শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২

আক্রান্ত সংবাদ মাধ্যম : শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা


আহমদ আশিকুল হামিদ :
 আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে কয়েকটি মাস রয়েছে যে মাসগুলো বিশেষ কারণে স্মরণীয়। যেমন ফেব্রুয়ারি স্মরণীয় ভাষা আন্দোলনের জন্য, মার্চ স্মরণীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনার জন্য এবং ডিসেম্বর স্মরণীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য। ততটা আলোচিত না হলেও জুন মাসও বিশেষ কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছে। সে কারণটি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং সাংবাদিকদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া। এ সবকিছুর পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শেখ মুজিব। সরকারের বিরোধিতাকে পাকিস্তানী কায়দায় রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করতেন তিনি। এর ফলে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের তো বটেই, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সরকারের উদ্যোগে দলীয় সন্ত্রাসকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, লালবাহিনী এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা বাহারী নামে বাহিনীকে বিরোধী দল দমনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। তিনি নিজে পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া' দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। কর্মীদের বলেছেন ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি' হাতে নিতে। সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর সংসদের ভাষণে জানতে চেয়েছেন, ‘কোথায় গেলো সিরাজ সিকদার?' এই মনোভাবের পরিণতিতে শেখ মুজিবের মাত্র সাড়ে তিন বছরে জীবন দিয়েছিলেন ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী।
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও মুজিব সরকার প্রচন্ড দমনের অভিযান চালিয়েছিল। সরকার শুধু ১৯৬০ সালে আইয়ুব সরকারের প্রবর্তিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বহাল রাখেনি, ১৯৭৩ সালে সে কালাকানুনটিকেই ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স' নামে প্রবর্তন করেছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে সরকার একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছে, অন্যদিকে একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা' ছাড়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঁচটি সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি', ‘লাল পতাকা', ‘নয়াযুগ', মুখপত্র' ও ‘স্পোকসম্যান' এবং চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা'। জাসদের দৈনিক ‘গণকণ্ঠ'ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। কয়েকজন সম্পাদক ও সাংবাদিককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার।
কিন্তু এতকিছু করেও বিরোধী রাজনীতিকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে নতুন এক হাতিয়ারের যোগান দিয়েছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল সে দুর্ভিক্ষে। দরকার যখন ছিল সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো শেখ মুজিব তখন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের' ডাক দিয়েছিলেন। এর পরিস্কার উদ্দেশ্য ছিল একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ‘ইত্তেফাক', দৈনিক ‘বাংলা', ‘বাংলাদেশ অবজারভার' ও ‘বাংলাদেশ টাইমস' ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন। এর ফলে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীরা বেকার হয়ে পড়েছিলেন। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর। সে কারণেই ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্রের কালোদিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
কিছুটা দীর্ঘ হলেও শুরুতে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই পৃথকভাবে উল্লেখের দরকার পড়ে না। শেখ মুজিবের সুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলেও প্রথম থেকে গোটা সংবাদ মাধ্যম আক্রান্তই হচ্ছে। সরকার ন্যক্কারজনকভাবে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উল্লেযোগ্যদের মধ্যে প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ। সরকার দৈনিকটির প্রকাশনা বন্ধ করেছে এবং এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে ঢুকিয়েছে। এটা ২০১০ সালের ১ জুনের ঘটনা। আমার দেশ ও এর সম্পাদকের ব্যাপারে এমন কিছুই যে করা হবে সেকথা বোঝা গিয়েছিল অনেক আগে থেকে। ক্ষমতাসীনরা দৈনিকটির পেছনে আঠার মতো লেগেছিলেন। একযোগে চলছিল মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিযোগিতা। মামলার সংখ্যা ডজন তিনেকে দাঁড়িয়েছিল। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কেউ কেউ জাতীয় সংসদের ভাষণে পর্যন্ত তাকে ‘দেখে নেয়ার' হুমকি দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে দফায় দফায় আক্রান্ত হয়েছেন মাহমুদুর রহমান। এভাবে হুমকি, মামলা ও আক্রমণের পর এসেছিল তাকে গ্রেফতারের পালা। কৌশল হিসেবেও সরকার বাঁকা পথে পা বাড়ায়নি বরং সোজা হেঁটেছিল বাকশালী স্টাইলে। এখানে বহুল আলোচিত মূল কারণটিরও উল্লেখ করা দরকার। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে দৈনিকটি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ওই দু'জন পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ খেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রিপোর্টে কিন্তু বলা হয়নি যে, দু'জন সত্যি সত্যি ঘুষ খেয়েছেন। বরং বলা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে যে বিভাগীয় তদন্ত চলছে সে কথাও ছিল রিপোর্টে। কিন্তু এতেই একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হলো, সম্পাদককে গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা বা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ছিল না। এর অর্থ, পুলিশকে সোজা গিয়ে মাহমুদুর রহমানকে ধরে আনার হুকুম দেয়া হয়েছিল। এখানে আইন কোনো বিষয় ছিল না, সরকার সংবিধানেরও তোয়াক্কা করেনি। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তী দিনগুলোতে। দিনের পর দিন ধরে রিম্যান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে তার ওপর। বহুবার তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও মাহমুদুর রহমান বিচার বিভাগের সমর্থন বা সাহায্য পাননি। ‘স্বাধীন' বিচার বিভাগও তাকে বরং ‘বেচারা'ই বানিয়ে ছেড়েছিল। এজন্যই দীর্ঘ ১০ মাস জেল খাটতে হয়েছে মাহমুদুর রহমানকে। আমার দেশ-এর অন্য একজন সাংবাদিককেও জেলের ভাত খাইয়েছে সরকার। এখনও মামলা রয়েছে দৈনিকটির অন্য পাঁচজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ডজন চারেক।
দৈনিক আমার দেশ শুধু নয়, বর্তমান সরকারের প্রথম থেকে গোটা সংবাদ মাধ্যমই আক্রান্ত হচ্ছে। সরকার ন্যক্কারজনকভাবে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যমুনা টিভি ও চ্যানেল ওয়ানসহ একাধিক টিভি ও পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়েছে, দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদসহ সাংবাদিকরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আজকাল পথেঘাটে ও বাসাবাড়িতেও সাংবাদিকদের ওপর চলছে ভয়ংকর আক্রমণ। পুলিশ যখন-তখন হানা দিচ্ছে সংবাদপত্রের অফিসে। ক'দিন আগেই দৈনিক সংগ্রাম ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলা অফিসে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এর পরপর দৈনিক প্রথম আলোর তিনজন ফটোসাংবাদিককে পিটিয়েছে পুলিশ। পুলিশ এমনকি আদালত চত্বরেও সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের গলা টিপে ধরছে এবং পেটাচ্ছে যথেচ্ছভাবে। সরকারের এই কর্মকান্ডে সন্ত্রাসীরাও উৎসাহিত হচ্ছে। তারাও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ক'দিন আগে বিডি নিউজের অফিসে সন্ত্রাসী হামলা এর একটি উদাহরণ। তারও আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিজেদের বাসায় নিহত হয়েছেন। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এবং ‘প্রণিধানযোগ্য' অগ্রগতি অর্জন করা সত্ত্বেও খুনিদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। একই কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে গোটা সংবাদ মাধ্যম।
অন্য কিছু বিশেষ পন্থায়ও সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। প্রসঙ্গক্রমে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মাঝপথে একটি চিহ্নিত মহলের হস্তক্ষেপ চেষ্টার উল্লেখ করা যায়। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে নির্দেশনা জারি করে হত্যা মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো খবর প্রকাশ ও প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল। ব্যবস্থা নেয়ার জন্য হুকুম জারি করা হয়েছিল সচিব ধরনের আরো কয়েকজনের উদ্দেশেও। নির্দেশটি সঙ্গত কারণেই সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। সাংবাদিক নেতারা আশংকা প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই নির্দেশটিকে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এমন আশংকার কারণ হলো, বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘অ্যাডভাইস' বা উপদেশের আড়ালে এখনও সরকার গণমাধ্যমকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। সরকার সুযোগ পেলে উচ্চ আদালতের দেয়া রায়েরও অপব্যবহার করছে। উদাহরণ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করার কথা উল্লেখ করা যায়। ক্ষমতাসীনরা আংশিক রায়ের ‘আলোকে'ই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নিয়েছেন। আদালত আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার কষ্ট যেমন করেনি তেমনি সরকারও অপেক্ষা করেনি সে রায়ের জন্য। সুতরাং আলোচ্য নির্দেশটিকেও সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলতে পারতো। বস্তুত নির্দেশটির মাধ্যমে সরকারের জন্য তেমন সুযোগই তৈরি করে দেয়া হয়েছিল।
অথচ ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ‘স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই' যথেষ্ট দায়িত্বশীল। সাগর-রুনির হত্যাকান্ডকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহেও দেখা গেছে, কোনো গণমাধ্যমই বিষয়টিকে নিয়ে গালগল্প জুড়ে দেয়নি, ওড়ায়নি গুজবের ফানুসও। এ পর্যন্ত প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিটি খবরের সূত্রই ছিল পুলিশের বক্তব্য। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা যখন যেভাবে তদন্তের ‘অগ্রগতি' সংক্রান্ত তথ্য জানিয়েছেন সেভাবেই খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং সাংবাদিকদের বা গণমাধ্যমকে নয়, সতর্ক করা দরকার ছিল পুলিশ কর্মকর্তাদের। তারা কেন ‘প্রণিধানযোগ্য' অগ্রগতি অর্জনের গালগল্প শুনিয়ে বিভ্রান্তির ডালপালা ছড়িয়েছেন তা তাদের কাছেই জানতে চাওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিখ্যাত সেই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামসহ এমন আরো অনেক তথ্যেরও উল্লেখ করা যায়, যেগুলোর কারণে তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। যেমন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হত্যাকান্ডের জন্য জামায়াত-শিবিরের দিকে আঙুল তুলেছেন। এরও আগে পিলখানা হত্যাকান্ডের পরবর্তী দিনগুলোতে ক্ষমতাসীনরা ইসলামী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো একটি ব্যাপারেই কোনো ‘মনজিল হোসেন' যেমন ফাইল বগলদাবা করে আদালতে গিয়ে হাজির হননি, তেমনি কাউকে ‘স্বতঃপ্রণোদিত' হয়ে কোনো হুকুম জারি করতেও দেখা যায়নি। বিষয়টি অবশ্যই স্বাভাবিক ছিল না। এর অন্তর্নিহত উদ্দেশ্য নিয়ে তাই গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। মূলত এজন্যই সাংবাদিক নেতারা জনাকয়েক ‘অবিবেচক' ব্যক্তির জন্য আদালত ও সংবাদ মাধ্যম যাতে মুখোমুখি অবস্থানে না চলে আসে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। গণঅনশনের মঞ্চ থেকে তারা ঘোষণা করেছিলেন, সাংবাদিকরা কারো নির্দেশ ও রক্তচক্ষুর কাছে কলম বিকিয়ে দেবেন না। সাংবাদিক নেতারা একথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে যারাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে তাদেরই হাত পুড়ে গেছে। ইতিহাসের আলোকেই নেতারা সবাইকে নিজ নিজ সীমার মধ্যে থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, আমরা আদালতের স্বাধীনতায় যেমন বিশ্বাসী তেমনি যে কোনো অবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায়ও বদ্ধপরিকর। কোনো কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হলে সাংবাদিকরা অবশ্যই তেমন চেষ্টাকে রুখে দাঁড়াবেন। 
বস্তুত ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে যথার্থ ঘোষণাই এসেছে। কারণ, সংবিধান রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগ ও স্তম্ভেরই সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সীমার মধ্যে থাকা এবং অসতোদ্দেশ্যে অন্যের এলাকায় ঢুকে নাক না গলানো। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশে ন্যাশনাল প্রেস কাউন্সিল রয়েছে, আছে মানহানি মামলা করার মতো আইনী অনেক বিধানও। ক্ষুব্ধ হলে যে কেউ আদালতে যেতে পারেন, অনেকে যাচ্ছেনও। উচ্চ আদালতও ব্যবস্থা নিচ্ছেন, অভিযুক্তদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। এটুকুই যথেষ্ট হওয়া উচিত। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকার সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নেয়নি। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ হলো, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী সরকার, সংসদ এবং বিচার বিভাগের পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমও রাষ্ট্রের একটি প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সে স্তম্ভটিকেই আক্রমণ করে চলেছে। তারও আগে সরকার বিচার বিভাগকে তছনছ করে ফেলেছে। বিচারকরা ‘চাপের' মুখে থাকছেন। ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই পারছেন না, গণমাধ্যমের দরোজায় তালা ঝোলানোর পদক্ষেপ আসলে নিজের পায়ে কুড়াল মারার নামান্তর মাত্র। কারণ, পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ‘ডিজিটাল' তথ্য প্রবাহের এই যুগে কিছুই লুকিয়ে ফেলা বা আড়াল করা যায় না। সুতরাং আমার দেশ-এর মতো দৈনিককে নিষিদ্ধ করে, দৈনিক সংগ্রামের মতো পত্রিকা অফিসে হানা দিয়ে কিংবা মাহমুদুর রহমান ও আবুল আসাদের মতো সম্পাদকদের গ্রেফতার করে ও তাদের ওপর মামলা চাপিয়ে কিংবা চ্যানেল ওয়ানের মতো দু-একটি মাত্র টিভি চ্যানেল বন্ধ করেই মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া যাবে না। মানুষ কোনো না কোনো উৎস থেকে সব খবরই পেয়ে যাবে, যাচ্ছেও। এখানে বেশি দরকার আসলে ক্ষতির দিকটি লক্ষ্য করা। কোনো কিছুকে নিষিদ্ধ করা হলে তার ব্যাপারেই মানুষ বরং বেশি আগ্রহী হয়। নির্যাতিতের প্রতিও মানুষ সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। এসবের ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য শুভ হয় না। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলে এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ করলে বেশি লাভবান হবে সরকারই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন