কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম
জনপ্রিয় তরুণ রাজনৈতিক নেতা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর গুমের প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা গত ২৯ এপ্রিল হরতালের রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে একটি গাড়ি পোড়ানো হয়। ওই গাড়িটি পুড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকার অধিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা দ্রুত বিচার আইনের মামলায় আমাকেসহ বেশ কিছু বিরোধী নেতাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল। আমরা পাঁচ সংসদ সদস্য গত ২৮ মে জামিনে মুক্তি পেলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশক’জন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এখনও কারান্তরীণ রয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের একসঙ্গে কারাবন্দী করার তথ্য আগে শুনিনি। তাই এ ঘটনাকে আমি পৃথিবীর ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলে অভিহিত করছি।
এ দফায় ১২ দিনের কারাজীবনে বেশকিছু নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের কারাজীবনের শুরু হয় গত ১৬ মে। ওইদিন আদালত থেকে আমাদের সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি যেহেতু সবার মধ্যে সিনিয়র, ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, ১৯৮১ সালে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করি, স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যুদ্ধের সময় সর্বপ্রথম সেপ্টেম্বর মাসে খেতাবপ্রাপ্ত অফিসার, একজন (অব.) কর্নেল, বয়স প্রায় ৭৪ বছর; সবদিক বিবেচনায় রেখে আমাকে সবচেয়ে ভালো স্থানে রাখার কথা। তাদের আমি সেভাবে অনুরোধও করেছিলাম। পুরনো ২৬ সেলটি মোটামুটি ভালো। ইবাদতের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অনরূপভাবে আমাকে নিশ্চয়তা দেয়া হলো, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পুরনো ২৬ সেলে রাখা হবে। দীর্ঘক্ষণ পর আমাদের সাবজেলারের কক্ষের ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। হঠাত্ একজন এসে বললেন, কাগজপত্রে কিছু ভুল হয়েছে। আবার বসুন। পুনরায় ওই রুমে বসলাম।
১৫/২০ মিনিট পরে হঠাত্ দেখলাম আমাদের তিন গ্রুপে ভাগ করা হলো। প্রথম গ্রুপটি হলো নন-ডিভিশন প্রাপ্ত। তাদের নাম ডাকা হলো। ভেতরে নিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় গ্রুপের নাম ডাকা হলো। সে গ্রুপে ছিল বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার এমপি, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনের নাম। তৃতীয় গ্রুপে আমি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি ও বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি। সবশেষে আমাদের ১০ নম্বর সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। যেখানে কক্ষগুলোতে মশা প্রতিরোধক নেট ছিল না। ভেনটিলেটরগুলো ছিল খোলা। ওই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন কক্ষে নন-ডিভিশনপ্রাপ্ত হাজতিরাই ছিলেন। তাদেরকে খালি করার জন্য আমাদেরকে দীর্ঘক্ষণ সাবজেলারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। ১০ নম্বর সেলে পৌঁছার পরও পরিষ্কার করার জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মশারি ও বিছানার ব্যবস্থাও করা হয় নতুনভাবে।
এসব কারণে একটু দেরিতেই রাতের খাবার পৌঁছল। প্রথম রাতে খাবার পরিবেশন করা হলো গরুর গোশতের সঙ্গে একটি ডিম ও ভাত। ওইদিন দুপুর বেলা আমরা কেউ খাবার খাইনি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একজন হিন্দু, তিনি গরুর গোশত খান না। তার পরিবারের কেউ কখনও খায়নি। ওইদিন দুপুরে ও রাতে তিনি অভুক্ত ছিলেন।
আমরা আশ্চর্য হলাম, একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে খাবার জন্য কীভাবে গরুর গোশত পরিবেশন করা হলো!
আমাদের ভবনের সামনে একটি দুর্গন্ধযুক্ত বড় নালা ছিল। সেখানে ছিল কেবল মশা-মাছির বাসস্থান। একাধিকবার অনুরোধের পর দ্বিতীয় দিনে সেটি পরিষ্কার করা হয়। বিকাল ৪টা থেকে ৯টা পর্যন্ত একাধিকবার অনুরোধের পরও ১০ নম্বর সেলে আমাদের এক কাপ চা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আমরা বলেছি, চা-বিস্কুটের মূল্য পরিশোধ করতে আমরা রাজি আছি। সবার উত্তর একটাই, ‘পাঠাচ্ছি’।
আমি সঙ্গে কোনো জিনিসপত্র নেইনি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমার ছেলে ও ছোট জামাই আমার সুটকেসটি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। তা আমি রাত ৮টায় হাতে পাই। বক্স খুলে দেখলাম আমার একটি পাউডার এবং প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবহৃত আমার গোঁফ কাটার কাঁচিটা নেই। একাধিকবার অনুরোধ করার পরও আমার এ জিনিস ফিরে পাইনি। কে নিয়েছে কেউ স্বীকার করেনি। কর্তৃপক্ষের সবাইকে অনুরোধ করার পরও অদ্যাবধি আমার জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। কাঁচিটার দাম কম হতে পারে, কিন্তু আমার ২০ বছরের পুরনো স্মৃতি।
আমার কাছে ৯ হাজার টাকা ছিল, যা আমি যথারীতি জেল কর্তৃপক্ষের হাতে জমা রাখি। ওই টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫/৬শ’ টাকার ওপরে কোনো জিনিসপত্র কেনা হয়নি। আমার একার জন্য কেনা হয়েছিল একটি প্লাস্টিকের প্লেট ও মগ। অবশিষ্ট রুমের জন্য কিছু জিনিস কেনা হয়। এসব খরচ সবার নামে সমপরিমাণে হিসাব লেখা হয়।
১৮ মে বিকেলে আমাদের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানলাম। সাড়ে তিনটার দিকে আমরা প্রস্তুতি নিলাম। সাবজেলারের রুমে ঢোকার পর আমার জমাকৃত টাকা ফেরত দিতে অনুরোধ করলাম। উত্তরে তারা জানালেন, আপনার জমাকৃত টাকা থেকে দেড় দিনে চার হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। তখন জিজ্ঞেস করলাম, ওই টাকা কে ব্যয় করল? কী কী জিনিস কেনা হলো। কোনো জিনিস কেনার বিষয়ে আমার স্বাক্ষরকৃত কোনো কাগজ আছে কি-না? কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি।
এ অবস্থায় কাশিমপুরে যারা যাচ্ছিলেন, সবাই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে খরচের হিসাব চাইলেন। সবার জমাকৃত টাকা থেকে দেড়-দুই হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে আমারটাই ছিল সর্বোচ্চ। আমি বললাম, আমার টাকা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত আমি প্রিজন ভ্যানে উঠব না।
টাকা জমা রাখার দায়িত্বে যে লোকটি ছিলেন, তাকে ডাকা হলো এবং এর জবাবদিহিতা করার জন্য বলা হলো। একবাক্যে তিনি বলে দিলেন, আপনাদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে ফেরত দেয়া হবে। অন্যরা পেয়েছিলেন কি-না জানি না, তবে আমার টাকার সঙ্গে এক হাজার টাকা যোগ করে কাশিমপুর কারাগারে সরকারিভাবে পাঠানো হয়েছে।
কাশিমপুর কারাগারে যাওয়ার পর আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, আমার স্বাক্ষরকৃত কোনো চাহিদাপত্র ছাড়া কোনো টাকা খরচ করা যাবে না। কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিল। কোনো সমস্যা হয়নি। সত্যিকার অর্থে, কাশিমপুরে বিদ্যুতের সমস্যা ছাড়া বড় কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের সঙ্গে জেল কোড অনুসারেই কর্তৃপক্ষ আচরণ করেছে। বিদ্যুত্ সঙ্কটটি ছিল প্রকট। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছে। দৈনিক ৬/৭ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুত্ থাকে না। কোনো কোনো সময় একাধারে দুই-আড়াই ঘণ্টা লোডশেডিং। গোটা কাশিমপুর জেলা রাতে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে। এটি ছিল জেল কর্তৃপক্ষ ও কারারক্ষীদের জন্য বিব্রতকর ও কঠিন সমস্যা।
আমরা জেল কর্তৃপক্ষকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অনুরূপ জেনারেটর চালানোর অনুরোধ করি। উত্তরে তারা জানান, তাদের কাছে একটি ডিজেল জেনারেটর আছে। ঘণ্টায় ৪৫ লিটার ডিজেল লাগে। তবে এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই।
কারাগারে চিকিত্সার অবস্থা আরও করুণ। দেশে ৭৭টি কারাগার রয়েছে। আর এতে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ১২ জন। তন্মধ্যে পাঁচজন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও দুইজন কাশিমপুর কারাগারের জন্য। অন্য ৭৫টি কারাগারে চিকিত্সার জন্য ডাক্তার মাত্র পাঁচজন। খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, অন্য কারাগারগুলোতে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টরাই (ফার্মাসিস্ট) চিকিত্সা দিয়ে থাকেন।
এই প্রচণ্ড গরমে সাধারণ কয়েদিদের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকে বিনা বিচারে এবং বিচার চলছে, এ ধরনের অবস্থায় কয়েক বছর কারাগারে রয়েছে।
প্রত্যেকটি নাগরিকের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশেষ করে যারা কারাভ্যন্তরে বহুদিন যাবত রয়েছেন, তাদের প্রতি সরকারের দয়ালু হতে হবে।
অনুলিখন : মাহাবুবুর রহমান
এ দফায় ১২ দিনের কারাজীবনে বেশকিছু নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের কারাজীবনের শুরু হয় গত ১৬ মে। ওইদিন আদালত থেকে আমাদের সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি যেহেতু সবার মধ্যে সিনিয়র, ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, ১৯৮১ সালে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করি, স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যুদ্ধের সময় সর্বপ্রথম সেপ্টেম্বর মাসে খেতাবপ্রাপ্ত অফিসার, একজন (অব.) কর্নেল, বয়স প্রায় ৭৪ বছর; সবদিক বিবেচনায় রেখে আমাকে সবচেয়ে ভালো স্থানে রাখার কথা। তাদের আমি সেভাবে অনুরোধও করেছিলাম। পুরনো ২৬ সেলটি মোটামুটি ভালো। ইবাদতের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অনরূপভাবে আমাকে নিশ্চয়তা দেয়া হলো, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পুরনো ২৬ সেলে রাখা হবে। দীর্ঘক্ষণ পর আমাদের সাবজেলারের কক্ষের ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। হঠাত্ একজন এসে বললেন, কাগজপত্রে কিছু ভুল হয়েছে। আবার বসুন। পুনরায় ওই রুমে বসলাম।
১৫/২০ মিনিট পরে হঠাত্ দেখলাম আমাদের তিন গ্রুপে ভাগ করা হলো। প্রথম গ্রুপটি হলো নন-ডিভিশন প্রাপ্ত। তাদের নাম ডাকা হলো। ভেতরে নিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় গ্রুপের নাম ডাকা হলো। সে গ্রুপে ছিল বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার এমপি, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনের নাম। তৃতীয় গ্রুপে আমি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি ও বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি। সবশেষে আমাদের ১০ নম্বর সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। যেখানে কক্ষগুলোতে মশা প্রতিরোধক নেট ছিল না। ভেনটিলেটরগুলো ছিল খোলা। ওই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন কক্ষে নন-ডিভিশনপ্রাপ্ত হাজতিরাই ছিলেন। তাদেরকে খালি করার জন্য আমাদেরকে দীর্ঘক্ষণ সাবজেলারের কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। ১০ নম্বর সেলে পৌঁছার পরও পরিষ্কার করার জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মশারি ও বিছানার ব্যবস্থাও করা হয় নতুনভাবে।
এসব কারণে একটু দেরিতেই রাতের খাবার পৌঁছল। প্রথম রাতে খাবার পরিবেশন করা হলো গরুর গোশতের সঙ্গে একটি ডিম ও ভাত। ওইদিন দুপুর বেলা আমরা কেউ খাবার খাইনি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একজন হিন্দু, তিনি গরুর গোশত খান না। তার পরিবারের কেউ কখনও খায়নি। ওইদিন দুপুরে ও রাতে তিনি অভুক্ত ছিলেন।
আমরা আশ্চর্য হলাম, একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে খাবার জন্য কীভাবে গরুর গোশত পরিবেশন করা হলো!
আমাদের ভবনের সামনে একটি দুর্গন্ধযুক্ত বড় নালা ছিল। সেখানে ছিল কেবল মশা-মাছির বাসস্থান। একাধিকবার অনুরোধের পর দ্বিতীয় দিনে সেটি পরিষ্কার করা হয়। বিকাল ৪টা থেকে ৯টা পর্যন্ত একাধিকবার অনুরোধের পরও ১০ নম্বর সেলে আমাদের এক কাপ চা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আমরা বলেছি, চা-বিস্কুটের মূল্য পরিশোধ করতে আমরা রাজি আছি। সবার উত্তর একটাই, ‘পাঠাচ্ছি’।
আমি সঙ্গে কোনো জিনিসপত্র নেইনি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমার ছেলে ও ছোট জামাই আমার সুটকেসটি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। তা আমি রাত ৮টায় হাতে পাই। বক্স খুলে দেখলাম আমার একটি পাউডার এবং প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবহৃত আমার গোঁফ কাটার কাঁচিটা নেই। একাধিকবার অনুরোধ করার পরও আমার এ জিনিস ফিরে পাইনি। কে নিয়েছে কেউ স্বীকার করেনি। কর্তৃপক্ষের সবাইকে অনুরোধ করার পরও অদ্যাবধি আমার জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। কাঁচিটার দাম কম হতে পারে, কিন্তু আমার ২০ বছরের পুরনো স্মৃতি।
আমার কাছে ৯ হাজার টাকা ছিল, যা আমি যথারীতি জেল কর্তৃপক্ষের হাতে জমা রাখি। ওই টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫/৬শ’ টাকার ওপরে কোনো জিনিসপত্র কেনা হয়নি। আমার একার জন্য কেনা হয়েছিল একটি প্লাস্টিকের প্লেট ও মগ। অবশিষ্ট রুমের জন্য কিছু জিনিস কেনা হয়। এসব খরচ সবার নামে সমপরিমাণে হিসাব লেখা হয়।
১৮ মে বিকেলে আমাদের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানলাম। সাড়ে তিনটার দিকে আমরা প্রস্তুতি নিলাম। সাবজেলারের রুমে ঢোকার পর আমার জমাকৃত টাকা ফেরত দিতে অনুরোধ করলাম। উত্তরে তারা জানালেন, আপনার জমাকৃত টাকা থেকে দেড় দিনে চার হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। তখন জিজ্ঞেস করলাম, ওই টাকা কে ব্যয় করল? কী কী জিনিস কেনা হলো। কোনো জিনিস কেনার বিষয়ে আমার স্বাক্ষরকৃত কোনো কাগজ আছে কি-না? কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি।
এ অবস্থায় কাশিমপুরে যারা যাচ্ছিলেন, সবাই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে খরচের হিসাব চাইলেন। সবার জমাকৃত টাকা থেকে দেড়-দুই হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে আমারটাই ছিল সর্বোচ্চ। আমি বললাম, আমার টাকা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত আমি প্রিজন ভ্যানে উঠব না।
টাকা জমা রাখার দায়িত্বে যে লোকটি ছিলেন, তাকে ডাকা হলো এবং এর জবাবদিহিতা করার জন্য বলা হলো। একবাক্যে তিনি বলে দিলেন, আপনাদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে ফেরত দেয়া হবে। অন্যরা পেয়েছিলেন কি-না জানি না, তবে আমার টাকার সঙ্গে এক হাজার টাকা যোগ করে কাশিমপুর কারাগারে সরকারিভাবে পাঠানো হয়েছে।
কাশিমপুর কারাগারে যাওয়ার পর আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, আমার স্বাক্ষরকৃত কোনো চাহিদাপত্র ছাড়া কোনো টাকা খরচ করা যাবে না। কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিল। কোনো সমস্যা হয়নি। সত্যিকার অর্থে, কাশিমপুরে বিদ্যুতের সমস্যা ছাড়া বড় কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের সঙ্গে জেল কোড অনুসারেই কর্তৃপক্ষ আচরণ করেছে। বিদ্যুত্ সঙ্কটটি ছিল প্রকট। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছে। দৈনিক ৬/৭ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুত্ থাকে না। কোনো কোনো সময় একাধারে দুই-আড়াই ঘণ্টা লোডশেডিং। গোটা কাশিমপুর জেলা রাতে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে। এটি ছিল জেল কর্তৃপক্ষ ও কারারক্ষীদের জন্য বিব্রতকর ও কঠিন সমস্যা।
আমরা জেল কর্তৃপক্ষকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অনুরূপ জেনারেটর চালানোর অনুরোধ করি। উত্তরে তারা জানান, তাদের কাছে একটি ডিজেল জেনারেটর আছে। ঘণ্টায় ৪৫ লিটার ডিজেল লাগে। তবে এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই।
কারাগারে চিকিত্সার অবস্থা আরও করুণ। দেশে ৭৭টি কারাগার রয়েছে। আর এতে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ১২ জন। তন্মধ্যে পাঁচজন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও দুইজন কাশিমপুর কারাগারের জন্য। অন্য ৭৫টি কারাগারে চিকিত্সার জন্য ডাক্তার মাত্র পাঁচজন। খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, অন্য কারাগারগুলোতে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টরাই (ফার্মাসিস্ট) চিকিত্সা দিয়ে থাকেন।
এই প্রচণ্ড গরমে সাধারণ কয়েদিদের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকে বিনা বিচারে এবং বিচার চলছে, এ ধরনের অবস্থায় কয়েক বছর কারাগারে রয়েছে।
প্রত্যেকটি নাগরিকের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশেষ করে যারা কারাভ্যন্তরে বহুদিন যাবত রয়েছেন, তাদের প্রতি সরকারের দয়ালু হতে হবে।
অনুলিখন : মাহাবুবুর রহমান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন