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, কেউ ঘোষণা দিয়েও সরকারকে অবহিত করেনি। নির্লজ্জ মানুষ দেখেছি। একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এমন নির্লজ্জ হয় এবং মূর্খের মতো কথা বলে এদেশে এই প্রথম দেখলাম বলে বিশ্বাস করছেন হয়তো মানুষ। সমাজের বিবেক ব্যারিস্টার রফিক উল হক তো বলেই দিলেন ইতিপূর্বে বিএনপি সরকারের আমলে ৬৩টি জেলায় বোমা ফাটিয়েছিল একটি জঙ্গি সংগঠন। সরকারের কোনো এজেন্সি তা ঘটানোর পূর্বে জানতে পারেনি। সরকারকে অগ্রভাগে অবহিত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট বাংলাদেশে সফরে এসে চলে গেলেন। কখন কোথায় কি করবেন তা সরকারের কোনো এজেন্সি সরকারকে অগ্রভাগে জানাতে পারল না। কি চমত্কার এদেশ, দেশের সরকার, আর দেশের সেইসব বিশেষ বিশেষ এজেন্সি। অথচ একথা বলতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এলজিআরডিমন্ত্রী মোটেও লজ্জা পেলেন না। এখন সব দোষ হলো ড. ইউনূসের আর স্যার আবেদের। বোবার মুখেও এবার কথা ফুটেছে। জনাব আশরাফ আরও বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায় না। নোবেল পেতে হলে স্যান্ডুইচ আর সাদা মদ খেতে হয় বিদেশে গিয়ে। বাবু অমর্ত্য সেন যদি এই খবর দেখে থাকেন বা পত্রিকায় পড়ে থাকেন তাহলে হয়তো কখনও এদেশে ‘মামার’ দাবি নিয়ে, মেহমান হয়ে আর আসবেন না ভবিষ্যতে। কারণ তিনিও তো অর্থনীতির লোক। প্রসঙ্গক্রমে দুই মহিলার নোবেলপ্রাপ্তির কথাও উল্লেখ করেছেন জনাব আশরাফ। আমি আসলেই এখনও বুঝতে পারলাম না যে, হিলারি বাংলাদেশে সফর করায় ড. ইউনূস বা স্যার আবেদ সরকারের কি এমন ক্ষতি করলেন? ভুল হয়তো হতে পারে তাদের। যেমন ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ হিলারির সঙ্গে আলাপকালে কেয়ারটেকার সরকারের কথা বলতে গেলেন কেন? কেন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন? কেন দলীয় সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে বসার কথা আলাপ করলেন? দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দল নির্বাচনে যাবেন না একথা বলতে গেলেন কেন? গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার তামাশা করছে, সে কথাগুলো বলার কি খুব দরকার ছিল? বরং হিলারির সফর শুধু সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সহযোগিতা করতে পারতেন দু’জনেই? এ সরকারের সময় হিলারিকে আনলেন বাংলাদেশে, আর লাভ করে নিলেন পরে পরে। এইটা একটা কথা হলো; ডা. ইউনূস ও স্যার আবেদের সরকারের কথা বা সরকারের প্রশংসা করার কথাটা এমনভাবে ভুলে যাওয়াটা বা এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হয় নাই হয়তো। সরকারের তো ক্ষ্যাপার নিশ্চয়ই এটাই একটা বড় কারণ। সরকারের কথা একবারও ভাবলেন না, ভাবলেন গিয়ে সেখানে তাদের মতো ‘হতভাগা দেশের, অকৃতজ্ঞ জনগণের কথা’। যে জনগণের চোখে বর্তমান সরকারের কোনো উন্নতিই ধরা পড়ছে না।! সেই জনগণের জন্যই কি সরকার হিলারির সফরে সম্মত হয়েছিলেন? আগে বুঝলে বাংলাদেশে আর আসা লাগতো না। কান মলে ধরে উঠতো সরকার। এটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সরকারকে এমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপর একটি গণতান্ত্রিক বন্ধুরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোকা বানিয়ে চলে যাবেন তা বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে কোনোভাবেই আমাদের সরকারের কাম্য ছিল না। ড. দীপু মনি তিনি কেন জানতে পারলেন না। সফরের সময় বাংলাদেশে হিলারি কি কি করবেন, কোথায় কোথায় যাবেন, কার কার সঙ্গে কথা বলবেন, কোথায় খাবেন আর কোথায় খাবেন না। সরকারের তত্ত্বাবধানে হিলারির এই সফর। আর কিনা সরকারই চরম অবজ্ঞার শিকার। এটা হয়তো ঠিক করেননি হিলারি। সরকার তো সে কারণে রাগ করে এত কথা বলছে।
তাছাড়া ধরে নিলাম সরকার বুঝতে পারেনি। বাংলাদেশের দুই গুণীজন ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ অন্তত সরকারের জন্য হিলারির কাছে একটু দালালি করলে খুব কি দেশের ক্ষতি হয়ে যেত? সরকারের তো তাদের ওপর এতটুকু দাবি আছে! তাই নিজের মানুষের ওপর সরকার রাগ করে একথাগুলো বলেছেন হয়তো। অর্থমন্ত্রী বলেছেন রাবিশ, আশরাফ বলেছেন সাদা মদ, আর সাদা স্যান্ডউইচ। দীলিপ বড়ুয়া বলেছেন রাজনীতিতে আসলেই পারেন। আর মতিয়া আপাও তাদের মতো করে সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সর্বদা বলতেন সুদখোরের কাছে দেশ নিরাপদ নয়। সরকারের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, হিলারি যা যা করেছেন বাংলাদেশের তা সবই ড. ইউনূস ও স্যার আবেদের কথামতোই করেছেন। তবে এটা অন্তত চেঁচামেচি থেকে প্রমাণিত যে, সরকারকে হিলারি তেমন গুরুত্ব দেন নাই, যেমনটা সরকার আশা করেছিল সফরের পূর্বে। আর তাই সরকারের পরে এত প্রতিক্রিয়া। সরকারের আচরণেই আজ এমনটা ভাবতে বাধ্য হয়েছে হয়তো দেশবাসী। বিচার-বিশ্লেষণেও এমনটাই প্রমাণিত। মনে হচ্ছে, এটাই সরকারের মনোকষ্টের সাময়িক কারণ। তাই ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ দিয়ে পার পেতে চাচ্ছে জনগণের সরকার।
এলেন ড. প্রণব মুখার্জি। ‘মামা’ তুল্য লোক। তিনিও এবার শরীরে হিলারির বাতাস লাগালেন। বেফাঁস কথা বলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিলেন। কি দরকার ছিল বলার যে, আমাদের বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নাই। বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে। ভীষণ মন খারাপ তাতেই এই সরকার আর তার মন্ত্রীদের। যেভাবে অতীতে দেখেছি। আমেরিকা আর ভারতের কোনো বড় নেতা বাংলাদেশ সফর করলে সরকারের কিছু রাজনৈতিক পুঁজি সঞ্চালন ঘটে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে হলে তো আর কথাই নাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এবার ঘটলো উল্টোটা। বোধ করি এ কারণে সরকার এতটা ঘাবড়ে গেছেন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মনে মনে হয়তো ভাবছেন কি দরকার ছিল এই সফরের? তাই হয়তো সরকারের অনেকেই বিড়বিড় করে গাইছেন ‘বন্ধু যখন আমার বাড়ির পাশ দিয়া হাঁইটা যায়, মনডা ফাইটা যায়।’ হিলারির স্বামী এ অঞ্চলে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তখন ট্যুর থেকে পাকিস্তানের নাম বাদ দেয়া হয়েছিল। কারণ ছিল পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকার তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায়। তিনি পরে অবশ্য পাকিস্তান গিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমেরিকা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। তবে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি হয় যে কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, ইচ্ছা না থাকলেও তা মেনে নিতে হয়। আমি আজও ভুলে যাই নাই ক্লিনটনের সেই বিশেষ উক্তিটি। আমেরিকার মতি-গতি বোঝা বড় কঠিন, বড়ই দুরূহ। কখন যে কি করে বসে বুঝে ওঠা বড় দায়। তাই বলতে চাই, ওদের ওপর নির্ভর করে হয়তো ক্ষমতায় থাকার দিন শেষ। আসুন এবার জনগণের কথা ভাবি, জনগণের ওপর নির্ভর করি। জনগণের দাবি মেনে নিই। ফল হয়তো খুব খারাপ হবে না। ওদের যা বলার তা কিন্তু বলে দিয়ে গেছে। বুদ্ধিমান আর ভদ্রলোকরা নাকি কিল চুরি করে। ৪ মন্ত্রী যখন নিজেদের ব্যর্থতাকে এভাবে দেশের মানুষের কাছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তুলে ধরেছেন, তখন মনে হয় এ যাবত্ যে যা বলেছেন এ সরকার সম্পর্কে তা সবই ঠিক। বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি এ সরকার হিলারি ও প্রণবের সফরকে বৈরীভাবে উপস্থাপন না করে বরং তাদের সম্পর্কে আন্তরিক মনোভাব পোষণ করতেন, তাদের প্রশংসা করলে ভালো করতেন, ফলও হয়তো ভালো হতো। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা যা করলেন তাতে সরকারের মান-ইজ্জত বোধ করি আর রক্ষার কোনো উপায় থাকল না।
শান্তিতে নোবেল পাওয়ার ঘটনাটা আশরাফ সাহেব ‘ম্যানেজড’ বলে উল্লেখ করেছেন। না হলে একজন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল না পেয়ে শান্তিতে পেলেন কেন? আশরাফ সাহেবের মতে শান্তির সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। একমাত্র যুদ্ধ থামাতে পারলেই ধরে নেয়া যায় যে, শান্তির জন্য কাজ করা হলো। আশরাফ সাহেবের বোঝা উচিত ছিল মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মানুষকে অনেক বড় যুদ্ধ করতে হয়। মানুষ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যুদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত। জীবনের এই যুদ্ধ, এই সংগ্রাম, যদি কারও কর্মের মাধ্যমে বা আদর্শের দ্বারা বা দর্শনের মাধ্যমে থেমে যায় বা অভাব জয় করে, তাহলে সেটা কি কোনো বড় যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার চাইতে ছোট কোনো ঘটনা? মনে রাখা দরকার অভাব জয় করা কোনো অংশে যুদ্ধ জয় করার চাইতে কম নয়। ড. ইউনূস মানুষকে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। স্যার আবেদ নিপীড়িত মানুষের সেবায় নিয়োজিত দেশে-বিদেশে। এ সহজ বিষয়টি আশরাফ সাহেবের বুঝতে এত কষ্ট হয় কেন? ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের মনোভাব দেখলে মনে হয় আগে নোবেল জেতার কারণে অন্যের জেতার পথ হয়তো বন্ধ করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। শুনেছি, মেহমান-ভগবান। মেহমানকে ছোট করে দেখতে হয় না। অপমান করতে হয় না। মেহমানের সেবা-যত্নের ওপরই নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষ, কে কতটা ঐতিহ্যের অধিকারী তা প্রমাণ করার। মূল কথা, যাদের ঐতিহ্য আছে তারা মেহমানকে অপমান করে না। তেমনি তারা গুণীজনেরও কদর করেন। গুণীজন মানুষের সবচাইতে বেশি আপনজন। একথা যারা ভুলে গেছেন, তারা অচিরেই অধপতিত হয়েছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, হিলারির সফর সরকার ক্যাচ করতে পারেনি। এটাতো হিলারির দোষ না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। নিজের ব্যর্থতা অপরের ওপর চাপানো ঠিক নয়। ড. ইউনূস সাহেব নোবেল জয়ী হওয়ায় আপনার সরকারের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। যেদিন নোবেল জয়ী হয়ে দেশে ফিরেছিলেন সেদিন তো গিয়ে বড় লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক তোষামোদ করেছিলেন ইউনূস সাহেবকে। সে কথা মনে করে তো তাহলে লজ্জা পাওয়ার কথা। এত তাড়াতাড়ি, এতটা নির্লজ্জের পরিচয় দেয়াটা ভালো চরিত্রের লক্ষণ নয়। গুণী মানুষকে সম্মান করা ভালো কাজ, আত্মসম্মান বেড়ে যায়। আল্লাহ সোবহান ওয়াতায়ালাও গুণী মানুষকে সম্মান করার কথা বলেছেন পবিত্র কোরআন শরীফে। তাই আসুন, সমালোচনার কালচার বন্ধ করি সবাই মিলে। আত্মসমালোচনা শুরু করি। ‘নিজেকে নিজের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত করি।’ ভালোর প্রশংসা করি। সমালোচনা করা পরিহার করি। ‘সত্যের সঙ্গে অসত্যকে সম্পৃক্ত করে সম্পূর্ণ সত্যকে অসত্যে রূপান্তর করা থেকে বিরত থাকি।’ সত্য উপলব্ধিতেই কেবল আমাদের মঙ্গল নিহিত, আসুন এ সত্য উপলব্ধি করি। এ সত্য আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার। আর তাহলে হয়তো গুনগুন করতে হবে না, ‘আমার বলার কিছু ছিল না।’ ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে।’ হিলারি কার মেহমান ছিলেন, তাও হয়তো ভুলে যেতে হবে না, আর অযথা গাল-মন্দের শিকার হবেন না ড. ইউনূস আর স্যার আবেদ।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন