সাজজাদ হোসাইন খান
পুলিশ শব্দটি এসেছে পর্তুগীজ ভাষা থেকে। মূল শব্দটি ছিল পুলিটিয়া (Politea)। ইংরেজ ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজরা পুলিশ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে ১৭৩০ সালে স্কটল্যান্ডে। ‘পুলিশম্যান' শব্দটি উঠে আসে ১৮২৯ সালে। অনেকে মনে করেন ১৫৩০ সালের দিকেই প্রথম এমন একটি ধারণা জনগণের মধ্যে ব্যপ্ত ছিল। দেখা যায়, এই পুলিশ সর্বযুগেই আইনশৃক্মখলা বাহিনীরূপেই চিহ্নিত। মূলত পুলিশ শব্দটি ছয়টি সুবচনের সমাহার। সুবচনগুলো হলো এরকম- P-Polite, O-obient, L-Loyal, I-Intelligent, C-Courageous, E-Efficient. এ শব্দগুলোর বঙ্গকরণ করলে দাঁড়ায়- ভদ্র, কর্তব্যপরায়ণ (আজ্ঞাবহ), বিশ্বস্ত জ্ঞানসম্পন্ন, সাহসী এবং দক্ষ। এই শব্দ ছয়টির মাধ্যমে পুলিশের যে চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে এর কতটুকু ধারণ করে বাংলাদেশের পুলিশবাহিনী? ইদানিং পুলিশ যে চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছে-তাতে করে তো সভ্য বিশ্ব জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশের মানুষের লজ্জার সীমা পরিসীমা আর থাকছে না। তাই পুলিশ এখন আলোচনার মধ্যমণি। পত্রিকার ব্যানার হেডিং দখলে রেখেছে তারা। ছবি, কার্টুনসহ নানা ধরনের খবর থাকে পুলিশ বিষয়ক। টিভির টকশোতেও পুলিশ শব্দটির উপস্থিতি বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে ইদানিং। স্কুল-কলেজ, হাটবাজার এমনকি ঘরের গিন্নিরাও পুলিশ কালচারে ব্যস্ত। বলতে গেলে দেশ এখন পুলিশময়। পুলিশ আগেও ছিল বর্তমানেও আছে, আগামীতেও যে থাকবে না তা কিন্তু নয়। অর্থাৎ পুলিশ ‘চিরঞ্জীব'। কেবল স্বভাবে হেরফের ব্যতিত আর সব স্থিত। পুলিশ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে, এখনো হয়। তাদের নিয়ে সাহিত্যও হয়েছে প্রচুর। পুলিশ সাহিত্যিকও আছেন নামি-দামি। আমি যখন পুলিশ ছিলাম' এই শিরোনামে ধীরাজ মুখোপাধ্যায় না কার একটা বিখ্যাত বই আছে। সুসাহিত্যিক বেদুইন সামাদ তো পুলিশের বড় এক কর্মকর্তা ছিলেন। তাছাড়া কবি কথাশিল্পী আবুল খায়ের মুছলেহ উদ্দিন এই ক'দিন আগেও সরব রেখেছিলেন বাংলাসাহিত্যকে। তিনিও ছিলেন পুলিশের এক বড় কর্তা। তাই পুলিশ যেমন লেখার বিষয় হয় পুলিশ আবার অন্যের সুখ-দুখের সাথি হয় লেখার মাধ্যমে। অর্থাৎ নিজেরা- লেখক সাহিত্যিক কবি, সৎ চিন্তা, মঙ্গল চিন্তার ধারক। তাই পুলিশের স্বভাব নিয়ে ভাববার অনেক অবকাশ আছে।
পুলিশ জনগণের সেবক এমন আপ্ত বাক্যই লেখা আছে তাদের কাগজপত্রে। কিন্তু হাহতিস্বি, এ আপ্তবাক্যটির রঙে বর্তমানে হরিদ্রাভাব দেখা দিয়েছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে। জনগণের সেবার পরিবর্তে নিজের সেবায় যেন ব্যতিব্যস্ত। পুলিশ আইনের লোক। আইনকে সঠিক পথে পরিচালনা এদের দায়িত্ব। কর্তব্যও বলা যায়। এই দুটি শব্দ এখন সে এলাকায় ধূয়াশায় নিমজ্জিত। শৃক্মখলা শব্দটির আগে ‘বি' অক্ষরটি এসে বসে আছে বহুদিন থেকে। অপরাধ দমনে যারা নিয়োজিত হেন অপরাধ নেই যার সাথে পুলিশ শব্দটি যুক্ত নয়। প্রায় হররোজ কোন না কোন অপরাধের সাথে এদের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পায়। তামাম বাংলাদেশের চিত্র অবলোকন করলে অপরাধের অন্ধি-সঙ্গির সাথে পুলিশের যুক্ততা বেরিয়ে আসছে। এই দৃশ্য বাংলাদেশের সচেতন এবং শান্তিপ্রিয় জনগণের হৃদয়কে পীড়িত করে। হতাশায় করে আচ্ছন্ন। এদেশের পুলিশের মূলনীতি হলো ‘শান্তিশৃক্মখলা নিরাপত্তা এবং প্রগতি। পুলিশের সাম্প্রতিক আচরণ ওজনদার শব্দ চারটিকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। অশান্তির আগুনে যেমন তারা নিজেরা পুড়ছে, পুড়িয়ে মারছে দেশ ও জনগণকে। ‘নিরাপত্তা' এখন হত্যা গুম প্রতিশব্দে রূপ নিয়েছে। পুলিশ শব্দটির সাথেই যেন একাত্ম হয়ে পড়েছে। অভব্যতা আর অসততা। একজন সুনাগরিকের কাছে পুলিশ যেখানে আপনজন হয়ে উপস্থিত হবার কথা, সেখানে তারা জলজ্যন্ত আতঙ্ক। অপরাধীর সাথে সখ্য বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে, এই জটিলতা জটাজালে জড়িয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সুনাগরিক এবং সভ্য মানুষের অনাত্মীয় নয়। এমনটাই ভাবে দেশবাসী। কিন্তু পুলিশের ভাবনা এর বিপরীতে। তাদের আচরণ-ব্যবহার এই ধারণাকেই বদ্ধমূল করে। অনাহূত চড়াও হয় নিরপরাধ মানুষের উপর। অসত্য মামলায় জড়িয়ে ফেলে কষ্ট দেয়, অপমানিত করে। যদিও এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয় কিন্তু তারা ঘটিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত অপ্রত্যাশিত এ ধরনের বিষয়-আসয়। বিবেকবর্জিত তাদের এই কর্মকান্ডগুলো পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার জায়গাটি ক্রমশই সংকুচিত করে ফেলছে। পুলিশ এ বিষয়ে কতটা সচেতন বা আদৌ সচেতন কিনা কে জানে। একসময় পুলিশ মানির মান রাখত। নেতা-নেত্রীবৃন্দের প্রতি সহনশীল থাকতো, মান্য করত। বর্তমান দৃশ্য ভিন্নরকম। লাঠিপেটা করছে, টানাহেঁচড়া করছে, জামার কলার চেপে ধরছে। এদের কেউ কদিন আগেও মন্ত্রী ছিলেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক। কারোরই রেহাই নেই এই অভব্য আচরণের হাত থেকে। সাধারণ কর্মী-ছাত্রদের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। লাঠিপেটা তো আছেই, এদের গলায়-বুকে পুলিশের ‘বুট' হরহামেসাই উঠে যাচ্ছে। এই অপনীতি থেকে নারী-সমাজও মুক্ত নয়। পুলিশী লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার তারাও। রাজনৈতিক মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে যেন ‘হায়েনা' দঙ্গল। বেশিরভাগ সময়েই তা করা হয় অপ্রয়োজনে। নিষিদ্ধ জিনিস নিরীহ মানুষকে ধরিয়ে দিয়ে তাকে নির্যাতনের খবর প্রায়শই পাওয়া যাচ্ছে। এসব করা হচ্ছে উৎকোচ আদায়ের জন্য। দিতে বাধ্যও হচ্ছে কেউ কেউ। প্রকাশ পাচ্ছে ছিটেফোটা, আড়ালে থেকে যাচ্ছে অনেক। পুলিশের এরকম উদভ্রান্ত আচরণে সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত, আতঙ্কিতও। নারী নির্যাতনের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে এরা। আইনের লোকের বেআইনী কর্মকান্ড সামাজিক শৃক্মখলাকে বিনাশের তালিকায় তুলে আনছে। সৎ-সুবোধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পুলিশ এখন চ্যাম্পিয়ন। তাই পুলিশকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চায় জনগণ। যা কোন অবস্থায়ই কাম্য নয়। তারপরও এমনটাই সার্বিক দৃশ্য। বিপরীতে অপরাধীরা পুলিশের আশ্রয়েই বড় হয়, বলশালী হয়। এমনটাই প্রচারিত, প্রমাণিতও কোন কোন সময়।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রতীয়মান হচ্ছে গোড়ায় গলদ। পুলিশের প্রশিক্ষণে কোথাও খুঁত রয়ে গেছে। নৈতিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হয় এমন কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পুলিশ বাহিনী রাখা হয়েছে কিনা কে জানে। থাকলে তো এর প্রতিফলন ঘটতো। তাছাড়া অন্যায়ের প্রতিবিধানের ব্যাপারেও ‘ধরি মাছ না ছুই পানি'। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, আইওয়াশের আয়োজন, ‘বজ্র আটুনি ফস্কা গিড়ো' যা পুলিশের আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন আনে না। তাই পুলিশ সৎ মানুষের বন্ধু না হয়ে সক্ষাত আতঙ্ক হয়েই বিরাজ করছে।
পুলিশেরও দুঃখ আছে, বেদনা আছে, ক্ষোভ আছে। কিন্তু নিরীহ মানুষ এবং সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেতো আর এই দুঃখ-বেদনার উপশম হবে না। অপরাধীর সাথে সখ্য গড়ে তুলে তো হৃদয়ে জমা হয়ে থাকা ক্ষোভের প্রশমন ঘটানো যাবে না। এটি পথও নয়। তারপরও পুলিশ এই বেপথেরই যাত্রী। এ যাত্রার শেষ কোথায়? বলতে গেলে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট, বর্তমানে পুলিশ অসহায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা আমাত্যতো আছেই পুচকে কর্মীর আদেশও পুলিশকে মান্য করতে হয়। তাদের অন্যায় আবদারের সাথে পুলিশকে একাত্ম থাকতে হয়। বিপরীত চিন্তার কোন অবকাশ নেই। করলে বদলি না হয় চাকরিচ্যুতি। এরকম বৈরি আবহাওয়ায় পুলিশ বসবাস করছে। তারপর পুলিশকে কাটাতে হয় বিনিদ্র রজনী। তাপদগ্ধ রোদকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মন্ত্রী-আমাত্য আগমন-নির্গমনের অপেক্ষায়। বিনিময়ে জোটে সামান্য কড়ি। এই বাজারে যা দিয়ে সংসারের চাকা পনেরদিনও ঘোরানো সম্ভব নয়। তারপরও পুলিশ আছে, থাকবে। এছাড়া পুলিশ যখন দেখে হাজার অন্যায় করেও অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কেবল ক্ষমতার দাপটে, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই বিষয়টি ক্রিয়া করে, পুলিশ প্রভাবিত হয়। অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণ সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশকে গ্রাস করে। অপরাধ দমনের সঠিক ব্যবস্থা থাকলে ব্যাধির সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হতো হয়তো বা। সব পুলিশ অন্যায়-অসত্যের সাথে জড়িত এমনটা ভাবা আদৌ ঠিক হবে না। এদের একটা ক্ষুদ্র অংশ অপরাধের সাথে জড়িত। অভব্যতা এবং দস্যুতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। গুটি কতক অসৎ পুলিশের কারণে সমগ্র পুলিশ আজ কলঙ্কিত। এই কলঙ্ক অপনোদনের যথাযথ ব্যবস্থার দিকে যদি নজর না দেয়া হয়, সহসা তাহলে পুলিশের চরিত্র বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তা চিরন্তন বাক্য হিসাবেই থেকে যাবে। পুলিশ বিষয়ক রবীন্দ্রনাথের বাক্যটি হলো এরকম-
পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনকালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে। (ছোট ও বড়)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন