রবিবার, ২০ মে, ২০১২

ভারতের সাথে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধন ও আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব


মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
ভারত সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখার্জি ৬ মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্যের কিছু কথা বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষিত হওয়া জরুরি । ঢাকার প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তার বক্তব্যের কিছু অংশ ছিল এমন ‘‘বাংলাদেশে আসা তার জন্য আনন্দের। একজন বাঙালি হিসেবে এখানে এসে তিনি মনে করেন, নিজেদের মধ্যেই এসেছেন। এটি সত্যিই একটি সুন্দর ঘরে ফেরার মতো অভিজ্ঞতা।... সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হলেও বাংলাদেশ ও ভারত অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রীতি, মূল্যবোধ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ।’’
প্রণব মুখার্জি আবেগাপ্লুত হয়েই একথাগুলো বলেছেন, এমনটি বলব না, আবার এসব উক্তিকে আন্তরিক হিসেবে মেনে নেয়ারও সুযোগ নেই, যেহেতু এসব উক্তি বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং ইতিহাস ও দলিলপত্রের পরিপন্থী। তার এসব বক্তব্যের অনুকূলে কোন যুক্তি-প্রমাণ নেই। ‘‘বাংলাদেশে আসা তার জন্য আনন্দের। একজন বাঙালি হিসেবে এখানে এসে তিনি মনে করেন, নিজেদের মধ্যেই এসেছেন। এটি সত্যিই একটি সুন্দর ঘরে ফেরার মতো অভিজ্ঞতা,’’ এ কথাগুলো আন্তরিক হতো যদি তিনি বাংলাদেশের প্রতি সামান্য আনুকূল্য না দেখিয়ে কেবলমাত্র বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারগুলো প্রদানে সামান্যও আন্তরিক হতেন। তার এসব কথার সাথে তাদের কাজের মিল সামান্যই। তিনি/তারা যখন যা বলেন, বাস্তবে তার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আমাদের সরকার জ্যোতিবসু, প্রণব মুখার্জি, মমতাদের কাছে বার বার ধর্ণা দিয়ে এবং কাকা, দাদা, দিদি ডেকে বাংলাদেশের জন্য সামান্য সহানুভূতি পেয়েছেন  এমন কোন প্রমাণ নেই। তারা শুধু আশ্বাসের গন্ডিতে আমাদের বন্দী রেখেছেন, যেগুলো একান্তভাবেই বায়বীয়, কখনোই বাস্তবায়িত হয় না । গত ৪১ বছরে আমরা হাজার হাজার আশ্বাস শুনেছি, কিন্তু কোনটির ন্যায্য বাস্তবায়ন হয়নি। সাতপাঁকে বন্দী হতে রাজি হলেই চুক্তি নামক ব্যবস্থায় তারা সম্মত হন, যেগুলোর মাধ্যমে আমরাই আমাদের স্বার্থ তাদের হাতে তুলে দেই। এভাবে তারা সব সময়ই তাদের অমূলক স্বার্থ-সুবিধা বজায় রেখে তাদের ইচ্ছে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। বিপদের বন্ধু ভারত এখন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য ক্ষুধাতুর ব্যঘ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারত কোন ক্ষেত্রেই আমাদেরকে ছাড় দেয়া তো দূরের কথা, আমাদের ন্যায্য অধিকারও মেনে নিচ্ছে না। আমাদের অস্তিত্বের শরীরে হাজারো কাঁটাবিদ্ধ করার পরেও এরা বলেন, আমরা নাকি ভারতের সাথে ‘‘উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ।’’ সেটা কেমন ভবিষ্যত? এটা কি অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার চক্রান্তের জালে আমাদেরকে বেঁধে ফেলার ইঙ্গিত? পলাশী যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার যে চক্রান্ত জগৎশেঠ উমিচাঁদরা শুরু করেছিলেন, প্রণব মুখার্জিরা আজো সেখানে রয়েছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ৬ মে তার বক্তব্যে সে মহাচক্রান্তের কথাই কেবল ভিন্ন ভাষায় বেরিয়ে এসেছে।
ভারতের সাথে আমাদের ভবিষ্যত প্রত্যাশা তো কোনভাবেই এক হতে পারে না, অন্তত  সুদূর অতীত তো দূরের কথা, নিকট অতীতও তেমন সাক্ষ্য দেয় না। এমনকি '৭১ সালের পরবর্তী ঘটনাবলী পলাশী-পরবর্তী শোষণ অপমানের ধারাবাহিকতামাত্র। তখন আমরা পরাধীন ছিলাম আর প্রণব মুখার্জিদের পূর্বসূরীরা দখলদার ব্রিটিশদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আমাদের পূর্বসূরীদেরকে পদতলে রেখেছিল। এখন আমরা স্বাধীন হলেও গত ৪১ বছরে ভারতের কর্মকান্ডে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত বাস্তবে আমাদের দেশকে অন্তত ভারতের ছায়ারাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন থাকার জন্য '৭১ সালে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।  ভারত মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও বাস্তবে প্রভূত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ । অন্যদিকে ভারত যদি একেবারে খাঁটি বন্ধুভাবাপন্নও হতো  তা'হলেও দুটো স্বাধীন দেশের  ভবিষ্যৎ ও প্রত্যাশা কোনদিনই এক হতে পারে না। যদি তেমনটি হয় তবে দুটো দেশ পৃথক থাকার প্রয়োজন হয় না। ইউরোপের, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক  সহযোগিতা ও গভীর বন্ধুত্বের প্রতীক। কিন্তু কোন দেশই মনে করে না, তাদের সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা এক ও অভিন্ন, একই বন্ধনে আবদ্ধ। ভারতের সাথে আমাদের দূরত্ব কেবল ভিন্ন সীমান্তই নয়, অন্তর থেকেই আমরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন  -  ভারতই বার বার তা  প্রমাণ করেছে। আন্তরিক দূরত্বের সীমান্ত ভৌগোলিক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। কবে কাঁটাতারের পরিবর্তে ফিলিস্তিন-ইসরাইলী সীমান্তের মতো কংক্রিটের দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে যায়,  এখন তা-ই দেখার বিষয়।  
তারা যে বাস্তব অর্থে কোনভাবেই আমাদের শুভাকাক্মখী নন, তা'তো তারাই প্রমাণ করেছেন। পলাশী যুদ্ধের অনুঘটকদের কথা বাদ দিলেও ইতিহাসের কোন অধ্যায়েই তারা পূর্ব-বাংলার অবহেলিত অধিবাসী আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিলেন না। কারণ আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন মুসলমান। এ মুসলমানদের সামান্যতম সুবিধাও মুখার্জিদের পূর্বসুরীরা সইতে পারেননি। তাদের এবং আমাদের প্রত্যাশা যে এক নয়, তা বহুবার প্রমাণ হয়েছে। শহীদ তিতুমীরের জমিদারদের নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন দমাতে ভারতীয় নেতাদের পূর্বসূরীরা ইংরেজদের সহযোগিতা নেয়। এতে হিন্দু জমিদার তথা শোষকদের অত্যাচার ও শোষণ বিজয়ী হয় তিতুমীরদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে। সিপাহী বিদ্রোহে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিশ্চিত পরাজয়কে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত জমিদার শ্রেণী তাদের পরাজয় এবং মুসলমানদের বিজয় হিসেবে বিবেচনা করে ঐ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের ধরে ধরে এনে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। আর তাদেরকে গুলী করে কিংবা ভিক্টোরিয়া পার্কসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে সারা ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত ও প্রলম্বিত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে হিন্দুরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনে নেমেছে, এমন নজির নেই বললেই চলে। আর বঙ্গভঙ্গের পর ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল মুসলিম বিরোধিতা থেকে, মুসলমানরা ঐ বিভক্তির ফলে উপকৃত হচ্ছে দেখে।  ঢাকায় রাজধানী করে পূর্ব বাংলা-আসাম প্রদেশ হলে পূর্ব বাংলার অবহেলিত খেটে-খাওয়া মুটে মজুরদের সন্তানরা একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং হিন্দু স্বার্থ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এ ভাবনা থেকেই  বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় এবং সারা ভারতের হিন্দুরা, এমনকি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে  পরিচিত কংগ্রেস পর্যন্ত ঐ আন্দোলনকে সমর্থন করে। বাংলা তাদের মায়ের মতো, বাংলাকে বিভক্ত করা মানে মাকে বিভক্ত করা, এ শ্লোগানকে ব্যবহার করে রচিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।' ঐ আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়, বাংলার বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা হিন্দুদের হাতে আক্রান্ত ও লাঞ্চিত হয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলা-আসাম প্রদেশ বিলুপ্ত করলে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এরপরই ব্রিটিশ সরকার যেসব পদক্ষেপ নেয়, তা' বাংলার জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সারা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লীতে নিয়ে যায়। বাংলাকে চার ভাগে ভাগ করে বিহার, উড়িষ্যা, বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়। রবি ঠাকুরসহ কোন হিন্দু বাংলার এমন ক্ষতি ও বিভক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' এমন ধ্বনি গড়ের মাঠে শোনা যায়নি, রাখি বন্ধন, অরন্ধন দিবস পালিত হয়নি। কারণ ঐ বিভক্তির ফলে বাংলার ক্ষতি হলেও মুসলমানদের লাভ হয়নি।
১৯০৫ সালে যে বাঙালী হিন্দু ঐক্যবদ্ধ বাংলার জন্য আন্দোলন করেন ১৯৪৭ সালে তারাই বাংলা বিভক্তির  জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎবসু, আবুল হাশেমসহ তৎকালীন বাংলার হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান'এর বাইরে স্বাধীন সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে  তোলেন। এমনকি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা না করার ঘোষণা দেন। কিন্তু হিন্দুদের বিরোধিতার কারণে তা ব্যর্থ হয়। তৎকালীন বাংলা আইন পরিষদে এ নিয়ে ভোটাভুটি হলে মুসলমান সদস্যরা অবিভক্ত বাংলার পক্ষে আর হিন্দু সদস্যরা  বাংলা বিভক্তির পক্ষে ভোট দেন। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলায় মুসলমানরা সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ  (১০৬:১০০) হওয়ার কারণে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এমন আশংকা থেকেই হিন্দুরা বাংলা বিভক্তির পক্ষে চলে যায়। এমনকি গান্ধী-নেহেরু দুজনই এর তীব্র বিরোধিতা করলেন। নেহেরু আরো একধাপ এগিয়ে পূর্বশর্ত জুড়ে দিলেন যে, উপমহাদেশ ভাগ করতে হলে  পাঞ্জাব ও বাংলাকেও ভাগ করতে হবে । তাহলে পাঞ্জাব ও বাংলার যেসব অঞ্চল পাকিস্তানে যোগ দেবে সেগুলো অচিরেই ভারতে ফিরে আসবে।
১৯৭১ সনে ভারত সে লক্ষ্য নিয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল। ভারতের বিশ্বাস ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ তাৎক্ষণিত ভারতের অঙ্গীভূত না হলেও কালক্রমে অঙ্গীভূত করার লক্ষ্যে ভারতের ছায়ারাষ্ট্র হিসেবে পতাকা ও নামসর্বস্ব সরকার নিয়ে টিকে থাকতে দেয়া হবে, যেখানে ভারতীয় সৈন্য  থাকবে এবং এর প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও বহির্বাণিজ্য ভারতের মাধ্যমে সম্পন্ন  হবে, যেমনটি ভুটানের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ভারত সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে বার বার হোঁচট খেয়ে মঈন গংদের সহযোগিতায় অনুকূল আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় প্রণব মুখার্জিরা এখন ফুরফুরে মেজাজে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মিডিয়া হাউস, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বদের একাংশকে হাত করে বিভিন্ন বাহানায় অবিরাম ফরমায়েসী সাংস্কৃতিক আক্রমণ চালানোর প্রেক্ষাপটে প্রণবদের মনে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, বাংলাদেশ তাদের স্বপ্নের অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এবং এ প্রবাহকে ধরে রাখতে হবে। আর ধরে রাখার জন্য যতো ধরনের প্রলোভন, আশ্বাস, মিথ্যাচার, ধমক, এমনকি শক্তি প্রয়োগ দরকার তার কোনটা করতেই তারা পিছপা হবেন না। তাই হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন, ‘‘ সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হলেও বাংলাদেশ ও ভারত অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রীতি, মূল্যবোধ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ।’’ অথচ এগুলোতো মীমাংসিত  বিষয়। এগুলো এক নয় বলেই তো, বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫-১১) বাতিল করতে ব্রিটিশদের বাধ্য করা হয়েছে। ১৯৪৭ সনে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সুযোগ উপেক্ষা করে মহাভারতের মহাসাগরে বাঙালিত্ব লীন করে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে গত ৪১ বছরে একদিনের জন্য সুখে-শান্তিতে থাকতে দেয়া হয়নি। ট্রানজিটের নামে নয়টি পয়েন্টে বাংলাদেশের হৃদয়ে ছিদ্র করা হয়েছে। পুরো সীমান্তে বেড়া দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সবগুলো নদীর পানি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে, গুপ্তহত্যা, গুম, অগ্নি-সংযোগ, গাড়ি ভাঙ্চুর, ককটেল-বোমা নিক্ষেপ, সন্ত্রাসী লালন, সীমান্ত হামলা, একতরফা বাণিজ্যসহ হাজারো সমস্যা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এতো সব বৈরি নজির সামনে থাকা সত্ত্বেও  কিভাবে প্রণব মুখার্জিরা আমাদেরকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান ? যেকোন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিতো বটেই, এমনকি বিবেক-সম্পন্ন বিদেশিদের কাছেও এমন ভবিষ্যৎ চরম ভাওতা, মিথ্যাচার ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই বলে মনে হয় না । 
চাপিয়ে দেয়া সমস্যা সত্ত্বেও এখন আমরা স্বাধীন জাতি। আগের তুলনায় - ভারতীয়দের তুলনায় অনেক ভাল আছি। আমাদের এ সুখ জগতশেঠ, উমিচাঁদ, রাজভল্লবদের উত্তরসূরিদের সহ্য হয় না, তাই নতুন প্রজন্মকে শোনানো হচ্ছে তাদের ও আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রীতি, মূল্যবোধ নাকি অভিন্ন । অথচ  প্রণব মুখার্জিরা ভালো করেই জানেন আমরা কেবল সীমান্ত দ্বারাই বিভক্ত নই, সর্ববিষয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছি। আর সে প্রমাণ প্রণব  মুখার্জি ৬ মে নিজেই দিয়ে গেলেন। সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় শেষে তিনি দুহাত জোড় করে কুর্নিশ করে আর মুখে ‘নমস্কার' বলে বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোন সংস্কৃতির অনুসারী। এটাতো বাঙালী সংস্কৃতি নয়, এটা সারা ভারতের হিন্দুদের সংস্কৃতি। সুতরাং এটা হিন্দু বাঙালিদের সংস্কৃতি হতে পারে, মুসলমান বাঙালিদের নয়। অমুসলিম ভারতীয় নেতারা মারা গেলে মুখে আগুন দেয়া হবে, মৃতদেহ দাহ করা হবে। আমাদের কবর দেয়া হয়। তারা বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাসী মূর্তিপূজারী। আমরা এক আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী এবং মূর্তিপূজার বিরোধী। এ ধরনের হাজারো পার্থক্য রয়েছে, যেগুলোকে কোনভাবেই একত্রিত করা যায় না, যাবে না।
আর স্বার্থের ব্যাপারে প্রণব মুখার্জিরা এতো অন্ধ ও বেপরোয়া যে, তারা নিজেরটা বাদে অন্যেরটা বুঝেন না। উপমহাদেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও প্রণব মুখার্জিদের মতো সমসুযোগের দাবিদার তা তারা কখনোই স্বীকার করেননি। তাদের রক্তে ভারত বার বার রঞ্জিত হয়েছে । ভারতে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও উপজাতি-আদিবাসীরা কেমন অধিকারহীন তা বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানদের স্বার্থ-স্বপ্ন, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, এক নয় বলেইতো হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির  দাবি তুলেছিলেন, যা এক পর্যায়ে সব পক্ষই মেনে নিয়েছিল। সে আবাসভূমি গড়তে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা ব্যাপকভাবে সমর্থন যুগিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা এর গর্বিত মালিক। আমরা এর প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, সেনাবাহিনী প্রধান,  আইজি, ডিসি, উপাচার্য, শিল্পপতি, শিক্ষক, সাংবাদিক, এর ভাগ্য-নিয়ন্ত্রা। স্বাধীন স্বদেশের মালিক হবার কারণেই আমরা প্রায় এককোটি বাংলাদেশী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে  পড়ার সুযোগ পেয়েছি। হাজারো প্রতিদ্বনিদ্বতা ও চক্রান্ত সত্ত্বেও আমরা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের সমৃদ্ধি, স্বাধীন স্বদেশ অনেকেরই চক্ষুশূল। আমাদের প্রাপ্তি, ভবিষ্যত প্রত্যাশা ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ মানচিত্রের মধ্যেই নিহিত। অন্য কারো সাথে আমাদের ভাগ্যকে জড়িয়ে আমরা ক্রীতদাসের হাসি হাসতে চাই না।
বাংলাদেশ আপনাদের কোন ক্ষতি করেনি, করার ইচ্ছেও নেই। দয়া করে আমাদেরকে লেজকাটা শিয়াল বানাবেন না। '৪৭ সনে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে আপনারা বাঙালিত্বকে কবর দিয়ে ভারতের সাথে মিশেছেন, হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন, '৪৭ সনে উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও  শিল্পায়িত অঞ্চল পশ্চিম বাংলাকে ভারতের অন্যতম দরিদ্র জনপদে পরিণত  করেছেন, হিন্দির দাপটে আপনাদের ভাষা এখন পালিয়ে বেড়ায়। আর আমরা কেবল একটি স্বাধীন স্বদেশই সৃষ্টি করিনি, বাংলা ভাষাকে সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি, হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন বাংলা জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা পাবে। আপনাদের কাছ থেকে এতো শত বাধা না আসলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধিতে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যেত। আপনারা আপনাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমাদেরকেও সে পরিণতির দিকে নিয়ে যাবেন না। আমরা লেজকাটা শিয়াল হতে চাই না। সুখময় দাসত্বের চেয়ে দারিদ্র্যক্লিষ্ট স্বাধীনতা আমাদের কাছে অনেক শ্রেয়। আমাদের স্বাধীন থাকতে দিন।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক
Email: noa@agni.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন