জিবলু রহমান :
শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা দাবি করেন, শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামল ছিল বাংলাদেশের ‘স্বর্ণযুগ'। সেই স্বর্ণযুগের নমুনা কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মুজিব সরকারের প্রথম চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত ‘বলেছি বলেছি বলব' গ্রন্থে। তার ভাষায়, ‘কবি লিখলেন, ‘‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’’..... নেতা বললেন, ‘‘আমি তিন বছর কিছু দিতে পারুম না।’’ ভাল কথা সকলে মিলে যদি তিন বছর কিছু না নিতাম তাহলে একথা বলা শোভা পেতো। কিন্তু আমরা পেলাম এবং নিলাম কেবল দিলাম না। এটা কি করে হয়। এক যাত্রায় দুরকম ফল মেনে নেয়া কষ্টকর।'
যুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে শাহ মোয়াজ্জেম সবকিছু দেখে শুনে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারেননি। তাই কতকটা স্বগোক্তির মতোই নিজের কাছে নিজেই যেন প্রশ্ন করেছেন, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের আপনজন কেউ না কেউ স্বাধীনতার বলি হয়েছে-ঘরবাড়ি নিঃশেষ হয়েছে অগণিত মানুষের। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদেরকে পাকিস্তান সরকারই সুরক্ষা দিয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। মাসিক ভাতা নির্ধারণ করে খোরপোষের ব্যবস্থা করেছে এমনও শোনা গেছে। এর অর্থ কী দাঁড়ায় বোধগম্য হওয়া কঠিন। কোন অদৃশ্য জাদু বলে এসব সম্ভব হলো? সন্দেহ আর দ্বনদ্ব বাড়ছেই।'
শেখ মুজিব তার আমলে কাউকেই গণতন্ত্র চর্চা করতে দেননি। একবার রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ রাষ্ট্রীয় সফরে ভুটান যান। স্পীকার আব্দুল মালেক উকিলকে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছিল। তিনি জাতীয় সংসদে গিয়ে স্পীকারের আসনে বসে সংসদের দায়িত্ব পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে জানতে চান, স্পীকার কিভাবে সংসদে এসে অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার তখন বঙ্গভবনে থাকার কথা। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে আরো কিছু সদস্য সমর্থন জানান। আচমকা এই প্রশ্নে মন্ত্রীরা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান। ত্বরিত কোন উত্তর তাঁরা খুঁজে পাননি। আমিরুল ইসলামের সমর্থনে অন্য সদস্যরাও স্পীকারকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না নেয়ার সমালোচনা শুরু করেন। স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল বসে বসে এই বিতর্ক শুনে হঠাৎ এক পর্যায়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘হেতারা না কইল্লে আই কি ক্যু কইত্যামনি।' অর্থাৎ তারা না করলে আমি কি ক্যু করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেব? এ কাজটি ছিল কেবিনেট ডিভিশনের। এক পর্যায়ে অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। আধ ঘণ্টা পর সংসদের বৈঠক যখন পুনরায় শুরু হলো তখন অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর দাঁড়ান ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের বৈধতার প্রশ্নের জবাব দিতে। তিনি বলেন, দেশে রাষ্ট্রপতি নেই একথা ঠিক। কিন্তু তিনি বিদেশে অবস্থান করেই দেশের সব দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিয়মিত তার অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি দেশে উপস্থিত না থাকলে তিনিই রাষ্ট্রপতি। মনোরঞ্জন ধরের এই খোঁড়া যুক্তি ব্যারিষ্টার আমির-উল ইসলামরা মেনে নিতে পারেননি সেদিন। একটা গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছিল। আব্দুল মালেক উকিল তার এই দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারটা জানতেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। এভাবেই সেদিন আওয়ামী লীগ সংবিধানকে উপেক্ষা করছিল। তখন বলেছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করছে।
১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রহমান ক্ষমা ঘোষণা করে অনেক কয়েদীকে মুক্তি দিয়েছেন বলে গণভবন থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রচার করা হয়। সেদিন ঘোষণায় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অবাক হয়েছিলেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কোনো কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।' রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রদানমন্ত্রী প্রয়োগ করলেন। প্রতিষ্ঠান রক্ষার কি চমৎকার নজির।
১৯৭৪ সালের শেষ দিকে দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে শুরু করে। কঙ্কালসার মানুষে শহর ভর্তি। শোনা গেল, একটি খাদ্য শস্য ভর্তি জাহাজ মধ্য সমুদ্র থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটি আসছিলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিউবার কাছে পাট বিক্রি করার অপরাধে এটি ছিলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তি। এ সময বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত ইউনিনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। এই প্রবণতাটি শুরু হয় ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে শেখ মুজিবের চিকিৎসার পর থেকে। এ সময় তার ব্রংকাল সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসা হয় মস্কোতে। অনেক রাজনৈতিক পন্ডিতই বুঝেই উঠতে পারেনি কেন শেখ মুজিব চিকিৎসা করতে মস্কো গেলেন। তিনি চাইলে লন্ডন কিংবা আমেরিকায় চিকিৎসা করাতে পারতেন। সম্ভবত তিনি সোভিয়েতপন্থীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নানাভাবে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় এলেন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব জার্নালিষ্ট (আইওজে)- এর সেক্রেটারি জেনারেল মি. কুবকা। আইওজে ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের এর সদস্য করে মস্কোর আদর্শে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। মস্কো ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের নামে সাংবাদিকদের নিয়ে মগজ ধোলাই করা হতো। এতে কিন্তু সব সময় ফল ভালো হতো না। বরং অনেকেই উল্টো মস্কোবিরোধী হয়ে ফিরে আসতেন।
আইওজে'র সেক্রেটারি জেনারেলের ঢাকা আগমনকে মস্কোবিরোধী সাংবাদিকরা ভালো চোখে দেখেননি। তবুও সাংবাদিকরা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। কুবকা বিএফইউজে'-কে আইওজে'র কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু সাংবাদিকরা রাজি হননি। মি. কুবকা এ পদক্ষেপে বিরক্তবোধ করলেন। কারণ সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের মধ্যে সাংবাদিকদের আনতে পারলে অনেক সুবিধা হতো।
অনেকেই আজো মনে করেন, সেদিন যদি শেখ মুজিব চিকিৎসার জন্য মস্কো না গিয়ে পশ্চিমা কোনো দেশে যেতেন তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্য ও তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের ফলেই বোধ হয় বাংলাদেশকে চরম মূল্য দিতে হলো। দেশ নিক্ষিপ্ত হলো দুর্ভিক্ষের মধ্যে।
এই দুর্ভিক্ষের খবর সংবাদপত্রগুলো নির্ভয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা মানুষ মানুষের বমি খাচ্ছে এমন ছবি পেয়েছে। অনেক কাগজে ডাস্টবিন থেকে মানুষ ও কুকুর এক সঙ্গে খাবার খাচ্ছে এমন ছবি ছাপা হয়েছে। ইত্তেফাকে ছাপা হয় বাসন্তী নামে এক মহিলার ছবি, কাপড়ের অভাবে যে মাছ ধরার জাল জড়িয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করছিল। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন ছাত্র গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। সবাই ছিল আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রলীগের কর্মী। শফিউল আলম প্রধান তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। হঠাৎ একদিন তাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল ছিল এটা। দেশের যখন এই অবস্থা তখন শাসকরা দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য। হাতে নগদ অর্থ নাই যা দিয়ে খাদ্য আমদানি করে মানুষকে বাঁচানো যায়।
এমনি সময়ে সংবাদপত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকরা দেখা করতে যান। তিনি সাংবাদিকদের দেশের দুরবস্থার কথা বললেন। তিনি বললেন, জাতিসংঘ থেকে ফেরার পথে ১৯৭৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ইরাক যান। সাদ্দাম হোসেন তখন বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি শেখ মুজিবকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। সাদ্দাম ছিলেন ইরাকী বার্থ পার্টির নেতা। দলটি সোভিয়েত-ঘেঁষা ছিলো। সেদিক থেকে শেখ মুজিব সেখানে উষ্ণ সংবর্ধনা পেলেন। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, দেশের ওই দুঃসময়ে ইরাক প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়। এই ডলার না পেলে আমি খাদ্য আমদানি করতে পারতাম না। কিন্তু খাদ্য আসতে আসতে অনেক লোক মরে গেল।
১৯৭৪ সালের শেষ দিকে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বিশ্বব্যাংকের সভা থেকে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সর্বদলীয় খাদ্য কমিটি গঠন করা দরকার। তাজউদ্দিনের বক্তব্যের খবর প্রকাশের পরই তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর আগে শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাদ দেন। তাজউদ্দিনের গুরুত্ব দলের মধ্যে এবং সরকারের মধ্যে কতটা ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনিই ছিলেন প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী যিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাকে বাদ দেয়া ছিলো রাজনৈতিক মহলে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু তাও ঘটলো। এদিকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) ও মনি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে এক জোট গঠন করা হলো যা ত্রিদলীয় ঐক্যজোট বা ট্রয়কা নামে পরিচিত ছিলো। আওয়ামী লীগে যারা একটু মার্কিন-ঘেঁষা ছিলেন তারা এই জোট পছন্দ করলেন না। এই জোট গঠনের ফলে মার্কিনপন্থী বলে পরিচিত শেখ মুজিব ক্রমশই মস্কোর খপ্পরে পড়ে যান আর তারই পরিণতিতে একদলীয় শাসনের চিন্তা তার মাথায় আসে।
সোভিয়েত বিরোধী আন্তর্জাতিক মহল দুর্ভিক্ষের পর থেকে শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ করতে শুরু করে। দেশের ভেতর জাসদ, সর্বহারা পার্টি, তোহা সাহেব ও হক সাহেবের গোপন দল সরকারের ওপর প্রচন্ড মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সরকারও মরিয়া হয়ে ওঠে। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে থাকে। শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যা। সঙ্গত কারণেই শাসক দলের লোকই মারা গেল বেশি। আর বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর রক্ষীবাহিনী ও সাদা পোশাকধারীদের আক্রমণ চরম আকার ধারণ করে। গোটা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দিশেহারা শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, এর আগে আওয়ামী লীগের ভেতরেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মাত্র ১২ মিনিটে বিল পাস করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হন এবং সংসদের বারান্দায় স্টেজ বানিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ জানতেও পারেননি এই নাটকের কথা।
ইন্দিরা গান্ধী তার এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, সিআইএ-এর সঙ্গে শেখ মুজিবের যোগাযোগের কথা। বক্তৃতাটি তিনি দেন ১৯৭১ সালের ৬ নবেম্বর, নিউইয়র্কে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর নিজের ভাষায়- He is not an extremist. He was a moderate person. In fact, if I may use the term, he used to be called by some others as American stooge at one time. ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের পেপ্টেম্বর ও নবেম্বর মাসের মধ্যে অনেকগুলো বক্তৃতা দেন আমেরিকা ও ইউরোপে। তার এসব বক্তৃতা একত্র করে প্রকাশ করা হয় একটি বইতে। বইটির নাম India Speaks। প্রকাশক ভারত সরকার। সাংবাদিক Anthony Maskarenhas তার বহুল পঠিত Bangladesh A Legacy of Blood নামক বইতে দাবি করেছেন যে, মুজিব তাকে বিলেতে বলেন, "I have a big scope for you, We are going to keep some link with Pakistan but I can not say anything more till I have talked it our with the others. And for God sake don't you write anything till I tell you.
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী চাচ্ছিলেন যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করতে। কারণ, ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সে সময় ভাবছিলেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশে বাড়বে চীনপন্থীদের প্রভাব। আর তা হবে ভারতের জন্য বিশেষ ক্ষতিরই কারণ। নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদার সে সময় অবস্থান করছিলেন খুলনার কোনো এক স্থলে অথবা যশোরের মণিরামপুরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ঠিক পরপরই চারু মজুমদার ধরা পড়েন। তাকে মেরে ফেলা হয়। কোনো বিচারই তার করা হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি তার বিচার করবার।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানী হানাদাররা লড়াই করছে একটা জাতির বিরুদ্ধে এবং ফলে এ লড়াইয়ে জয় লাভ করার তাদের কোনই সম্ভাবনা নেই। হানাদারদের পতন ও উৎখাত সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই যদি পাকবাহিনীর পতন ঘটে, তাহলে বিজয়ের পর স্বভাবতই মুক্তিবাহিনীর নেতারাই হয়ে যাবেন স্বাধীন দেশের আসল নেতা। এটা বুঝতে পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নবেম্বর মাসের শেষের দিকে নয়াদিল্লী ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাদের অবস্থা বুঝিয়ে বলেন এবং ভারতীয় বাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে নামানোর জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে কাতর অনুনয় বিনয় জানাতে থাকেন। এমতাবস্থায়, ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতীয় নেতৃত্বে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং আওয়ামী নেতাদের বলেন যে, কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ভারত যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তখন তাদের আত্মাকে বন্ধক দিতে পর্যন্ত রাজি ছিলেন। তারা ৭ দফা গোপন চুক্তির মাধ্যমে ভারতের সহযোগিতা পেলেন।
যেকোন উন্মাদও বুঝেন যে, ভারতের প্রদত্ত ৭ শর্ত মেনে নিলে বাংলাদেশ আর স্বাধীন-সার্বভৌম হয় না, বাংলাদেশ পরিণত হয় ভারতের একটি দাস রাষ্ট্রে। কিন্তু, আওয়ামী নেতৃত্ব তাই-ই মেনে নেন এবং বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম কূটনৈতিক কর্মকর্তা হুমায়ুন রশীদের সামনেই ওই চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করে নেন। বলাবাহুল্য, উক্ত ৭ দফা চুক্তিনামার ৫ নং দফা অনুযায়ীই (৫. আসন্ন ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব করবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে কাজ করবে) ভারতীয় প্রধান সেনাপতি জেনারেল স্যাম মানেকশ-এর পক্ষে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাই হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, সমগ্র মুক্তিবাহিনীই হয়ে পড়ে ভারতীয় বাহিনীর অধীন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী ও সেক্টর কমান্ডারদের হাতে কোন কমান্ডই থাকে না। অন্যদের কমান্ডের তো প্রশ্নই ওঠে না।
৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা অকস্মাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৫-৬ ডিসেম্বর ভারতীয় ফৌজ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকের সকল সেক্টরে হামলা চালায়। বস্তুত ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ করেছিল মাত্র ১১/১২ দিন। মাত্র ১১/১২ দিনের এই যুদ্ধে পাকিস্তানী ফৌজ পরাজয়বরণ করেছিল এ জন্য যে, প্রায় নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আঘাতের পর আঘাত হেনে হানাদার বাহিনীকে একেবারেই বিপর্যস্ত অবস্থায় এনে ফেলেছিল।
১৯৭১ সালে প্রধানত মার্কিন চাপে ভারত বাধ্য হয় ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজী যখন রমনার ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তখন বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার খুব কাছেই অবস্থান করছিল মার্কিন সপ্তম নৌবহর। বাংলাদেশ কিভাবে স্বাধীন হতে পেরেছে, তা বুঝতে হলে এসব ঘটনার কথাও বিবেচনায় নিতে হয়। কেবলই শেখ মুজিবকে দিয়ে বুঝতে গেলে চলে না। শেখ মুজিব নিহত হবার ঠিক পরপরই চীন, সউদী আরব ও পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যে ট্যাঙ্ক বাহিনী ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটায় তার ৩০টি টি-৫৪ ট্যাঙ্ক বাংলাদেশকে উপহার দেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত। কেন তিনি ট্যাঙ্কগুলো দেন, সেটা ভাববার বিষয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত কি চাচ্ছিলেন, শেখ মুজিবের অপসারণ? ১৫ আগস্টের শিকড় ছিল বহুদূর প্রোথিত। শেখ মুজিব মুসলিম বিশ্বের কাছে একজন হেয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তাকে মুসলিম বিশ্বে কেউ বিশ্বাস করছিল না।
৭ দফা চুক্তি অনুযায়ী জেনারেল অরোরাই যেহেতু সম্মিলিত বাহিনীর একচ্ছত্র প্রধান, সেহেতু পরাজিত জেনারেল নিয়াজির জেনারেল অরোরা ব্যতীত কর্নেল ওসমানী বা অন্য কারো কাছে আত্মসমর্পণের কোন আইনগত সুযোগ ছিল না। বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতারাই ৭ দফা চুক্তির মাধ্যমে এসব ব্যাপার নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন। ওই ৭ দফা চুক্তি অনুযায়ীই ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র সেট হয়ে বসে। ভারতীয় বাহিনীকে সর্বত্র সেট করার সুবিধার্থেই বাংলাদেশ সরকারের সদস্যদের ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হয় ২২ ডিসেম্বর। বিজয়ের পরপরই ভারতীয় বাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে স্তূপীকৃত হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য, বিপুল পরিমাণ অটো মোবাইল, লোকোমোটিভ, অন্যান্য যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, অলংকারপত্র, ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বর্তমান বাজর মূল্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সামগ্রী লুটে নিয়ে যায়।
শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান বিলেতে। পিআইএ'র একটি বিশেষ বিমানে করে। কেন তিনি ভারতে না গিয়ে বিলেতে যান এবং বিলেতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন, আজো তা রহস্যময় হয়ে আছে। ভারত ধরেই নিয়েছিল, শেখ মুজিব প্রথমে আসবেন ভারতে। এরপর ভারত হয়ে যাবেন বাংলাদেশে। শেখ মুজিবের আচরণে হতবাক হয়েছিল সারা ভারতবর্ষ।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রথম জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতাকালে মুজিব উল্লেখ করেছিলেন, ‘এ সংবিধান হবে শহীদের রক্তে লিখিত জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।' তিনি সমাজতন্ত্র কায়েমে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। মুজিবের শাসনামলে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে, তবে তা সর্বজন স্বীকৃত নয় বরং দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য। মুজিবের শাসনামলে সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় লোকদের বড় বড় পদে বসিয়ে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করানো হয়। বেপরোয়া লুণ্ঠন, অপচয় ও পাচারে জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের শেষ ধাপে নামিয়ে আনা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ লুটেপুটে খেয়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলো বেআইনীভাবে দখল করে, লাইসেন্স, পারমিট বিক্রি ও হুন্ডির হিড়িক লাগিয়ে আওয়ামী-বাকশালীরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। সংবাদপত্রে শিরোনাম আসে, ‘প্রভাবশালীদের জন্য ব্ল্যাক মার্কেটারদের শাস্তি হয় না। খাদ্য-শস্য রেশনের চাল, সিগারেট ও সিমেন্ট দিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঢালাও কালোবাজারি।' (সূত্র দৈনিক গণকণ্ঠ ৪-৭-১৯৭২)
২ জুন ১৯৭২ সাপ্তাহিক হক কথা লিখেছে, ‘ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিও হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।'
স্বাধীন বাংলাদেশে নরমেধযঞ্জে শেখ মুজিবের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সিআইএ' গ্রন্থে। ঐ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের এই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিক এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।'
এর কয়েক মাস পর ১৯৭২-এর ১৮ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আদায়কৃত কয়েক লাখ টাকার শুল্ক করের সঠিক হিসাব অদ্যাবধি পাওয়া যায় নাই বলিয়া অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। প্রকাশ উত্তরাঞ্চলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে রংপুরে কর আদায়ের জন্য বহু সংখ্যক কাস্টমস অফিসার নিয়োগ করেন। এ সময় বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ পাট, চাল, মাছ ও অসংখ্য হাঁস, মুরগি, গবাদি পশু এবং ডিম ভারতে প্রেরণ করা হতো।'
‘বাংলাদেশে শ্রমিক হত্যা' শীর্ষক সংবাদে দৈনিক গণকণ্ঠ (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩) উল্লেখ করেছে, ‘বিগত ৪ ফেব্রুয়ারি বারবকুন্ডে অবস্থিত আর আর টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক হামলার খবর এখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি হিসেব মতে সেখানে নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। বেসরকারি, শ্রমিক ও অন্যান্য সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে যে, সেখানে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। সব মিলিয়ে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বিরাট।'
এ প্রসঙ্গে ফ্রন্টিআর কলকাতা : ভলিউম বি, নং-২-এ প্রকাশিত চিত্রটি হচ্ছে ‘.... রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারিতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙ্গালি যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন.... বস্তুত বাংলাদেশে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার অভাব নেই।' (ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ : আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা- ১৩৬)
‘বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা' গ্রন্থে হায়দার আকবার খান রনো লিখেছেন, ‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্তহত্যা, গুন্ডামী এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়, যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনীর ওপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হল এবং তারা তিন দিন তিন রাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নীচে অবস্থান করতে বাধ্য হল।'
আহমেদ মুসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ' গ্রন্থের উৎসর্গনামায় আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আব্দুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘.... ঐখানে আমাকে (আব্দুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বললো, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বললো তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরলো। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে।'
শেখ মুজিব কোন দিনই মস্কোপন্থী ছিলেন না। কিন্তু মস্কো ঘুরে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাকশাল গঠনের। দেশে সব রাজনৈতিক দলকে করলেন বেআইনী। মাত্র চারটি সরকারি পত্রিকা ছাড়া আর সব সংবাদপত্রকে করে দেয়া হলো বন্ধ। এটা যে ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত, সেটা স্বীকার করতে মনে হয় খুব যুক্তির প্রয়োজন হয় না। দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম, প্রায় ৫০০ সাংবাদিক শেখ মুজিবকে অভিনন্দন জানালো এই কাজের জন্য। শেখ মুজিব এর বাকশাল যদি চলতো, তবে দেশের কি অবস্থা দাঁড়াতো, তা আজ ভাবাই যায় না। যে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনি অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন, আজ তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে। আর রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা সকলেরই এখন জানা। জারদের আমলেও রাশিয়ার আর্থিক অবস্থা এত খারাপ ছিল না। এক দলের রাজত্ব দেশটাকে কার্যত দিতে পারেনি কিছুই। এরকমই একটা ভ্রান্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন এক পর্যায়ে শেখ মুজিব।
শেখ মুজিব ভুগতেন দারুণ সিদ্ধান্তহীনতায়। তার জাতীয় চেতনা স্বচ্ছ ছিল না। ছিল না তার গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা। তাই তিনি গড়তে পেরেছিলেন বাকশাল। যে জাতীয়তাবাদ শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় এনেছিল, তার যথার্থ স্বরূপ না বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলেই শেখ মুজিবকে তার বিয়োগান্তক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তাকে করে তুলেছিল বিশেষভাবে জনসমর্থনহীন। শেখ মুজিবের জাতীয় চেতনা পরিচ্ছন্ন ছিল না। থাকলে তিনি অনেক সুসংহতভাবে নেতৃত্ব প্রদানে সমর্থ হতেন।
শেখ মুজিব-এর রাজনীতি যে পথে চলেছিল, তাতে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত কার্যত রক্ষা করতে পারত না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনা, পালটে দেয় ইতিহাসের গতি। তাই বাংলাদেশ এখনও ভারতের ‘করদরাজ্যে' পরিণত হয়নি। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে চাচ্ছে একটা পূজার বিষয় করতে। আর তা ভাঙ্গিয়ে রাজনীতি করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি হন দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট, তিনি প্রেসিডেন্ট হন পরপর দু'বার। তৃতীয়বার তিনি প্রেসিডেন্ট হতে অস্বীকার করেন। নির্বাচনে দাঁড়ান না। বলেন, তিনি দেশটির রাজা হতে চান না। তার ছবি টাঙ্গাবার প্রশ্ন নেই সরকারি অফিসে। তাকে কেউ উল্লেখ করে না জাতির জনক হিসেবে। মার্কিন গণতন্ত্র যে গড়ে উঠতে পেরেছে, তার একটা কারণ সে দেশের নেতার প্রচলিত পূজা নেই।
হঠাৎ করেই বাংলাদেশে ১৫ আগস্টে একটা অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তা নয়। এর মূলে কাজ করেছিল একটা ভিন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনা, পরে যা পরিচিতি পায়, ‘বাংলাদেশী' জাতীয়তাবাদ হিসেবে। শেখ মুজিব যদি দিল্লী-মস্কো অক্ষের প্রতি অতটা ঝুঁকে না পড়তেন, তবে তার জনপ্রিয়তা অত দ্রুত তিরোহিত হতো না। যারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন তারা অত ব্যাপকভাবে জনসমর্থন পেতে পারতেন না।
‘নেতা হিসেবে শেখ মুজিব' লেখায় এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি ঢাকায় ছিলাম। সারা ঢাকা সেদিন নীরব ছিলো। সেদিন আমরা চারধারে কাউকে একফোঁটা চোখের পানিও ফেলতে দেখিনি। ১৯৭১ সালে লাখ লাখ লোক পথে নেমেছিল যার ডাকে, তারা অভ্যুত্থানে খুশিই হয়েছিল। যদিও ছিল নীরব। শেখ মুজিব হত্যার পর হতে দেখা গেল না কোন বিক্ষোভ। মানুষের ঢল নামালো না পথে। অথচ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর হাতে ক'টা অস্ত্রই বা ছিলো? মানুষ ভয় পেয়ে পথে নামেনি, এমন নয়। শেষ মুজিব নেতা হিসেবে হারিয়েছিলেন তার সাবেক আবেদন। না হলে মানুষ নামতো ঠিকই পথে। রাজশাহী ফিরে শুনেছিলাম, শেখ মুজিব-এর মৃত্যু খবর পেয়ে বহু মানুষ পথে নেমেছিলো, প্রতিবাদ করার জন্য নয়, আনন্দ করবার জন্য! রাজশাহী শহরে বেরিয়েছিল আনন্দ মিছিল অথছ এই শহরেই একদিন মানুষ পথে নেমেছিল শেখ মুজিবের ডাকে। দিয়েছিল রক্ত। মাত্র ৪ বছর গত না হতেই বিরাট এক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিলো এই শহরের মানুষের মানসিকতায়। আমার বাড়ি থেকে বেশ কাছেই এক বাড়িতে শেখ মুজিবের এক আপন ফুফাত বোনের বিয়ে হয়েছে। শেখ মুজিব রাজশাহী এলে সেই ভগ্নির বাড়িতেই উঠতেন আগে। দেখে অবাক হলাম, শেখ মুজিব-এর এই আত্মীয় বাড়িতেও কেউ শেখ মুজিবের মৃত্যু বিলাপ করছে না। বরং করছে ভিন্ন ধরনের মন্তব্য! দেশে একটা কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে, অনেকেই সেটা বেশ কিছুটা আগে থেকে অাঁচ করতে পেরেছিলো। বিখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গফফার চৌধুরী বিলাতে যাবার আগে আমাকে পরোক্ষভাবে এর একটা আভাস দিয়েছিলেন এ সম্বন্ধে। গাফফার সাহেব আওয়ামী লীগের ভেতরের অনেক কথাই জানতেন। যা হয়তো অন্য সাংবাদিকরা জানতেন না। ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ‘‘জয়বাংলা কাগজ। কাগজটা প্রকাশে যারা উদ্যোগ নেন, আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। পরে ঢাকা থেকে গিয়ে গাফফার সাহেবও যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। সে আর এক ইতিহাস। আমি ওই পত্রিকায় যতো লিখেছি, অন্য কেউ তা লিখেনি। কিন্তু সেই আমিও মত বদলে ফেলি। আমি ভীত হই ভারতীয় আধিপত্যবাদের কথা ভেবে। আমি ভীত হই ‘বাকশাল' গঠনের পরিণতির কথা চিন্তা করে.......জীবনে শেখ মুজিবকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম মাত্র একবার। তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একজন প্রফেসর দাওয়াত করেছিলেন বাড়িতে। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম নিমন্ত্রিতদের মধ্যে। তখনও ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। শেখ মুজিবের ৬ দফা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সারা দেশে। আমাদের এক অধ্যাপক শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, ‘৬ দফা আসলে কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, পাকিস্তান না ভেঙ্গে?' শেখ মুজিব এড়িয়ে যান তার প্রশ্নটিকে। বলেন ‘নির্বাচন তো আগে হোক'। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব ২৩ আগস্ট ২০০২)
আধিপত্যবাদী শক্তির ক্রীড়ণকরা ১৫ আগস্টকে হত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করছেন। যদি দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবিধান এবং স্বাধীনতার সাবভৌমত্ব রক্ষার বিবেচনায় দেখা যায় তাহলে ১৫ আগস্ট শুক্রবার যেভাবে জনগণের কাছে নাজাত দিসব রূপে প্রতিভাত হয়েছিলো, তাকে সেভাবেই দেখতে হবে। ব্যক্তির পেরিফেরির বাইরে এসে দেশ, জাতি, রাষ্ট্রের বিবেচনায় এ কথা কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, দেশে এখনও যেটুকু গণতন্ত্র, মানবাধিকার, কথা বলার অধিকার বহাল রয়েছে তা মূলত ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতা নয়? ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগালেও তাতে দাগ স্পষ্টই থেকে যায়। স্বাধীনতার পর যে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হতে পারতো, তা বহাল থাকলে আজকে হয়তো কোন কিছুই অন্তরায় বলে মনে হতো না। যারা বলেন, ১৫ আগস্ট থেকে ক্যু-এর রাজনীতি শুরু, তারা এই কথাটুকু যুক্ত করলে পুরোটা বলা হতে পারতো যে, মানুষকে নির্বিচারে গুলী করার কথিত গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট ছিলো সম্মিলিত অভ্যুত্থান। বাংলাদেশে চলার নতুন পথ নির্দেশক। সেই সাথে এ কথাও বলা অসঙ্গত নয় যে, ১৫ আগস্ট ও ৭ নবেম্বর থেকেই এদেশের মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রকৃত জাগরণ শুরু হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে এ কথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, ১৫ আগস্ট কোন ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে ঘটেনি। যা হয়েছিলো তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। আর এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মোট কথা স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ কোন না কোনভাবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের নেতৃত্ব মেনেই নিয়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে, এই সুবাদে একটি পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা, দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্রের লাল ঘোড়ার দাবড়ানি মেনে নিতে হবে। এই আবদার বড্ড বেশি মনে হয়েছিলো বলেই ১৫ আগস্টকে মধ্যবিত্ত চেতনরার এক নব উন্মেষ লগ্নও বলা যেতে পারে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন দেশ স্বাধীনের পর তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না বিধায় তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি, জেলা কমিটি, অঙ্গ-সংগঠনসমূহের কেন্দ্রীয় নেতা এবং এম.এন.এ এমপিদের একজনও মুক্তিযুদ্ধে নিহত হননি, এদের কেউ আহতও হননি। যে মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের একজনের শরীরেও ফুলের টোকা লাগেনি এটা একমাত্র ১৯৭১ সালেই সম্ভব হয়েছিলো। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে না যে, তারা প্রকৃত যুদ্ধের ত্রিসীমানাতেই ছিলেন না। প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রই আরও জানেন যে, তারা কলকাতায় বসে পরস্পরের বিরুদ্ধে কোন্দলেই লিপ্ত ছিলেন প্রায় সর্বক্ষণ। যুদ্ধটা আসলে করেছিলেন ১১টি সেক্টর কমান্ডাররা এবং তাদের সামরিক-বেসামরিক সহযোদ্ধারা। মেজর জেনারেল উবানের উদ্যোগে যে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিলো তা করা হয়েছিল মূলত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সরকারকে নার্ভাস এবং বেকায়দায় রাখার জন্য।
লেখক পরিচিতি : সদস্য সচিব, শামসুর রহমান ফাউন্ডেশন, সিলেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন