এমএ নোমান
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি আলোচিত, সমালোচিত ও কলঙ্কিত দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা আজ পদত্যাগ করতে পারেন, সকাল থেকেই এ গুঞ্জন সর্বত্র। গত কয়েকদিন ধরেই বঙ্গভবনের সামনের ফাঁকা জায়গাটাই সাংবাদিকদের ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের টালমাটাল অবস্থা, রাজনৈতিক টানাপড়েন, একটি প্রধান রাজনৈতিক দল কর্তৃক বঙ্গভবনের অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা প্রভৃতি বিষয়ে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সাংবাদিকদের ব্রিফিং করছেন। কোনো কোনো টিভি চ্যানেল ওই ব্রিফিং লাইভ টেলিকাস্ট করছে।
সন্ধ্যার পর উপদেষ্টারা বের হচ্ছেন, চলেও যাচ্ছেন। অন্যদিন আমরা এগিয়ে গেলে তারা গাড়ি থামিয়ে কথা বলতেন, ওইদিন কেউ গাড়িও থামাচ্ছেন না ব্রিফিংও করছেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এলো সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে ‘নির্দলীয়’ সরকার গঠন করা হয়েছে। যাত্রা শুরু হলো ওয়ান ইলেভেন খ্যাত মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের।
১/১১-এর কুশীলব মইন উ আহমেদের ‘পটেটো ক্যাম্পেইন’ কেউ ভুলবে না। আলুকে ভাতের বিকল্প খাবার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য দেশের সব বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধানদের একত্র করে কত শত বিজ্ঞাপন যে তিনি তৈরি করেছিলেন আর নামিদামি সব শিল্পীকে দিয়ে আলু বাজারজাত করার গান তৈরি করেছিলেন তার হিসাব কষা মুশলিক। হোটেল রেডিসনে অনুষ্ঠিত আলুবিষয়ক এক প্রচারণায় মুন্সীগঞ্জের আলু উত্পাদনকারী কয়েকজন কৃষক এসে ‘আলু আর মইন উ আহমেদ’র স্মৃতিচারণ করেছেন। মূলত ওই থেকেই মইন উ আহমেদ হয়ে যান ‘আলু মইন’।
ওয়ান ইলেভেন সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশকেই কারান্তরীণ হতে হয়েছে। ‘আগে গ্রেফতার, পরে মামলা’—এই নীতিই ছিল ১/১১ সরকারের মূলনীতি। শীর্ষ নেতানেত্রীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে একবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিন বলেছিলেন, ‘আমরা পুঁটি মাছের ব্যবসা করব না। রুই কাতলার ব্যবসাই করতে চাই। আমরা যে জাল পেতেছি তাতে শুধু রুই-কাতলাই ধরা পড়বে।’ আদালতবিষয়ক রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে যতটুকু জেনেছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো নাগরিককে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, কাউকে বিন্দুমাত্র হয়রানি করাও সংবিধানের লঙ্ঘন।
আমার জানা মতে, আগে গ্রেফতার পরে মামলা বা অভিযোগ দায়েরের ঘটনা মূলত ১/১১ সরকারের আমলেই শুরু হয়। আজকের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও ঘুষ গ্রহণ ইত্যাদি অপরাধের অভিযোগ এনে একটি কিংবা দু’টি নয়, এক ডজনের উপরে মামলা করা হয়। এসব মামলায় নেত্রীকে জড়িয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে নেতারা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা আবার সিডি করে প্রচারও করা হয়েছে। এসব নেতানেত্রীকে বিচারের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে বিশেষ আদালতও গঠন করা হয়েছিল। ওইসব আদালতে বিচারের জন্য কাউকে হাজির করা হলেই শুনানিতে সাক্ষী কিংবা আইনজীবীরা যা-ই বলেন না কেন, আসামির (৮+৫) ১৩ বছরের জেল। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সম্প্রতি এক টিভি টকশোতে বলেছেন, ‘মইন উ আহমদ ও ফখরুদ্দীন কাপুরুষ। সাহস থাকলে তারা দেশে আসুক। তাদের বিচার একদিন এ বাংলার মাটিতে হবেই।’
বিরোধী দলের নামে মামলা দায়ের ও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়ে বর্তমান সরকারও ১/১১’র সরকারের দেখানো সেই চেনা পথেই হাঁটছে। বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের কাঁধে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ১/১১-এর সরকারের ভূত চেপে বসেছে। অদ্ভুত ওই সরকারের পথেই হাঁটছে এ সরকার। যেসব অভিযোগে বিরোধী দলের নেতাদের নামে মামলা দেয়া হচ্ছে, তা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, পাগলামিও বটে। সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ তো দূরের কথা, দেশের কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না যে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী জোটের এতগুলো নেতা একসঙ্গে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সংরক্ষিত এলাকায় বাস পোড়াতে যাবেন কিংবা সচিবালয়ে ককটেল নিক্ষেপ করতে যাবেন। আমরা আসলেই বেকুবের দেশে বাস করছি। মূলত শেয়ারবাজারের ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, দলীয় সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্হীন দেশ সব মিলিয়ে প্রচণ্ড জন-অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে নাকাল অবস্থায় সরকার বিরোধী দল দমনেই সাফল্য পেতে চায়। বেশ কয়েক বছর আগে একজন প্রবীণ সাংবাদিকের কাছে একদলীয় বাকশাল সরকারের আচরণ ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তোমরা তো তরুণ প্রজন্মের নাগরিক। বাকশাল কী ছিল? এটা বইপুস্তক পড়েও বুঝতে পারবে না। এটা বুঝিয়ে বলার মতো নয়। কয়েকদিন আগে তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, বাকশাল কী ছিল এখন বুঝতে পারছ তো? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, আমরা উন্মাদের শাসনের কবলে পড়েছি। দেশ আবারও একদলীয় স্বৈরাচারী বাকশালী শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, সরকারের জনপ্রিয়তায় যখন ধ্বস নামে ও পায়ের তলার নিচের মাটি সরে যায়, তখনই সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণ করে এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালায়।
লেখক : সাংবাদিক
nomansalimbd@yahoo.com
সন্ধ্যার পর উপদেষ্টারা বের হচ্ছেন, চলেও যাচ্ছেন। অন্যদিন আমরা এগিয়ে গেলে তারা গাড়ি থামিয়ে কথা বলতেন, ওইদিন কেউ গাড়িও থামাচ্ছেন না ব্রিফিংও করছেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এলো সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে ‘নির্দলীয়’ সরকার গঠন করা হয়েছে। যাত্রা শুরু হলো ওয়ান ইলেভেন খ্যাত মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের।
১/১১-এর কুশীলব মইন উ আহমেদের ‘পটেটো ক্যাম্পেইন’ কেউ ভুলবে না। আলুকে ভাতের বিকল্প খাবার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য দেশের সব বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধানদের একত্র করে কত শত বিজ্ঞাপন যে তিনি তৈরি করেছিলেন আর নামিদামি সব শিল্পীকে দিয়ে আলু বাজারজাত করার গান তৈরি করেছিলেন তার হিসাব কষা মুশলিক। হোটেল রেডিসনে অনুষ্ঠিত আলুবিষয়ক এক প্রচারণায় মুন্সীগঞ্জের আলু উত্পাদনকারী কয়েকজন কৃষক এসে ‘আলু আর মইন উ আহমেদ’র স্মৃতিচারণ করেছেন। মূলত ওই থেকেই মইন উ আহমেদ হয়ে যান ‘আলু মইন’।
ওয়ান ইলেভেন সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশকেই কারান্তরীণ হতে হয়েছে। ‘আগে গ্রেফতার, পরে মামলা’—এই নীতিই ছিল ১/১১ সরকারের মূলনীতি। শীর্ষ নেতানেত্রীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে একবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিন বলেছিলেন, ‘আমরা পুঁটি মাছের ব্যবসা করব না। রুই কাতলার ব্যবসাই করতে চাই। আমরা যে জাল পেতেছি তাতে শুধু রুই-কাতলাই ধরা পড়বে।’ আদালতবিষয়ক রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে যতটুকু জেনেছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো নাগরিককে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, কাউকে বিন্দুমাত্র হয়রানি করাও সংবিধানের লঙ্ঘন।
আমার জানা মতে, আগে গ্রেফতার পরে মামলা বা অভিযোগ দায়েরের ঘটনা মূলত ১/১১ সরকারের আমলেই শুরু হয়। আজকের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও ঘুষ গ্রহণ ইত্যাদি অপরাধের অভিযোগ এনে একটি কিংবা দু’টি নয়, এক ডজনের উপরে মামলা করা হয়। এসব মামলায় নেত্রীকে জড়িয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে নেতারা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা আবার সিডি করে প্রচারও করা হয়েছে। এসব নেতানেত্রীকে বিচারের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে বিশেষ আদালতও গঠন করা হয়েছিল। ওইসব আদালতে বিচারের জন্য কাউকে হাজির করা হলেই শুনানিতে সাক্ষী কিংবা আইনজীবীরা যা-ই বলেন না কেন, আসামির (৮+৫) ১৩ বছরের জেল। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল সম্প্রতি এক টিভি টকশোতে বলেছেন, ‘মইন উ আহমদ ও ফখরুদ্দীন কাপুরুষ। সাহস থাকলে তারা দেশে আসুক। তাদের বিচার একদিন এ বাংলার মাটিতে হবেই।’
বিরোধী দলের নামে মামলা দায়ের ও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়ে বর্তমান সরকারও ১/১১’র সরকারের দেখানো সেই চেনা পথেই হাঁটছে। বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের কাঁধে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ১/১১-এর সরকারের ভূত চেপে বসেছে। অদ্ভুত ওই সরকারের পথেই হাঁটছে এ সরকার। যেসব অভিযোগে বিরোধী দলের নেতাদের নামে মামলা দেয়া হচ্ছে, তা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, পাগলামিও বটে। সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ তো দূরের কথা, দেশের কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না যে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী জোটের এতগুলো নেতা একসঙ্গে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সংরক্ষিত এলাকায় বাস পোড়াতে যাবেন কিংবা সচিবালয়ে ককটেল নিক্ষেপ করতে যাবেন। আমরা আসলেই বেকুবের দেশে বাস করছি। মূলত শেয়ারবাজারের ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, দলীয় সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্হীন দেশ সব মিলিয়ে প্রচণ্ড জন-অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে নাকাল অবস্থায় সরকার বিরোধী দল দমনেই সাফল্য পেতে চায়। বেশ কয়েক বছর আগে একজন প্রবীণ সাংবাদিকের কাছে একদলীয় বাকশাল সরকারের আচরণ ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তোমরা তো তরুণ প্রজন্মের নাগরিক। বাকশাল কী ছিল? এটা বইপুস্তক পড়েও বুঝতে পারবে না। এটা বুঝিয়ে বলার মতো নয়। কয়েকদিন আগে তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, বাকশাল কী ছিল এখন বুঝতে পারছ তো? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, আমরা উন্মাদের শাসনের কবলে পড়েছি। দেশ আবারও একদলীয় স্বৈরাচারী বাকশালী শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, সরকারের জনপ্রিয়তায় যখন ধ্বস নামে ও পায়ের তলার নিচের মাটি সরে যায়, তখনই সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণ করে এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালায়।
লেখক : সাংবাদিক
nomansalimbd@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন